চারদিক-সুরের পরশমণি
‘বাজান রে, লাইগ্যা থাকিস’ বলে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যাঁকে আশীর্বাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, ড. যামিনীনাথ গঙ্গোপাধ্যায় যাঁকে বলেছিলেন, ‘করুণা রে, প্রচারে শিল্পীর ব্যর্থতা আর প্রকাশে সার্থকতা।’ আর যিনি বলে থাকেন, ‘সংগীত বিলাসের সামগ্রী নয়, সংগীত সাধনার মাধ্যমেই পরমেশ্বরের শ্রীচরণ লাভ করা যায়।
সংগীত মানুষের অন্তর্নিহিত প্রেমের অভিব্যক্তির উৎ কৃষ্টতম ও সহজতম পদ্ধতি।’ তিনিই আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় সংগীতগুরু সংগীতাচার্য শ্রীকরুণাময় অধিকারী। ফরিদপুরের সংগীতভুবনে যিনি ‘মাস্টারমশাই’ নামে আমাদের শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত। সংগীতের সোনার খনি, আমাদের সংগীত কাননের মহীরুহ যাঁর শীতল ছায়ায় আমরা ধন্য, যিনি চাননি কিছুই, শুধু দিয়ে যাচ্ছেন অকৃপণভাবে। প্রচারবিমুখ এক সুরের পরশমণি আমাদের মাস্টারমশাই। ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল তাঁর ৭৯তম জন্মদিন। সেদিন আমরা তাঁরই গুণগ্রাহী অসংখ্য ছাত্রছাত্রী সশ্রদ্ধচিত্তে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছি তাঁর শ্রীচরণে।
১৫ সেপ্টেম্বর ‘সুরের গুরু, দাও গো শিক্ষা’ শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ফরিদপুরে। শহরের চারটি সাংস্কৃতিক সংগঠন—হিন্দোল সংগীত একাডেমী, ফুলকি. অগ্নিবীণা ও বঙ্গবন্ধু শিশুনিকেতন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানটি করে। অনুষ্ঠানে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়েছিল, সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়েছিল। হয়েছিল আলোচনা সভা, হয়েছিল একক ও সম্মেলক গান।
বিকেল পাঁচটায় সম্মেলক গান ‘শোনাও তোমার অমৃতবাণী, অধমেরে ডাকি চরণে আমি’ যখন বাজছিল, তখন প্রকৃতই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হচ্ছিল শিল্পীরা। এরপর পরিবেশন করা হয়, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। এ রকম আরও কিছু গান শুনে মন ভরে যায়।
এবার তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা।
শাস্ত্রীয় সংগীতের শুদ্ধ সাধনার এক উজ্জ্বল ধ্রুব নক্ষত্র মাস্টারমশাই আমাদের পরম বান্ধব। পিতৃস্নেহ আর মধুমাখা বাণী দিয়ে আমাদের সংগীতের আলোকিত পথে সাবলীলভাবে চলার শক্তি তিনি জুগিয়েছেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে সুনামের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করে যাচ্ছেন। তাঁরই ছাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার, সংগীত-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রশিক্ষক হিসেবে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। দেশের বাইরেও অনেক ছাত্রছাত্রী সংগীতভুবনে সুনাম অর্জন করেছেন।
সদাচারী ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান শ্রীকরুণাময় অধিকারী। প্রকৃতপক্ষে তিনি শক্ত হলেও বিশ্বপ্রেম ও মানবতাবোধে তাঁর হূদয় পুষ্ট। কবিগুরুর জগতে আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে তিনিও অন্যতম নিমন্ত্রিত অতিথি। পারিবারিক জীবনের কোনো কষ্ট তাঁর অনাবিল হাসিমুখে চেয়ে পালিয়ে যায়। প্রতিদিন তাঁর বাসভবনে বসে মানুষের মেলা। কেউবা সংগীত, কেউবা ধর্ম আবার কেউবা মানবীয় জীবন বোধের নানা জটিল প্রশ্ন নিয়ে এসে সহজ-সুন্দর উত্তর পেয়ে আনন্দিত চিত্তে বাসায় ফেরেন।
শিল্পীর বিনয় ও ভালোবাসা দুটি বিশেষ গুণ, যা মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে পূর্ণভাবে লক্ষ করা যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষই তাঁর আত্মীয়, আপনজন। প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎ সবের মহা অষ্টমীতে তিনি মহাশক্তির পূজা করে নরনারায়ণের সেবা দিয়ে থাকেন। আমি প্রতিবছর শত শত জনের মাঝে উপস্থিত থেকে তাঁরই নির্দেশিত একটু সেবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মানি।
মহা অষ্টমীতে মাস্টারমশাইয়ের মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে কেঁদে বলি, ‘মারে, আরও এক বছর আয়ু দিলে আগামী বছরের মহা অষ্টমীতে অঞ্জলি যেন মাস্টার-মশাইয়ের এখানেই দিতে পারি।’ অন্তরে সুরের সুধা, মুখে মধুবাণী, চিন্তনে বিশ্বপ্রেম আর জীবনবোধে সদা আনন্দিত আমাদের মাস্টারমশাই নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর চোখে চোখ পড়লেই অন্তরে শান্তি আসে, হূদয় শান্ত হয়ে যায়।
ছেলেবেলায় পিতা স্বর্গীয় কানাইলাল অধিকারী ও মা স্বর্গীয়া বিমলা সুন্দরী অধিকারীর কাছে তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি। পরে ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় তাঁর জ্যাঠাতো ভাই স্বর্গীয় নিত্যানন্দ অধিকারীর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ শুরু করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন, ড. যামিনীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর আট ভাইবোনের মধ্যে ছয়জনই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত। চতুর্থ ভাই শ্রীকিরিটীভূষণ অধিকারী বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য তবলাবাদক।
২০০৪ সালে রবীন্দ্র পদক ও অনেক সম্মাননা পদক লাভ করলেও তাঁর অনেক পাওয়ার আছে আমাদের কাছে। তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী। আসুন, আমরা আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কাছে এসে তাঁকে আনন্দিত করি, শান্ত হূদয়ে আরও শান্তি দিই।
মাস্টারমশাইয়ের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে।
বিষ্ণুপদ ঘোষাল
১৫ সেপ্টেম্বর ‘সুরের গুরু, দাও গো শিক্ষা’ শীর্ষক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল ফরিদপুরে। শহরের চারটি সাংস্কৃতিক সংগঠন—হিন্দোল সংগীত একাডেমী, ফুলকি. অগ্নিবীণা ও বঙ্গবন্ধু শিশুনিকেতন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানটি করে। অনুষ্ঠানে প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়েছিল, সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হয়েছিল। হয়েছিল আলোচনা সভা, হয়েছিল একক ও সম্মেলক গান।
বিকেল পাঁচটায় সম্মেলক গান ‘শোনাও তোমার অমৃতবাণী, অধমেরে ডাকি চরণে আমি’ যখন বাজছিল, তখন প্রকৃতই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হচ্ছিল শিল্পীরা। এরপর পরিবেশন করা হয়, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’। এ রকম আরও কিছু গান শুনে মন ভরে যায়।
এবার তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা।
শাস্ত্রীয় সংগীতের শুদ্ধ সাধনার এক উজ্জ্বল ধ্রুব নক্ষত্র মাস্টারমশাই আমাদের পরম বান্ধব। পিতৃস্নেহ আর মধুমাখা বাণী দিয়ে আমাদের সংগীতের আলোকিত পথে সাবলীলভাবে চলার শক্তি তিনি জুগিয়েছেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে সুনামের সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করে যাচ্ছেন। তাঁরই ছাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও সুরকার, সংগীত-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও প্রশিক্ষক হিসেবে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। দেশের বাইরেও অনেক ছাত্রছাত্রী সংগীতভুবনে সুনাম অর্জন করেছেন।
সদাচারী ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান শ্রীকরুণাময় অধিকারী। প্রকৃতপক্ষে তিনি শক্ত হলেও বিশ্বপ্রেম ও মানবতাবোধে তাঁর হূদয় পুষ্ট। কবিগুরুর জগতে আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে তিনিও অন্যতম নিমন্ত্রিত অতিথি। পারিবারিক জীবনের কোনো কষ্ট তাঁর অনাবিল হাসিমুখে চেয়ে পালিয়ে যায়। প্রতিদিন তাঁর বাসভবনে বসে মানুষের মেলা। কেউবা সংগীত, কেউবা ধর্ম আবার কেউবা মানবীয় জীবন বোধের নানা জটিল প্রশ্ন নিয়ে এসে সহজ-সুন্দর উত্তর পেয়ে আনন্দিত চিত্তে বাসায় ফেরেন।
শিল্পীর বিনয় ও ভালোবাসা দুটি বিশেষ গুণ, যা মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে পূর্ণভাবে লক্ষ করা যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষই তাঁর আত্মীয়, আপনজন। প্রতিবছর শারদীয় দুর্গোৎ সবের মহা অষ্টমীতে তিনি মহাশক্তির পূজা করে নরনারায়ণের সেবা দিয়ে থাকেন। আমি প্রতিবছর শত শত জনের মাঝে উপস্থিত থেকে তাঁরই নির্দেশিত একটু সেবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মানি।
মহা অষ্টমীতে মাস্টারমশাইয়ের মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে কেঁদে বলি, ‘মারে, আরও এক বছর আয়ু দিলে আগামী বছরের মহা অষ্টমীতে অঞ্জলি যেন মাস্টার-মশাইয়ের এখানেই দিতে পারি।’ অন্তরে সুরের সুধা, মুখে মধুবাণী, চিন্তনে বিশ্বপ্রেম আর জীবনবোধে সদা আনন্দিত আমাদের মাস্টারমশাই নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর চোখে চোখ পড়লেই অন্তরে শান্তি আসে, হূদয় শান্ত হয়ে যায়।
ছেলেবেলায় পিতা স্বর্গীয় কানাইলাল অধিকারী ও মা স্বর্গীয়া বিমলা সুন্দরী অধিকারীর কাছে তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি। পরে ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় তাঁর জ্যাঠাতো ভাই স্বর্গীয় নিত্যানন্দ অধিকারীর কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ শুরু করেন। ১৯৫৪ সাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছেন, ড. যামিনীনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর আট ভাইবোনের মধ্যে ছয়জনই সংগীতের সঙ্গে যুক্ত। চতুর্থ ভাই শ্রীকিরিটীভূষণ অধিকারী বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য তবলাবাদক।
২০০৪ সালে রবীন্দ্র পদক ও অনেক সম্মাননা পদক লাভ করলেও তাঁর অনেক পাওয়ার আছে আমাদের কাছে। তাঁর কাছে আমরা চিরঋণী। আসুন, আমরা আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কাছে এসে তাঁকে আনন্দিত করি, শান্ত হূদয়ে আরও শান্তি দিই।
মাস্টারমশাইয়ের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে।
বিষ্ণুপদ ঘোষাল
No comments