শিল্পীর সম্মানী-গান গাইবেন তো ভ্যাট দিতে হবে by আবিদ আনোয়ার

বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক অজিত রায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে: শিল্পীদের সাহায্যার্থে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব ও আগ্রহে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ইউএনবির সূত্রে এই খবর ৬ সেপ্টেম্বর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে।


এই প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অজস্র ধন্যবাদ জানাতে হয়।
অন্যদিকে, এ দেশের নামকরা ও গণনাযোগ্য সংগীতশিল্পীরা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অবগত কি না, তা আমাদের জানা নেই। সরকারি প্রচারকেন্দ্র অর্থা ৎ বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভিতে গান গাওয়া ও গান তৈরির জন্য একেকজন শিল্পী সম্মানী হিসেবে যে য ৎ সামান্য টাকা পান, তার ওপর সম্প্রতি ভ্যাট আরোপের ফলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সরকারি প্রচারকেন্দ্রগুলোতে তাঁরা আর গান গাইবেন না বা গানে সুর দেবেন না। অবিশ্বাস্য কম অঙ্কের সম্মানীর ওপর ভ্যাট আরোপের বিষয়টিকে অনেক শিল্পী ও সুরকার তাঁদের সঙ্গে ‘একটি হাস্যকর ঠাট্টা’ বলে অভিহিত করছেন। শিল্পীমহলের বাইরের কেউ যদি একটি গানের জন্য শিল্পীদের প্রাপ্ত সম্মানীর পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত হন, তবে তিনি তাঁকে ‘অসম্মানী’ও বলে ফেলতে পারেন! এর ওপর ভ্যাট আরোপকে বলা যায় গোদের ওপর বিষফোড়া।
বিক্রিযোগ্য পণ্য হিসেবে গান অবশ্যই করের আওতাধীন, যা কেবল সংগীত ব্যবসায়ীদের জন্য প্রযোজ্য। শিল্পীদের জন্যও প্রযোজ্য হতো, যদি তাঁরা ভারতের মতো ওআরসিভুক্ত হতেন। ওআরসি বা ‘অমনি রয়্যালটি কন্ট্রাক্ট’ এমন একটি ব্যবস্থা, যাতে প্রতিবার গান প্রচারের সময় সংশ্লিষ্ট শিল্পীর হিসাবের খাতে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা হবে। এ দেশে গীতিকারদের জন্য ওআরসি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কিন্তু শিল্পী ও সুরকারদের জন্য নেই। তাঁরা ওআরসি পেতে বহুবার বহু দেনদরবার করেও সংশ্লিষ্ট আমলা ও মন্ত্রীদের মন গলাতে পারেননি। সরকারি প্রচারকেন্দ্রের দেওয়া শিল্পী ও সুরকারদের সম্মানী থেকে যে ভ্যাট কাটা হয়, তা অত্যন্ত হাস্যকর। এটি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর কারণ নিম্নরূপ:
বাংলাদেশ বেতারে একটি গান গেয়ে এবং সুরারোপ করে সর্বোচ্চ মানের (স্পেশাল গ্রেডের) একজন শিল্পী ও সুরকার প্রত্যেকে একটি ইউনিট থেকে এক হাজার ২৭৯ টাকা পান। ঢাকাকেন্দ্রে প্রধান তিনটি ইউনিট হলো ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস, হোম সার্ভিস ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম। একটি ইউনিটে মাসে একবারের বেশি গান গাওয়ার সুযোগ পান, এমন দৃষ্টান্ত যেমন বিরল, তেমনি প্রত্যেকে প্রতি মাসে গান করার সুযোগ পান, এমন দৃষ্টান্তও বিরল। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বেতার থেকে ঢাকানিবাসী সর্বোচ্চ মানের একজন শিল্পী ও সুরকারের মাসিক আয় কোনোক্রমেই চার হাজার টাকার বেশি হবে না। বিটিভিতে সর্বোচ্চ মানের শিল্পীকে একটি গানের জন্য দেওয়া হয় দুই হাজার ৮০০ টাকা, কিন্তু সেখানে প্রতি তিন মাসে একবার একজন সর্বোচ্চ মানের শিল্পী গান গাওয়ার বা সুর করার সুযোগ পান।
উপরিউক্ত তথ্যের আলোকে অর্থনীতিবিদ না হয়েও বলা যায়, শিল্পী ও সুরকারদের আয়ের ওপর ভ্যাট আরোপ সত্যিকার অর্থেই গোদের ওপর বিষফোড়া। অধিকন্তু, যাকে ‘সম্মানী’ বলে গণ্য করা হয়, তা ভ্যাটের আওতাভুক্ত হতে পারে না। সবচেয়ে বড় কথা, বছরে দুই লাখ টাকার কম আয়ও করারোপযোগ্য নয়।
সরকারি প্রচারকেন্দ্রে গান গাওয়া বা তৈরির জন্য যে কন্ট্রাক্ট ফরমে শিল্পী ও সুরকারকে তাঁদের কাজটি গ্রহণের জন্য সই দিতে হয়, তাতে একজনের স্বাক্ষর থাকে, যার ওপর লেখা থাকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষে’। এর মানে, রাষ্ট্রপতি শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন প্রজাতন্ত্রের জনগণের জন্য একটি গান গাইতে বা তৈরি করতে। এখন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে গান গাওয়া বা তৈরি করার এই বিষয়টিকেও যদি ভ্যাটের আওতায় আনা হয়, তবে তা খুবই হতাশার।
প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে শিল্পীদের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের সরকারি উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হয়। এই তহবিল অবশ্য দুস্থ শিল্পীদের চিকি ৎ সায় কিংবা তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের পরিবারের দরিদ্র সদস্যদের মধ্যে বিতরণের জন্য গঠন করা হবে। কিন্তু যাঁরা অক্লান্ত সাধনায় জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য নিজেদের অন্য অনেক অর্থ উপার্জনের পথ উপেক্ষা করছেন, জীবদ্দশায় কেবল সংগীতসাধনার মাধ্যমে তাঁদের উপার্জনের পথকে সুগম করার ভাবনা কি আমাদের মাথায় আসতে পারে না? সত্যিকারের সাধকশিল্পী কখনো নিজেকে ‘দুস্থ’ বলে প্রচার করতে চান না।
মৃতদেহ বা কবরের ওপর মাল্যদান করার চেয়ে জীবদ্দশায় একজন শিল্পীকে অন্তত জীবনধারণের মতো অর্থ উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার কথা কি আমরা ভাবতে পারি না? উপরিউক্ত তথ্য যদি সঠিক হয়, তবে অজস্র ঋণখেলাপি ও করখেলাপির দেশে সরকারি প্রচারকেন্দ্র থেকে শিল্পীদের এই নগণ্য উপার্জনের ওপর থেকে অন্তত ভ্যাট প্রত্যাহার কি যুক্তিযুক্ত নয়?
আবিদ আনোয়ার: কবি, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার।

No comments

Powered by Blogger.