আলো ফিরে আসুক চোখে আলো আসুক মানসিক অন্ধত্বে
ইদানীং সংবাদপত্রগুলোর ওয়েবসাইটে খবরের নিচে পাঠকের প্রতিক্রিয়া লেখার জায়গা থাকে। কোন খবর পাঠক কিভাবে নিচ্ছেন, এ নিয়ে তাঁদের মতামত কী তা জানার বেশ ভালো ব্যবস্থা। আমাদের সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্কর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুমানা মঞ্জুরের ওপর নির্যাতনের পর সাধারণ মানুষ কী ভাবছে, তা জানতে এসব
মতামত আমরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে পড়া শুরু করি। সেই সঙ্গে ব্লগগুলোতে এ নিয়ে বেশ উত্তপ্ত আলোচনাও আমরা খেয়াল করি। ওয়েবসাইটে বা ব্লগে রুমানা মঞ্জুরের পক্ষে ও বিপক্ষে প্রচুর মতামত রয়েছে। এসব জায়গায় নানা মতের নানা শ্রেণীর মানুষ লেখেন, তাই রুমানার বিপক্ষেও কিছু মতামত থাকবে_এমনটাই আমরা ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু বেশ কিছু মতামতে মূল্যবোধ-যুক্তিবোধ ও মনুষ্যত্বের এতই অভাব যে তা আমাদের স্তম্ভিত করে। যদিও খুব কম মানুষই এসব মতামত পড়েন, আরো কম মানুষ তা লেখার সময় পান, তার পরও আমরা চিন্তিত হই, সমাজের আরো অনেক মানুষও কি এভাবেই ভাবছেন? একজন নৃশংসভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িতের বিরুদ্ধে কিভাবে, কোন যুক্তিতে তাঁরা কথা বলছেন? কোন কারণই যে নির্যাতনকে বৈধ করে না, এই স্বাভাবিক সত্যটুকুও কি তাঁরা জানেন না?
এটা ঠিক, কোনো এক বিচিত্র কারণে স্বাভাবিক অনেক কিছুই আমরা স্বাভাবিকভাবে করতে পারি না। তাই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক নির্যাতিত হওয়ার পরও লোকলজ্জার ভয়ে তাঁর নিজের পরিবার নির্যাতনের ঘটনাকে প্রায় এক সপ্তাহ চেপে রাখার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়, নিপীড়ককে গ্রেপ্তার করার মতো পুলিশের একটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত কর্মকাণ্ড ঘটানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ নানা সংগঠনকে পথে নামতে হয়, নানা মেয়াদে সময় বেঁধে দিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করতে হয়। গ্রেপ্তার করার পর গণমাধ্যমের সামনে হাসান সাঈদের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে শুরু হওয়া অস্বাভাবিক আলোচনা আবারও প্রমাণ করে; একজন নারী বারবার নারীই থেকে যান, তা তিনি যতই উচ্চ শিক্ষিত বা যতই পরিচিত হন না কেন, মানুষ হয়ে উঠতে তাঁর পথে পথে অসংখ্য বাধা। দেরিতে হলেও রুমানা মঞ্জুরের নিপীড়ক হাসান শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। গণমাধ্যমে রুমানার নিপীড়িত চেহারার প্রচার মানবিক মূল্যবোধসম্কন্ন যেকোনো মানুষকেই নাড়া দিয়েছিল। গণমানুষের ধিক্কার হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর সম্মিলিত ঘৃণার যে আঁচ রয়েছে তা টের পাওয়া যায়। তাই হাসান সাঈদের গ্রেপ্তার দেশের অসংখ্য মুক্তবুদ্ধির মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
পারিবারিক নির্যাতন সব সময়ই একটি স্কর্শকাতর ও ভয়াবহ বিষয়। এর পেছনে দুটি কারণ মূলত দায়ী। প্রথমত, একটি সম্কর্ক গড়ে ওঠার পেছনে যে অসংখ্য হাসি, কান্না, দুঃখ আর উচ্ছ্বাসের স্মৃতি থাকে তা সহজে সম্কর্কটিকে ভেঙে ফেলতে দেয় না। এর সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক চাপ, লোকনিন্দা আর অনিরাপত্তার ভয়। সব মিলিয়ে হাজারো নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যেও বছরের পর বছর, অনেক সময় সারা জীবন ধরেই মুখ বুজে সম্কর্কটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন অনেকেই। এই যে গোপন করা, সহ্য করার যে মানসিকতা, তা কিন্তু নিপীড়ককে আরো শক্তিশালী করে দেয়, তার ভেতরে এক ধরনের নির্যাতনের অধিকারবোধের জন্ম দেয়। সামাজিক চাপ বা লোকলজ্জার ভয় যে কতটা শক্তিশালী ও স্কর্শকাতর, তা রুমানা মঞ্জুরের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় আবারও পরিষ্কার হলো। তাই রুমানা মঞ্জুরের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার পরও 'স্কর্শকাতরতা'র এ ভয় থেকে মুক্ত হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। আর এর পেছনে তিনি যতটা না দায়ী, তাঁর আশপাশের সামাজিক চাপ তার চেয়ে বেশি দায়ী। পারিবারিক নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে, এখানে নিপীড়ক অতিকাছের মানুষ। এই নিপীড়কের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকতে হয়, একই বিছানার ভাগ দিতে হয়, একই ভবিষ্যতের সঙ্গে, স্বপ্নের সঙ্গে জড়াতে হয়। আমাদের দেশে এই চেনা নিপীড়নের ভয়াবহতাটুকু আমরা অনেক সময়ই এড়িয়ে যাই, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকি।
আমরা যারা রুমানা মঞ্জুরকে কেউ সহকর্মী, কেউ শিক্ষিকা, কেউ ডিপার্টমেন্টের বড় আপু হিসেবে পেয়েছি, তারা সবাই জানি, রুমানার মতো নম্র, ভদ্র, অমায়িক, বিনীত মেয়ে খুব একটা দেখা যায় না। কোনো দিন কখনো কারো সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতেও আমরা তাঁকে দেখিনি। প্রচলিত অর্থে আমরা যাদের 'ভালো' মেয়ে বলি, তার কোনোটারই ঘাটতি ছিল না তাঁর মধ্যে। কিন্তু একটি মেয়ের ওপর নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা আর 'ভালোত্বের' প্রসঙ্গ টেনে আনতে হবে কেন? নম্র, ভদ্র না হয়ে রুমানা যদি খুবই মুখরা হতেন, অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন, তাঁর চরিত্রে অনেক 'স্ক্যান্ডাল' জড়িত থাকত, তাহলে কি তাঁর ওপর চালানো নিপীড়ন বৈধ হয়ে যেত?
এ ঘটনার মাধ্যমে আমাদের আরেকবার চিন্তা করা দরকার, কাকে আমরা ভালো মেয়ে বলব। ভালো মেয়ের আসল সংজ্ঞাটি কী? ভালো মেয়ে মানেই কি নম্র হয়ে অন্যায় মেনে নেওয়া, প্রতিবাদ না করা? ভালো মেয়ে মানেই কি সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনাচার আর লোকলজ্জার জন্য চুপ করে থাকা? ভালো মেয়ে মানেই কি সব কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যের পশুত্বকে বাড়তে দেওয়া? আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমন ভালো করে গড়ে তুলতে চাই? সাহসী হয়ে, প্রতিবাদী হয়ে বিপদে পড়ার নানা উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে রয়েছে, তাই এই সমাজে প্রতিনিয়ত অনাচারের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলার সাহস সবার না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কাকে ভালো বলব আর কাকে ভালো বলব না, এ ধারণাটুকু তো নিজের ভেতরেই পরিবর্তন করা যায়। নম্রতার, ভদ্রতার পাশাপাশি কোনো সাহসী, প্রতিবাদী মেয়ের সাহস দেখে আমরা তো নিজের মনে মনেই বলে উঠতে পারি, কী অসম্ভব 'ভালো' এই মেয়েটা! হাসান সাঈদ দাবি করেছে, সে ইচ্ছা করে রুমানার চোখ বা নাক ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বরং রুমানাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, সে চশমা হারিয়ে ফেলে, আঙুল ভেবে নাক কামড়ে দেয়, না বুঝে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে রুমানার চোখের ক্ষতি করে ফেলে। কিন্তু পুলিশের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তারের সময় হাসান সাঈদের দেহে কোনো ধরনের আঘাত তারা লক্ষ করেনি। তাই এ বর্ণনা যে কতটুকু বানোয়াট ও কল্পিত, তা সহজেই বোঝা যায়। হাসান যে নিজ জ্ঞানে, নিজের শিশুর সামনে তার স্ত্রীকে নৃশংস পশুর মতো নির্যাতন করেছে, তা দিবালোকের মতো স্কষ্ট।
কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই ছোট-বড় যেকোনো অপরাধ করার পর অনুশোচনা আর অপরাধ বোধে ভোগে। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েই মানুষের চরিত্র শুচি হয়ে ওঠে, হাসান সাঈদের চরিত্রে সে রকম শুচিতার কোনো লক্ষণও আমরা দেখতে পাই না। হাসান সাঈদের বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে পড়াশোনা শেষ না করতে পারা, শেয়ারের ব্যবসায় ব্যর্থতা, প্রায় অন্ধত্ব ও হতাশার মতো বিষয়গুলোও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এসব কোনো কারণই কখনোই শারীরিক নির্যাতনকে বৈধতা দিতে পারে না, নিপীড়ককেও সহানুভূতির প্রাপ্য করে তোলে না। যেকোনো নির্যাতনই নির্যাতন, এটাই মুখ্য বিষয়। বনিবনা না হলে হাসান সাঈদের সামনে বিচ্ছেদের পথ খোলা ছিল, সে পথ বেছে নেয়নি সে, বেছে নিয়েছে তার ধারালো নখর দিয়ে চোখ তুলে নেওয়ার পথ। এই লেখাটা যখন আমরা তৈরি করছি, তখন খবর পেলাম, ভারতের শংকর নেত্রালয় থেকে বলা হয়েছে, রুমানার দুটি চোখের কোনোটাই আশঙ্কামুক্ত নয়। শংকর নেত্রালয়ের পর অরবিন্দ আই ইনস্টিটিউটের ডাক্তাররাও কোনো আশার কথা শোনাতে পারছেন না। একরাশ অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন তিনি। এ সংবাদের ভয়াবহতা সহকর্মী হিসেবে আমাদের প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। এ সংকট মোকাবিলা করতে রুমানার নানা রকম সাহায্য দরকার। পারিবারিক দৃঢ়তা, আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা দরকার, আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য অর্থ দরকার। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিকভাবে পাশে থাকা। তাই রুমানাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, আপনার ওপর যে আঘাত করা হয়েছে, সে আঘাত আপনার একার নয়। আপনার পাশে শুধু সহকর্মীরাই নন, রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা, এ দেশের সব মুক্তবুদ্ধির মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাহস ও প্রতিবাদ অতীতের নানা ক্ষয়িষ্ণু সময়ে আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাই আমরা আস্থা হারাইনি। রুমানার নিপীড়ক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যতই প্রভাবশালী আত্মীয় তার থাক না কেন, ন্যায়ের পক্ষে একতাবদ্ধ শক্তি তার শাস্তি নিশ্চিত করবে। কারণ রুমানা, আপনি শুধু একজন নির্যাতিত নন, বরং পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান সামাজিক আন্দোলনের এক প্রতীক। আপনার চোখে আলো ফিরে আসুক, আলোকিত হোক সমাজের মানসিক অন্ধত্বেরও।
লেখকবৃন্দ : ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
এটা ঠিক, কোনো এক বিচিত্র কারণে স্বাভাবিক অনেক কিছুই আমরা স্বাভাবিকভাবে করতে পারি না। তাই সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক নির্যাতিত হওয়ার পরও লোকলজ্জার ভয়ে তাঁর নিজের পরিবার নির্যাতনের ঘটনাকে প্রায় এক সপ্তাহ চেপে রাখার চেষ্টা করতে বাধ্য হয়, নিপীড়ককে গ্রেপ্তার করার মতো পুলিশের একটি স্বাভাবিক ও নিয়মিত কর্মকাণ্ড ঘটানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ নানা সংগঠনকে পথে নামতে হয়, নানা মেয়াদে সময় বেঁধে দিতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করতে হয়। গ্রেপ্তার করার পর গণমাধ্যমের সামনে হাসান সাঈদের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে শুরু হওয়া অস্বাভাবিক আলোচনা আবারও প্রমাণ করে; একজন নারী বারবার নারীই থেকে যান, তা তিনি যতই উচ্চ শিক্ষিত বা যতই পরিচিত হন না কেন, মানুষ হয়ে উঠতে তাঁর পথে পথে অসংখ্য বাধা। দেরিতে হলেও রুমানা মঞ্জুরের নিপীড়ক হাসান শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। গণমাধ্যমে রুমানার নিপীড়িত চেহারার প্রচার মানবিক মূল্যবোধসম্কন্ন যেকোনো মানুষকেই নাড়া দিয়েছিল। গণমানুষের ধিক্কার হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু এর সম্মিলিত ঘৃণার যে আঁচ রয়েছে তা টের পাওয়া যায়। তাই হাসান সাঈদের গ্রেপ্তার দেশের অসংখ্য মুক্তবুদ্ধির মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
পারিবারিক নির্যাতন সব সময়ই একটি স্কর্শকাতর ও ভয়াবহ বিষয়। এর পেছনে দুটি কারণ মূলত দায়ী। প্রথমত, একটি সম্কর্ক গড়ে ওঠার পেছনে যে অসংখ্য হাসি, কান্না, দুঃখ আর উচ্ছ্বাসের স্মৃতি থাকে তা সহজে সম্কর্কটিকে ভেঙে ফেলতে দেয় না। এর সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক চাপ, লোকনিন্দা আর অনিরাপত্তার ভয়। সব মিলিয়ে হাজারো নির্যাতন-নিপীড়নের মধ্যেও বছরের পর বছর, অনেক সময় সারা জীবন ধরেই মুখ বুজে সম্কর্কটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন অনেকেই। এই যে গোপন করা, সহ্য করার যে মানসিকতা, তা কিন্তু নিপীড়ককে আরো শক্তিশালী করে দেয়, তার ভেতরে এক ধরনের নির্যাতনের অধিকারবোধের জন্ম দেয়। সামাজিক চাপ বা লোকলজ্জার ভয় যে কতটা শক্তিশালী ও স্কর্শকাতর, তা রুমানা মঞ্জুরের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় আবারও পরিষ্কার হলো। তাই রুমানা মঞ্জুরের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হওয়ার পরও 'স্কর্শকাতরতা'র এ ভয় থেকে মুক্ত হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। আর এর পেছনে তিনি যতটা না দায়ী, তাঁর আশপাশের সামাজিক চাপ তার চেয়ে বেশি দায়ী। পারিবারিক নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে, এখানে নিপীড়ক অতিকাছের মানুষ। এই নিপীড়কের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকতে হয়, একই বিছানার ভাগ দিতে হয়, একই ভবিষ্যতের সঙ্গে, স্বপ্নের সঙ্গে জড়াতে হয়। আমাদের দেশে এই চেনা নিপীড়নের ভয়াবহতাটুকু আমরা অনেক সময়ই এড়িয়ে যাই, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকি।
আমরা যারা রুমানা মঞ্জুরকে কেউ সহকর্মী, কেউ শিক্ষিকা, কেউ ডিপার্টমেন্টের বড় আপু হিসেবে পেয়েছি, তারা সবাই জানি, রুমানার মতো নম্র, ভদ্র, অমায়িক, বিনীত মেয়ে খুব একটা দেখা যায় না। কোনো দিন কখনো কারো সঙ্গে উচ্চ স্বরে কথা বলতেও আমরা তাঁকে দেখিনি। প্রচলিত অর্থে আমরা যাদের 'ভালো' মেয়ে বলি, তার কোনোটারই ঘাটতি ছিল না তাঁর মধ্যে। কিন্তু একটি মেয়ের ওপর নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে তাঁর নম্রতা, ভদ্রতা আর 'ভালোত্বের' প্রসঙ্গ টেনে আনতে হবে কেন? নম্র, ভদ্র না হয়ে রুমানা যদি খুবই মুখরা হতেন, অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন, তাঁর চরিত্রে অনেক 'স্ক্যান্ডাল' জড়িত থাকত, তাহলে কি তাঁর ওপর চালানো নিপীড়ন বৈধ হয়ে যেত?
এ ঘটনার মাধ্যমে আমাদের আরেকবার চিন্তা করা দরকার, কাকে আমরা ভালো মেয়ে বলব। ভালো মেয়ের আসল সংজ্ঞাটি কী? ভালো মেয়ে মানেই কি নম্র হয়ে অন্যায় মেনে নেওয়া, প্রতিবাদ না করা? ভালো মেয়ে মানেই কি সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনাচার আর লোকলজ্জার জন্য চুপ করে থাকা? ভালো মেয়ে মানেই কি সব কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যের পশুত্বকে বাড়তে দেওয়া? আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এমন ভালো করে গড়ে তুলতে চাই? সাহসী হয়ে, প্রতিবাদী হয়ে বিপদে পড়ার নানা উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে রয়েছে, তাই এই সমাজে প্রতিনিয়ত অনাচারের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলার সাহস সবার না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কাকে ভালো বলব আর কাকে ভালো বলব না, এ ধারণাটুকু তো নিজের ভেতরেই পরিবর্তন করা যায়। নম্রতার, ভদ্রতার পাশাপাশি কোনো সাহসী, প্রতিবাদী মেয়ের সাহস দেখে আমরা তো নিজের মনে মনেই বলে উঠতে পারি, কী অসম্ভব 'ভালো' এই মেয়েটা! হাসান সাঈদ দাবি করেছে, সে ইচ্ছা করে রুমানার চোখ বা নাক ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। বরং রুমানাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, সে চশমা হারিয়ে ফেলে, আঙুল ভেবে নাক কামড়ে দেয়, না বুঝে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে রুমানার চোখের ক্ষতি করে ফেলে। কিন্তু পুলিশের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তারের সময় হাসান সাঈদের দেহে কোনো ধরনের আঘাত তারা লক্ষ করেনি। তাই এ বর্ণনা যে কতটুকু বানোয়াট ও কল্পিত, তা সহজেই বোঝা যায়। হাসান যে নিজ জ্ঞানে, নিজের শিশুর সামনে তার স্ত্রীকে নৃশংস পশুর মতো নির্যাতন করেছে, তা দিবালোকের মতো স্কষ্ট।
কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই ছোট-বড় যেকোনো অপরাধ করার পর অনুশোচনা আর অপরাধ বোধে ভোগে। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েই মানুষের চরিত্র শুচি হয়ে ওঠে, হাসান সাঈদের চরিত্রে সে রকম শুচিতার কোনো লক্ষণও আমরা দেখতে পাই না। হাসান সাঈদের বিপর্যস্ত হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে পড়াশোনা শেষ না করতে পারা, শেয়ারের ব্যবসায় ব্যর্থতা, প্রায় অন্ধত্ব ও হতাশার মতো বিষয়গুলোও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এসব কোনো কারণই কখনোই শারীরিক নির্যাতনকে বৈধতা দিতে পারে না, নিপীড়ককেও সহানুভূতির প্রাপ্য করে তোলে না। যেকোনো নির্যাতনই নির্যাতন, এটাই মুখ্য বিষয়। বনিবনা না হলে হাসান সাঈদের সামনে বিচ্ছেদের পথ খোলা ছিল, সে পথ বেছে নেয়নি সে, বেছে নিয়েছে তার ধারালো নখর দিয়ে চোখ তুলে নেওয়ার পথ। এই লেখাটা যখন আমরা তৈরি করছি, তখন খবর পেলাম, ভারতের শংকর নেত্রালয় থেকে বলা হয়েছে, রুমানার দুটি চোখের কোনোটাই আশঙ্কামুক্ত নয়। শংকর নেত্রালয়ের পর অরবিন্দ আই ইনস্টিটিউটের ডাক্তাররাও কোনো আশার কথা শোনাতে পারছেন না। একরাশ অনিশ্চয়তা বুকে নিয়ে দেশে ফিরে আসছেন তিনি। এ সংবাদের ভয়াবহতা সহকর্মী হিসেবে আমাদের প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে। এ সংকট মোকাবিলা করতে রুমানার নানা রকম সাহায্য দরকার। পারিবারিক দৃঢ়তা, আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা দরকার, আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য অর্থ দরকার। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিকভাবে পাশে থাকা। তাই রুমানাকে আমরা জানিয়ে দিচ্ছি, আপনার ওপর যে আঘাত করা হয়েছে, সে আঘাত আপনার একার নয়। আপনার পাশে শুধু সহকর্মীরাই নন, রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা, এ দেশের সব মুক্তবুদ্ধির মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাহস ও প্রতিবাদ অতীতের নানা ক্ষয়িষ্ণু সময়ে আমাদের নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। তাই আমরা আস্থা হারাইনি। রুমানার নিপীড়ক যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যতই প্রভাবশালী আত্মীয় তার থাক না কেন, ন্যায়ের পক্ষে একতাবদ্ধ শক্তি তার শাস্তি নিশ্চিত করবে। কারণ রুমানা, আপনি শুধু একজন নির্যাতিত নন, বরং পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে চলমান সামাজিক আন্দোলনের এক প্রতীক। আপনার চোখে আলো ফিরে আসুক, আলোকিত হোক সমাজের মানসিক অন্ধত্বেরও।
লেখকবৃন্দ : ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
No comments