সরল গরল-যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু হতে পারলে বিএনপি নয় কেন? by মিজানুর রহমান খান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৈকট্য ও সমঝোতা থেকে আমরা বুঝতে চাই, বিএনপির সঙ্গে তাঁর অহিনকুল সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু। এটা এখন মাপা চলে আর সুযোগটি এনে দিয়েছে উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্র ও বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের এই বৈপরীত্য একটি ইস্যুতে নয়, এর বহুমাত্রিক তাৎ পর্য আছে।
আমরা এ লেখায় শুধু আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র ও বিএনপির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা প্রতিফলন তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারি।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সিলর স্টিফেন আইজেন ব্রাউন ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎ কারে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে জড়িত। তাঁর কথায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ জন্য শেখ হাসিনার ‘প্রবল আক্রোশ’ (stৎ ong gৎ udge) রয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইজেনব্রাউন সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রাউন বলেন, ‘আমরা মুজিব হত্যাকাণ্ডে কোনো ভূমিকাই পালন করিনি বরং তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল।’ মার্কিন তরফে এ বিষয়ে এতটা বিস্তারিত বক্তব্য এ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকেই জানা গেছে। আর এবার আমরা প্রথম জানলাম, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত তৎ কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের কাছে মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে সরাসরি বক্তব্য রেখেছিলেন।
দুই ঘণ্টা স্থায়ী ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় জানতে চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর কিংবা তাঁর দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কি না? শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছিলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম গুজব, বিশেষ করে তাঁর দলের মধ্যে বলাবলি আছে যে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।
মাইলাম পরে পাকিস্তানেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দুটি দেশ নিয়েই লিখেছেন। ২০০৯ সালে মাইলাম তাঁর বইয়ে (বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান: ফ্লার্টিং উইথ ফেইলিয়োর ইন সাউথ এশিয়া) লিখেছেন, ‘মুজিব ও ভুট্টো দুজনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুজিবের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ এতটাই নিচে নেমে গিয়েছিল যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার প্রতি দুঃখ প্রকাশের জন্য অল্প লোকই অবশিষ্ট ছিল।’ ডেভিস ইউজিন বোস্টারের মন্তব্য ছিল, মুজিবের মধ্যে স্বৈরশাসকের চিরায়ত চেহারা ফুটে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মার্কিন তরফে এ রকম রূঢ় মন্তব্যের কমতি নেই।
কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জবানিতে সেসব পাওয়া যাবে না। মাইলাম ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনাকে মুজিব হত্যাকাণ্ডে মার্কিন সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেছিলেন কি না, তা প্রাপ্ত নথিতে দেখি না। তবে শেখ হাসিনার বিরোধিতার অভিযোগ তিনি খণ্ডন করেছিলেন। মাইলাম বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, এই গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের পক্ষে আমরা অবস্থান নিই না। আপনার দলের যে অংশটি বামঘেঁষা, তারাই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে।’ এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা তাঁকে বলেন, ‘তাঁর দলের কিছু সদস্যের মধ্যে এখনো এই মনোভাব রয়ে গেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর পিতার হত্যাকাণ্ডে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল।’ শেখ হাসিনা বলেন, মধ্য আশির দশকে তিনি যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান, তখন তিনি বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর নিজের দল ও অন্যান্য মহল থেকেও যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে মাখামাখি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সমালোচিত হয়েছিলেন। মাইলাম এরপর লেখেন, ‘শেখ হাসিনা এমনকি এ কথাও উল্লেখ করেন যে এখন অবশ্য তাঁর দলের অধিকাংশ সদস্যই তেমন মনোভাব পোষণ করেন না। তবে কিছুসংখ্যক এখনো তা মনে করেন।’
মুজিব হত্যায় সন্দেহভাজন, একাত্তরের শত্রুরাষ্ট্রের (জনগণ নয়) করণীয় সম্পর্কে এরপর তিনি যা বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্যের দীক্ষার জন্য সম্ভবত তা অসাধারণ তাৎ পর্যমণ্ডিত। তখনো কিন্তু ইনডেমনিটি বিল বাতিল হয়নি। ঘাতকদের বিচার-প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি। শেখ হাসিনা মাইলামকে বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খণ্ডাতে গোড়াতেই যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল।’
আমরা কিন্তু দেখি, মুজিব হত্যায় বোস্টার ও সিআইএর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ জরুরি অবস্থায় ভারতীয় পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো নিয়ে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি কিসিঞ্জারের বৈরিতা এবং পরে তাঁর খুনিদের প্রতি তাঁর মমতা সুবিদিত। খাদ্যসাহায্য নিয়ে কিসিঞ্জারের চক্রান্তের দালিলিক প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পরোক্ষ মদদদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আজও অনুতপ্ত নয়। সেই রকম একটি পক্ষের সঙ্গে যদি দহরম-মহরম হতে পারে ‘জাতীয় স্বার্থে’, তাহলে বিএনপি বা বাংলাদেশে যারা মুজিব হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী বলে পরিচিত, তাদের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকবে কেন?
শেখ হাসিনা মাইলামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘যখনই কোনো উপলক্ষ আসবে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করা যে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনো সম্পর্ক নেই।’ এই একই উক্তি কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রযোজ্য হতে পারে না? জিয়ার নাম বঙ্গবন্ধু হত্যার এজাহার থেকে বাদ পড়লে অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা দুই প্রধান দলের মধ্যে রিকনসিলিয়েশনের জন্য সহায়ক। অনেকে যুক্তি দেখাবেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থে মুজিব ও তাঁর কন্যার বিরোধিতা পরিত্যাগ করেছে। আর খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন পালন করছেন।
১৯৭৩ সালে ফারুক-রশীদের জিয়ার নেতৃত্বাধীন অস্ত্র ক্রয় কমিটির পক্ষে মার্কিন দূতাবাসে গমন এবং মার্কিন কর্মকর্তার বাসায় গিয়ে মুজিব সরকার উৎ খাতে ফারুকের সহায়তা চাওয়া-সংক্রান্ত মার্কিন দলিলগুলো আমরা দেখেছি। তবে এখনো এমন কিছু বের হয়নি, যাতে মুজিব হত্যাকাণ্ডে সিআইএর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে লরেন্স লিফশুলজকে নিঃশর্তে গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করা চলে। কিন্তু আমরা জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আপাতত যেটুকু বুঝতে চাই সেটা হলো, মুজিব হত্যাকাণ্ডে নিক্সন-কিসিঞ্জারের মতো জিয়ার ভূমিকাও প্রশ্নসাপেক্ষ, প্রমাণিত নয়। এ অবস্থায় একটি কর্মসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ, উইকিলিকস আমাদের এই ধারণা দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এমনকি দলগতভাবেও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।
গওহর রিজভীর মার্কিন-ভারত যোগসূত্রতা জোরালো। আর সেটাই দীপু মনিকে ম্লান করে দিয়ে তাঁকে পাদপ্রদীপে এনেছে। বিডিআর বিদ্রোহের কঠিনতম সময়েও শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে আস্থায় নিতে পারেননি। অথচ সেই নিক্সনের একজন উত্তরসূরি বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ বা তাঁদের একটি বিবৃতি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছিল।
সেনাছাউনিতে বিএনপির জন্ম-প্রক্রিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা আমরা জেনেছি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরের দিনগুলোতে ভারত যাতে খুনি মোস্তাক সরকারের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করতে না পারে, ওই সরকারটি যাতে টিকে থাকে, সে জন্য এ অঞ্চলের সব মার্কিন কূটনীতিক তৎ পর ছিলেন। সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মহত্ত্ব ছিল না, ছিল কৌশলগত এবং সেই সময়ের মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সুতরাং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওয়াশিংটনের রমরমা সম্পর্ক মানে সব ক্ষেত্রেই নিরঙ্কুুশভাবে বাংলাদেশের তাবৎ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলা যাবে না। উইকিলিকসের বহু বার্তার বিবরণ পড়তে পড়তে আমাদের সামনে ভেসে উঠছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী মার্কিন দূতাবাসের বার্তাগুলোর চেহারা। এগুলো পড়ে বেশ মনে হচ্ছে সুর ও ছন্দটা যেন চেনা চেনা, শুধু সময়ের বিবর্তনে ও ঘটনাচক্রে পাত্র-পাত্রী বদল হয়ে গেছে। আমাদের আপ্তবাক্য—রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। পররাষ্ট্রনীতিতেও এ কথা কখনো অনেক বেশি সত্য।
আমরা যখন মুজিব হত্যাকাণ্ডে ফারুক-রশীদের মার্কিন-সংশ্লিষ্টতায় জিয়ার ভূমিকা বিশ্লেষণ করছিলাম, তখন অধ্যাপক আসিফ নজরুল আমাকে বলেছিলেন, ‘জাতীয় স্বার্থে দরকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দূরত্ব কমানো। কিন্তু আপনি যা প্রকাশ করছেন, তাতে দূরত্ব আরও বাড়ছে।’ এখন আশা করতে পারি, সন্দেহ-সংশয় পাশে ঠেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যদি সম্পর্ক মধুর হতে পারে, তাহলে জাতীয় স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে মধুর হতে পারবে না কেন?
শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস একটি বার্তা পাঠান। তিনি তাতে উল্লেখ করেন, বিচারপতি কে এম হাসান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার পিতার হত্যাকাণ্ডের দুই দণ্ডিতের আত্মীয়। তাঁকে মানতে না পারার ক্ষেত্রে সেটাই ‘প্রকৃত, খুবই আবেগপূর্ণ’ কারণ। তিনি একদা বিএনপির সঙ্গে (আন্তর্জাতিক সম্পাদক) ছিলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেও বিউটেনিস উল্লেখ করেছিলেন। তাহলেই প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগ যদি খুনি চক্রের মদদদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে পারে, তাহলে শুধু এ রকম ঠুনকো কারণে কেন এক-এগারোর মতো জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টি হতে পারল?
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের প্রত্যর্পণ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখে, সেটাও আমরা দেখতে পেলাম উইকিলিকসে। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি জেমস এফ মরিয়ার্টি লিখেছেন, দণ্ডিত খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে অন্য খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা বাংলাদেশ এখন দ্বিগুণ করবে। কিন্তু এখানে সাফল্য কোথায়? মহিউদ্দিনকে আমেরিকা ফেরত পাঠায়নি, বিতাড়িত করেছে।
মরিয়ার্টি ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে দারুণ মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা এটা জেনে প্রীত বোধ করতে পারি যে শীর্ষে আমাদের সমর্থন (তাৎ ক্ষণিক প্রবেশাধিকারসহ) রয়েছে।’
এটা যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের ইঙ্গিত হয়, তাহলে গওহর রিজভী হয়তো বিব্রত হবেন না। মরিয়ার্টি যে বার্তায় মওদুদকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ-সহায়ক বলেছেন, সেই একই বার্তায় রিজভীকে সরকারের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগে সহায়ক ও তথ্য পাওয়ার উৎ স হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ডেভিড এন মেরিল একসময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে দিতে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকা যে এ ক্ষেত্রে বাধা নয়, সেটা দীপু মনি মার্কিনদের কাছে যথার্থই তুলে ধরেছেন।
২০০৯ সালের ৬ আগস্ট মরিয়ার্টি সুপ্রিম কোর্টে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আপিল বিষয়ে একটি বার্তা পাঠান। অন্তত তিন খুনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। মহিউদ্দিনকেই শুধু বাংলাদেশ পেয়েছে। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে এ এম রাশেদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন অভিবাসী বিচারক গ্রহণ করেন। মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় তা সমুন্নত রাখে। আহমেদ শরিফুল হোসেন এখন মার্কিন অভিবাসন প্রক্রিয়া মোকাবিলা করছেন। তাঁদের এই আশ্রয় চাওয়া-সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখতে মরিয়ার্টি নোট দিয়েছিলেন। মরিয়ার্টির মতে, ‘১৫ আগস্টই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভাজনরেখা, এটাই বিরোধের উৎ স। ৩৪ বছর পরেও এটা বাংলাদেশকে বিভক্ত রেখেছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দুই দলের মধ্যকার তিক্ততাই গত দুই দশকের বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আমরা আশা করি, এই ইস্যুতে উভয় পক্ষের বিতর্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজকে প্রত্যাহার করে নেবে।’
সত্যিই আমরা দেখতে উদ্গ্রীব, এটা বাস্তবে কীভাবে ঘটে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mৎ khanbd@gmail.com
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সিলর স্টিফেন আইজেন ব্রাউন ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎ কারে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করেন, মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে জড়িত। তাঁর কথায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ জন্য শেখ হাসিনার ‘প্রবল আক্রোশ’ (stৎ ong gৎ udge) রয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইজেনব্রাউন সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রাউন বলেন, ‘আমরা মুজিব হত্যাকাণ্ডে কোনো ভূমিকাই পালন করিনি বরং তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল।’ মার্কিন তরফে এ বিষয়ে এতটা বিস্তারিত বক্তব্য এ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকেই জানা গেছে। আর এবার আমরা প্রথম জানলাম, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত তৎ কালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলামের কাছে মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে সরাসরি বক্তব্য রেখেছিলেন।
দুই ঘণ্টা স্থায়ী ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় জানতে চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর কিংবা তাঁর দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে কি না? শেখ হাসিনা তাঁকে বলেছিলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম গুজব, বিশেষ করে তাঁর দলের মধ্যে বলাবলি আছে যে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছে।
মাইলাম পরে পাকিস্তানেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দুটি দেশ নিয়েই লিখেছেন। ২০০৯ সালে মাইলাম তাঁর বইয়ে (বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান: ফ্লার্টিং উইথ ফেইলিয়োর ইন সাউথ এশিয়া) লিখেছেন, ‘মুজিব ও ভুট্টো দুজনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুজিবের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ এতটাই নিচে নেমে গিয়েছিল যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতার প্রতি দুঃখ প্রকাশের জন্য অল্প লোকই অবশিষ্ট ছিল।’ ডেভিস ইউজিন বোস্টারের মন্তব্য ছিল, মুজিবের মধ্যে স্বৈরশাসকের চিরায়ত চেহারা ফুটে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মার্কিন তরফে এ রকম রূঢ় মন্তব্যের কমতি নেই।
কিন্তু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জবানিতে সেসব পাওয়া যাবে না। মাইলাম ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনাকে মুজিব হত্যাকাণ্ডে মার্কিন সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেছিলেন কি না, তা প্রাপ্ত নথিতে দেখি না। তবে শেখ হাসিনার বিরোধিতার অভিযোগ তিনি খণ্ডন করেছিলেন। মাইলাম বলেছিলেন, ‘আমি তাঁকে বললাম, এই গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের পক্ষে আমরা অবস্থান নিই না। আপনার দলের যে অংশটি বামঘেঁষা, তারাই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে।’ এ পর্যায়ে শেখ হাসিনা তাঁকে বলেন, ‘তাঁর দলের কিছু সদস্যের মধ্যে এখনো এই মনোভাব রয়ে গেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর পিতার হত্যাকাণ্ডে কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল।’ শেখ হাসিনা বলেন, মধ্য আশির দশকে তিনি যখন প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান, তখন তিনি বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর নিজের দল ও অন্যান্য মহল থেকেও যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে মাখামাখি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে সমালোচিত হয়েছিলেন। মাইলাম এরপর লেখেন, ‘শেখ হাসিনা এমনকি এ কথাও উল্লেখ করেন যে এখন অবশ্য তাঁর দলের অধিকাংশ সদস্যই তেমন মনোভাব পোষণ করেন না। তবে কিছুসংখ্যক এখনো তা মনে করেন।’
মুজিব হত্যায় সন্দেহভাজন, একাত্তরের শত্রুরাষ্ট্রের (জনগণ নয়) করণীয় সম্পর্কে এরপর তিনি যা বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্যের দীক্ষার জন্য সম্ভবত তা অসাধারণ তাৎ পর্যমণ্ডিত। তখনো কিন্তু ইনডেমনিটি বিল বাতিল হয়নি। ঘাতকদের বিচার-প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি। শেখ হাসিনা মাইলামকে বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খণ্ডাতে গোড়াতেই যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল।’
আমরা কিন্তু দেখি, মুজিব হত্যায় বোস্টার ও সিআইএর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ জরুরি অবস্থায় ভারতীয় পত্রপত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো নিয়ে দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি কিসিঞ্জারের বৈরিতা এবং পরে তাঁর খুনিদের প্রতি তাঁর মমতা সুবিদিত। খাদ্যসাহায্য নিয়ে কিসিঞ্জারের চক্রান্তের দালিলিক প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পরোক্ষ মদদদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আজও অনুতপ্ত নয়। সেই রকম একটি পক্ষের সঙ্গে যদি দহরম-মহরম হতে পারে ‘জাতীয় স্বার্থে’, তাহলে বিএনপি বা বাংলাদেশে যারা মুজিব হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী বলে পরিচিত, তাদের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকবে কেন?
শেখ হাসিনা মাইলামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘যখনই কোনো উপলক্ষ আসবে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করা যে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনো সম্পর্ক নেই।’ এই একই উক্তি কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রযোজ্য হতে পারে না? জিয়ার নাম বঙ্গবন্ধু হত্যার এজাহার থেকে বাদ পড়লে অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা দুই প্রধান দলের মধ্যে রিকনসিলিয়েশনের জন্য সহায়ক। অনেকে যুক্তি দেখাবেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় স্বার্থে মুজিব ও তাঁর কন্যার বিরোধিতা পরিত্যাগ করেছে। আর খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন পালন করছেন।
১৯৭৩ সালে ফারুক-রশীদের জিয়ার নেতৃত্বাধীন অস্ত্র ক্রয় কমিটির পক্ষে মার্কিন দূতাবাসে গমন এবং মার্কিন কর্মকর্তার বাসায় গিয়ে মুজিব সরকার উৎ খাতে ফারুকের সহায়তা চাওয়া-সংক্রান্ত মার্কিন দলিলগুলো আমরা দেখেছি। তবে এখনো এমন কিছু বের হয়নি, যাতে মুজিব হত্যাকাণ্ডে সিআইএর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে লরেন্স লিফশুলজকে নিঃশর্তে গ্রহণ বা অগ্রাহ্য করা চলে। কিন্তু আমরা জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আপাতত যেটুকু বুঝতে চাই সেটা হলো, মুজিব হত্যাকাণ্ডে নিক্সন-কিসিঞ্জারের মতো জিয়ার ভূমিকাও প্রশ্নসাপেক্ষ, প্রমাণিত নয়। এ অবস্থায় একটি কর্মসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ, উইকিলিকস আমাদের এই ধারণা দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে এমনকি দলগতভাবেও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।
গওহর রিজভীর মার্কিন-ভারত যোগসূত্রতা জোরালো। আর সেটাই দীপু মনিকে ম্লান করে দিয়ে তাঁকে পাদপ্রদীপে এনেছে। বিডিআর বিদ্রোহের কঠিনতম সময়েও শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে আস্থায় নিতে পারেননি। অথচ সেই নিক্সনের একজন উত্তরসূরি বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ বা তাঁদের একটি বিবৃতি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছিল।
সেনাছাউনিতে বিএনপির জন্ম-প্রক্রিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের ভূমিকা আমরা জেনেছি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পরের দিনগুলোতে ভারত যাতে খুনি মোস্তাক সরকারের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করতে না পারে, ওই সরকারটি যাতে টিকে থাকে, সে জন্য এ অঞ্চলের সব মার্কিন কূটনীতিক তৎ পর ছিলেন। সেটা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মহত্ত্ব ছিল না, ছিল কৌশলগত এবং সেই সময়ের মার্কিন জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সুতরাং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওয়াশিংটনের রমরমা সম্পর্ক মানে সব ক্ষেত্রেই নিরঙ্কুুশভাবে বাংলাদেশের তাবৎ জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলা যাবে না। উইকিলিকসের বহু বার্তার বিবরণ পড়তে পড়তে আমাদের সামনে ভেসে উঠছে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী মার্কিন দূতাবাসের বার্তাগুলোর চেহারা। এগুলো পড়ে বেশ মনে হচ্ছে সুর ও ছন্দটা যেন চেনা চেনা, শুধু সময়ের বিবর্তনে ও ঘটনাচক্রে পাত্র-পাত্রী বদল হয়ে গেছে। আমাদের আপ্তবাক্য—রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। পররাষ্ট্রনীতিতেও এ কথা কখনো অনেক বেশি সত্য।
আমরা যখন মুজিব হত্যাকাণ্ডে ফারুক-রশীদের মার্কিন-সংশ্লিষ্টতায় জিয়ার ভূমিকা বিশ্লেষণ করছিলাম, তখন অধ্যাপক আসিফ নজরুল আমাকে বলেছিলেন, ‘জাতীয় স্বার্থে দরকার বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দূরত্ব কমানো। কিন্তু আপনি যা প্রকাশ করছেন, তাতে দূরত্ব আরও বাড়ছে।’ এখন আশা করতে পারি, সন্দেহ-সংশয় পাশে ঠেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যদি সম্পর্ক মধুর হতে পারে, তাহলে জাতীয় স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে মধুর হতে পারবে না কেন?
শেখ হাসিনার সঙ্গে এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে ২০০৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস একটি বার্তা পাঠান। তিনি তাতে উল্লেখ করেন, বিচারপতি কে এম হাসান বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার পিতার হত্যাকাণ্ডের দুই দণ্ডিতের আত্মীয়। তাঁকে মানতে না পারার ক্ষেত্রে সেটাই ‘প্রকৃত, খুবই আবেগপূর্ণ’ কারণ। তিনি একদা বিএনপির সঙ্গে (আন্তর্জাতিক সম্পাদক) ছিলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেও বিউটেনিস উল্লেখ করেছিলেন। তাহলেই প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগ যদি খুনি চক্রের মদদদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে পারে, তাহলে শুধু এ রকম ঠুনকো কারণে কেন এক-এগারোর মতো জাতীয় দুর্যোগ সৃষ্টি হতে পারল?
যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের প্রত্যর্পণ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের অনুরোধ যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখে, সেটাও আমরা দেখতে পেলাম উইকিলিকসে। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি জেমস এফ মরিয়ার্টি লিখেছেন, দণ্ডিত খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে অন্য খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা বাংলাদেশ এখন দ্বিগুণ করবে। কিন্তু এখানে সাফল্য কোথায়? মহিউদ্দিনকে আমেরিকা ফেরত পাঠায়নি, বিতাড়িত করেছে।
মরিয়ার্টি ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে দারুণ মুগ্ধতা নিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা এটা জেনে প্রীত বোধ করতে পারি যে শীর্ষে আমাদের সমর্থন (তাৎ ক্ষণিক প্রবেশাধিকারসহ) রয়েছে।’
এটা যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের ইঙ্গিত হয়, তাহলে গওহর রিজভী হয়তো বিব্রত হবেন না। মরিয়ার্টি যে বার্তায় মওদুদকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ-সহায়ক বলেছেন, সেই একই বার্তায় রিজভীকে সরকারের সঙ্গে দূতাবাসের যোগাযোগে সহায়ক ও তথ্য পাওয়ার উৎ স হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ডেভিড এন মেরিল একসময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে দিতে সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকা যে এ ক্ষেত্রে বাধা নয়, সেটা দীপু মনি মার্কিনদের কাছে যথার্থই তুলে ধরেছেন।
২০০৯ সালের ৬ আগস্ট মরিয়ার্টি সুপ্রিম কোর্টে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আপিল বিষয়ে একটি বার্তা পাঠান। অন্তত তিন খুনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। মহিউদ্দিনকেই শুধু বাংলাদেশ পেয়েছে। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে এ এম রাশেদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন অভিবাসী বিচারক গ্রহণ করেন। মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় তা সমুন্নত রাখে। আহমেদ শরিফুল হোসেন এখন মার্কিন অভিবাসন প্রক্রিয়া মোকাবিলা করছেন। তাঁদের এই আশ্রয় চাওয়া-সংক্রান্ত তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখতে মরিয়ার্টি নোট দিয়েছিলেন। মরিয়ার্টির মতে, ‘১৫ আগস্টই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভাজনরেখা, এটাই বিরোধের উৎ স। ৩৪ বছর পরেও এটা বাংলাদেশকে বিভক্ত রেখেছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দুই দলের মধ্যকার তিক্ততাই গত দুই দশকের বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আমরা আশা করি, এই ইস্যুতে উভয় পক্ষের বিতর্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজকে প্রত্যাহার করে নেবে।’
সত্যিই আমরা দেখতে উদ্গ্রীব, এটা বাস্তবে কীভাবে ঘটে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mৎ khanbd@gmail.com
No comments