সময়ের প্রতিধ্বনি-ভারতের আশা-জাগানিয়া উদ্যোগ by মোস্তফা কামাল
গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরটি ছিল দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ওই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্কর্কে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সুযোগ তৈরি হয় কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগ তথা ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পরিবারের মধ্যে ঐতিহ্যগত পারিবারিক সম্কর্ক ঝালাই করে
নেওয়ারও। পারিবারিক সম্কর্ক যে রাষ্ট্রীয় সম্কর্কেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে তার প্রমাণ এই দুটি পরিবার।
প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করতে দিলি্লতে গিয়ে তখন দেখেছিলাম, ইন্দিরার পুত্রবধূ ও বর্তমান কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী কিভাবে পরম মমতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। পারিবারিক সম্কর্ক না থাকলে হয়তো এ রকম আবেগময় দৃশ্য আমরা দেখতে পেতাম না। রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী এবং কংগ্রেসের সাধারণ সম্কাদক ও রাজীব তনয় রাহুল গান্ধীর আন্তরিকতা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। ওই দৃশ্য যেকোনো বাংলাদেশিকেই স্কর্শ করবে। এই পারিবারিক সুসম্কর্কটি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্কর্কের সেতুবন্ধে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।
নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং যৌথবাহিনী গঠন করে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ভারতের সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কত বছর লড়াই করতে হতো কে জানে। তা ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইন্দিরা গান্ধী সারা বিশ্বে ছুটে বেরিয়েছেন। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুযায়ী ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ভারতের এই সহযোগিতা এখনো এ দেশের মানুষ স্মরণ করে।
দুই দেশের মধ্যে এখন এমন কোনো ইস্যু নেই, যা নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া দুই দেশের গণমাধ্যমই প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সম্কর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। গত জানুয়ারি মাসে দিলি্লতে সফরে গিয়ে দেখেছি, ভারতীয় গণমাধ্যমও দুই দেশের সম্কর্ক নিয়ে অনেক ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেছে। যে গণমাধ্যম বাংলাদেশের ওপর একের পর এক নেতিবাচক স্টোরি করে আসছিল, তাদের হঠাৎ বদলে যাওয়া দেখেও আমরা অবাক হয়েছি। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তখন বলছিল, 'বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে। এবার ভারতের দেওয়ার পালা। প্রতিবেশী বাংলাদেশকে এবার উজাড় করে দিতে হবে। দুই হাত ভরে দিতে হবে।'
ভারতীয় গণমাধ্যমের এই ইতিবাচক মনোভাবের কারণ হচ্ছে, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের আন্তরিক ও নিঃশর্ত সহযোগিতা। ভারত বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্যাম্ক রয়েছে বলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা বন্ধে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো কোনো নেতাকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ সহযোগিতা করেছে। ফলে ভারতীয় সরকার, গণমাধ্যম এবং দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। শুধু এ কারণেই ভারত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, বাড়িয়েছে সহযোগিতার হাত। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভারত দুই হাত ভরে দেবে তো দূরে থাক, হাত সম্ক্রসারণও করেনি। বরং ভারত একেবারে হাত গুটিয়ে নিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে এটা ঠিক, শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের দেড় বছর পরও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ভারতের এ আমলাতান্ত্রিকতা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীও নাকি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে দুই দেশের সীমান্তসংক্রান্ত সমস্যা এবং অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই কমিটির জনৈক প্রবীণ সদস্য এই লেখককে জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটির লিখিত প্রস্তাবটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে হস্তান্তরের সময় কমিটির বাংলাদেশ পক্ষের সদস্যরা বলেছিলেন, প্রস্তাবটি আপনি অনুমোদন করে দিলেই ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যায়। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'সবই তো বুঝি এবং আপনাদের বক্তব্যও সঠিক বলে মনে করি। কিন্তু আমাদের সাউথ ব্লক (পররাষ্ট্র দপ্তর) তো কিছুতেই কিছু করতে চায় না। আপনারা ওদের একটু বোঝান।'
ইন্দিরা গান্ধীর মতো এখন ড. মনমোহন সিংও হয়তো সাউথ ব্লককে রাজি করাতে ব্যর্থ। তাই দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্কর্ক থাকা সত্ত্বেও অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।
শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের পর ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানে আরো দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। সে রকম নির্দেশনা ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কুটিল আমলাতন্ত্র সব কিছু যেন আটকে দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে এক ধরনের হতাশা জন্ম নেয়। সংশ্লিষ্ট অনেককেই বলতে শুনেছি, দুই দেশের রাজনৈতিক ও পারিবারিক পর্যায়ে এত ভালো সম্কর্ক থাকার পরও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে আর কোনো দিনও হবে না। ৪০ বছর ধরে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো আগামী ৪০ বছরেও সমাধান হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের হতাশা হয়তো ভারত সরকার আঁচ করতে পেরেছে। আর সে কারণেই সম্ভবত ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের দিক থেকে এ উদ্যোগ আমাদের নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। সম্ক্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে দুটি ইস্যুতে সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টন। দুটিই বাংলাদেশের জন্য বড় ইস্যু। এ দুটি ইস্যুর সমাধান হলে দুই দেশের বেশির ভাগ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিং। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যৌথবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই এখন চাকরিতে আছেন। ৪০ বছর পর তিনি বাংলাদেশে এলেন। যে ভূখণ্ডটির জন্য তিনি অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন সেই ভূখণ্ডের মানুষদের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁকে যে সম্মান দিয়েছে, তা তাঁর প্রাপ্য। যে জাতি সম্মান দিতে জানে না, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। পাশাপাশি বলতে চাই, বাঙালি বড়ই শান্তিপ্রিয় জাতি। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ড বাংলার মাটিতে হবে না। এটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
আমরা দেখছি, প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের সব উদ্যোগ যখন থেমে গিয়েছিল, ঠিক তখনই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। তাঁর সফরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা ঘুরে গেছেন। ৬ জুলাই ঢাকায় আসছেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে তিনি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। বৈঠকে দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। পরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব বিষয়ে চুক্তি সই হবে। এসব বিষয়ে ভারতের সাম্ক্রতিক উদ্যোগ বাংলাদেশকে আশাবাদী করে তুলছে। আরো বেশি আশাবাদী করেছে, ভারত সরকারের মূল চালিকাশক্তি কংগ্রেস জোট নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশ সফর। তিনি প্রতিবন্ধীদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগামী ২৫ জুলাই ঢাকায় আসবেন। তিনি নিশ্চয়ই দুই দেশের সম্কর্ক উন্নয়নের পথে কোনো বাধা থাকলে তা দূর করার পরামর্শ দেবেন। তাঁর দিকনির্দেশনা দুই দেশের সম্কর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
আমরা আশা করি, সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিং আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও দুই দেশের সীমানা অমীমাংসিত থাকতে পারে না। অথচ মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণ বাকি থাকায় ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর সম্ভব হচ্ছে না। দুই দেশের মধ্যে এখনো ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সম্ভব হয়নি। এবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে লজ্জায় পড়তে হবে। দুই দেশের সমুদ্রসীমা নিয়েও এখনই মীমাংসা হওয়া দরকার। কারণ ইস্যুটি এরই মধ্যে ভারত জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করবে। সেটা নিশ্চয়ই ভারতের ভালো লাগবে না।
আমরা জানি, ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। এ ছাড়া নৌপথে পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও ভুটান ও নেপালে সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। আঞ্চলিক ভিত্তিতে পরস্করের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ প্রদানে উভয়পক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পণ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা চায়। এবার ৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভারত দেবে বলে শোনা যায়। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে।
আমাদের দেশে কোনো কোনো পক্ষ বলতে চায়, ভারত সব সময়ই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বড় ভাই সুলভ আচরণ করে। আর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। ভারতের এ মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। ছোট দেশগুলোকে এগিয়ে নেওয়া বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই দায়িত্ব। গুজরাল মতবাদেও ঠিক এ কথাই বলা হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল বলেছিলেন, বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যাওয়া।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ভারতের প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সমর্থন লাগবে। সেই সমর্থন পেতে হলে ভারতের হাতই প্রসারিত করতে হবে। প্রতিবেশীদের আস্থায় নিতে হবে। ছোট দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই ভারত বড় হতে পারবে। অন্যথায় নয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করতে দিলি্লতে গিয়ে তখন দেখেছিলাম, ইন্দিরার পুত্রবধূ ও বর্তমান কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী কিভাবে পরম মমতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বরণ করে নিয়েছিলেন। পারিবারিক সম্কর্ক না থাকলে হয়তো এ রকম আবেগময় দৃশ্য আমরা দেখতে পেতাম না। রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী এবং কংগ্রেসের সাধারণ সম্কাদক ও রাজীব তনয় রাহুল গান্ধীর আন্তরিকতা দেখে যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছি। ওই দৃশ্য যেকোনো বাংলাদেশিকেই স্কর্শ করবে। এই পারিবারিক সুসম্কর্কটি দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সম্কর্কের সেতুবন্ধে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।
নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং যৌথবাহিনী গঠন করে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ভারতের সহযোগিতা না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কত বছর লড়াই করতে হতো কে জানে। তা ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ইন্দিরা গান্ধী সারা বিশ্বে ছুটে বেরিয়েছেন। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছানুযায়ী ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ভারতের এই সহযোগিতা এখনো এ দেশের মানুষ স্মরণ করে।
দুই দেশের মধ্যে এখন এমন কোনো ইস্যু নেই, যা নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া দুই দেশের গণমাধ্যমই প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে সম্কর্ক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। গত জানুয়ারি মাসে দিলি্লতে সফরে গিয়ে দেখেছি, ভারতীয় গণমাধ্যমও দুই দেশের সম্কর্ক নিয়ে অনেক ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করেছে। যে গণমাধ্যম বাংলাদেশের ওপর একের পর এক নেতিবাচক স্টোরি করে আসছিল, তাদের হঠাৎ বদলে যাওয়া দেখেও আমরা অবাক হয়েছি। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো তখন বলছিল, 'বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে। এবার ভারতের দেওয়ার পালা। প্রতিবেশী বাংলাদেশকে এবার উজাড় করে দিতে হবে। দুই হাত ভরে দিতে হবে।'
ভারতীয় গণমাধ্যমের এই ইতিবাচক মনোভাবের কারণ হচ্ছে, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের আন্তরিক ও নিঃশর্ত সহযোগিতা। ভারত বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নতাবাদী ক্যাম্ক রয়েছে বলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা বন্ধে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো কোনো নেতাকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিশেষ সহযোগিতা করেছে। ফলে ভারতীয় সরকার, গণমাধ্যম এবং দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। শুধু এ কারণেই ভারত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, বাড়িয়েছে সহযোগিতার হাত। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভারত দুই হাত ভরে দেবে তো দূরে থাক, হাত সম্ক্রসারণও করেনি। বরং ভারত একেবারে হাত গুটিয়ে নিয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে এটা ঠিক, শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের দেড় বছর পরও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ভারতের এ আমলাতান্ত্রিকতা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীও নাকি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে দুই দেশের সীমান্তসংক্রান্ত সমস্যা এবং অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে বিশেষজ্ঞ কমিটি একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই কমিটির জনৈক প্রবীণ সদস্য এই লেখককে জানান, বিশেষজ্ঞ কমিটির লিখিত প্রস্তাবটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে হস্তান্তরের সময় কমিটির বাংলাদেশ পক্ষের সদস্যরা বলেছিলেন, প্রস্তাবটি আপনি অনুমোদন করে দিলেই ঝুলে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যায়। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'সবই তো বুঝি এবং আপনাদের বক্তব্যও সঠিক বলে মনে করি। কিন্তু আমাদের সাউথ ব্লক (পররাষ্ট্র দপ্তর) তো কিছুতেই কিছু করতে চায় না। আপনারা ওদের একটু বোঝান।'
ইন্দিরা গান্ধীর মতো এখন ড. মনমোহন সিংও হয়তো সাউথ ব্লককে রাজি করাতে ব্যর্থ। তাই দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ সম্কর্ক থাকা সত্ত্বেও অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।
শেখ হাসিনার দিলি্ল সফরের পর ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানে আরো দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। সে রকম নির্দেশনা ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদের পক্ষ থেকে দেওয়াও হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কুটিল আমলাতন্ত্র সব কিছু যেন আটকে দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে এক ধরনের হতাশা জন্ম নেয়। সংশ্লিষ্ট অনেককেই বলতে শুনেছি, দুই দেশের রাজনৈতিক ও পারিবারিক পর্যায়ে এত ভালো সম্কর্ক থাকার পরও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে আর কোনো দিনও হবে না। ৪০ বছর ধরে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো আগামী ৪০ বছরেও সমাধান হবে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের হতাশা হয়তো ভারত সরকার আঁচ করতে পেরেছে। আর সে কারণেই সম্ভবত ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের দিক থেকে এ উদ্যোগ আমাদের নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। সম্ক্রতি ভারতের পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা সফর করে গেছেন। তিনি বাংলাদেশ পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে দুটি ইস্যুতে সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান এবং তিস্তা নদীর পানি বণ্টন। দুটিই বাংলাদেশের জন্য বড় ইস্যু। এ দুটি ইস্যুর সমাধান হলে দুই দেশের বেশির ভাগ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন ভারতীয় সেনাপ্রধান বিজয় কুমার সিং। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যৌথবাহিনীর সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিই এখন চাকরিতে আছেন। ৪০ বছর পর তিনি বাংলাদেশে এলেন। যে ভূখণ্ডটির জন্য তিনি অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন সেই ভূখণ্ডের মানুষদের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁকে যে সম্মান দিয়েছে, তা তাঁর প্রাপ্য। যে জাতি সম্মান দিতে জানে না, সে জাতি কখনো বড় হতে পারে না। পাশাপাশি বলতে চাই, বাঙালি বড়ই শান্তিপ্রিয় জাতি। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ড বাংলার মাটিতে হবে না। এটা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
আমরা দেখছি, প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সমস্যা সমাধানের সব উদ্যোগ যখন থেমে গিয়েছিল, ঠিক তখনই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। তাঁর সফরের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও ঢাকা ঘুরে গেছেন। ৬ জুলাই ঢাকায় আসছেন সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে তিনি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। বৈঠকে দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। পরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব বিষয়ে চুক্তি সই হবে। এসব বিষয়ে ভারতের সাম্ক্রতিক উদ্যোগ বাংলাদেশকে আশাবাদী করে তুলছে। আরো বেশি আশাবাদী করেছে, ভারত সরকারের মূল চালিকাশক্তি কংগ্রেস জোট নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বাংলাদেশ সফর। তিনি প্রতিবন্ধীদের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আগামী ২৫ জুলাই ঢাকায় আসবেন। তিনি নিশ্চয়ই দুই দেশের সম্কর্ক উন্নয়নের পথে কোনো বাধা থাকলে তা দূর করার পরামর্শ দেবেন। তাঁর দিকনির্দেশনা দুই দেশের সম্কর্কে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
আমরা আশা করি, সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিং আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও দুই দেশের সীমানা অমীমাংসিত থাকতে পারে না। অথচ মাত্র সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণ বাকি থাকায় ছিটমহল বিনিময় ও অপদখলীয় জমি হস্তান্তর সম্ভব হচ্ছে না। দুই দেশের মধ্যে এখনো ৫৩টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সম্ভব হয়নি। এবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে লজ্জায় পড়তে হবে। দুই দেশের সমুদ্রসীমা নিয়েও এখনই মীমাংসা হওয়া দরকার। কারণ ইস্যুটি এরই মধ্যে ভারত জাতিসংঘে উত্থাপন করেছে। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করবে। সেটা নিশ্চয়ই ভারতের ভালো লাগবে না।
আমরা জানি, ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। এ ছাড়া নৌপথে পণ্য পরিবহনের জন্য চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। বাংলাদেশও ভুটান ও নেপালে সড়কপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে চায়। আঞ্চলিক ভিত্তিতে পরস্করের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ প্রদানে উভয়পক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের কাছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পণ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা চায়। এবার ৬১টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভারত দেবে বলে শোনা যায়। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসবে।
আমাদের দেশে কোনো কোনো পক্ষ বলতে চায়, ভারত সব সময়ই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বড় ভাই সুলভ আচরণ করে। আর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুধু নিতে জানে, দিতে জানে না। ভারতের এ মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। ছোট দেশগুলোকে এগিয়ে নেওয়া বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই দায়িত্ব। গুজরাল মতবাদেও ঠিক এ কথাই বলা হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল বলেছিলেন, বড় দেশ হিসেবে ভারতেরই উচিত প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যাওয়া।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ভারতের প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সমর্থন লাগবে। সেই সমর্থন পেতে হলে ভারতের হাতই প্রসারিত করতে হবে। প্রতিবেশীদের আস্থায় নিতে হবে। ছোট দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলেই ভারত বড় হতে পারবে। অন্যথায় নয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com
No comments