চারদিক-ভাষার জন্য স্কুল

মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন ছোট-বড় প্রায় সবাই। সেই ভাষার লিপি বা বর্ণমালাও আছে। কিন্তু সেই বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় আছে হাতেগোনা দু-চারজনের। এ কারণে তারা শঙ্কিত—হয়তো একদিন তাদের কাছ থেকে তাদের মায়ের ভাষাটি হারিয়ে যাবে। যাঁরা ভাষা নিয়ে ভাবেন, তাঁদের অনেককেই বিষয়টি পীড়া দেয়, উদ্বিগ্ন করে।


তাঁদের নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি আছে, ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। শুধু নিজের ভাষায় লিখতে ও পড়তে না পারার বেদনাটা তাঁরা নীরবে মনের ভেতর বহন করছেন। কিন্তু এই বেদনাটা আর বহন করতে হয়তো পারছেন না। যে কারণে কারও (ব্যক্তি বা রাষ্ট্র) অপেক্ষা করেননি তাঁরা। যে ভাষা এত দিন বাংলা হরফে লিখে গেছেন। সেই ভাষাটি তাঁরা আপন হরফেই লিখতে ও পড়তে এবার হাতেখড়ি দানের উদ্যোগ নিয়েছেন নিজেরাই।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর একটি মণিপুরি অধ্যুষিত এলাকা। সেখানেই মণিপুরি ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে চালু হয়েছে ‘মণিপুরি স্কুল’। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অন্যতম মণিপুরিরা বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে এ দেশে বসবাস করছে। সমৃদ্ধ একটি সংস্কৃতির মতো প্রাচীনতা ও উৎকর্ষের গৌরবে ঋদ্ধ মণিপুরিদের নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্যের এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য আছে; আছে মণিপুরী ভাষার স্বতন্ত্র একটি বর্ণমালাও। তাই মণিপুরি ভাষার মূলধারার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এ দেশেও মণিপুরি লিপি ও ভাষার চর্চা এবং বিকাশ দরকার। আপাতত সপ্তাহে এক দিন এই স্কুলে মণিপুরি বর্ণমালা ও ভাষার পাঠ দেওয়া হবে। ১৭ ফেব্রুয়ারি আদমপুর বাজারের শ্রীসানাঠাকুর মণ্ডপে মায়ের ভাষা চালুর আকুতি নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন নানা বয়সের অনেকে। মণিপুরি ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কবি এ কে শেরাম বলেন, ‘সামান্য ঘটনা বিশাল ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। লিপি ও ভাষা শিক্ষার উদ্যোগ সে রকম একটি ঘটনা। মণিপুরি ভাষা একটি প্রাচীনতম ভাষা—যার লিখিত রূপ পাওয়া গেছে অষ্টম শতাব্দীতে। এই ভাষার ইতিহাস প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের। তবু নতুন প্রজন্মের অনেকে মাতৃভাষা ভালোভাবে বলতে ও লিখতে পারে না। পারিবারিকভাবে কথা বললেও এই ভাষা চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সুযোগ নেই। এখানে বাংলা ভাষায় সবাই কবিতা লিখছে, পড়ছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেলে ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে।’ তিনি জানান, মণিপুরি (মৈতৈ) ও পাঙান (মণিপুরি মুসলিম)—এই দুই সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ হাজার মানুষ একই ভাষাভাষী। কিন্তু মণিপুরি ভাষার লিপি থাকা সত্ত্বেও তা না জানার কারণে এই ভাষাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু চর্চা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে এখানে এই ভাষা একটি ক্ষয়িষ্ণু ভাষা। প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর কাছে তার মাতৃভাষা একটি আবেগের বিষয়। ভাষার জন্য জীবন দিতেও কেউ কুণ্ঠাবোধ করে না (যেমন—বাংলা ভাষা ও বাঙালি উদাহরণ)। এ কে শেরাম জানান, মণিপুরে (ভারতের একটি রাজ্য) এখন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মণিপুরি ভাষায় লেখা ও চর্চা হচ্ছে। যদি মণিপুরি ভাষা জানা না থাকে, তাহলে একসময় এই অঞ্চলের মণিপুরিরা মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। কবি এল পদ্মামনী দেবী বলেন, ‘মণিপুরি ভাষার একটা স্কুল হচ্ছে। এটা খুবই খুশির একটি ঘটনা।’ বাংলা ভাষার মূল স্রোতে টিকে থাকতে অনেকেই তাঁর নিজের ভাষাটাকে ভুলে যাচ্ছেন বা ভুলতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনটাই মনে হলো তেতইগাঁও রশিদ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল মতিনের কথায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্কুলের প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই মণিপুরি। কিন্তু এখানে মণিপুরি ভাষা শেখার সুযোগ নেই। বরং আমাদের চেষ্টা থাকে, মণিপুরি ভাষা যাতে স্কুলে ব্যবহার না করে বাংলা ভাষা ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে।’
কবি এ কে শেরাম মণিপুরি ভাষা শেখার জন্য ‘ময়েক মপী’ নামে একটি বর্ণমালার সহজপাঠ্য বই লিখেছেন। মণিপুরি ভাষায় ২৭টি বর্ণ আছে। প্রতিটি বর্ণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন—মণিপুরি ভাষায় ‘কোক’। বাংলায় প্রতিবর্ণ হচ্ছে ‘ক’; যার অর্থ মাথা। তেমনই—‘সম’। বাংলা প্রতিবর্ণ হচ্ছে ‘স’; যার অর্থ চুল। এভাবে প্রতিটি বর্ণের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। মণিপুরি স্কুলের একজন শিক্ষক শিল্পী কন্তৌজম বলেন, ‘আমাদের একটা ভাষা আছে। বর্ণমালা আছে। কিন্তু আমরা তা পড়তে-লিখতে পারি না। এটা কষ্টের।’ আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ভূঁইয়া বলেন, ‘স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার যতটুকু সহযোগিতা দরকার; আমি তা করব।’ কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের কাছে, শিকড়ের কাছে যেতে হবে। নিজেদের ভাষা হারালে আর দুর্ভাগ্যের কিছু থাকবে না। সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের দিক থেকে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।’
মায়ের ভাষায় কথা বলার এই উদ্যোগটি সবার মধ্যে তৈরি করেছিল হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার আনন্দ—যে আনন্দ আসলে যেকোনো ভাষাভাষীরই, মাতৃকোল ফিরে পাওয়ার আনন্দ!
আকমল হোসেন: মৌলভীবাজার প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.