বাজেটে উপেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

বাংলাদেশের কথা ভাবলে আমাদের মনে পড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটের কথা। বাংলাদেশের কথা মনে হলে আমাদের মনে আসে বগুড়া, কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ অথবা কক্সবাজারের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম; তার খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর রাঙামাটির কথা, আমাদের মনেই আসে না।


মনে হয় বহুদূরের এক অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম, বড় অজানার এক রহস্যভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম। অথচ কতটা দূরে পার্বত্য চট্টগ্রাম? মোটেই দূরে নয়। চট্টগ্রাম থেকে বাসে কেবল দেড়-দুই ঘণ্টার পথ পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাটগাঁর সমভূমি পার হলেই তার ডান-বাঁয়ে চোখজুড়ানো সবুজ পাহাড় নিয়েই মায়াবী সৌন্দর্য গায়ে মেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ঝরনার কুলকুল ধ্বনি, জলপ্রপাতের মনোরম শব্দ, পাখির কলকাকলি, সবুজের বিশাল সমারোহ আর হ্র্রদের টলমল জলের বিস্ময় নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম তার স্নিগ্ধ লাবণ্য ছড়িয়ে দেওয়ার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামকে আর সেখানে বসবাস করা উপজাতিদের আমরা আপন মনে করি না। এর সবচেয়ে বড় কারণ, আমাদের দেশ সব সময় উপেক্ষা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে। 'উপজাতি' নাম দিয়ে তাদের পাহাড়ে রেখে দিয়েছি আমরা। সমতল থেকে বন্ধুতের হাত বাড়িয়ে দিইনি।
আমরা সব সময় ভুলে যাই, বাংলাদেশ কেবল বাঙালি জাতির দেশ নয়। এ দেশে রয়েছে চাকমা, সাঁওতাল, মগ, আরো অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, শতাব্দী পরম্করায় যারা বাংলাদেশের অধিবাসী। এ বাংলাদেশ তাদেরও দেশ। কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, পাহাড়ে বাস করে বলেই রাষ্ট্র তাদের ভুলে থেকেছে সব সময়। বাংলাদেশের প্রতিবছরের রাষ্ট্রীয় বাজেট দেখে অন্তত তা-ই মনে হয়।
গত ৯ জুন ঘোষিত হয়েছে নতুন বাজেট এবং এই বাজেটে পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রায় অনেকটাই উপেক্ষা করা হয়েছে। শুধু রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আর কোনো ঘোষণাই নেই। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, আর বান্দরবান_এ তিন জেলা মিলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর ভেতর রাঙামাটিতে বিশ্ববিদ্যালয় হলে খাগড়াছড়ি আর বান্দরবানের শিক্ষার্থীরা কোথায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে, সে বিষয়ে সরকারের কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ ভৌগোলিক কারণে দুর্গম, প্রত্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দেশের কেন্দ্রে এসে পড়াশোনা করার মতো বা হোস্টেলে থাকার মতো আর্থিক সংগতি অনেকেরই নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ করার জন্য সরকারের যে প্রত্যয়, সেটি পার্বত্য চট্টগ্রামে কিভাবে বাস্তবায়িত হবে_এ বিষয়ে কোনো রূপরেখা নেই; যেখানে খাগড়াছড়ি কিংবা বান্দরবানের উচ্চশিক্ষার জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বাজেটে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত পার্বত্যবাসীকে পরিবেশসচেতন করে তোলার জন্য কোনো প্রকল্প ঘোষণা না করা। আগামী ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ গাছপালা কর্তন, বন উজাড় ও বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে জলবায়ুঘটিত উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা ঘোষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা; সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলছে নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন, বন উজাড়, পাহাড় উজাড়। জীবিকার তাগিদে আদিবাসীদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছে এসব কাজে। অথচ পার্বত্যবাসীকে সচেতন করতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘোষণা করা হয়নি। হয়নি জীবিকার জন্য শিল্প-কারখানা স্থাপনের কোনো উদ্যোগের কথা। শ্রমিকের অভাবে যেখানে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের অনেক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম উল্লেখযোগ্য একটি সমাধান হতে পারত। সরকার যদি এ বিষয়ে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারত, তাহলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গার্মেন্ট স্থাপিত হতো। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এখন যেমন অনেক লোককে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে কাজ করতে হচ্ছে, সে রকম করতে হতো না, বরং পার্বত্যবাসী পার্বত্য চট্টগ্রামে নিজ এলাকায় বসবাস করে শিল্প-কারখানায় কাজ করতে পারত। তারপর যেটি সবচেয়ে বড় বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে, সেটি হচ্ছে পার্বত্যবাসী বাজেটের আগেই দাবি করেছিল যে আনারস, কমলা, কাঁঠালসহ প্রচুর ফল সম্কদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি উদ্যোগে কয়েকটি হিমাগারের ব্যবস্থা করা, সে বিষয়ে কোনো ঘোষণাই আসেনি বাজেটে। সারা দেশের বিদ্যুতের একটি বড় অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের বহু অংশে এখনো বিদ্যুৎ নেই। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্যই সব জায়গায় বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দেওয়া যেখানে প্রথম শর্ত। এ ছাড়া বনসম্কদনির্ভর কোনো শিল্প-কারখানার কথাও বাজেটে আসেনি। কথা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বাজেটে যত বেশি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ হবে, পাহাড়ের আদিবাসীদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য এবং পাহাড়িদের যত বেশি চাকরির সুবিধা তৈরি হবে, ততই পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অথবা উপজাতিদের সঙ্গে আমাদের সমতলের বাঙালিদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচবে এবং পরস্করের মধ্যে ব্যবধান কমবে বলে বিশ্বাস করি। আর এ ব্যবধান কমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যে হানাহানি চলছে, তা অনেকখানি কমবে।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া

No comments

Powered by Blogger.