অর্থনীতি-সৎ ব্যাংক পরিচালকের সন্ধানে by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
ব্যাংক পরিচালনায় কল্যাণ নীতির ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। অন্য ব্যবসায়িক কোম্পানির সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানির একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, অন্যান্য কোম্পানি মালিকের মূলধন বা পুঁজিতে চলে। কিন্তু ব্যাংক পরিচালিত হয় আমানতকারীর জমা রাখা অর্থে। ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন সামান্যই। বরং অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের অর্থই বেশি।
শেয়ারহোল্ডাররা যাতে অ্যাকাউন্টহোল্ডারদের স্বার্থ বিঘি্নত করতে না পারেন, সে জন্য ব্যাংকিং আইনে অনেক বিধিবিধান রয়েছে
ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ গঠন বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এ নীতিমালা সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পুঁজিবাদী শক্তির শক্তিশালী বিরোধিতার মুখেও সরকারের অবস্থান সুদৃঢ়। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোনো ব্যক্তি বীমা কোম্পানির পরিচালক হলে তিনি একই সঙ্গে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। দেশের বিত্তশালী বীমা পরিচালকদের দাবি অগ্রাহ্য করে অর্থমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
অর্থলিপ্সা এমন একটি প্রবণতা, যা বাধা মানতে চায় না। তাদের একমাত্র দাবি 'আরও চাই'। কট্টর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে দেখা যায়, পুঁজিপতিরা অর্থশক্তি অর্জন করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে পেঁৗছে যায়, যেখান থেকে তারা একাট্টা হয়ে রাষ্ট্রশক্তিকেই গ্রাস করে ফেলে। সংসদীয় ব্যবস্থা হলে অঢেল অর্থ ব্যয় করে সংসদীয় আসনগুলো জিতে নেয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা হলে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিকেই নির্বাচিত করে আনা হয়। ফলে রাষ্ট্রপতি বা সংসদ, সবাই থাকে পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে। ভোট জনগণের, কিন্তু ভোগ পুঁজিপতিদের। এর সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্য বিল। ওবামা কিছুটা ঔদার্য দেখিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার জন্য বিল এনেছিলেন। বাড়তি ব্যয়ের জন্য অর্থশালীদের ওপর করারোপের ব্যবস্থা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বিলটি নিয়ে কত বেশি টানাহ্যাঁচড়া হয়েছিল, তা অনেকেরই স্মরণে রয়েছে। এর একটাই কারণ। অর্থশালীরা অর্থের ব্যাপারে অন্ধ। জনকল্যাণে ছাড় দেওয়া তাদের ধর্মবিরুদ্ধ।
এসব বিবেচনা করেই মুক্তিযুদ্ধ-জাত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র। তবে এ সমাজতন্ত্র কমিউনিজম নয়। বরং গণতন্ত্রের সংমিশ্রণে এ সমাজতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায় কল্যাণ রাষ্ট্র। কল্যাণ অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ব্যাংক-বীমা কোম্পানির পরিচালক পদে নিষেধাজ্ঞা অর্পিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সেই সুনীতির প্রতিধ্বনি করেছেন।
ব্যাংক পরিচালনায় কল্যাণ নীতির ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। অন্য ব্যবসায়িক কোম্পানির সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানির একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, অন্যান্য কোম্পানি মালিকের মূলধন বা পুঁজিতে চলে। কিন্তু ব্যাংক পরিচালিত হয় আমানতকারীদের জমা রাখা অর্থে। ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন সামান্যই। বরং অ্যাকাউন্টহোল্ডারদের অর্থই বেশি। শেয়ারহোল্ডাররা যাতে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের স্বার্থ বিঘি্নত করতে না পারেন, সেজন্য ব্যাংকিং আইনে অনেক বিধিবিধান রয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ যাতে কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হতে না পারে, সেজন্য ব্যাংকিং আইনে বিধান রাখা হয়েছে যে, কোনো অবস্থাতেই একই পরিবারের সদস্যদের শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ব্যাংক কোম্পানির মোট মূলধনের দশ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। একটি গোষ্ঠী যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে না পারে সেজন্য বিধান করা হয়েছে যে, কোনো পরিচালক একাদিক্রমে ছয় বছরের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালক নিয়োগের বিধান রয়েছে, যিনি শেয়ারহোল্ডার নন। তিনি হতে পারেন বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ অথবা সর্বজনস্বীকৃত বিশিষ্ট ব্যক্তি। উদ্দেশ্য হলো সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং নৈতিকতা বজায় রাখা।
আমানতকারীদের স্বার্থে আর একটি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেটা হলো_ পরিচালনা পরিষদে আমানতকারীদের একজন প্রতিনিধিকে পরিচালক পদে নিয়োগ দান। শত শত শাখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ আমানতকারীর প্রতিনিধি নির্বাচন যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। তাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা যায়নি। বর্ণিত ব্যবস্থাগুলো থেকে বোঝা যায়, অন্যান্য কোম্পানি থেকে ব্যাংক কোম্পানি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমানতকারীদের মালিকানা থাকে না, অথচ ব্যাংকের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল তারাই সরবরাহ করে। এজন্য তাদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। শেয়ারহোল্ডারদের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তা করা হয়। ব্যাংক পরিচালক নিয়োগে মূল উদ্দেশ্যই থাকে_ ক. এক পরিবার বা এক ব্যক্তির শেয়ারের পরিমাণ নিম্নপর্যায়ে রাখা; খ. একটি গোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত না করা; গ. দীর্ঘদিন একই পরিচালক নিয়োজিত না থাকা এবং ঘ. ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারদের উৎসাহিত করা।
সরকারের এ যাবৎকালের জারি করা বিধিবিধান এসব নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক জারিকৃত সাম্প্রতিক এক নির্দেশ এ নীতিমালার লঙ্ঘন। অন্য কোম্পানির সঙ্গে একত্রিত করে এসইসি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের জন্যও জনপ্রতি নিম্নতম ২% মূলধন রক্ষণের বিধান করেছে। এটি ব্যাংকিং নীতিমালার বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। ব্যাংক পরিচালকদের শেয়ারের কনসেন্ট্রেশন না হয়, সেটাই লক্ষ্য ছিল। এসইসি এটি পাল্টে দিয়ে কনসেন্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছে। ব্যাংক আইনে পরিচালকের শেয়ারহোল্ডিংয়ের ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে, নিম্নসীমা নেই। অথচ এসইসির বিধানে নিম্নসীমা দেওয়া হয়েছে, ঊর্ধ্বসীমা নেই। এতে বিত্তশালী পরিচালকদের ক্ষমতা বেড়ে যাবে। স্বল্প শেয়ারধারী বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পরিচালকরা ছিটকে পড়বেন। ব্যাংকের বোর্ডে বিত্তের কোটারি গড়ে উঠবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। লাখ লাখ আমানতকারীর স্বার্থ দেখার কেউ থাকবে না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্যাংক পরিচালকদের জনপ্রতি নূ্যনপক্ষে ২% শেয়ার রাখার বিধান করার সময় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ/সম্মতি নেওয়া হয়েছিল। হয়ে থাকলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গর্হিত কাজ করেছে। না হয়ে থাকলে, এসইসি গর্হিত কাজ করেছে। অনুমোদন দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্ববিরোধী কাজ করেছে।
ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির পরিচালকদের নূ্যনতম ২% শেয়ার রক্ষণের বিধান যথার্থ। আগে তেমনটাই ছিল। শেয়ারের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে নিজ কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে এসব চতুর পরিচালকরা অঢেল কাঁচা অর্থ পকেটস্থ করেছে। এখন এদের ২% শেয়ার ক্রয়ে বাধ্য করা কোম্পানির জন্য ভালো, পুঁজিবাজারের জন্যও ভালো। কিন্তু একই নিয়ম ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হওয়া অনুচিত।
নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ প্রায়শই বিত্তশালী হন না। এমন উদাহরণও রয়েছে যে, একজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুধী কোয়ালিফাইং শেয়ার কিনে একটি ব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন। তার প্রশাসনিক নৈপুণ্য, অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আপসহীন নৈতিকতা ব্যাংকটিকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে এসেছিল। তিনি ২% শেয়ার ক্রয়ের ক্ষমতা রাখেন না। তার মতো ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ব্যাংকটি শুধু দরিদ্রই হবে না বরং অর্থলিপ্সু পরিচালকদের বালাখানায় পরিণত হবে। ভালো মানুষেরা সচ্ছল হতে পারে, বিত্তশালী হন না। আর বিত্তশালীদের থাকে নৈতিকতার সংকট।
আগেই বলেছি, অন্যান্য কোম্পানি চলে মালিকের অর্থে, আর ব্যাংক চলে আমানতকারীর অর্থে। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যাংক পরিচালকদের নিম্নতম মূলধন ধারণের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিতে হবে। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এ লক্ষ্যে এসইসির উলি্লখিত নির্দেশ পরিপালনে ব্যাংক পরিচালকদের অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।
অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার ক্যাপিটাল থাকে কম, কয়েক কোটি টাকা বা আরও কম। ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার ক্যাপিটাল কয়েকশ' কোটি টাকা। ব্যাসল বিধি অনুযায়ী আরও বৃদ্ধি পাবে। যে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৬০০ কোটি টাকা, সে ব্যাংকের একজন পরিচালকের শেয়ার থাকতে হবে ১২ কোটি টাকা। আমাদের দেশের কোনো সৎ ব্যাংক-পরিচালকের কি এত টাকা থাকা সম্ভব?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ গঠন বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এ নীতিমালা সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পুঁজিবাদী শক্তির শক্তিশালী বিরোধিতার মুখেও সরকারের অবস্থান সুদৃঢ়। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোনো ব্যক্তি বীমা কোম্পানির পরিচালক হলে তিনি একই সঙ্গে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। দেশের বিত্তশালী বীমা পরিচালকদের দাবি অগ্রাহ্য করে অর্থমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রীর এ ঘোষণা সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
অর্থলিপ্সা এমন একটি প্রবণতা, যা বাধা মানতে চায় না। তাদের একমাত্র দাবি 'আরও চাই'। কট্টর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে দেখা যায়, পুঁজিপতিরা অর্থশক্তি অর্জন করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে পেঁৗছে যায়, যেখান থেকে তারা একাট্টা হয়ে রাষ্ট্রশক্তিকেই গ্রাস করে ফেলে। সংসদীয় ব্যবস্থা হলে অঢেল অর্থ ব্যয় করে সংসদীয় আসনগুলো জিতে নেয়। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা হলে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিকেই নির্বাচিত করে আনা হয়। ফলে রাষ্ট্রপতি বা সংসদ, সবাই থাকে পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে। ভোট জনগণের, কিন্তু ভোগ পুঁজিপতিদের। এর সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্য বিল। ওবামা কিছুটা ঔদার্য দেখিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার জন্য বিল এনেছিলেন। বাড়তি ব্যয়ের জন্য অর্থশালীদের ওপর করারোপের ব্যবস্থা ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশে বিলটি নিয়ে কত বেশি টানাহ্যাঁচড়া হয়েছিল, তা অনেকেরই স্মরণে রয়েছে। এর একটাই কারণ। অর্থশালীরা অর্থের ব্যাপারে অন্ধ। জনকল্যাণে ছাড় দেওয়া তাদের ধর্মবিরুদ্ধ।
এসব বিবেচনা করেই মুক্তিযুদ্ধ-জাত বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ছিল সমাজতন্ত্র। তবে এ সমাজতন্ত্র কমিউনিজম নয়। বরং গণতন্ত্রের সংমিশ্রণে এ সমাজতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায় কল্যাণ রাষ্ট্র। কল্যাণ অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ব্যাংক-বীমা কোম্পানির পরিচালক পদে নিষেধাজ্ঞা অর্পিত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সেই সুনীতির প্রতিধ্বনি করেছেন।
ব্যাংক পরিচালনায় কল্যাণ নীতির ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়। অন্য ব্যবসায়িক কোম্পানির সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানির একটা মৌলিক পার্থক্য হলো, অন্যান্য কোম্পানি মালিকের মূলধন বা পুঁজিতে চলে। কিন্তু ব্যাংক পরিচালিত হয় আমানতকারীদের জমা রাখা অর্থে। ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন সামান্যই। বরং অ্যাকাউন্টহোল্ডারদের অর্থই বেশি। শেয়ারহোল্ডাররা যাতে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের স্বার্থ বিঘি্নত করতে না পারেন, সেজন্য ব্যাংকিং আইনে অনেক বিধিবিধান রয়েছে।
ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ যাতে কোনো ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর দ্বারা অতিমাত্রায় প্রভাবিত হতে না পারে, সেজন্য ব্যাংকিং আইনে বিধান রাখা হয়েছে যে, কোনো অবস্থাতেই একই পরিবারের সদস্যদের শেয়ার মূলধনের পরিমাণ ব্যাংক কোম্পানির মোট মূলধনের দশ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। একটি গোষ্ঠী যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে না পারে সেজন্য বিধান করা হয়েছে যে, কোনো পরিচালক একাদিক্রমে ছয় বছরের বেশি পরিচালক থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালক নিয়োগের বিধান রয়েছে, যিনি শেয়ারহোল্ডার নন। তিনি হতে পারেন বিষয়বস্তু বিশেষজ্ঞ অথবা সর্বজনস্বীকৃত বিশিষ্ট ব্যক্তি। উদ্দেশ্য হলো সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং নৈতিকতা বজায় রাখা।
আমানতকারীদের স্বার্থে আর একটি ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেটা হলো_ পরিচালনা পরিষদে আমানতকারীদের একজন প্রতিনিধিকে পরিচালক পদে নিয়োগ দান। শত শত শাখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ আমানতকারীর প্রতিনিধি নির্বাচন যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। তাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা যায়নি। বর্ণিত ব্যবস্থাগুলো থেকে বোঝা যায়, অন্যান্য কোম্পানি থেকে ব্যাংক কোম্পানি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমানতকারীদের মালিকানা থাকে না, অথচ ব্যাংকের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল তারাই সরবরাহ করে। এজন্য তাদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। শেয়ারহোল্ডারদের কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই তা করা হয়। ব্যাংক পরিচালক নিয়োগে মূল উদ্দেশ্যই থাকে_ ক. এক পরিবার বা এক ব্যক্তির শেয়ারের পরিমাণ নিম্নপর্যায়ে রাখা; খ. একটি গোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত না করা; গ. দীর্ঘদিন একই পরিচালক নিয়োজিত না থাকা এবং ঘ. ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারদের উৎসাহিত করা।
সরকারের এ যাবৎকালের জারি করা বিধিবিধান এসব নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক জারিকৃত সাম্প্রতিক এক নির্দেশ এ নীতিমালার লঙ্ঘন। অন্য কোম্পানির সঙ্গে একত্রিত করে এসইসি ব্যাংকগুলোর পরিচালকদের জন্যও জনপ্রতি নিম্নতম ২% মূলধন রক্ষণের বিধান করেছে। এটি ব্যাংকিং নীতিমালার বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। ব্যাংক পরিচালকদের শেয়ারের কনসেন্ট্রেশন না হয়, সেটাই লক্ষ্য ছিল। এসইসি এটি পাল্টে দিয়ে কনসেন্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছে। ব্যাংক আইনে পরিচালকের শেয়ারহোল্ডিংয়ের ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে, নিম্নসীমা নেই। অথচ এসইসির বিধানে নিম্নসীমা দেওয়া হয়েছে, ঊর্ধ্বসীমা নেই। এতে বিত্তশালী পরিচালকদের ক্ষমতা বেড়ে যাবে। স্বল্প শেয়ারধারী বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পরিচালকরা ছিটকে পড়বেন। ব্যাংকের বোর্ডে বিত্তের কোটারি গড়ে উঠবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। লাখ লাখ আমানতকারীর স্বার্থ দেখার কেউ থাকবে না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্যাংক পরিচালকদের জনপ্রতি নূ্যনপক্ষে ২% শেয়ার রাখার বিধান করার সময় কি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ/সম্মতি নেওয়া হয়েছিল। হয়ে থাকলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গর্হিত কাজ করেছে। না হয়ে থাকলে, এসইসি গর্হিত কাজ করেছে। অনুমোদন দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্ববিরোধী কাজ করেছে।
ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির পরিচালকদের নূ্যনতম ২% শেয়ার রক্ষণের বিধান যথার্থ। আগে তেমনটাই ছিল। শেয়ারের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে নিজ কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে এসব চতুর পরিচালকরা অঢেল কাঁচা অর্থ পকেটস্থ করেছে। এখন এদের ২% শেয়ার ক্রয়ে বাধ্য করা কোম্পানির জন্য ভালো, পুঁজিবাজারের জন্যও ভালো। কিন্তু একই নিয়ম ব্যাংকের জন্য প্রযোজ্য হওয়া অনুচিত।
নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন মানুষ প্রায়শই বিত্তশালী হন না। এমন উদাহরণও রয়েছে যে, একজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুধী কোয়ালিফাইং শেয়ার কিনে একটি ব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকে চেয়ারম্যান ছিলেন। তার প্রশাসনিক নৈপুণ্য, অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আপসহীন নৈতিকতা ব্যাংকটিকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে এসেছিল। তিনি ২% শেয়ার ক্রয়ের ক্ষমতা রাখেন না। তার মতো ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ব্যাংকটি শুধু দরিদ্রই হবে না বরং অর্থলিপ্সু পরিচালকদের বালাখানায় পরিণত হবে। ভালো মানুষেরা সচ্ছল হতে পারে, বিত্তশালী হন না। আর বিত্তশালীদের থাকে নৈতিকতার সংকট।
আগেই বলেছি, অন্যান্য কোম্পানি চলে মালিকের অর্থে, আর ব্যাংক চলে আমানতকারীর অর্থে। আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যাংক পরিচালকদের নিম্নতম মূলধন ধারণের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিতে হবে। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এ লক্ষ্যে এসইসির উলি্লখিত নির্দেশ পরিপালনে ব্যাংক পরিচালকদের অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।
অন্যান্য কোম্পানির শেয়ার ক্যাপিটাল থাকে কম, কয়েক কোটি টাকা বা আরও কম। ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার ক্যাপিটাল কয়েকশ' কোটি টাকা। ব্যাসল বিধি অনুযায়ী আরও বৃদ্ধি পাবে। যে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ৬০০ কোটি টাকা, সে ব্যাংকের একজন পরিচালকের শেয়ার থাকতে হবে ১২ কোটি টাকা। আমাদের দেশের কোনো সৎ ব্যাংক-পরিচালকের কি এত টাকা থাকা সম্ভব?
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ব্যাংকার ও কলাম লেখক
No comments