প্রান্তকথা-তিস্তা সড়ক সেতু ও জনদুর্ভোগ by শান্ত নূরুননবী
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২ যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রংপুরের তিস্তা সড়ক সেতুর নির্মাণকাজ পরিদর্শন করতে এসে বললেন, ‘সেতুর নির্মাণকাজ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হলে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন।’ মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘এর আগে এ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে বেশ কয়েকবার সময় বাড়ানো হয়েছে।
তাই আগামী ৩০ জুনের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে’ (প্রথম আলো, ১৯.০২.২০১২)। মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, জুনের মধ্যে তিস্তা সড়ক সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। গত বছরও ওই সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন ঘোষণা দিয়েছিলেন, জুনের (২০১১) মধ্যে তিস্তা সড়ক সেতু জনসাধারণের চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হবে। শুরু থেকেই তিস্তা সড়ক সেতু প্রকল্প নিয়ে রাজনীতি হয়েছে, যেমনটা হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই আমলেই আলাদা করে এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন হয়েছে। তারপর অর্থায়ন, দরপত্র জটিলতা ইত্যাদি পেরিয়ে তিস্তার স্রোত ক্ষীণতর হতে হতে যখন মৃতপ্রায়, তখন ২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন-ডেলিম-জেভি ৭৫০ মিটার দীর্ঘ তিস্তা সড়ক সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। তখন এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৭ কোটি ছয় লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকায় সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী নির্মাণব্যয় পুনর্নির্ধারিত হয় ১১২ কোটি টাকা। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার সর্বশেষ তারিখ ছিল বিগত ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু কাজ এখনো যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে আমরা আগামী ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারছি না।
অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তিস্তা রেলসেতু নির্মিত হয়েছিল ১৮৩৪ সালে এবং সেতুর মেয়াদ ধরা হয়েছিল ১০০ বছর। ১৯৭৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে মেয়াদোত্তীর্ণ ১২ ফুট প্রশস্ত তিস্তা রেলসেতুর ওপর কাঠের পাটাতন বিছিয়ে রেলগাড়ির পাশাপাশি বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। রেলসেতুর ওপর দিয়ে একদিকে চলার জন্য প্রতিটি যানবাহনকে টোল দিতে হয়। বর্তমান টোলের হার মোটরসাইকেল ৩০ টাকা, পিকআপ-মাইক্রোবাস ২০ টাকা, বাস-ট্রাক ৩০ টাকা। টোল আদায়কারীদের হিসাবমতে, সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার যানবাহন তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়ে এক দিকে চলাচল করে। অর্থাৎ দুই দিক মিলে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা দুই হাজারের কাছাকাছি। তবে, আমি নিজে যতবার তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়ে গেছি, ততবারই টোলের রসিদ চেয়ে নিতে হয়েছে। নিয়মের বাইরে এই নাজুক সেতুর ওপর দিয়ে পার হচ্ছে অতিরিক্ত ওজন বহনকারী ট্রাক। তিস্তা রেলসেতুর দুই দিকেই পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। তার ভেতর দিয়েই নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ওজনের মালামাল বহনকারী ট্রাক পার হচ্ছে। কোনো কোনো ট্রাকে মালামাল এত উঁচু করে ভরা থাকে যে সেগুলো রেলসেতুর রেলিংয়ের ছাদে আটকে যায়। তখন ট্রাক থেকে মালামাল নামিয়ে নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। সেতুর দুই পার্শ্বেই আটকে থাকে হাজার হাজার মানুষ। বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনেরও একমাত্র মাধ্যম এই তিস্তা রেলসেতু। বুড়িমারী বন্দর দিয়ে আমদানি করা ফল, পাথর, কয়লা, চাল, মসলা ইত্যাদির ভারী ট্রাকগুলোকে যেতে হচ্ছে তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়েই, ঝুঁকি নিয়ে। যদিও ডালিয়ার তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে ইতিমধ্যেই তিস্তা ব্যারেজের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানিকারকেরা এতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।
এত এত ভারী যানবাহনের ভারে সেতুতে বসানো কাঠের পাটাতন স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ১৮ তারিখেও দেখা গেল রেলসেতুর ওপর কাঠের পাটাতনগুলো ভেঙেচুরে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। বড় বড় লোহার পেরেক এখানে-ওখানে খাড়া হয়ে আছে যানবাহনের টায়ার ফুটো করে দেওয়ার জন্য। পাটাতন ভেঙে তৈরি হওয়া গর্তে চাকা বসে গিয়ে বাস-ট্রাক আটকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেতুর ওপর এই কারণে প্রতিদিনই কোনো না কোনো যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় সেতুর ওপর একটি যান আটকে গিয়ে সেতু-সংলগ্ন দুই দিকের সড়কেই অসহনীয় সময়কাল আটকে থাকছে হাজার হাজার মানুষ ও জরুরি পণ্যবাহী শত শত যানবাহন। এমনকি লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম থেকে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বড় চিকিৎসাকেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অভিমুখে মুমূর্ষু রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকছে। তিস্তা সড়ক সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রতিদিন এ রকম অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষকে। কিন্তু রেলসেতুর ওপরের কাঠের পাটাতন ঠিক করা হচ্ছে না এই অজুহাতে যে, খুব শিগগিরই নির্মাণাধীন তিস্তা সড়ক সেতুর উদ্বোধন হবে।
ধরা যাক, জুনের মধ্যেই তিস্তা সড়ক সেতুর উদ্বোধন হবে। কিন্তু, তার আগেই তো বর্ষা এসে পড়বে। তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে থাকা রেলসেতুর পাটাতনগুলো আর সেগুলোর পিচ্ছিলতা কত বড় দুর্ঘটনাই না ঘটিয়ে ফেলতে পারে! জনগণ তো রেলসেতু ব্যবহার করার বিনিময়ে টোল দিচ্ছে। তাহলে তারা নিরাপদে পারাপারের নিশ্চয়তা পাবে না কেন? রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানা গেল, রেলসেতুকে সড়কের যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাখার জন্য যে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, সেটা দেওয়ার কথা সড়ক বিভাগের। সড়ক বিভাগ যেহেতু তিস্তা সড়ক সেতু প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করবে, তাই তারা রেলসেতুর পাটাতন মেরামতে আর কোনো টাকা খরচ করতে চাইছে না। তাহলে জনগণ যে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা টোল দিচ্ছে, সেটা কী কাজে লাগছে? টোল আদায় করার জন্য যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পেয়েছে, তাদের দায়িত্ব কী? কর্তৃপক্ষই নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, তিস্তা সড়ক সেতু আগামী জুনের মধ্যে চলাচলের উপযুক্ত হোক বা না হোক, তিস্তা রেলসেতুকে আরও অন্তত ছয় মাস যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাখা দরকার। সে জন্য আশু মেরামতের বিকল্প নেই।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তিস্তা রেলসেতু নির্মিত হয়েছিল ১৮৩৪ সালে এবং সেতুর মেয়াদ ধরা হয়েছিল ১০০ বছর। ১৯৭৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে মেয়াদোত্তীর্ণ ১২ ফুট প্রশস্ত তিস্তা রেলসেতুর ওপর কাঠের পাটাতন বিছিয়ে রেলগাড়ির পাশাপাশি বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। রেলসেতুর ওপর দিয়ে একদিকে চলার জন্য প্রতিটি যানবাহনকে টোল দিতে হয়। বর্তমান টোলের হার মোটরসাইকেল ৩০ টাকা, পিকআপ-মাইক্রোবাস ২০ টাকা, বাস-ট্রাক ৩০ টাকা। টোল আদায়কারীদের হিসাবমতে, সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার যানবাহন তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়ে এক দিকে চলাচল করে। অর্থাৎ দুই দিক মিলে সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা দুই হাজারের কাছাকাছি। তবে, আমি নিজে যতবার তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়ে গেছি, ততবারই টোলের রসিদ চেয়ে নিতে হয়েছে। নিয়মের বাইরে এই নাজুক সেতুর ওপর দিয়ে পার হচ্ছে অতিরিক্ত ওজন বহনকারী ট্রাক। তিস্তা রেলসেতুর দুই দিকেই পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। তার ভেতর দিয়েই নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ওজনের মালামাল বহনকারী ট্রাক পার হচ্ছে। কোনো কোনো ট্রাকে মালামাল এত উঁচু করে ভরা থাকে যে সেগুলো রেলসেতুর রেলিংয়ের ছাদে আটকে যায়। তখন ট্রাক থেকে মালামাল নামিয়ে নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়। সেতুর দুই পার্শ্বেই আটকে থাকে হাজার হাজার মানুষ। বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনেরও একমাত্র মাধ্যম এই তিস্তা রেলসেতু। বুড়িমারী বন্দর দিয়ে আমদানি করা ফল, পাথর, কয়লা, চাল, মসলা ইত্যাদির ভারী ট্রাকগুলোকে যেতে হচ্ছে তিস্তা রেলসেতুর ওপর দিয়েই, ঝুঁকি নিয়ে। যদিও ডালিয়ার তিস্তা ব্যারেজের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে ইতিমধ্যেই তিস্তা ব্যারেজের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানিকারকেরা এতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন।
এত এত ভারী যানবাহনের ভারে সেতুতে বসানো কাঠের পাটাতন স্বাভাবিকভাবেই দ্রুত ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। ১৮ তারিখেও দেখা গেল রেলসেতুর ওপর কাঠের পাটাতনগুলো ভেঙেচুরে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। বড় বড় লোহার পেরেক এখানে-ওখানে খাড়া হয়ে আছে যানবাহনের টায়ার ফুটো করে দেওয়ার জন্য। পাটাতন ভেঙে তৈরি হওয়া গর্তে চাকা বসে গিয়ে বাস-ট্রাক আটকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেতুর ওপর এই কারণে প্রতিদিনই কোনো না কোনো যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় সেতুর ওপর একটি যান আটকে গিয়ে সেতু-সংলগ্ন দুই দিকের সড়কেই অসহনীয় সময়কাল আটকে থাকছে হাজার হাজার মানুষ ও জরুরি পণ্যবাহী শত শত যানবাহন। এমনকি লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম থেকে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বড় চিকিৎসাকেন্দ্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অভিমুখে মুমূর্ষু রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকছে। তিস্তা সড়ক সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রতিদিন এ রকম অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষকে। কিন্তু রেলসেতুর ওপরের কাঠের পাটাতন ঠিক করা হচ্ছে না এই অজুহাতে যে, খুব শিগগিরই নির্মাণাধীন তিস্তা সড়ক সেতুর উদ্বোধন হবে।
ধরা যাক, জুনের মধ্যেই তিস্তা সড়ক সেতুর উদ্বোধন হবে। কিন্তু, তার আগেই তো বর্ষা এসে পড়বে। তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে থাকা রেলসেতুর পাটাতনগুলো আর সেগুলোর পিচ্ছিলতা কত বড় দুর্ঘটনাই না ঘটিয়ে ফেলতে পারে! জনগণ তো রেলসেতু ব্যবহার করার বিনিময়ে টোল দিচ্ছে। তাহলে তারা নিরাপদে পারাপারের নিশ্চয়তা পাবে না কেন? রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জানা গেল, রেলসেতুকে সড়কের যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাখার জন্য যে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, সেটা দেওয়ার কথা সড়ক বিভাগের। সড়ক বিভাগ যেহেতু তিস্তা সড়ক সেতু প্রকল্পের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করবে, তাই তারা রেলসেতুর পাটাতন মেরামতে আর কোনো টাকা খরচ করতে চাইছে না। তাহলে জনগণ যে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা টোল দিচ্ছে, সেটা কী কাজে লাগছে? টোল আদায় করার জন্য যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পেয়েছে, তাদের দায়িত্ব কী? কর্তৃপক্ষই নিশ্চয়ই স্বীকার করবে যে, তিস্তা সড়ক সেতু আগামী জুনের মধ্যে চলাচলের উপযুক্ত হোক বা না হোক, তিস্তা রেলসেতুকে আরও অন্তত ছয় মাস যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাখা দরকার। সে জন্য আশু মেরামতের বিকল্প নেই।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
No comments