গণপরিবহন-পাতালরেলে জট দূর, বিমানবাহিনীর উল্টা সুর by শেখ হাফিজুর রহমান
ঢাকা এখন প্রায় অকার্যকর এক শহর। জনসংখ্যার চাপ, নির্মল বাতাসের অভাব, বিশুদ্ধ পানির দুষ্প্রাপ্যতা, পুলিশের নিষ্ঠুরতা, ট্রাফিক জ্যাম, নোংরা-আবর্জনার স্তূপ—সবকিছু মিলিয়ে দিন দিন ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। পথে বেরোলে এখন প্রায়ই মনে হয়, পৃথিবী যেন ঢাকা শহরের রাস্তায় এসে থমকে গেছে।
গ্রহ-নক্ষত্রের কার্যকরণে কোনো মৃত নগর গতি পেলেও ঢাকা শহর সচল হবে কি না, তা নিয়ে ভয় হয়! কে এমন ঢাকা শহর চেয়েছিল, যেখানে ২০-২৫ মিনিটের পথ যেতে তিন ঘণ্টা লেগে যায়? যেখানে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ১৫-২০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয় ফুসফুসের নানা ব্যাধিতে? এমন ঢাকা শহর কি আমরা চেয়েছিলাম, যেখানে ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কারণে মাতৃগর্ভের শিশু সুস্থ হয়ে জন্মাবে কি না, তা নিয়ে আতঙ্কে থাকেন মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন?
প্রতিদিনের দৃশ্যপট থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রায় দুই কোটি মানুষের ভার নিয়ে ঢাকা শহর আর চলতে পারছে না। যেকোনো সময় বড় ধরনের কোনো সংকটে পড়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহর। কোনো ব্যক্তিকে ঢাকা শহরের এক নম্বর সমস্যা কোনটি, জিজ্ঞাসা করা হলে কোনো দ্বিধা না করেই তিনি উত্তর দেবেন, ঢাকা শহরের এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে যানজট। ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিবছর ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের (ডিটিসিবি) অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক এস এম সালেহউদ্দিন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য প্রদান করেন। শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে অতিরিক্ত সময় লেগে যাওয়ায় অতিরিক্ত তেল ও গ্যাস খরচ হওয়ার ফলে এ বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ওই সেমিনারে মত প্রকাশ করেন। এতে পরিবহনদূষণের হার কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে বলে মত দেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞরা ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজটের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন-অবকাঠামোর অভাব, নিচু মানের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবৈধ কার পার্কিং, স্বল্প ও সংকীর্ণ ফুটপাত এবং বাসের জন্য ভিন্ন লেন না থাকাকে দায়ী করেন। (দ্য ডেইলি স্টার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১০)।
ঢাকা শহরের যানজট নিরসনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে যে কর্মত ৎপরতা দরকার, তার কোনো কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বিশেষজ্ঞরা যেমন বলেছেন, আমরাও তেমন মনে করি যে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যামের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিবহন-অবকাঠামোর অভাব। সহজ করে বললে, ঢাকার মতো মেগা সিটিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণপরিবহন বলে এখন কিছুই নেই। সাত-আট বছর আগেও পাবলিক ট্রান্সপোর্টের যে কাঠামোটি ছিল, তা পরিবহন সিন্ডিকেট নামক দুষ্টচক্রের পেটের মধ্যে চলে গেছে অনেক আগেই। এ চক্রের সঙ্গে রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সামরিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক সংগঠন জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আমি ইউরোপ-আমেরিকার পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কথা বলতে চাই না। এমনকি এশিয়ার সিঙ্গাপুরের কথাও বলতে চাই না। তবে কয়েক শ মাইল দূরের কলকাতা শহরের উদাহরণ নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক হবে এখানে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট ও পরিবহন-অবকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ঢাকা শহরে না আছে পাতালরেল, না আছে ভালো কোনো বাস, না আছে কোনো ট্যাক্সি সার্ভিস। থাকার মধ্যে আছে কিছু সিএনজি, চাহিদার তুলনায় যা খুবই অপর্যাপ্ত। আর দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সিএনজি অটোরিকশাচালকদের মর্জি ও করুণার ওপরই যাত্রীদের ভরসা করে থাকতে হয়। ঢাকার রাস্তায় বেরোলেই মনে হয়, অনেক জনমের পাপ জমা হয়েছিল, আর তার প্রায়শ্চিত্ত করতেই এ জনমে ঢাকা শহরের বাসিন্দা হয়ে জন্মেছি।
বিশ্বের যেকোনো ভালো শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উন্নত মানের যোগাযোগ-অবকাঠামো এবং পর্যাপ্ত ও শক্তিশালী পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। শহরের নাগরিক ও বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াতের জন্য সেখানে অনেক বিকল্প থাকে। তাঁরা পাবলিক বাস বা ট্রামে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারেন। কেউ বাসে বা ট্রামে যেতে না চাইলে মেট্রো বা পাতালরেলে করে যেতে পারেন। বাস, ট্রাম ও ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব শহরে রয়েছে ভালো ট্যাক্সি সার্ভিস। ঢাকা শহরের যোগাযোগ-অবকাঠামো খুবই দুর্বল, কেননা এখানে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কোনো ফ্লাইওভার নেই। এ শহরে কোনো পাতালরেলও নেই, যা অফিস শুরু ও শেষের সময় বিপুলসংখ্যক মানুষকে অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। মাটির ওপর আমাদের যে রাস্তাঘাট রয়েছে, নাগরিকদের যোগাযোগের চাহিদা ও বিপুলসংখ্যক গাড়ির চাপের তুলনায় তা খুবই অপর্যাপ্ত। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি তৈরিকারক যানজট!
ঢাকা শহরের অসহনীয় যানজটের মধ্যে একটি খবর একপশলা বৃষ্টির মতো প্রশান্তি নিয়ে এসেছিল। আর সেটি হচ্ছে, জাপান আন্তর্জাতিক সমন্বয় এজেন্সির (জাইকা) অর্থসহায়তায় উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত পাতাল-রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনার খবর। এটি ‘মাস র্যাপিড ট্রানজিট (MRT-6)’ নামে পরিচিত। পাতালরেল চালু হলে তা অফিস শুরু ও সমাপ্তির সময়ে এক ঘণ্টায় ৬০ হাজার মানুষকে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এ পরিকল্পনায় বাদ সেধেছে বিমানবাহিনী। পরিকল্পিত পাতালরেলের যে লাইন বিজয় সরণি দিয়ে গেছে, তা যুদ্ধকালীন ও জরুরি অবস্থায় সমস্যা তৈরি করবে বলে বিমানবাহিনী আপত্তি জানিয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিশেষজ্ঞ, মন্ত্রী, বিমানবাহিনীর প্রতিনিধি ও জাইকা প্রতিনিধিদের যে বৈঠক হয়, সেখানে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে এ আপত্তি জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বিমানবাহিনীকে আশ্বস্ত করার পরও তারা গোঁ ধরে বসে থাকে এবং বিমানবাহিনীর গোয়ার্তুমির পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে মূল পরিকল্পনায় আরেকটি সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীর ফলে পাতালরেল এখন বিজয় সরণির পরিবর্তে সংসদ ভবনসংলগ্ন এলাকার মধ্য দিয়ে নির্মিত হবে। জাইকা প্রতিনিধি এ পরিকল্পনা এ শর্তে গ্রহণ করেছেন যে সাংসদেরা বা সংসদ সচিবালয় থেকে যদি কোনো আপত্তি না আসে, তাহলে তাঁরা এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করবেন। জাইকা প্রতিনিধি স্পষ্ট করে বলেছেন, আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে পাতালরেলের রুট সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে হবে, নইলে তারা যে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা এক বছর বিলম্বিত হতে পারে।
বিমানবাহিনী পাতালরেলের রুট নিয়ে যে আপত্তি করেছে, তাকে আমরা হালকা করে দেখছি না। কেননা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন হলে তাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা কোনো সমস্যা নেই মর্মে আশ্বস্ত করার পরও বিমানবাহিনী যে গোঁ ধরে বসে থাকল, তাকে আমরা যৌক্তিক ও সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে করি না। আর ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত ও মসৃণ করার জন্য তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর ও সেনানিবাসকে অবিলম্বে ঢাকার আশপাশে সরিয়ে নেওয়া উচিত বলে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা যে মত দিয়েছেন, সাধারণ নাগরিকেরা এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। পরিকল্পনা করে সত্বর কর্মত ৎপর না হলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা বাসযোগ্য থাকবে কি না, সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করি।
শেখ হাফিজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
sheikhrahman2@gmail.com
No comments