স্বাস্থ্যসেবার চালচিত্র by লুৎফর রহমান রনো

রোগী একজন শিক্ষিত-সচেতন নাগরিক। তাঁর শরীরে যে কিছু রোগ তাঁকে মাঝেমধ্যে পীড়া দেয়, সে রোগগুলো সম্পর্কে তিনি মোটামুটি সচেতন। বাস করেন প্রত্যন্ত গ্রামে। হঠাৎ একদিন বুকের নিচে (তাও বাঁ দিকে) প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। তার পরও তিনি নিশ্চিত, এটি হৃৎপিণ্ডের ব্যথা নয়। তবু বেতাল ব্যথার কারণে দ্রুত ভর্তি হলেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।


ডাক্তার কী করবেন? ইসিজি করার যন্ত্র নেই। আলট্রাসনোগ্রাম করার ব্যবস্থা নেই। হাঁটতে-চলতে অক্ষম রোগীকে তখন পাঠানো হলো একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে, যেখানে ওসব আছে। ওখানে তাঁরা ইসিজি করলেন। না, হার্টের সমস্যা নয়, আলট্রাসনোগ্রাম করলেন। লিভার, গলব্লাডার, কিডনি_সব কিছুই ভালো। তাহলে? ডাক্তার নিশ্চিত হলেন, গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা। এভাবে পাঁচ দিন পার হয়ে গেল।
গল্পের মতো লেখাটি শুরু করলেও একটি সত্য ঘটনা এবং আমাদের দেশের এমন স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চনার কাহিনী রচিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মন্দ নয়। আর সেই পুরনো কথাগুলো রয়েছেই স্বাস্থ্যনীতির পাতায়_মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতিসেবা বৃদ্ধি, চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। কিন্তু কেন যে মানুষের ভোগান্তি কমে না! কেন যে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথা শুনলে একরাশ ভয় ও অবিশ্বাস এসে ভর করে...! আজকাল শুধু সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নয়, বড় বা দামি প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও স্বস্তি নেই।
এসব কি প্রশাসনের দুর্বলতা? সে যাই হোক, সব দুর্বলতার মূল সেই অবিতর্কিত উৎস, তা হলো রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও ডাক্তার কাম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়ার নামে ফাঁদ তৈরি করে অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার চাতুরীপনা। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির দুর্বলতার সুযোগে দিন দিন সব খাতেই ক্রমাগত নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। আর তার পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে নিরীহ জনসাধারণকে।
যে রোগীর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগের নিরাময় হচ্ছে না, অথচ ডাক্তাররা একটুও মনোযোগ দিয়ে ভাবছেন না যে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের টেস্টগুলোতে ত্রুটি থাকতে পারে। অথবা রোগীকে জেলা শহর কিংবা ঢাকায় পাঠানো দরকার। এক দিন রোগী অজ্ঞান হয়ে গেলেন ব্যথায়। আত্মীয়স্বজন ডাক্তারের কাছে ছুটলেন। বললেন, ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থাপত্র লেখেন। অনেক বাগ্বিতণ্ডার পর সরকারি অ্যাম্বুলেন্স খরচ বাবদ চার হাজার টাকা দামদর করে নিয়ে আসা হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ল, রোগীর পিত্তের সরু পথে একটি কৃমির কিছু অংশ ঢুকে আছে। যথারীতি হাসপাতালের বেডে থাকা শুরু হলো। কৃমিনাশক বড়ি তিন দিন খাওয়ানো হলো। কৃমি মরে গেল। কিন্তু আটকে থাকল। ডাক্তার বললেন, এটি আপনাআপনি পড়ে যেতে পারে। দ্বিতীয় পথ অপারেশন অথবা ইআরসিপি করা। আর ইআরসিপি করার কৌশল বা যন্ত্র ঢাকা মেডিক্যালে নেই, আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে যেতে বললেন।
রোগী ভাবলেন, শনাক্ত হওয়ায় রোগ অন্তত অর্ধেক সেরে গেছে বলা যায়। দেখা যাক, আপনাআপনি কৃমিটা পড়ে যায় কি না। ব্যথানাশক বড়ি খেয়ে খেয়ে দুই মাস পার করলেন। না, সারছে না। আবার ঢাকায় ছুটলেন। এক বন্ধুর সহায়তায় বিখ্যাত আলট্রাসনোগ্রাফারের কাছে পরীক্ষা করালেন। ডাক্তার বললেন, কৃমির যে অংশ বাইরে ছিল তা পচে পড়ে গেছে; অন্য অংশ পিত্তের ভেতরে থেকে গেছে। ইআরসিপি ছাড়া হবে না। রোগী তত দিনে প্রায় না খেয়ে থাকা এবং বিরতিহীন ব্যথা-যাতনায় একেবারে শীর্ণ ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ইআরসিপি করানোর জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাস্ট্রোলিভার বিভাগের ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন, বললেন ভর্তি হবেন। বহির্বিভাগে দুজন ডাক্তার বসা ছিলেন। ডাক্তার কিছু বলার আগে অ্যাটেনডেন্ট বলে উঠল, ভর্তি হবেন কোথায়? সিট খালি নেই। রোগী বললেন, 'কবে খালি হবে?'
'তিন দিন পর আসেন, দেখা যাবে'_অ্যাটেনডেন্ট বলল। এবার সংশ্লিষ্ট ডাক্তার বললেন, 'আমি আপনাকে সুপরামর্শ দিই। আমার কথামতো কাজ করুন, ভালো হবে। এখানে ভর্তি হলেও সিরিয়াল কবে পাবেন ঠিক নেই, তা ছাড়া যন্ত্রটিও বেশির ভাগ সময় থাকে বিকল। আমি একজন ডাক্তারের নাম-ঠিকানা দিচ্ছি, সেখানে চলে যান।' পর দিন পরামর্শমতো ধানমণ্ডির বিখ্যাত একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুবিখ্যাত গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞের কাছে পেঁৗছলেন রোগী। ৮০০ টাকা ফি নিয়ে ডাক্তার আগের কাগজপত্র দেখলেন। বেডে শুইয়ে পেটের দুই পাশে দুটি চাপ দিয়ে জানতে চাইলেন, ব্যথা হয়? রোগী বললেন, না। দেখা শেষ। ডাক্তার বললেন, 'পিত্তে তো সমস্যাই, লিভারও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আপনি এই কার্ড নিন, ঠিকমতো গিয়ে ভর্তি হয়ে যান। ইআরসিপিসহ বাকি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।' কার্ড হাতে নিয়ে রোগী দেখলেন একটি বিখ্যাত প্রাইভেট ক্লিনিকের নাম।
এ গল্পে পরিষ্কার যে এই রোগীর সংস্পর্শে আসা কোনো ডাক্তার রোগীর আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক কষ্টের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে তাঁদের স্বার্থ বড় করে দেখেছেন। সে জন্য রোগীকে ভয় দেখাতেও বিবেকে বাধেনি। লিভারও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বলেছিলেন পছন্দের ক্লিনিকে ভর্তি করানো জন্য। এ দেশে ডাক্তার, ব্যারিস্টার, মিনিস্টার_এসবের অভাব নেই, কিন্তু শিক্ষিত (মানুষ হওয়ার শিক্ষা) মানুষের বড় অভাব।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.