বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-মমতার নাটুকেপনা, ভণ্ডুল তিস্তার পানির হিস্যা by মইনুল ইসলাম
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির শেষ মুহূর্তের ‘বেঁকে বসার নাটুকেপনার’ শিকার হয়ে তিস্তা নদীর পানির হিস্যা নির্ধারণের চুক্তি স্বাক্ষর থেকে ভারত একতরফাভাবে সরে যাওয়াতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরটা প্রায় শুরু থেকেই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।
কূটনৈতিক পাল্টা চাল হিসেবে বাংলাদেশ যখন ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সম্মতিপত্র বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানাল, তখন তা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য মহাবিপর্যয়কর হওয়ার উপক্রম হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্যও তা ছিল মারাত্মক অস্বস্তিকর। কিন্তু দুজনের প্রাণান্তকর প্রয়াসে এই মহাবিপর্যয় থেকে তাঁরা কিছুটা সম্মান পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন, সে জন্য তাঁদের সাধুবাদ জানাচ্ছি।
মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক স্টাইলটাই হলো একধরনের সস্তা ‘পপুলিজম’ এবং নাটক সৃষ্টি করার পারঙ্গমতার অপূর্ব সংমিশ্রণে জনগণের মন জয় করার উদ্দেশে ইস্যুর পর ইস্যুর সমাহার ঘটানো। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের কয়েকটি মারাত্মক ভুলকে কাজে লাগিয়ে তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে ক্ষমতায় এসেছেন। তাই তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে বামফ্রন্ট ও কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি স্বাক্ষর যে মে, ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের পর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা জেনেশুনে মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশকে বেশি পানি কীভাবে দেবেন? ৬ সেপ্টেম্বর তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পরদিনই তো বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন গড়ে তুলত, সে প্রস্তুতির খবর তাঁর না জানার কথা নয়। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির নাটুকেপনা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের গালে চপেটাঘাতের শামিল হিসেবে বিবেচিত হবে। ওই চপেটাঘাতটা সবচেয়ে অপমানজনক হয়েছে অবশ্য ড. মনমোহন সিংয়ের জন্য। তাঁর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন যখন মমতা ব্যানার্জিকে তিস্তা চুক্তির খসড়া দেখাতে কলকাতা গেলেন, তখনই যদি তিনি তাঁর অসম্মতির বিষয়টি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতেন, তাহলেও কূটনৈতিক ‘ব্যাক চ্যানেলে’ বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপারটা জানিয়ে পানির হিস্যা-সম্পর্কিত দর-কষাকষি লোকচক্ষুর আড়ালে দৌড়ঝাঁপ করে সমাধান করা যেত। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যখন বাংলাদেশকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে নয়াদিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে একতরফাভাবে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে ড. মনমোহনের ঢাকা সফরে ‘তিস্তা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হবে না, তখন ভারত কয়েকটি ক্ষেত্রে ‘কূটনৈতিক অসদাচরণ’ করে ফেলেছে: ১. বাংলাদেশকে বিষয়টা না জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আগেভাগে একতরফা ঘোষণা বাংলাদেশকে অপমান করার শামিল। কারণ, চুক্তি স্বাক্ষর একটি দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে; ২. সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে ড. মনমোহনের ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের মাঝখানের সময়টাতেও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টা জানানো হয়নি। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিব দফায় দফায় মিডিয়াকে জানিয়েছেন যে ‘তিস্তা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যায়ের এই উল্টাপাল্টা বক্তব্য প্রহসনমূলক হয়ে গেছে; ৩. বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার নয়াদিল্লির তিস্তা চুক্তি স্থগিতকরণের সিদ্ধান্তটি নয়াদিল্লির নির্দেশে বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানোটাই ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচার। অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর তাঁকে ডেকে নেওয়ার পরই কেবল তিনি লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এটাও বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অমর্যাদাকর আচরণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিস্তার মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যে আন্তর্জাতিক আইন ও পানির অধিকার-সম্পর্কিত ন্যায়নীতির জবরদস্তিমূলক বরখেলাপ, সেটি মমতা ব্যানার্জি হয়তো থোড়াই কেয়ার করেন। এমনকি খোদ ভারতই যে পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে অনুদার আচরণ করে চলেছে, তা ফারাক্কা বাঁধ এবং ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানিচুক্তি মোতাবেক পানির নির্ধারিত হিস্যা না দেওয়ার গত ১৫ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড থেকে প্রমাণিত। এ বঞ্চনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২০টি নদী ইতিমধ্যেই মরে গেছে। (অথচ পদ্মা নদীর ভাটিতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নিতে পারছে না আজও) তিস্তার পানি চুক্তি আগামী তিন মাসের মধ্যেই স্বাক্ষরিত হবে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। তবে ব্যাপারটি অত সহজ না হওয়ারই কথা। দেখা যাক!
ভারতীয় পক্ষের ৬ সেপ্টেম্বরের শেষ মুহূর্তের কূটনৈতিক চপেটাঘাতের প্রত্যুত্তর প্রদান বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর বিষয় ছিল নিঃসন্দেহে। বিশেষত, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজেই যেহেতু ওই সময়ে এ দেশের পরম সম্মানিত অতিথি হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামার মুহূর্ত থেকেই তাঁর চেহারা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল শেষ মুহূর্তের ওই অপ্রত্যাশিত নাটকটি তিনি হজম করতে পারছিলেন না। এরপর পর্দার অন্তরালে কী হয়েছে, তা আমাদের জানার সুযোগ নেই, কিন্তু তাঁকে খোশ আমদেদ জানানোর মুহূর্ত থেকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যামেরার সামনে একবারের জন্যও নিজের স্থৈর্য হারাননি এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সহমর্মিতাপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণের ব্যত্যয় ঘটাননি দেখে আমি অভিভূত হয়েছি।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পাল্টা চাল হিসেবে ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সম্মতিপত্র বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরকে স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। তবে ৬৫ দফার সফর-পরবর্তী যৌথ ইশতেহার পাঠ করে ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত হওয়াটাকে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ (damage control) প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষত, আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের রাজ্যের জনগণের জন্য বাংলাদেশের ‘তোহফা’ হিসেবে ট্রানজিট চালুর স্বাক্ষরিত সম্মতি চুক্তি নিয়ে যাওয়ার আশাতেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা খালি হাতেই ফিরে গেলেন মমতার কূটচালে। অথচ ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত পূর্বের সাতটি রাজ্যের জনগণই যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে অনুন্নয়নের দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে রয়েছে। ট্রানজিট তাদের কাছে বরাবরই প্রথম অগ্রাধিকার। সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, উ ৎ সবের সব আয়োজনই সম্পন্ন হয়েছিল ওই রাজ্যগুলোতে। কিন্তু তাদেরও বঞ্চিত করলেন মমতা ব্যানার্জি।
এ বিষয়ে আমরা যাঁরা গবেষণা করি, তাঁদের কাছে মমতার আচরণের আরেকটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। মমতা কি ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন?’ আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগ সহযোগিতা বৃদ্ধি হলে পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতা বন্দরের কায়েমি স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে। বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং নেপাল ও ভুটানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সঞ্চালিত হয় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা-হলদিয়া বন্দরগুলোর মাধ্যমে। প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তির দুটো প্রধান দিক বা মাত্রা হচ্ছে: ১. ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য এবং নেপাল-ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার ও ২. বাংলাদেশের সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর করিডর বা ট্রানজিট স্থাপন।
প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাংলাদেশের সড়ক-জনপথব্যবস্থার বর্তমান বিপর্যয়কর অবস্থার বিবেচনায় বর্তমান বাস্তবতায় সড়কপথে বা রেলপথে বাংলাদেশ ভারতকে অদূর ভবিষ্যতে ট্রানজিট-সুবিধা দিতে পারবে না। যথাযথ বিনিয়োগ অর্থায়ন সাপেক্ষে দু-তিন বছর লেগে যাবে করিডর-সুবিধা রেলপথ ও সড়কপথে বাস্তবায়ন করতে। (তত দিনে যদি আবারও বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসে যায়, তাহলে তো নতুন নাটক শুরু হয়ে যাবে!) যে ধরনের ট্রানজিট-সুবিধা আগামী কয়েক মাসেই দেওয়া যাবে, তা হলো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে নদীপথে আশুগঞ্জ নৌবন্দর হয়ে সড়কপথে আখাউড়া-আগরতলা রুটে মালামাল পরিবহন। মমতা ব্যানার্জির এই সম্ভাবনাটা পছন্দ না করারই কথা। কারণ, কলকাতা বন্দরের ব্যবহার কমিয়েই তো চট্টগ্রাম-মংলা বন্দরের ব্যবহার বাড়ানো হবে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের পশ্চিমবঙ্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে দেখেছি যে সেভেন সিস্টার্সের বঞ্চনার অবসান পশ্চিমবঙ্গ চায় না।
যাক, আমরা আশা করতে চাই, আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগের সম্প্রসারণ ক্রমশই এতদঞ্চলে অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা হিসেবে সব মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। কারণ, যেকোনো গভীর বিশ্লেষণেই প্রমাণিত হবে, আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগ বৃদ্ধির ইস্যুটা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড—সবার জন্যই লাভজনক। এটা জিরো-সাম গেম নয়। যেসব জ্ঞানপাপী সেভেন সিস্টার্সকে বাংলাদেশের ‘ক্যাপটিভ বাজার’ হিসেবে বহাল রাখার খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরছেন কিংবা নিরাপত্তার জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন, তাঁদের শুধু বলব, অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতি ও ভারতবিরোধিতার রাজনীতি এবং মতাদর্শ থেকেই এ ধরনের ভুয়া বিশ্লেষণের জন্ম। ‘ডায়নামিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ’ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে শুধু সেভেন সিস্টার্স নয়, বাংলাদেশের লাভও বাড়তে থাকবে। সেভেন সিস্টার্সের উন্নয়নে গতি সঞ্চার করা গেলে বাংলাদেশের ফায়দা হবে সবচেয়ে বেশি।
আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে চাই, আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়াটা ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার। উজানের দেশ ভারত আঞ্চলিক বড় ভাইনুলভ মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যাকে ব্যবহার করে চলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানপ্রেমী দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি দর-কষাকষির দুষ্টচক্রে নিপতিত হয়। দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের এহেন দর-কষাকষির কূটনীতি ও রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশের সরকার যেভাবে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’র ভূমিকা পালনে ত ৎ পর থাকে, তা বাংলাদেশের জনগণকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর জন্য অস্ত্র চোরাচালানের ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকূল ও ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্রিয় তত্ত্বাবধানে ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্রে তা স্বীকার করা হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার সশস্ত্র শান্তিবাহিনীকে ভারত লালন করত, সেটাও প্রমাণিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশকে এই ন্যক্কারজনক পাকিস্তানি প্রক্সির ভূমিকা থেকে সরিয়ে এনেছে। প্রতিবেশী ভারত শেখ হাসিনার এই ঐতিহাসিক অবদানকে যেন খাটো করে না দেখে। শেখ হাসিনা এই নিরাপত্তা ইস্যুটির জন্য কোনো দর-কষাকষি করেননি, কোনো বিনিময়মূল্য দাবি করেননি। ভারত ও বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আত্মার আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ আবারও পাকিস্তানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমী সরকার ও রাজনীতির খপ্পরে পড়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই ‘পাকিস্তান সিনড্রোম’ পুরো জাতিকে চেতনাগতভাবে বিভাজিত করে রেখেছে। অতএব তিস্তার পানির হিস্যা বনাম ভারতকে ট্রানজিট প্রদান—এভাবে দর-কষাকষির ইস্যু বানানো সমস্যাটির অতি সরলীকরণেরই নামান্তর। পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করলে প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পালে তা হাওয়া জোগাবে। কেবল সংকীর্ণ স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি কি বিএনপি-জামায়াতের খপ্পরে বাংলাদেশকে আবারও ঠেলে দিতে চাইছেন? বিষয়টি ভারতকে ভেবে দেখতে বলি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মমতা ব্যানার্জির রাজনৈতিক স্টাইলটাই হলো একধরনের সস্তা ‘পপুলিজম’ এবং নাটক সৃষ্টি করার পারঙ্গমতার অপূর্ব সংমিশ্রণে জনগণের মন জয় করার উদ্দেশে ইস্যুর পর ইস্যুর সমাহার ঘটানো। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের কয়েকটি মারাত্মক ভুলকে কাজে লাগিয়ে তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে ক্ষমতায় এসেছেন। তাই তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে বামফ্রন্ট ও কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি স্বাক্ষর যে মে, ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের পর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা জেনেশুনে মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশকে বেশি পানি কীভাবে দেবেন? ৬ সেপ্টেম্বর তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পরদিনই তো বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলন গড়ে তুলত, সে প্রস্তুতির খবর তাঁর না জানার কথা নয়। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির নাটুকেপনা ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের গালে চপেটাঘাতের শামিল হিসেবে বিবেচিত হবে। ওই চপেটাঘাতটা সবচেয়ে অপমানজনক হয়েছে অবশ্য ড. মনমোহন সিংয়ের জন্য। তাঁর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা শিবশংকর মেনন যখন মমতা ব্যানার্জিকে তিস্তা চুক্তির খসড়া দেখাতে কলকাতা গেলেন, তখনই যদি তিনি তাঁর অসম্মতির বিষয়টি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতেন, তাহলেও কূটনৈতিক ‘ব্যাক চ্যানেলে’ বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপারটা জানিয়ে পানির হিস্যা-সম্পর্কিত দর-কষাকষি লোকচক্ষুর আড়ালে দৌড়ঝাঁপ করে সমাধান করা যেত। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রসচিব যখন বাংলাদেশকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে নয়াদিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে একতরফাভাবে ঘোষণা দিয়ে দিলেন যে ড. মনমোহনের ঢাকা সফরে ‘তিস্তা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হবে না, তখন ভারত কয়েকটি ক্ষেত্রে ‘কূটনৈতিক অসদাচরণ’ করে ফেলেছে: ১. বাংলাদেশকে বিষয়টা না জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আগেভাগে একতরফা ঘোষণা বাংলাদেশকে অপমান করার শামিল। কারণ, চুক্তি স্বাক্ষর একটি দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে; ২. সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে ড. মনমোহনের ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের মাঝখানের সময়টাতেও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টা জানানো হয়নি। ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিব দফায় দফায় মিডিয়াকে জানিয়েছেন যে ‘তিস্তা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। শেষ পর্যায়ের এই উল্টাপাল্টা বক্তব্য প্রহসনমূলক হয়ে গেছে; ৩. বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার নয়াদিল্লির তিস্তা চুক্তি স্থগিতকরণের সিদ্ধান্তটি নয়াদিল্লির নির্দেশে বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানোটাই ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচার। অথচ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর তাঁকে ডেকে নেওয়ার পরই কেবল তিনি লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এটাও বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অমর্যাদাকর আচরণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিস্তার মতো একটি আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহের ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা যে আন্তর্জাতিক আইন ও পানির অধিকার-সম্পর্কিত ন্যায়নীতির জবরদস্তিমূলক বরখেলাপ, সেটি মমতা ব্যানার্জি হয়তো থোড়াই কেয়ার করেন। এমনকি খোদ ভারতই যে পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে অনুদার আচরণ করে চলেছে, তা ফারাক্কা বাঁধ এবং ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানিচুক্তি মোতাবেক পানির নির্ধারিত হিস্যা না দেওয়ার গত ১৫ বছরের ট্র্যাক রেকর্ড থেকে প্রমাণিত। এ বঞ্চনার প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২০টি নদী ইতিমধ্যেই মরে গেছে। (অথচ পদ্মা নদীর ভাটিতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পদক্ষেপ নিতে পারছে না আজও) তিস্তার পানি চুক্তি আগামী তিন মাসের মধ্যেই স্বাক্ষরিত হবে বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। তবে ব্যাপারটি অত সহজ না হওয়ারই কথা। দেখা যাক!
ভারতীয় পক্ষের ৬ সেপ্টেম্বরের শেষ মুহূর্তের কূটনৈতিক চপেটাঘাতের প্রত্যুত্তর প্রদান বাংলাদেশের জন্য খুবই বিব্রতকর বিষয় ছিল নিঃসন্দেহে। বিশেষত, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং নিজেই যেহেতু ওই সময়ে এ দেশের পরম সম্মানিত অতিথি হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামার মুহূর্ত থেকেই তাঁর চেহারা দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল শেষ মুহূর্তের ওই অপ্রত্যাশিত নাটকটি তিনি হজম করতে পারছিলেন না। এরপর পর্দার অন্তরালে কী হয়েছে, তা আমাদের জানার সুযোগ নেই, কিন্তু তাঁকে খোশ আমদেদ জানানোর মুহূর্ত থেকেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যামেরার সামনে একবারের জন্যও নিজের স্থৈর্য হারাননি এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সহমর্মিতাপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণের ব্যত্যয় ঘটাননি দেখে আমি অভিভূত হয়েছি।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পাল্টা চাল হিসেবে ভারতকে ট্রানজিট প্রদানের সম্মতিপত্র বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরকে স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। এ পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। তবে ৬৫ দফার সফর-পরবর্তী যৌথ ইশতেহার পাঠ করে ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত হওয়াটাকে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ (damage control) প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষত, আমাদের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের চারজন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের রাজ্যের জনগণের জন্য বাংলাদেশের ‘তোহফা’ হিসেবে ট্রানজিট চালুর স্বাক্ষরিত সম্মতি চুক্তি নিয়ে যাওয়ার আশাতেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা খালি হাতেই ফিরে গেলেন মমতার কূটচালে। অথচ ভারতের সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত পূর্বের সাতটি রাজ্যের জনগণই যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে অনুন্নয়নের দুষ্টচক্রে বন্দী হয়ে রয়েছে। ট্রানজিট তাদের কাছে বরাবরই প্রথম অগ্রাধিকার। সাম্প্রতিক পত্রপত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, উ ৎ সবের সব আয়োজনই সম্পন্ন হয়েছিল ওই রাজ্যগুলোতে। কিন্তু তাদেরও বঞ্চিত করলেন মমতা ব্যানার্জি।
এ বিষয়ে আমরা যাঁরা গবেষণা করি, তাঁদের কাছে মমতার আচরণের আরেকটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। মমতা কি ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন?’ আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগ সহযোগিতা বৃদ্ধি হলে পশ্চিমবঙ্গ এবং কলকাতা বন্দরের কায়েমি স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে। বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং নেপাল ও ভুটানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সঞ্চালিত হয় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা-হলদিয়া বন্দরগুলোর মাধ্যমে। প্রস্তাবিত ট্রানজিট চুক্তির দুটো প্রধান দিক বা মাত্রা হচ্ছে: ১. ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য এবং নেপাল-ভুটান কর্তৃক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার ও ২. বাংলাদেশের সড়ক ও রেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর করিডর বা ট্রানজিট স্থাপন।
প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাংলাদেশের সড়ক-জনপথব্যবস্থার বর্তমান বিপর্যয়কর অবস্থার বিবেচনায় বর্তমান বাস্তবতায় সড়কপথে বা রেলপথে বাংলাদেশ ভারতকে অদূর ভবিষ্যতে ট্রানজিট-সুবিধা দিতে পারবে না। যথাযথ বিনিয়োগ অর্থায়ন সাপেক্ষে দু-তিন বছর লেগে যাবে করিডর-সুবিধা রেলপথ ও সড়কপথে বাস্তবায়ন করতে। (তত দিনে যদি আবারও বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসে যায়, তাহলে তো নতুন নাটক শুরু হয়ে যাবে!) যে ধরনের ট্রানজিট-সুবিধা আগামী কয়েক মাসেই দেওয়া যাবে, তা হলো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে নদীপথে আশুগঞ্জ নৌবন্দর হয়ে সড়কপথে আখাউড়া-আগরতলা রুটে মালামাল পরিবহন। মমতা ব্যানার্জির এই সম্ভাবনাটা পছন্দ না করারই কথা। কারণ, কলকাতা বন্দরের ব্যবহার কমিয়েই তো চট্টগ্রাম-মংলা বন্দরের ব্যবহার বাড়ানো হবে। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে ভারতের সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের পশ্চিমবঙ্গের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে দেখেছি যে সেভেন সিস্টার্সের বঞ্চনার অবসান পশ্চিমবঙ্গ চায় না।
যাক, আমরা আশা করতে চাই, আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগের সম্প্রসারণ ক্রমশই এতদঞ্চলে অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা হিসেবে সব মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। কারণ, যেকোনো গভীর বিশ্লেষণেই প্রমাণিত হবে, আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগ বৃদ্ধির ইস্যুটা ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ড—সবার জন্যই লাভজনক। এটা জিরো-সাম গেম নয়। যেসব জ্ঞানপাপী সেভেন সিস্টার্সকে বাংলাদেশের ‘ক্যাপটিভ বাজার’ হিসেবে বহাল রাখার খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরছেন কিংবা নিরাপত্তার জুজুর ভয় দেখাচ্ছেন, তাঁদের শুধু বলব, অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতি ও ভারতবিরোধিতার রাজনীতি এবং মতাদর্শ থেকেই এ ধরনের ভুয়া বিশ্লেষণের জন্ম। ‘ডায়নামিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ’ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে শুধু সেভেন সিস্টার্স নয়, বাংলাদেশের লাভও বাড়তে থাকবে। সেভেন সিস্টার্সের উন্নয়নে গতি সঞ্চার করা গেলে বাংলাদেশের ফায়দা হবে সবচেয়ে বেশি।
আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে চাই, আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়াটা ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার। উজানের দেশ ভারত আঞ্চলিক বড় ভাইনুলভ মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্যাকে ব্যবহার করে চলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানপ্রেমী দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি দর-কষাকষির দুষ্টচক্রে নিপতিত হয়। দুই নিকট প্রতিবেশী ভারত ও বাংলাদেশের এহেন দর-কষাকষির কূটনীতি ও রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতেই হবে। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশের সরকার যেভাবে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’র ভূমিকা পালনে ত ৎ পর থাকে, তা বাংলাদেশের জনগণকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। সেভেন সিস্টার্সের বিভিন্ন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর জন্য অস্ত্র চোরাচালানের ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলাদেশের সমুদ্র-উপকূল ও ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্রিয় তত্ত্বাবধানে ২০০৪ সালের ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্রে তা স্বীকার করা হয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার সশস্ত্র শান্তিবাহিনীকে ভারত লালন করত, সেটাও প্রমাণিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশকে এই ন্যক্কারজনক পাকিস্তানি প্রক্সির ভূমিকা থেকে সরিয়ে এনেছে। প্রতিবেশী ভারত শেখ হাসিনার এই ঐতিহাসিক অবদানকে যেন খাটো করে না দেখে। শেখ হাসিনা এই নিরাপত্তা ইস্যুটির জন্য কোনো দর-কষাকষি করেননি, কোনো বিনিময়মূল্য দাবি করেননি। ভারত ও বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আত্মার আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ আবারও পাকিস্তানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানপ্রেমী সরকার ও রাজনীতির খপ্পরে পড়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনীতির এই ‘পাকিস্তান সিনড্রোম’ পুরো জাতিকে চেতনাগতভাবে বিভাজিত করে রেখেছে। অতএব তিস্তার পানির হিস্যা বনাম ভারতকে ট্রানজিট প্রদান—এভাবে দর-কষাকষির ইস্যু বানানো সমস্যাটির অতি সরলীকরণেরই নামান্তর। পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করলে প্রকারান্তরে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির পালে তা হাওয়া জোগাবে। কেবল সংকীর্ণ স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি কি বিএনপি-জামায়াতের খপ্পরে বাংলাদেশকে আবারও ঠেলে দিতে চাইছেন? বিষয়টি ভারতকে ভেবে দেখতে বলি।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments