সপ্তাহের হালচাল-সত্যের ঢাক আপনি বাজে by আব্দুল কাইয়ুম
এখন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, উইকিলিকসে তাঁদের নামে যেসব গোপন তারবার্তা প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো সব মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইত্যাদি। তাঁদের মূল কথা হলো, মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাঁরা আলাপ করলেও প্রকাশিত কথাগুলো তাঁরা বলেননি।
সোমবার দৈনিক ইত্তেফাক-এ এক প্রতিবাদলিপিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশিত দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, জনগণ যখন কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই ‘বিএনপিকে ভাঙার কল্পকাহিনিসহ এই অপপ্রচার চালিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে’ প্রবাহিত করার জন্য একটি মহল অপকৌশলে মেতে উঠেছে। এটা স্পষ্ট যে তিনি উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যগুলোকে তাঁদের ‘গণ-আন্দোলনের’ পথে বাধা হিসেবে দেখছেন। কারণ, তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন নিয়ে যদি কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়, যদি খালেদা জিয়া বিরোধী একটি গ্রুপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান, তাহলে দলে হতাশা ও বিভক্তি সৃষ্টি হবে। আন্দোলন হবে কীভাবে?
এর আগে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমুর প্রতিবাদ আসে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার এবং তাঁকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন প্রভৃতি বিষয়ে আমির হোসেন আমুর নামে যেসব কথা ছাপা হয়েছে, সেগুলো মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেছেন। তাঁর এ দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর ভূমিকা সবাই জানে, এখন অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু জেনেশুনেই তাঁর বিষয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে তিনি অভিমত দেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে দুর্নীতি, অনিয়ম, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে অযাচিত হস্তক্ষেপসহ অনেক অভিযোগ ছাপা হয়েছে। গুরুতর অভিযোগ ওঠে যে বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর পরামর্শে তারেক রহমান বাংলা ভাইয়ের সহযোগী জেএমবির নেতা খামারুর মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে দুলু প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, উইকিলিকসের তথ্য নির্জলা মিথ্যা। অথচ সবাই জানে, সে সময় বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে দুলু ও বিএনপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; ওই সময়ের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন খবরও বেরিয়েছে। এ জন্য উইকিলিকসের দরকার পড়ে না।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে দেশে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। তার ভেতরের অনেক কাহিনি উইকিলিকসের থলি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওগুলো নতুন কিছু নয়। তা-ও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ওসবের মূল্য আছে। আমাদের রাজনীতির শক্তি ও দুর্বলতা বোঝার জন্য অনেক তথ্য বেশ কাজে লাগে। যেমন—প্রকাশিত কয়েকটি তারবার্তায় বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, বিএনপির প্রয়াত নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ আরও অনেকে তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রধান দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সোজা কথায় বলা হয়, তাঁরা ‘মাইনাস টু’ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই অভিযোগ আগেও উঠেছে, এখন আবার আলোচনায় এসেছে। দলের মধ্যে সংস্কার বা এ জন্য কোনো নেতাকে পদচ্যুত করা যেতে পারে; কিন্তু সেটা হতে হবে দলের গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী। তা না করে যদি অবৈধভাবে চেপে বসা সামরিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা আর সংস্কার থাকে না, হয়ে যায় চক্রান্ত।
এক-এগারোত্তর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে অভিযুক্ত নেতারা মাইনাস টু করার চেষ্টা করেছিলেন বলেই তা ছিল চক্রান্তমূলক। ওই সময় বিএনপির একজন নেতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সমালোচনা করে বলেন, ‘একদিন গভীর রাতে ওরা এসে বলল, চলেন যেতে হবে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের অবসান ঘটাতে হবে, রাজনৈতিক দলের সংস্কার করতে হবে।’ অনেকটা চাপের মুখে তিনি রাজি হন বলে জানান। কিন্তু এরপর অনেক দিন পর্যন্ত আর সাড়াশব্দ নেই দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও একইভাবে বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁরা সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশে রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। আলাদা বিবৃতি দেন। পরে তাঁদের উদ্যোগ আর অগ্রসর হতে পারেনি। কারণ, যে দেশে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, সেখানে সেনাসমর্থনে কোনো রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের চিন্তা করাও বড় ধরনের এক রাজনৈতিক অপরাধ। তা ছাড়া সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ওই ধরনের সংস্কারের অনুকূল ছিল না।
শেখ হাসিনা আশির দশকের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি ছিলেন না। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের সংকট ও নৈরাজ্য দেখা দিলে সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে অনেক অনুরোধ করে নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।
খালেদা জিয়াও বিএনপির রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর দলে নেতৃত্বের শূন্যতা ও হতাশা সৃষ্টি হলে তাঁকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়। তিনিও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতা হিসেবে দলে ও দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এ দুই নেতার ভুলত্রুটি আছে। হয়তো তাঁদের রেষারেষি ও অবিবেচক কাজের ফলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। কিন্তু এ কারণে দুই নেত্রীকে চক্রান্ত করে ‘মাইনাস’ করা যাবে না, বা করলেও সমস্যার সমাধান হবে না।
এটা দুঃখজনক যে আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ নেতাদের অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। এটা যদি কোনোভাবে সফল হতো এবং উইকিলিকসের কিছু তথ্যে দেখা যায় ঘটনাক্রমে সফল হতেও পারত, তাহলে হয়তো সংস্কারের পরিবর্তে রাজনৈতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারত। কারণ, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকত সেনা নেতৃত্বের হাতে, গণতন্ত্র বিপন্ন হতো এবং পরোক্ষ সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দেশ আটকে যেত। তার চেয়ে বরং নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ অনেক বেশি ভালো হয়েছে।
এতে হয়তো দুই নেত্রীর রেষারেষির রাজনীতির অবসান হলো না, কিন্তু কোনো দিন হবে না, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। যেহেতু দুই নেত্রী এ দেশের গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি, তাই তাঁদের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই থাকতে হবে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে মানুষই তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবে।
বিশ্বের অনেক দেশে একসময়ের জনপ্রিয় কোনো নেতাকে তাঁর বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাখ্যাত হতে দেখা গেছে। আবার বিপরীতে দেখা গেছে, থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে সেনাশাসকেরা ২০০৬ সালে অকল্পনীয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে দেশত্যাগে বাধ্য করলেও তিনি বারবার থাই রাজনীতিতে ফিরে আসছেন। বিগত নির্বাচনে তাঁর বোন ইংলাক বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রকৃতপক্ষে দেশান্তরিত থাকসিনের অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তারই প্রমাণ দিয়েছেন। অথচ সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক দুর্নীতির অভিযোগ থাই আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে। হয়তো তাঁর অনেক দোষত্রুটি আছে, কিন্তু তিনি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই সেনাশাসকদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিলেন, সে কারণেই হয়তো বিপুল শক্তিতে আবার ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন। সেনা হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা থাইল্যান্ডের জন্য যে ভালো হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রশ্ন ওঠে, জনগণ কোনটা চায়, তা বোঝার উপায় কী? গণতন্ত্রে এর একটি নির্ভরযোগ্য উপায় হলো ভোটের ফলাফল। বিএনপি সরকারের আমলের দুর্নীতি, লুটপাট, অন্যায় ও অবিচারের অবসান চেয়েছে বলেই বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের নেতারা এ সত্য বুঝতে অক্ষম। তাঁরা বিপুল বিজয়কে বিপুল দুর্নীতির সুযোগ বলে ধরে নিয়েছেন। এর পরিণাম যে শুভ হবে না, তা মন্ত্রীরাও বোঝেন। উইকিলিকসের এক তারবার্তায় দেখা যায়, একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার মতো ভালো কাজ করতে না পারলে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের কারাগারে যেতে হবে! চোখ খুলে দেওয়ার মতো একটা জ্বলন্ত সত্য উইকিলিকস প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ দুর্নীতি করলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগই যথেষ্ট নয়, তার প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণ করা তো সরকারের কাজ, সদিচ্ছা থাকলে তারাই অনায়াসে সেটা করতে পারে, পত্রিকা বা অন্য কাউকে তা করতে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের একজন নেতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবই জানেন, বোঝেন, কিন্তু মনে করেন লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী অভিযুক্ত দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীদের সুরক্ষা দিচ্ছেন, যা নিজের দল ও দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
উইকিলিকস প্রায় আড়াই লাখ গোপন তারবার্তা প্রকাশ করে এক নতুন যুগের সূচনা করে গেল। ‘হ্যাকটিভিস্ট’রা (হ্যাকিংয়ে সিদ্ধহস্ত) তৎপর রয়েছে এবং থাকবে, সত্যের ঢাক তারা পিটিয়েই যাবে। এ থেকে আমাদের মতো দেশের রাজনীতিবিদেরা কতটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
এর আগে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমুর প্রতিবাদ আসে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার এবং তাঁকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন প্রভৃতি বিষয়ে আমির হোসেন আমুর নামে যেসব কথা ছাপা হয়েছে, সেগুলো মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেছেন। তাঁর এ দাবির বিষয়ে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর ভূমিকা সবাই জানে, এখন অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু জেনেশুনেই তাঁর বিষয়ে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে তিনি অভিমত দেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে দুর্নীতি, অনিয়ম, হাওয়া ভবনের মাধ্যমে অযাচিত হস্তক্ষেপসহ অনেক অভিযোগ ছাপা হয়েছে। গুরুতর অভিযোগ ওঠে যে বিএনপির স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক ও নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর পরামর্শে তারেক রহমান বাংলা ভাইয়ের সহযোগী জেএমবির নেতা খামারুর মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে দুলু প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, উইকিলিকসের তথ্য নির্জলা মিথ্যা। অথচ সবাই জানে, সে সময় বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে দুলু ও বিএনপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল; ওই সময়ের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন খবরও বেরিয়েছে। এ জন্য উইকিলিকসের দরকার পড়ে না।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে দেশে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। তার ভেতরের অনেক কাহিনি উইকিলিকসের থলি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওগুলো নতুন কিছু নয়। তা-ও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ওসবের মূল্য আছে। আমাদের রাজনীতির শক্তি ও দুর্বলতা বোঝার জন্য অনেক তথ্য বেশ কাজে লাগে। যেমন—প্রকাশিত কয়েকটি তারবার্তায় বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, বিএনপির প্রয়াত নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ আরও অনেকে তাঁদের নিজ নিজ দলের প্রধান দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সোজা কথায় বলা হয়, তাঁরা ‘মাইনাস টু’ করার চেষ্টা করেছিলেন। এই অভিযোগ আগেও উঠেছে, এখন আবার আলোচনায় এসেছে। দলের মধ্যে সংস্কার বা এ জন্য কোনো নেতাকে পদচ্যুত করা যেতে পারে; কিন্তু সেটা হতে হবে দলের গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী। তা না করে যদি অবৈধভাবে চেপে বসা সামরিক শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা আর সংস্কার থাকে না, হয়ে যায় চক্রান্ত।
এক-এগারোত্তর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে অভিযুক্ত নেতারা মাইনাস টু করার চেষ্টা করেছিলেন বলেই তা ছিল চক্রান্তমূলক। ওই সময় বিএনপির একজন নেতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সমালোচনা করে বলেন, ‘একদিন গভীর রাতে ওরা এসে বলল, চলেন যেতে হবে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের অবসান ঘটাতে হবে, রাজনৈতিক দলের সংস্কার করতে হবে।’ অনেকটা চাপের মুখে তিনি রাজি হন বলে জানান। কিন্তু এরপর অনেক দিন পর্যন্ত আর সাড়াশব্দ নেই দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও একইভাবে বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁরা সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে যোগসাজশে রাজনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। আলাদা বিবৃতি দেন। পরে তাঁদের উদ্যোগ আর অগ্রসর হতে পারেনি। কারণ, যে দেশে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে, সেখানে সেনাসমর্থনে কোনো রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের চিন্তা করাও বড় ধরনের এক রাজনৈতিক অপরাধ। তা ছাড়া সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ওই ধরনের সংস্কারের অনুকূল ছিল না।
শেখ হাসিনা আশির দশকের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সরাসরি ছিলেন না। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের সংকট ও নৈরাজ্য দেখা দিলে সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে অনেক অনুরোধ করে নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।
খালেদা জিয়াও বিএনপির রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর দলে নেতৃত্বের শূন্যতা ও হতাশা সৃষ্টি হলে তাঁকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়। তিনিও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতা হিসেবে দলে ও দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
এ দুই নেতার ভুলত্রুটি আছে। হয়তো তাঁদের রেষারেষি ও অবিবেচক কাজের ফলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় আসার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। কিন্তু এ কারণে দুই নেত্রীকে চক্রান্ত করে ‘মাইনাস’ করা যাবে না, বা করলেও সমস্যার সমাধান হবে না।
এটা দুঃখজনক যে আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভিজ্ঞ নেতাদের অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। এটা যদি কোনোভাবে সফল হতো এবং উইকিলিকসের কিছু তথ্যে দেখা যায় ঘটনাক্রমে সফল হতেও পারত, তাহলে হয়তো সংস্কারের পরিবর্তে রাজনৈতিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারত। কারণ, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকত সেনা নেতৃত্বের হাতে, গণতন্ত্র বিপন্ন হতো এবং পরোক্ষ সেনাশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্যে দেশ আটকে যেত। তার চেয়ে বরং নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত গণতন্ত্রে উত্তরণ অনেক বেশি ভালো হয়েছে।
এতে হয়তো দুই নেত্রীর রেষারেষির রাজনীতির অবসান হলো না, কিন্তু কোনো দিন হবে না, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। যেহেতু দুই নেত্রী এ দেশের গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি, তাই তাঁদের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই থাকতে হবে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে মানুষই তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবে।
বিশ্বের অনেক দেশে একসময়ের জনপ্রিয় কোনো নেতাকে তাঁর বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাখ্যাত হতে দেখা গেছে। আবার বিপরীতে দেখা গেছে, থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে সেনাশাসকেরা ২০০৬ সালে অকল্পনীয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে দেশত্যাগে বাধ্য করলেও তিনি বারবার থাই রাজনীতিতে ফিরে আসছেন। বিগত নির্বাচনে তাঁর বোন ইংলাক বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রকৃতপক্ষে দেশান্তরিত থাকসিনের অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তারই প্রমাণ দিয়েছেন। অথচ সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিনের বিরুদ্ধে সাংঘাতিক দুর্নীতির অভিযোগ থাই আদালতেই প্রমাণিত হয়েছে। হয়তো তাঁর অনেক দোষত্রুটি আছে, কিন্তু তিনি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগেই সেনাশাসকদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছিলেন, সে কারণেই হয়তো বিপুল শক্তিতে আবার ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছেন। সেনা হস্তক্ষেপে রাজনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা থাইল্যান্ডের জন্য যে ভালো হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রশ্ন ওঠে, জনগণ কোনটা চায়, তা বোঝার উপায় কী? গণতন্ত্রে এর একটি নির্ভরযোগ্য উপায় হলো ভোটের ফলাফল। বিএনপি সরকারের আমলের দুর্নীতি, লুটপাট, অন্যায় ও অবিচারের অবসান চেয়েছে বলেই বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মানুষ ভোট দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের নেতারা এ সত্য বুঝতে অক্ষম। তাঁরা বিপুল বিজয়কে বিপুল দুর্নীতির সুযোগ বলে ধরে নিয়েছেন। এর পরিণাম যে শুভ হবে না, তা মন্ত্রীরাও বোঝেন। উইকিলিকসের এক তারবার্তায় দেখা যায়, একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলছেন, পুনর্নির্বাচিত হওয়ার মতো ভালো কাজ করতে না পারলে বিরোধী দল ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের কারাগারে যেতে হবে! চোখ খুলে দেওয়ার মতো একটা জ্বলন্ত সত্য উইকিলিকস প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ দুর্নীতি করলে তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগই যথেষ্ট নয়, তার প্রমাণ দিতে হবে। প্রমাণ করা তো সরকারের কাজ, সদিচ্ছা থাকলে তারাই অনায়াসে সেটা করতে পারে, পত্রিকা বা অন্য কাউকে তা করতে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের একজন নেতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবই জানেন, বোঝেন, কিন্তু মনে করেন লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী অভিযুক্ত দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীদের সুরক্ষা দিচ্ছেন, যা নিজের দল ও দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
উইকিলিকস প্রায় আড়াই লাখ গোপন তারবার্তা প্রকাশ করে এক নতুন যুগের সূচনা করে গেল। ‘হ্যাকটিভিস্ট’রা (হ্যাকিংয়ে সিদ্ধহস্ত) তৎপর রয়েছে এবং থাকবে, সত্যের ঢাক তারা পিটিয়েই যাবে। এ থেকে আমাদের মতো দেশের রাজনীতিবিদেরা কতটা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments