ধর্ম-ভেজাল প্রতিরোধে ইসলামি অনুশাসন by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামের দৃষ্টিতে ভেজাল খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন, বিপণন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে খাদ্য মানবদেহের জন্য অবশ্যম্ভাবী, সে খাদ্যই যদি ভেজাল হয়, তবে তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ভেজালের ব্যবসা যেমন হারাম, তেমনি তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণও হারাম।


পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসামগ্রী হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করেন।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-১৫৭)
অতিশয় মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালসহ সব অপকর্মের মূলে ইসলাম কুঠারাঘাত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে কোনো ত্রুটিপূর্ণ জিনিস বিক্রি করে, সে আল্লাহর রোষানলে থাকবে বা ফেরেশতারা তাকে ক্রমাগত অভিশাপ দিতে থাকবে।’ (ইবনে মাজা)
খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রণ একধরনের গুপ্তহত্যার শামিল। কেননা, অবলীলাক্রমে ভেজালমিশ্রিত খাদ্যের বিষাক্ত ছোবলে বহু নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, জনস্বার্থ ও মানবস্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে। সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার জন্মগত নাগরিক অধিকার হারিয়ে ফেলছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। ব্যবসার আড়ালে তিলে তিলে মানুষ হত্যাকারীরা জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করে অধিক মুনাফার আশায় ভেজাল কারবার করছে। অথচ পবিত্র কোরআনে মানুষ হত্যাকে জঘন্যতম অন্যায় ও মহা অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে একজন মানুষ হত্যা করা সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যার সমান বলা হয়েছে। স্বেচ্ছায় মানুষ হত্যার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৯৩)
বিক্রেতার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস নিয়েই সাধারণত ক্রেতা কোনো কিছু ক্রয় করে থাকে। কিন্তু ভেজাল ব্যবসায়ী ক্রেতার এহেন বিশ্বাসের অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করে চরম প্রতারণা করে থাকে। আত্মস্বার্থ চিন্তা, অর্থলিপ্সা, নোংরা মন-মানসিকতা ও সংকীর্ণতা ভেজালকারীর নৈতিকতাবোধ ও বিবেক-বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। সে সবার কাছে একজন প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক ও জালেম হিসেবে পরিগণিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)
ইসলামের আলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ভেজাল ও প্রতারণামুক্ত করার জন্য বিধিসম্মত যেসব শাশ্বত ও সর্বজনীন নীতিমালা দেওয়া হয়েছে, অসাধুতা ত্যাগ করে ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ীদের তা যথাযথভাবে পালন করা উচিত। ক্রয়-বিক্রয়ে সততা, স্বচ্ছতা ও স্পষ্টবাদিতার নীতি অনুসরণ ইসলামের একটি সুমহান শিক্ষা। সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার অনুশীলন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ভেজালসহ সব ধরনের অসৎ কার্যকলাপ থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে, যার জন্য রয়েছে বিশেষ প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সত্যবাদী ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে।’ (তিরমিজি) অথচ ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত আয়ের নেশায় বিভোর। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, ‘আল্লাহ পাক পরকালে ব্যবসায়ীদের পাপী হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করবেন, তবে ওই সব ব্যবসায়ী ব্যতীত, যাঁরা আল্লাহকে ভয় করে ন্যায়পরায়ণতা ও সততার ভিত্তিতে ব্যবসা করেন।’ (ইবনে মাজা)
জনগণের মধ্যে সমাজে ভেজালবিরোধী গণসচেতনতা সৃষ্টি করে ভেজাল প্রতিরোধে ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সারা দেশে একশ্রেণীর অসৎ লোক বিনা বাধায় জনস্বাস্থ্যবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার হওয়া উচিত। অবিলম্বে ভেজাল রোধে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। জনগণ যদি ভেজালসামগ্রী শনাক্ত করে এ বিষয়ে সজাগ থাকে, তাহলে তারা ভেজাল দ্রব্য কিনবে না। জাতীয় জীবনে ভেজালের বিষয়টি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করায় ভেজাল প্রতিরোধে সমাজে ইসলামি আদর্শের লক্ষ্যভেদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রচারণামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন অব্যাহত রাখতে হবে।
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে সততা, ন্যায়পরায়ণতা তথা নৈতিকতা ও মানবীয় গুণাবলির মানদণ্ডে পরিচালিত করার জন্য মৌলিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে, যেন অবৈধ মুনাফার প্রলোভনে কেউ প্রতারণা, ধোঁকাবাজি বা ভেজালের মতো অমানবিক কোনো উপায়-উপকরণের আশ্রয় নিতে না পারে। তাই ভোক্তা-ক্রেতা স্বার্থ অধিকার আইন চূড়ান্ত করে নকল ও ভেজালের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ভেজালকারীকে মনে রাখতে হবে, ভেজালের মাধ্যমে অন্য মানুষের অর্থ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করে ইহকালে পার পাওয়া গেলেও পরকালে এর পরিণামে কঠিন শাস্তি থেকে রেহাই নেই।
উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সব মানুষের ওপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের প্রশ্নে আন্তরিক প্রচেষ্টা, সততার চর্চা ও সাবধানতা অবলম্বন করে না, তাদের ব্যাপারে নবী করিম (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করবে তার পরোয়া করে না, আল্লাহ তাকে কোন দরজা দিয়ে জাহান্নামে ঢোকাবেন তার পরোয়া করবেন না।’ (বায়হাকি)
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল প্রতিরোধ এখন সময়ের দাবি। প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সব জাতি-ধর্মের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ভেজাল ব্যবসায়ীদের বিবেক-বুদ্ধি ও মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। ইসলামের হালাল উপার্জননীতি সম্পর্কে সচেতন ব্যবসায়ীরা কখনোই ভেজাল খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যের ব্যবসা এবং ভোক্তার সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে না। সুস্থ-সবল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়তে, সুন্দর ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে সবাইকে ভেজাল প্রতিরোধে কাজ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo

No comments

Powered by Blogger.