খোলা হাওয়া-সুখের উপাত্ত ও উইকিলিকস-ঝড় by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
অর্থনীতিতে সুখের উপাত্ত বা হ্যাপিনেস ডেটার ব্যবহার আছে। বিশেষ করে, সামাজিক কল্যাণের ক্ষেত্রে সরকারি নীতির প্রভাব নির্ণয়ে এ রকম জ্ঞান আমাকে দিয়েছিলেন এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু। কয়েক বছর আগে কাগজে দেখেছিলাম, ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস ইনডেক্স’-এ বাংলাদেশ বিশ্বের দেশগুলোর ওপরের দিকে রয়েছে।
কী কী কারণে বাংলাদেশের মানুষ পাহাড়প্রমাণ সব সমস্যার নিচে চাপা পড়েও মুখে হাসি ধরে রাখে, তা নিরূপণের জন্য নানা জরিপের মধ্য দিয়ে হ্যাপিনেস ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে। তারপর বাংলাদেশের মানুষের মাথায় সুখিত্বের একটা মুকুট পরানো হয়েছে।
কিন্তু হ্যাপিনেস ডেটার অন্য রূপ এবং অন্য ব্যবহারও আছে। এবং তা পরিসংখ্যানের এক ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চলে। আমার অর্থনীতিবিদ বন্ধুর মতে, কোনো সৎ পরিসংখ্যানবিদ এ বিষয়টি স্বীকার করবেন না। কিন্তু স্বীকার না করলেও প্রচল তো রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি আশির দশকে বাংলাদেশে অনেক এনজিওর সংগৃহীত—তাঁর ভাষার ‘উৎ পাদিত’ তথ্য-উপাত্তের উদাহরণ দিলেন। কিছু কিছু দাতা সংস্থা বড় বড় তহবিল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে উন্নয়ন, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি—এসব নানা বিষয়ে তাদের নিজস্ব চিন্তা (অথবা ‘এজেন্ডা’) অনুযায়ী কাজ করতে। আমরা জানি, বাংলাদেশে যেমন অনেক ভালো এনজিও আছে, তেমনি খারাপ এনজিও আছে। যেমন আছে ভালো দাতা ও মন্দ দাতা। মন্দ কোনো কোনো দাতা মন্দ কোনো কোনো এনজিওর মাধ্যমে তাদের চিন্তাভাবনা ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করিয়ে নিয়েছে। দর্জির বানানো পোশাকের মতো হিসাব করে নিজস্ব উন্নয়ন-ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ফলে দেশের বাস্তবতা যা-ই হোক, দাতা এনজিওগুলো উন্নয়নের নানা উদাহরণ দেখিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে। মন্দ এনজিওগুলো দাতাদের মর্জিমতো তথ্য-উপাত্ত উৎ পাদন করেছে, গোয়ালে গরু না থাকলেও কেতাবে দেখিয়েছে, আর তাদের তরক্কি বেড়েছে। দাতার মর্জিমতো উৎ পাদিত তথ্য-উপাত্তকে আমার বন্ধু বলছেন হ্যাপিনেস ডেটা। এই ডেটা দাতার মুখে হাসি ফুটিয়েছে, ডেটা উৎ পাদকও হাসতে হাসতে ব্যাংকে গেছে।
বাংলাদেশে এখন চলছে হ্যাপিনেস ডেটা উৎ পাদনের মহোৎ সব। না, এনজিওগুলো এখন আর সে দৌড়ে তেমন নেই। দাতারাও এখন স্বচ্ছতা ও সুশাসন বিষয়ে অনেক বেশি নিরীক্ষার সম্মুখীন। এই হ্যাপিনেস ডেটা উৎ পাদিত হচ্ছে রাজনীতিতে। প্রতিটি দলের নেত্রী বা নেতা যা শুনতে চান, সহকর্মীরা তা ক্রমাগত শোনাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী যা শুনতে পছন্দ করেন, মন্ত্রী-উপদেষ্টারা তা শোনাচ্ছেন। বিরোধী নেত্রী যা শুনতে পছন্দ করেন, তাঁর উপদেষ্টা-সহকর্মীরা তা-ই শোনাচ্ছেন। ফলে মানুষ কী ভাবছে, বাস্তবে কী ঘটছে—এসব তাঁদের জানা হচ্ছে না, তাঁদের চোখেও পড়ছে না। তাঁরা শুধু শুনছেন খুশির সংবাদ। সুশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য এ যে কত বড় বিপদ, এটি আমরা, অর্থাৎ আমজনতা, বিপন্ন পাবলিকই শুধু বুঝতে পারি। বুঝতে অপারগ হন নেতা-নেত্রীরা। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যায়। মাঝেমধ্যে মেধাবী কেউ মারা গেলে এই চরম বেদনাদায়ক বিষয়টি আমাদের নতুন করে উপলব্ধি হয়। যেমন—আগস্ট মাসে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালে আমরা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমরা জানি, এসব দুর্ঘটনার অনেক কারণ আছে—অদক্ষ ও অশিক্ষিত চালক থেকে নিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও বিপজ্জনক মহাসড়ক যেগুলোর মাত্র কয়েকটি। আমরা যখন বলতে শুরু করলাম, ড্রাইভিং লাইসেন্স শুধু যোগ্য চালকদের দেওয়া হোক এবং মহাসড়কগুলো মানসম্পন্ন করা হোক, তখনই নৌমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী নানান হ্যাপিনেস ডেটা দেখিয়ে তাঁদের দায়িত্ব এড়াতে থাকলেন। গরু-মহিষ চিনতে পারলেই চালকের লাইসেন্স দেওয়া যায়, এ জন্য শিক্ষার প্রয়োজন নেই—বললেন একজন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির এক চালক যেহেতু ক্লাস ফাইভ পাস, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা ওই পর্যায়ে থাকলেই চলে—এ রকম ইঙ্গিতও তিনি দিলেন। অন্য মন্ত্রী বলেই যাচ্ছেন, রাস্তাঘাট সব মেরামত হয়ে গেছে। কোনো সমস্যা নেই। তাঁর এই হ্যাপিনেস ডেটায় তাঁর সহকর্মীদেরও মনে হচ্ছে আস্থা জন্মেছে। শুধু আস্থা নেই বিপন্ন পাবলিকের, যারা প্রতিদিন প্রিয় প্রাণটা হাতে নিয়ে মহাসড়কে চলাচল করে।
তবে হ্যাপিনেস ডেটার ছড়াছড়ি দেখলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের আগে ও পরে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে যা হ্যাপিনেস, বিরোধী দলের কাছে তা আনহ্যাপিনেস; ফলে বিরোধীরাও তাদের পাল্টা হ্যাপিনেস ডেটা পরিবেশন করছে। সরকার বলছে এবং বিশ্বাস করছে, মনমোহন সিংয়ের সফর অত্যন্ত সফল। বিরোধী দল বলছে এবং বিশ্বাস করছে, এটি চূড়ান্তভাবে বিফল। জনাব সিংয়ের ঢাকায় আসার আগের দিনও বলা হলো, তিস্তা চুক্তি হবেই, যদিও সেদিন বিকেলেই নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সোজা জানিয়ে দিয়েছিলেন, চুক্তি হবে না। এখন শুনছি, তিন মাসের মধ্যে চুক্তি হবে। আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দেখলাম, হ্যাপিনেস ডেটার উৎ পাদনে শীর্ষস্থানে থাকতে। তিনি ক্রমাগত বলেই যাচ্ছেন, মনমোহন সিংয়ের সফর বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক অর্জন। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হলো, তিস্তা চুক্তি এখন সময়ের ব্যাপার; ট্রানজিট ইস্যুটি ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে সেই ১৯৭৪ সালেই নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের আপাতত ৪৬টি, কিন্তু ক্রমান্বয়ে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় পণ্য শুল্কমুক্তসুবিধা নিয়ে ঢুকছে ও ঢুকবে (ঢুকে না গেলেও), শিগগিরই ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাব এবং ভারতের সঙ্গে আমাদের সব সীমান্তবিরোধ মিটে গেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যখন এ রকম হ্যাপিনেসের কথা আমাদের শোনাচ্ছেন, তখন পত্রপত্রিকা লিখছে ভিন্ন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপরীত কথা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বলবেন, তিনি কোনো দিনই তিস্তার পানি বাংলাদেশের দাবিমতো দেওয়াটা মেনে নেবেন না, অর্থাৎ তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন ঝুলেই থাকবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ ও তিনি বাংলাদেশে আসতে দেবেন না। তাঁকে যতই ইলিশ মাছ দেওয়া হোক, এ দুই দাবিতে তিনি অনড় থাকবেন। আর ভারতের বাজারে যে বাংলাদেশের পণ্য যাবে—কবে? সব শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করে কবে সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাবে আমাদের সামগ্রী? প্রশ্নটি দু-একজন অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাঁরা সংক্ষেপে জানালেন, ওপরওয়ালা বলতে পারেন।
মাটির বাস্তব যখন আমাদের বলছে বাংলাদেশ শুধু প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, ধরাছোঁয়ার মধ্যে এখনো অনেক কিছুই আসেনি, তখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দিচ্ছেন হ্যাপিনেসের বিরাট এক তালিকা এবং সে বিষয়টি অবাক করার মতো! তাঁর সেই হ্যাপিনেসের সঙ্গে একমত না হওয়ায় মিডিয়া, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের (বাকি তাহলে আর কে থাকল?) তিনি একহাত নিলেন। এসব পক্ষ মিলে নেতিবাচক ধারণা ছড়াচ্ছে—এমন কথাও তিনি বললেন। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি বলেছেন, ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারতের যে অর্থ সাশ্রয় হবে, তার অর্ধেক বাংলাদেশ দাবি করতে পারে। কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সুয়েজ খালের উদাহরণ দিয়ে বললেন, এটা অযৌক্তিক। এর আগে অবশ্য অর্থ উপদেষ্টা বলেছিলেন, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়াটাই হবে অভব্যতা।
বিরোধী দলের হ্যাপিনেস বাহিনী বলছে, সিং সাহেবের সফরে লাভ কিছুই হয়নি। বাংলাদেশ বরং আরও কিছু গোলামি চুক্তি করে দেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এই (আন)হ্যাপিনেস ডেটা, যাতে তাদের শীর্ষ নেতা-নেত্রীর রয়েছে পূর্ণ বিশ্বাস, তা যদি তাঁরা জনগণকে বিশ্বাস করাতে পারেন, তাহলে সরকারের হ্যাপিনেস বাহিনী যে তাদের বানানো স্বর্গ থেকে ভবিষ্যতে বিদায় নেবে, তা প্রায় নিশ্চিত। এবং শুধু মনমোহনের সফর নয়; দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, পদ্মা সেতু-উড়াল পুল, শেয়ারবাজারসহ নানা বিষয়ে সরকারের নেতারা এখন হ্যাপিনেস ডেটা উৎ পাদনে ব্যস্ত, যার ওপর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দেখা যাচ্ছে প্রবল আস্থা।
আমাদের দেশের সরকারের হ্যাপিনেস বাহিনী যে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে গিয়ে একটি কল্পকথার জগৎ তৈরি করে সেখানে আশ্রয় নেয় এবং ক্রমে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সে-কথাটি আমরা অনেক বছর থেকে জেনে এলেও সম্প্রতি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস তা নতুন করে তুলে ধরল। প্রধানত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের নানা কর্মকর্তার স্বদেশে পাঠানো গোপন বার্তাকে ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দিয়ে উইকিলিকস রীতিমতো এক ঝড়ই তুলেছে আমাদের রাজনীতিতে। উইকিলিকসের লিকগুলো থেকে আমরা জানতে পারছি, বিগত জোট সরকার কী দুর্নীতিটাই না করেছে। কিন্তু এখন সেই নেতা-নেত্রীরাই পূত-পবিত্রতার ভান করে সরকারের মুণ্ডুপাত করছেন এবং তাঁরা ক্ষমতায় গেলে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর অলীক হ্যাপিনেস বার্তা শোনাচ্ছেন। উইকিলিকস আমাদের জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে সত্য বলার মানুষ কম। অর্থাৎ যাঁরা আছেন, তাঁরা বেশির ভাগই হ্যাপিনেস বাহিনীর সদস্য। উইকিলিকস যখন পদ্মা সেতুর কানাডিয়ান পরামর্শক সংস্থার দুর্নীতির বিষয় ফাঁস করল, তখন বিএনপির মহাসচিব এর উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, সরকার যে দুর্নীতিবাজ, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত। টিভিতে তাঁর উৎ ফুল্ল মুখও দেখলাম। কিন্তু উইকিলিকস যখন জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, হাওয়া ভবন এবং তারেক জিয়ার নানা অপকর্মের কথা জানাতে থাকল, বিএনপির মহাসচিব তখন উইকিলিকসের লিকগুলোতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন। সেদিন শুনলাম, তিনি প্রশ্ন করছেন, ‘কারা এরা? কী এদের উদ্দেশ্য?’ ইত্যাদি। উইকিলিকসের লিকগুলো এখন তাঁর দলের জন্য বড়ই আন-হ্যাপিনেসের বিষয়। তবে, আমরা যারা বিষয়টি কৌতূহল নিয়ে অনুসরণ করছি, তাদের কাছে একটা নির্মম সত্য পুনর্বার ধরা পড়েছে—যে দলই সরকারে যায়, বাস্তবতা থেকে তার অবস্থান চলে যায় অনেক দূরে এবং হ্যাপিনেস ডেটা ছাড়া তারা আর কিছু শুনতে চায় না।
উইকিলিকস অবশ্য আমাদের রাজনৈতিক সংকট কিছুটা মোচনের একটা সুযোগ করে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল, উভয়ই এর নিন্দা জানাচ্ছে। যাঁরা সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ দেখতে চান, তাঁরা সংসদের একটা বিশেষ অধিবেশন ডাকার ব্যবস্থা করতে পারেন, যার একমাত্র এজেন্ডা হবে উইকিলিকসের অপকর্মের নিন্দা জানানো। আমি নিশ্চিত, অধিবেশনটি দুই পক্ষকে এক বিরল মতৈক্যের সুযোগ করে দেবে। অনেক দিন পর সংসদে দুই পক্ষের আনন্দিত সহ-অবস্থান নিশ্চিত হবে।
এই অধিবেশনের নাম হতে পারে হ্যাপিনেস অধিবেশন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments