'ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল'-যোগাযোগ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি চাই

বর্তমান সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে যোগাযোগ খাতে দীর্ঘর্তম পদ্মা সেতু, ঢাকায় ৩২ কিলোমিটার উড়াল সেতুসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের গতি এতটাই ধীর যে কেবল হাঁকডাকই সার হচ্ছে। ফলে বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তিটির কথাই মনে এসে যায়, 'ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল'।


কেন এ অবস্থা? বিশেষজ্ঞ ও সাবেক আমলাদেরও কেউ কেউ এ জন্য বর্তমান আমলাদের অদক্ষতাকেই প্রধানত দায়ী করেছেন। এক বছরে যে কাজ করা সম্ভব, দেখা যাচ্ছে, আড়াই বছরেও তাঁরা তা করতে পারেননি। আবার অর্থায়নের অভাব, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপে অনেক বেশি প্রকল্প গ্রহণকেও কেউ কেউ শ্লথগতির জন্য দায়ী করেছেন। ফলে মহাজোট সরকারের বর্তমান মেয়াদে যে প্রকল্পগুলো শেষ করার কথা বলা হয়েছিল, সে ব্যাপারে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে গতকালের কালের কণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
অর্থনীতি-বিশ্লেষকদের মতে, শুধু যোগাযোগ খাত নয়, আমলাদের অদক্ষতা অন্য অনেক খাতেই উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে লাগামহীন দুর্নীতি এবং শাস্তির বদলে তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অর্থদণ্ড দিয়ে সত্য ও জবাবদিহিতা কমিশন থেকে মার্জনাপ্রাপ্ত একজন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ কিভাবে আড়াই বছরে দুটি পদোন্নতি নিয়ে প্রধান প্রকৌশলী হয়ে গেছেন। জাতীয় সংসদে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এ রকম কয়েক শ আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ এখন গোটা প্রশাসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেবল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েই আছেন এ রকম ৪৩ জন। অবশ্য জবাবদিহিতা কমিশনের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করেননি এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সংখ্যাও কম নয়। আবার ক্ষমতা পরিবর্তনের কারণে গজিয়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সংখ্যাও কম নয়। এ রকম লাগামহীন দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা আমাদের প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ কারণে কেবল রেলওয়ের ২০টি প্রকল্পে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে দুই হাজার কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্বব্যাংক। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের জন্য তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।
আমরা ধরে নিচ্ছি, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু কেবল সদিচ্ছাই সব নয়, এখানে আন্তরিকতা এবং দক্ষতারও প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনে এবং নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষতার চেয়ে রাজনীতি ও অনৈতিক সুবিধা গ্রহণটাই প্রধান রীতি হিসেবে চলে আসছিল। আমরা নিকট-অতীতের দিকে ফিরে তাকালেই দেখতে পাব, পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা পিএসসিকে পর্যন্ত কিভাবে দলীয়করণ করা হয়েছিল। এসব কারণে দক্ষতার স্কেলে আমাদের প্রশাসন সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে এসেছে। অথচ প্রশাসন হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান চারটি স্তম্ভের একটি। কোনো একটি স্তম্ভ দুর্বল হলে পুরো স্থাপনাটিই দুর্বল হয়ে যায়। উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রধান দায়িত্ব যে প্রশাসনের, সেই প্রশাসন দুর্বল হলে উন্নয়নের গতি ব্যাহত হবেই_এটা বাস্তবতা। কাজেই উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে হলে সবার আগে আমাদের প্রশাসনকে দক্ষ করতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন হবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার। কিন্তু বর্তমান সরকারের আড়াই বছরেও আমরা সে আন্তরিকতা খুব একটা দেখতে পাইনি। এর মধ্যেও বর্তমান সরকারের যে কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে_তাকে আমরা অস্বীকার করছি না। আমরা চাই, সৎ ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার মাধ্যমে উন্নয়নের গতিকে আরো কিছুটা বেগবান করা হোক।

No comments

Powered by Blogger.