কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-'মানুষ হতে ব্যর্থ আমি ছাগল হতে চাইছি' by রণজিৎ বিশ্বাস
প্রতিবারই চেষ্টা থাকে, এবারও ছিল এবং এবারই প্রথম চেষ্টা থাকার পরও ফেল করলাম। আমার এক ভাবশিক্ষকের প্রস্থান দিবসের (১৪ মে) অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারলাম না। আমাকে শ্রমজীবনের একটি দাবি অবিকল্পভাবে পূরণ করতে হচ্ছিল।
নইলে আমার এই শিক্ষকের কনিষ্ঠ পুত্র জাঁ-নেসার ওসমান সভার 'চোর'-এ বসার জন্য কার্ডে আমার নাম পর্যন্ত ছাপিয়ে ফেলেছিলেন। বিলি করার পর সে কার্ড তাকে বাতিল করতে হয় এবং নতুন কার্ড ছাপাতে হয়। আমার এই শিক্ষকটির এক পুত্রের নাম বুলবুল ওসমান; একজন স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। শিক্ষকের নাম শওকত ওসমান।
শওকত ওসমান তাঁর 'কলমনাম'। এই নাম তাঁর স্কুল-কলেজের নাম, সার্টিফিকেটের নাম ও পেশা গ্রহণের নামটিকে প্রায় মুছেই দিয়েছে। মানুষের পরিচয়ের ভুবনে 'সেখ আজিজুর রহমান' নামটিকে প্রায় দাবিয়েই রেখেছে। নামটি সম্পর্কে কারো কারো মনে শুধু প্রশ্ন জাগিয়েছিল তখন, যখন ১৯৯৬-৯৭ সালে দৈনিক আজকের কাগজে তিনি প্রতিদিন একটি করে 'সম্বরা' ছাড়তেন।
গরম তেলে ফোড়ন পাঁচফোড়ন দেওয়ার সঙ্গে, ব্যঞ্জনে সম্ভার কিংবা ভাগাড় দেওয়ার সঙ্গে তাঁর কাজটি খুব মিলত। ছড়ার অবয়বে ছুরি মারার কাজটি করতেন বড় কৌশলে, বড় শানিত প্রক্রিয়ায়। কয়েক লাইনের ছড়ায় প্রতিদিন তিনি অসংগতিকে আঘাত করতেন। বেশি আঘাত করতেন এবং আঘাতে আঘাতে একেবারে চ্যাপ্টে দিতেন মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক মানবায়ব প্রাণীদের। যারা অসাধু, অসৎ, অনাধুনিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা তার শিক্ষাদীক্ষাহীন পরিবার-পরিজন ও অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত অথবা কুশিক্ষিত বেনিফিশিয়ারিদের তিনি কখনো ছাড়েননি, কোনোরূপ অনুকম্পা দেখাননি এবং যেখানেই পারেন, তাঁর শক্ত দীর্ঘ চাবুকের স্বাদ নির্দয় প্রহারে বড় উদারভাবে, বড় প্রাসঙ্গিকতায় ও কৌশলে-কুশলে বিতরণ করেছেন। যাদের তিনি টার্গেট করতেন, শিক্ষাবঞ্চনা ও পুরোপুরি 'চর্ম-মজবুতি' কিংবা 'দুর্বুদ্ধিসমৃদ্ধি'র জন্য তারা হয়তো বুঝতে পারত না অথবা বুঝতে চাইত না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবাসে, আধুনিকতা, সততা, সুশিক্ষা, সুরুচি, মানবতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভালোবাসে ও মূল্য দেয়, তারা এখনো সেই সম্বরাগুলোর বিষয়ে স্মৃতিছুট নন।
একটি-দুটি তো আমার মতো বিস্তৃতিপরায়ণ মানুষেরও মনে পড়ে। যেমন_ এক. 'মায়ের প্রথম স্বামী যেমন বাপ নয়/অতীতে কৃত অপরাধও তেমন পাপ নয়।' দুই. 'হিন্দু পাকিস্তানি হয় মরিবার পরে/মুসলমান পাকিস্তানি হয় মরিবার তরে।' তিন. 'যে দেশে ওরা খোদই এক মোল্লা/বড় অসহায় সেখানে রসুল ও আল্লা।'
এই 'ওরা' হচ্ছে তারা, যারা সমাজের অভিভাবক ও দেশের পরিচালক; তিতিবিরক্ত ও অত্যাচারিত মানুষ যথাসময়ে যথাকর্তব্য পালন করে বড় হেলায়-অবহেলায় ঘৃণায় বিবমিষায় তাদের দূরে নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তারা যখন গ্রিজি-গ্রিজি (ৎেবধংু-ৎেবধংু) অবস্থায় ছিল, মানুষকে মানুষ মানেনি, দালালকে দালাল মানেনি, স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা মানেনি। তারা মানুষের জন্মপরিচয়, আদর্শপরিচয় ও উপাস্য পরিচয়কে বড় করে দেখেছে এবং অপছন্দের মানুষ যেই হোক তার পিঠে লেবেল সেঁটেছে 'উহাদের লোক'। সেঁটেছে তাদের বঞ্চন, দলন ও পীড়নের জন্য।
শওকত ওসমান এই নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকদের তীরবিদ্ধ করতে বড় ভালো বাসতেন, বড় আনন্দ পেতেন। আমরা, নষ্ট ভ্রষ্ট ও দুষ্ট লোকদের হাতে বারবার নির্যাতিত বঞ্চিত ও দলিত লোকেরা ভাবতাম_কৌশলী লোকদের ভিড়ে একজন জাঁহাবাজ তো আছেন, যিনি মতলববাজ, ধান্ধাবাজ, সন্ত্রাসবাজ ও ধর্মবাজদের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা গদ্যে ও তেতোকষায় পদ্যে কথা বলেন!
তাই যখন কেউ তার মতো লোকদের বেলায় বলেন, 'অমুকের প্রয়াণ দিবস' তখন আমার মন খুঁট দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন_কার প্রয়াণ? কিসের প্রয়াণ?! 'প্রয়াণ'-এর অর্থ যদি হয় মুক্তি, মুক্তি তো হয়েছে ওদের, যারা তার প্রস্থানে স্বস্তি পেয়েছে, যারা যাদের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘাতিদীর্ঘ এক আনন্দশ্বাস 'রিলিজ' করেছে। কিছু কিছু মানুষ আমার ভাবশিক্ষক (যিনি আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ভোরবেলায় ফোন করে বলতেন, তাঁর সম্বোধনের বিশিষ্ট ভাষায়_'ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণ স্মরণীয় হোক') শওকত ওসমানের মতো থাকেন_যাকে নিয়ে হীনজনেরা ও মানবকীটেরা বড় অসোয়াস্তির মধ্যে দিন কাটায় এবং মৃত্যু যে বয়সেই হোক, যাদের মৃত্যুকে সব সময় অকালীন মনে হয়। মানুষকে মানুষ করার পথে টেনে নেওয়া ও এগিয়ে দেওয়ার জন্য এই মানুষগুলোর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার, বেঁচে থাকা দরকার সক্ষমতায়।
এদের মধ্যে প্রারম্ভ পঙ্্ক্তির মানুষ শওকত ওসমান, সমান্তর অনেক জনারই যিনি খবর নিতেন, নিয়ম মেনে অথবা প্রায় নির্ঘণ্ট মেনে, অনেককেই যিনি একই স্নিগ্ধতায় আশীর্বাণী দিয়ে বলতেন, 'ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণ স্মরণীয় হোক', তিনি নিজের মানুষ হওয়া সম্পর্কে বড় কড়া পাকের এক রসিকতা করে গেছেন। রেসিপিতে সেটি যেমন স্ট্রং, বার্তায় মর্মতেজে ও প্রাণরসে তেমন ভাবোদ্দীপক।
তাঁর পুত্র জাঁ-নেসার ওসমানের কাছে শোনা। 'বাবা যখন দাড়ি রাখতে শুরু করলেন, তখন একজন জানতে চাইলেন_ব্যাপার কী! ক্লিন সেইভড্ মানুষ হঠাৎ দাড়ি রাখতে শুরু করলেন যে!'
বাবা কি বলেছিলেন জানেন?
: কী বলেছিলেন?
: বাবা বলেছিলেন, মানুষ হওয়ার চেষ্টা তো অনেক দিন করলাম; হতে পারলাম না। তাই এবার 'ছাগল' হওয়ার চেষ্টা করছি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
শওকত ওসমান তাঁর 'কলমনাম'। এই নাম তাঁর স্কুল-কলেজের নাম, সার্টিফিকেটের নাম ও পেশা গ্রহণের নামটিকে প্রায় মুছেই দিয়েছে। মানুষের পরিচয়ের ভুবনে 'সেখ আজিজুর রহমান' নামটিকে প্রায় দাবিয়েই রেখেছে। নামটি সম্পর্কে কারো কারো মনে শুধু প্রশ্ন জাগিয়েছিল তখন, যখন ১৯৯৬-৯৭ সালে দৈনিক আজকের কাগজে তিনি প্রতিদিন একটি করে 'সম্বরা' ছাড়তেন।
গরম তেলে ফোড়ন পাঁচফোড়ন দেওয়ার সঙ্গে, ব্যঞ্জনে সম্ভার কিংবা ভাগাড় দেওয়ার সঙ্গে তাঁর কাজটি খুব মিলত। ছড়ার অবয়বে ছুরি মারার কাজটি করতেন বড় কৌশলে, বড় শানিত প্রক্রিয়ায়। কয়েক লাইনের ছড়ায় প্রতিদিন তিনি অসংগতিকে আঘাত করতেন। বেশি আঘাত করতেন এবং আঘাতে আঘাতে একেবারে চ্যাপ্টে দিতেন মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক ও ছদ্মসাম্প্রদায়িক মানবায়ব প্রাণীদের। যারা অসাধু, অসৎ, অনাধুনিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী, বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা তার শিক্ষাদীক্ষাহীন পরিবার-পরিজন ও অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষাবঞ্চিত অথবা কুশিক্ষিত বেনিফিশিয়ারিদের তিনি কখনো ছাড়েননি, কোনোরূপ অনুকম্পা দেখাননি এবং যেখানেই পারেন, তাঁর শক্ত দীর্ঘ চাবুকের স্বাদ নির্দয় প্রহারে বড় উদারভাবে, বড় প্রাসঙ্গিকতায় ও কৌশলে-কুশলে বিতরণ করেছেন। যাদের তিনি টার্গেট করতেন, শিক্ষাবঞ্চনা ও পুরোপুরি 'চর্ম-মজবুতি' কিংবা 'দুর্বুদ্ধিসমৃদ্ধি'র জন্য তারা হয়তো বুঝতে পারত না অথবা বুঝতে চাইত না। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবাসে, আধুনিকতা, সততা, সুশিক্ষা, সুরুচি, মানবতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভালোবাসে ও মূল্য দেয়, তারা এখনো সেই সম্বরাগুলোর বিষয়ে স্মৃতিছুট নন।
একটি-দুটি তো আমার মতো বিস্তৃতিপরায়ণ মানুষেরও মনে পড়ে। যেমন_ এক. 'মায়ের প্রথম স্বামী যেমন বাপ নয়/অতীতে কৃত অপরাধও তেমন পাপ নয়।' দুই. 'হিন্দু পাকিস্তানি হয় মরিবার পরে/মুসলমান পাকিস্তানি হয় মরিবার তরে।' তিন. 'যে দেশে ওরা খোদই এক মোল্লা/বড় অসহায় সেখানে রসুল ও আল্লা।'
এই 'ওরা' হচ্ছে তারা, যারা সমাজের অভিভাবক ও দেশের পরিচালক; তিতিবিরক্ত ও অত্যাচারিত মানুষ যথাসময়ে যথাকর্তব্য পালন করে বড় হেলায়-অবহেলায় ঘৃণায় বিবমিষায় তাদের দূরে নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তারা যখন গ্রিজি-গ্রিজি (ৎেবধংু-ৎেবধংু) অবস্থায় ছিল, মানুষকে মানুষ মানেনি, দালালকে দালাল মানেনি, স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা মানেনি। তারা মানুষের জন্মপরিচয়, আদর্শপরিচয় ও উপাস্য পরিচয়কে বড় করে দেখেছে এবং অপছন্দের মানুষ যেই হোক তার পিঠে লেবেল সেঁটেছে 'উহাদের লোক'। সেঁটেছে তাদের বঞ্চন, দলন ও পীড়নের জন্য।
শওকত ওসমান এই নষ্ট ও ভ্রষ্ট লোকদের তীরবিদ্ধ করতে বড় ভালো বাসতেন, বড় আনন্দ পেতেন। আমরা, নষ্ট ভ্রষ্ট ও দুষ্ট লোকদের হাতে বারবার নির্যাতিত বঞ্চিত ও দলিত লোকেরা ভাবতাম_কৌশলী লোকদের ভিড়ে একজন জাঁহাবাজ তো আছেন, যিনি মতলববাজ, ধান্ধাবাজ, সন্ত্রাসবাজ ও ধর্মবাজদের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা গদ্যে ও তেতোকষায় পদ্যে কথা বলেন!
তাই যখন কেউ তার মতো লোকদের বেলায় বলেন, 'অমুকের প্রয়াণ দিবস' তখন আমার মন খুঁট দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন_কার প্রয়াণ? কিসের প্রয়াণ?! 'প্রয়াণ'-এর অর্থ যদি হয় মুক্তি, মুক্তি তো হয়েছে ওদের, যারা তার প্রস্থানে স্বস্তি পেয়েছে, যারা যাদের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘাতিদীর্ঘ এক আনন্দশ্বাস 'রিলিজ' করেছে। কিছু কিছু মানুষ আমার ভাবশিক্ষক (যিনি আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ভোরবেলায় ফোন করে বলতেন, তাঁর সম্বোধনের বিশিষ্ট ভাষায়_'ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণ স্মরণীয় হোক') শওকত ওসমানের মতো থাকেন_যাকে নিয়ে হীনজনেরা ও মানবকীটেরা বড় অসোয়াস্তির মধ্যে দিন কাটায় এবং মৃত্যু যে বয়সেই হোক, যাদের মৃত্যুকে সব সময় অকালীন মনে হয়। মানুষকে মানুষ করার পথে টেনে নেওয়া ও এগিয়ে দেওয়ার জন্য এই মানুষগুলোর দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা দরকার, বেঁচে থাকা দরকার সক্ষমতায়।
এদের মধ্যে প্রারম্ভ পঙ্্ক্তির মানুষ শওকত ওসমান, সমান্তর অনেক জনারই যিনি খবর নিতেন, নিয়ম মেনে অথবা প্রায় নির্ঘণ্ট মেনে, অনেককেই যিনি একই স্নিগ্ধতায় আশীর্বাণী দিয়ে বলতেন, 'ভ্রাতঃ, প্রাতঃস্মরণ স্মরণীয় হোক', তিনি নিজের মানুষ হওয়া সম্পর্কে বড় কড়া পাকের এক রসিকতা করে গেছেন। রেসিপিতে সেটি যেমন স্ট্রং, বার্তায় মর্মতেজে ও প্রাণরসে তেমন ভাবোদ্দীপক।
তাঁর পুত্র জাঁ-নেসার ওসমানের কাছে শোনা। 'বাবা যখন দাড়ি রাখতে শুরু করলেন, তখন একজন জানতে চাইলেন_ব্যাপার কী! ক্লিন সেইভড্ মানুষ হঠাৎ দাড়ি রাখতে শুরু করলেন যে!'
বাবা কি বলেছিলেন জানেন?
: কী বলেছিলেন?
: বাবা বলেছিলেন, মানুষ হওয়ার চেষ্টা তো অনেক দিন করলাম; হতে পারলাম না। তাই এবার 'ছাগল' হওয়ার চেষ্টা করছি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
No comments