সমকালীন প্রসঙ্গ-বালুচিস্তানের জনগণের জন্য আমেরিকানদের কুম্ভীরাশ্রু by বদরুদ্দীন উমর

এটা অবশ্যই বলা দরকার যে, একটি দেশের কোনো অংশে পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য অন্য একটি দেশের পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন আপাতদৃষ্টিতে যতই হাস্যকর মনে হোক, এর মধ্যে চরম ফ্যাসিবাদী ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নেই।


মনে রাখা দরকার, এই রিপাবলিকানরা বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা ও চরম নির্যাতন সত্ত্বেও মার্কিন সরকার এ দেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নয়, পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকারকেই সমর্থন করেছিল। তাদের অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল



বালুচিস্তানকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র করার জন্য মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের রিপাবলিকান সদস্য ডানা রোহরাব্যাকার এবং অন্য দু'জন রিপাবলিকান যৌথভাবে কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। তাদের এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বালুচ জনগণের অধিকার আছে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের দেশের সার্বভৌমত্বের এবং তাদের সুযোগ দেওয়া দরকার নিজেদের মর্যাদা নির্ধারণের। তারা যে জাতিগত ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার সেটা ট্র্যাজিক এবং এটা আরও ট্র্যাজিক এ জন্য যে, আমেরিকা ইসলামাবাদে অবস্থিত তাদের নির্যাতককে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে। এই প্রস্তাবের সপক্ষে কংগ্রেসের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায়নি (ডেইলি স্টার, ১৯.২.২০১২)।
রোহরাব্যাকার পাকিস্তান সরকারের দীর্ঘদিনের সমালোচক। মার্কিন সেনাবাহিনী পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে পাওয়া ও হত্যার পর তিনি পাকিস্তানে সব রকম অর্থ ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। অবশ্য একেবারে লাভ হয়নি তা বলা যায় না। কারণ, পরবর্তী সময়ে মার্কিন সরকার পাকিস্তানে সামরিক খাতে তাদের অর্থ সাহায্য বড় আকারে বন্ধ রেখেছে। বালুচিস্তান সম্পর্কে রোহরাব্যাকারের উপরোক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তান সরকার তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। করাচিতে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী গিলানি বলেছেন, এটা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে এবং তারা এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করেন। (ঐ)
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের বালুচিস্তান সম্পর্কিত বক্তব্য খুব সঠিক। পূর্ব বাংলায় যেভাবে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়েছে বালুচিস্তানেও সেটা হওয়া দরকার। কারণ, ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তান বালুচিস্তানের জনগণের ওপর যে শোষণ-নির্যাতন করে এসেছে সেটা পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতন থেকে অনেক বেশি। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বালুচিস্তানে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন জায়গায় বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করেছে এবং তার সামরিক বাহিনী অন্য সব রকম উপায়েই বালুচ জনগণের ওপর চরমভাবে নির্যাতন চালিয়ে এসেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে বালুচরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, সশস্ত্রভাবেও প্রতিরোধ করেছে। আইয়ুব খানের আমলে বালুচিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বোমাবর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক নিয়মিত ব্যাপার। বালুচদের এই প্রতিরোধের কারণে তাদের অনেক নেতাকে পাকিস্তানের গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে। সেভাবে কোনো হত্যাকাণ্ড তারা পূর্ব বাংলাতে করেনি। কাজেই বালুচদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, এমনকি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ন্যায্যতা অস্বীকার করার নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকৃষ্টতম প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের অন্যতম রিপাবলিকান রোহরাব্যাকার হঠাৎ করে কেন এখন বালুচিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য এত দরদ ও সমর্থন প্রকাশ করছেন? এত অল্প সময়ের মধ্যে ভুলে যাওয়ার উপায় নেই যে, বালুচিস্তানে অবস্থিত মার্কিন সামরিক বিমান ঘাঁটি থেকেই চালকবিহীন ড্রোন বিমানগুলো পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত ওয়াজিরিস্তানে এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরেও বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার নিরীহ পাকিস্তানি ও আফগানকে হত্যা করেছে। সে সময় উপরোক্ত মার্কিন কংগ্রেস সদস্য অথবা তার মতো অন্য কোনো বালুচ দরদি বালুচিস্তানের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা, তাদের ওপর শোষণ-নির্যাতন, নিয়মিত বোমাবর্ষণের কোনো প্রতিবাদ করেননি। তখন বালুচ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা তাদের কারও মুখে শোনা যায়নি। কোনো আমেরিকান লিবারেল বা উদারনৈতিক নেতাও এসব কথা বলেননি। অথচ এখন সে দেশের নিকৃষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল এক রিপাবলিকান নেতা আগ বেড়ে কংগ্রেসে প্রস্তাব উপস্থিত করছেন বালুচ জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য!
প্রথমত, এটা অবশ্যই বলা দরকার যে, একটি দেশের কোনো অংশে পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের জন্য অন্য একটি দেশের পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপন আপাতদৃষ্টিতে যতই হাস্যকর মনে হোক, এর মধ্যে চরম ফ্যাসিবাদী ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নেই। মনে রখা দরকার, এই রিপাবলিকানরা বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা ও চরম নির্যাতন সত্ত্বেও মার্কিন সরকার এ দেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নয়, পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকারকেই সমর্থন করেছিল। তাদের অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
এর থেকেই বোঝা যায় যে, আজ আমেরিকানরা বালুচদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের দাবি জানিয়ে যেভাবে কংগ্রেসে প্রস্তাব পেশ করেছে এটা এক ঘোরতর মতলববাজি ও চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। এটা ঠিক যে, মার্কিন কংগ্রেসে এই প্রস্তাবের পক্ষে কোনো উল্লেখযোগ্য সমর্থন পাওয়া যায়নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা, বর্তমানে তাদের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে যাদের সামান্য ধারণা আছে তাদের পক্ষে এটা বোঝার কোনো অসুবিধাই নেই যে, এই প্রস্তাব পেশ করার অর্থ এটি কংগ্রেসে পাস করিয়ে মার্কিন সরকার কর্তৃক এ ব্যাপারে সরাসরি পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা নয়। কূটনীতি ও চক্রান্ত কখনোই এভাবে কাজ করে না। এই প্রস্তাব পেশের অর্থ হলো, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালুচিস্তানে চক্রান্ত সংঘটিত করা। সেখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সাহায্য করার নামে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা এবং সেই সঙ্গে সে আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সমর্থন করে পাকিস্তান সরকারের ওপর নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য চাপ সৃষ্টি করা। সিআইএ এভাবেই নিজেদের চক্রান্ত দেশে দেশে কার্যকর করে এবং এ জন্য মার্কিন কংগ্রেসের দুই পক্ষের সদস্যদের মাধ্যমেও উস্কানিমূলক বক্তব্য উপস্থিত করে। এই বক্তব্য প্রচার করে। এই সঙ্গে সক্রিয়ভাবে তারা স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে নিজেদের চক্রান্ত কার্যকর করতেও নিযুক্ত হয়। এবার যে বিষয়টিতে আসা দরকার তা হচ্ছে, এতদিন এ বিষয়ে কোনো কথা না বলে, উচ্চবাচ্য না করে এই মুহূর্তে কেন একজন প্রভাবশালী দক্ষিণপন্থি মার্কিন নেতা বালুচিস্তানের বিষয়টি সামনে নিয়ে এলেন? এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার, পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকার সময় কিছুদিন আগে পাকিস্তান সরকার মার্কিন সরকারকে নির্দেশ দেয় বালুচিস্তানে অবস্থিত তাদের সামরিক বিমান ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার। এই ঘাঁটি থেকেই তারা ড্রোন বিমান পাঠিয়ে ওয়াজিরিস্তানে নিয়মিত বোমাবর্ষণ করে আসছিল। পাকিস্তান সরকারের কঠোর নির্দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বালুচিস্তান থেকে তাদের সামরিক বিমান ঘাঁটি একেবারে সরিয়ে নিয়েছে। এভাবে বালুচিস্তান থেকে ঘাঁটি উচ্ছেদের কারণ তাদের উপরোক্ত কংগ্রেস সদস্য বালুচিস্তানের জন্য এখন কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করছেন। প্রকাশ্যে না হলেও এই উদ্যোগের সঙ্গে যে মার্কিন সরকার ও সিআইএ যুক্ত এবং তাদের প্ররোচনাতেই যে এ কাজ করা হচ্ছে এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
শেষ করার আগে এ প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়েরও উল্লেখ এখানে করা দরকার। বালুচিস্তান ইরানের সংলগ্ন। কাজেই বালুচিস্তানকে যদি কোনোমতে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় অথবা একেবারে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না হলেও যদি সেখানে পাকিস্তানবিরোধী এক বা একাধিক শক্তিশালী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, তাহলে সেখান থেকে ইরানের ওপর হামলার সুবিধা হয়। এই ভূরাজনৈতিক দিকটিও এ ক্ষেত্রে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সামাজ্যবাদী এবং বর্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত খুব চতুর ও সুদূরপ্রসারী। বালুচিস্তানে নিজেদের ছেড়ে যাওয়া ঘাঁটি অন্যভাবে গড়ে তোলার জন্য এখন মার্কিন সরকার বদ্ধপরিকর। রোহরাব্যাকার দু'একজন সহযোগী সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসে বালুচিস্তান সম্পর্কে যে প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার তাৎপর্য উপলব্ধির জন্য এসব দিকেই মনোযোগ নিবন্ধ করতে হবে।
১৯.২.২০১২
 

No comments

Powered by Blogger.