সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র-বাপেক্সের পরিকল্পনা অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ জরুরি by কল্লোল মোস্তফা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সামপ্রতিক আবিষ্কৃত বিপুল সম্ভাবনাময় সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কা দানা বাঁধছে। সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান কূপ ও উন্নয়ন কূপ খননের যে পরিকল্পনা বাপেক্স করেছিল, সে অনুযায়ী মূল কাজগুলো এখনো শুরু করতে পারছে না বাপেক্স।
ইট বিছানো একটা অর্ধকাঁচা রাস্তা তৈরি এবং অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য দুই বছরের জন্য জমি ভাড়া নিয়ে তার চারপাশটা ইটের নিচু দেয়াল চিহ্নিত করা ছাড়া তেমন কোনো কাজই এখনো শুরু হয়নি সুনেত্র অঞ্চলে।
অথচ বাপেক্সের প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১১ সালের আগস্টের মধ্যেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা এবং ড্রিল সাইটে সেগুলো স্থাপন করার কাজ সম্পন্ন করে অক্টোবরের মধ্যেই ড্রিলিংয়ের কাজ শুরু করার কথা, যেন ২০১২ সালের এপ্রিলের মধ্যেই অনুসন্ধান কূপ সুনেত্র-১ খনন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু বাপেক্স সেই কাজটুকু শুরুই করতে পারেনি। কারণ, বাপেক্সের সেই পরিকল্পনাটি অনুমোদন ও সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০১০ সালের অক্টোবরে বাপেক্সের তৈরি করা একটি অনুসন্ধান কূপ ও তিনটি উন্নয়ন কূপ খনন করার এই পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার পর শুধু একটি অনুসন্ধান কূপ খননের নতুন আরেকটি পরিকল্পনা গত আগস্টে পেট্রোবাংলার কাছে জমা দিয়েছে বাপেক্স।
সুনেত্র কথা: বাপেক্স আবিষ্কৃত ‘সুনেত্র’ গ্যাসক্ষেত্রটি দেশের গ্যাস ব্লক ১১ ও ১২-তে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে অবস্থিত। ক্ষেত্রটি ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৫৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বিবিয়ানা থেকে ৬৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গ্যাসসমৃদ্ধ সুরমা বেসিনের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। ২০০৯-১০ সালে বাপেক্সের ভূ-পদার্থিক বিভাগ সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা এলাকায় মোট ২৫৯ লাইন-কি.মি. দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে গ্যাসক্ষেত্রটি চিহ্নিত করে। নিকটস্থ বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করে বাপেক্স ক্ষেত্রটির সম্ভাব্য মজুদ নির্ধারণ করেছে ২ দশমিক ৪৭ টিসিএফ? যদিও বিবিয়ানার বেলায়ও প্রথমে ২ দশমিক ৫ টিসিএফ মজুদের কথা বলা হয়েছিল, পরে সেটা বেড়ে ৪ টিসিএফের বেশি হয়েছে। সে হিসাবে অনেকেই ৪ থেকে ৫ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন। উল্লেখ্য, ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার যৌথ একটি সমীক্ষা অনুসারে যে সুরমা বেসিন এলাকায় সুনেত্র অবস্থিত, সেখানে এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ ১ দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ১৪ টিসিএফ হতে পারে।
বাপেক্সের মূল প্রস্তাব: ২০১০ সালের ২৬ জুলাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ‘সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা (সুনেত্র) ভূ-গঠন এর ভূতাত্ত্বিক মূল্যায়ন’-এর ওপর অনুষ্ঠিত কারিগরি সভায় বাপেক্সের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বলা হয় যে ‘ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) চূড়ান্তকরত মার্চ-এপ্রিল ২০১১-এর মধ্যে সুনেত্র অনুসন্ধান কূপ নম্বর-১-এর খননের কাজ শুরু করার লক্ষ্যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা (Phase I)’ হবে। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ‘গ্যাস আবিষ্কৃত হলে একই ডিপিপির অধীনে দ্বিতীয় পর্যায়ের (Phase II) কার্যক্রম হিসেবে তিনটি উন্নয়ন কূপ খনন করা এবং প্রসেস প্ল্যান্ট ও পাইপলাইন স্থাপন করা’ হবে।
ওই নির্দেশনার আলোকে প্রথম পর্যায়ে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুসন্ধান কূপ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি উন্নয়ন কূপ খননের ডিপিপি গত ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু আশঙ্কাজনক খবর হচ্ছে বাপেক্সের এই একটি অনুসন্ধান কূপ ও তিনটি উন্নয়ন কূপ খননের ডিপিপিটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
বাপেক্সের প্রস্তাব বাতিল: গত ৬ জুলাই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.১: ‘১ম পর্যায় (Phase I)-এর জন্য আলাদা ডিপিপি প্রণয়নকরত এ বিভাগে প্রেরণ করতে হবে।’ সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.৭: ‘প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজের সফলতার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের ২য় পর্যায়ের (Phase I) ডিপিপি প্রণয়ন করে পেট্রোবাংলা এ বিভাগে প্রেরণ করবে। ২য় পর্যায়ের ডিপিপিতে তিনটি উন্নয়ন কূপ খননসহ গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্ট এবং গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিকটবর্তী জাতীয় গ্যাস গ্রিড পর্যন্ত সংযোগ লাইন স্থাপন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
লক্ষণীয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আলাদা ডিপিপি তৈরির এই সিদ্ধান্তটি ২০১০ সালের ২৬ জুলাই নেওয়া সিদ্ধান্ত ৩-এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। নতুন এই সিদ্ধান্তের আলোকে গত আগস্টে বাপেক্স থেকে পুনরায় শুধু একটি অনুসন্ধান কূপের জন্য ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়, যার প্রকল্প ব্যয় ৮৩ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সভায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নিয়েও একটি সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে বলা হয়: ‘গ্যাস উন্নয়ন নীতিমালা সংশোধনের নিমিত্তে বিইআরসিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিনিধিদের নিয়ে এ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.৬)
পরবর্তী সময়ে গত ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক সভায় বর্তমান গ্যাস উন্নয়ন তহবিলটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, এভাবে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাতে গেলে অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে, যার ফলে গ্যাস উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ দ্রুত বরাদ্দের যে উদ্দেশ্য নিয়ে গত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কর্তৃক এই তহবিলটি তৈরি হয়েছিল, সেটি ব্যাহত হবে। আর সুনেত্র প্রকল্পটি যেহেতু গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের ওপর নির্ভরশীল সুতরাং একদিকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের নিয়ন্ত্রণ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে বাপেক্সের মূল পরিকল্পনাটি দ্রুত অনুমোদন না করে উল্টো পৃথকভাবে শুধু অনুসন্ধান কূপের জন্য নতুন একটি ডিপিপি তৈরি করানোর বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরবর্তী সময়ে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজন দেখিয়ে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মতো কোনো প্রকল্পের আওতায় স্থলভাগের এই সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নের কাজও বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্ট হচ্ছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশি কোম্পানি ও বাড়তি খরচ: বাপেক্সসংশ্লিষ্টদের অনেকের আশঙ্কা, বাপেক্সের করা ডিপিপি থেকে দ্বিতীয় পর্যায় বাদ দিয়ে শুধু প্রথম পর্যায়ের একটি নতুন ডিপিপি তৈরি করে পেট্রোবাংলায় পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি কূপ খননের কাজ যেন রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম (Gazprom)-এর কাছে কন্ট্রাক্ট দেওয়া যায়। ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলা ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রামের আওতায় কোনো দরপত্র ব্যতিরেকে সরাসরি গ্যাজপ্রমকে ১০টি কূপ খননের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানে পেট্রোবাংলা প্রস্তাবিত ৯০ কোটি টাকার বিপরীতে প্রতিটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রম দাবি করেছে ১৪৫ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা! অথচ এক একটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের গড়ে ৭০-৮০ কোটি টাকার বেশি লাগে না। বাপেক্সের সুনেত্র প্রস্তাবে সম্ভাব্য ৭৯ কোটি টাকার খরচের হিসাব ছাড়াও দেখা যায় সম্প্রতি সমাপ্ত সুন্দলপুর অনুসন্ধান কূপ খননের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৭৩ কোটি টাকা। এভাবে বিদেশি কোম্পানি সিসমিক সার্ভে থেকে শুরু করে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ খনন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই কয়েক গুণ বাড়তি অর্থ আদায় করে। যেমন প্রতি লাইন কিলোমিটার সিসমিক সার্ভের জন্য বিদেশি কোম্পানি যেখানে ছয় লাখ ৫৩ হাজার টাকা করে খরচ দেখায়, বাপেক্সের সেখানে খরচ হয় গড়ে এক লাখ টাকা করে। সুনেত্র ক্ষেত্রের বেলায় মোট ২৫৯ লাইন-কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক সিসমিক সার্ভের জন্য বাপেক্সের মোট খরচ হয়েছে ৩ দশমিক ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি লাইন-কিলোমিটারে খরচ এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে এ কাজটি করানো হলে কমপক্ষে ১৭ কোটি টাকা লাগত।
কাজেই ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত সালদা নদী, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন ছাড়াও সামপ্রতিক সুন্দলপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাপেক্সের পরীক্ষামূলক গ্যাস উত্তোলন কিংবা বহুজাতিক টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় সিসমিক সার্ভে ও বাঙ্গোরায় ওয়ার্কওভার কূপ খননের সফলতা, বিদেশি কোম্পানির তুলনায় বহুগুণ কম খরচ, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, মাগুরছড়া-টেংরাটিলার মতো দুর্ঘটনা না ঘটানো ইত্যাদি বিষয় যদি বিবেচনায় রাখি, তাহলে কেবল সুনেত্র নয়, বাংলাদেশের কোনো গ্যাসক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের বদলে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কোনো ধরনের কাজ করানোর যৌক্তিকতা থাকে না। সে হিসেবে জাতীয় স্বার্থে বিপুল সম্ভাবনাময় সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রের সম্পূর্ণ কাজের জন্য বাপেক্সের নিয়োগ নিশ্চিত করে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়াই প্রত্যাশিত।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী।
অথচ বাপেক্সের প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০১১ সালের আগস্টের মধ্যেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা এবং ড্রিল সাইটে সেগুলো স্থাপন করার কাজ সম্পন্ন করে অক্টোবরের মধ্যেই ড্রিলিংয়ের কাজ শুরু করার কথা, যেন ২০১২ সালের এপ্রিলের মধ্যেই অনুসন্ধান কূপ সুনেত্র-১ খনন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। কিন্তু বাপেক্স সেই কাজটুকু শুরুই করতে পারেনি। কারণ, বাপেক্সের সেই পরিকল্পনাটি অনুমোদন ও সে অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ২০১০ সালের অক্টোবরে বাপেক্সের তৈরি করা একটি অনুসন্ধান কূপ ও তিনটি উন্নয়ন কূপ খনন করার এই পরিকল্পনা বাতিল হওয়ার পর শুধু একটি অনুসন্ধান কূপ খননের নতুন আরেকটি পরিকল্পনা গত আগস্টে পেট্রোবাংলার কাছে জমা দিয়েছে বাপেক্স।
সুনেত্র কথা: বাপেক্স আবিষ্কৃত ‘সুনেত্র’ গ্যাসক্ষেত্রটি দেশের গ্যাস ব্লক ১১ ও ১২-তে সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে অবস্থিত। ক্ষেত্রটি ছাতক গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৫৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বিবিয়ানা থেকে ৬৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে গ্যাসসমৃদ্ধ সুরমা বেসিনের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। ২০০৯-১০ সালে বাপেক্সের ভূ-পদার্থিক বিভাগ সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা এলাকায় মোট ২৫৯ লাইন-কি.মি. দ্বিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপের মাধ্যমে গ্যাসক্ষেত্রটি চিহ্নিত করে। নিকটস্থ বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনা করে বাপেক্স ক্ষেত্রটির সম্ভাব্য মজুদ নির্ধারণ করেছে ২ দশমিক ৪৭ টিসিএফ? যদিও বিবিয়ানার বেলায়ও প্রথমে ২ দশমিক ৫ টিসিএফ মজুদের কথা বলা হয়েছিল, পরে সেটা বেড়ে ৪ টিসিএফের বেশি হয়েছে। সে হিসাবে অনেকেই ৪ থেকে ৫ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন। উল্লেখ্য, ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার যৌথ একটি সমীক্ষা অনুসারে যে সুরমা বেসিন এলাকায় সুনেত্র অবস্থিত, সেখানে এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ ১ দশমিক ৮ থেকে ৮ দশমিক ১৪ টিসিএফ হতে পারে।
বাপেক্সের মূল প্রস্তাব: ২০১০ সালের ২৬ জুলাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ‘সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনা (সুনেত্র) ভূ-গঠন এর ভূতাত্ত্বিক মূল্যায়ন’-এর ওপর অনুষ্ঠিত কারিগরি সভায় বাপেক্সের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুনেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তে বলা হয় যে ‘ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) চূড়ান্তকরত মার্চ-এপ্রিল ২০১১-এর মধ্যে সুনেত্র অনুসন্ধান কূপ নম্বর-১-এর খননের কাজ শুরু করার লক্ষ্যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করা (Phase I)’ হবে। আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ‘গ্যাস আবিষ্কৃত হলে একই ডিপিপির অধীনে দ্বিতীয় পর্যায়ের (Phase II) কার্যক্রম হিসেবে তিনটি উন্নয়ন কূপ খনন করা এবং প্রসেস প্ল্যান্ট ও পাইপলাইন স্থাপন করা’ হবে।
ওই নির্দেশনার আলোকে প্রথম পর্যায়ে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুসন্ধান কূপ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি উন্নয়ন কূপ খননের ডিপিপি গত ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু আশঙ্কাজনক খবর হচ্ছে বাপেক্সের এই একটি অনুসন্ধান কূপ ও তিনটি উন্নয়ন কূপ খননের ডিপিপিটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
বাপেক্সের প্রস্তাব বাতিল: গত ৬ জুলাই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.১: ‘১ম পর্যায় (Phase I)-এর জন্য আলাদা ডিপিপি প্রণয়নকরত এ বিভাগে প্রেরণ করতে হবে।’ সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.৭: ‘প্রকল্পের ১ম পর্যায়ের কাজের সফলতার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পের ২য় পর্যায়ের (Phase I) ডিপিপি প্রণয়ন করে পেট্রোবাংলা এ বিভাগে প্রেরণ করবে। ২য় পর্যায়ের ডিপিপিতে তিনটি উন্নয়ন কূপ খননসহ গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্ট এবং গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিকটবর্তী জাতীয় গ্যাস গ্রিড পর্যন্ত সংযোগ লাইন স্থাপন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’
লক্ষণীয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আলাদা ডিপিপি তৈরির এই সিদ্ধান্তটি ২০১০ সালের ২৬ জুলাই নেওয়া সিদ্ধান্ত ৩-এর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। নতুন এই সিদ্ধান্তের আলোকে গত আগস্টে বাপেক্স থেকে পুনরায় শুধু একটি অনুসন্ধান কূপের জন্য ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়, যার প্রকল্প ব্যয় ৮৩ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সভায় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নিয়েও একটি সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে বলা হয়: ‘গ্যাস উন্নয়ন নীতিমালা সংশোধনের নিমিত্তে বিইআরসিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিনিধিদের নিয়ে এ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা আয়োজনের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪.৬)
পরবর্তী সময়ে গত ৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক সভায় বর্তমান গ্যাস উন্নয়ন তহবিলটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশঙ্কা, এভাবে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাতে গেলে অহেতুক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে, যার ফলে গ্যাস উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ দ্রুত বরাদ্দের যে উদ্দেশ্য নিয়ে গত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) কর্তৃক এই তহবিলটি তৈরি হয়েছিল, সেটি ব্যাহত হবে। আর সুনেত্র প্রকল্পটি যেহেতু গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের ওপর নির্ভরশীল সুতরাং একদিকে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের নিয়ন্ত্রণ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে বাপেক্সের মূল পরিকল্পনাটি দ্রুত অনুমোদন না করে উল্টো পৃথকভাবে শুধু অনুসন্ধান কূপের জন্য নতুন একটি ডিপিপি তৈরি করানোর বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পরবর্তী সময়ে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রয়োজন দেখিয়ে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মতো কোনো প্রকল্পের আওতায় স্থলভাগের এই সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নের কাজও বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্ট হচ্ছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশি কোম্পানি ও বাড়তি খরচ: বাপেক্সসংশ্লিষ্টদের অনেকের আশঙ্কা, বাপেক্সের করা ডিপিপি থেকে দ্বিতীয় পর্যায় বাদ দিয়ে শুধু প্রথম পর্যায়ের একটি নতুন ডিপিপি তৈরি করে পেট্রোবাংলায় পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের তিনটি কূপ খননের কাজ যেন রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম (Gazprom)-এর কাছে কন্ট্রাক্ট দেওয়া যায়। ইতিমধ্যে পেট্রোবাংলা ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রামের আওতায় কোনো দরপত্র ব্যতিরেকে সরাসরি গ্যাজপ্রমকে ১০টি কূপ খননের যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেখানে পেট্রোবাংলা প্রস্তাবিত ৯০ কোটি টাকার বিপরীতে প্রতিটি কূপ খননের জন্য গ্যাজপ্রম দাবি করেছে ১৪৫ দশমিক ৭৮ কোটি টাকা! অথচ এক একটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের গড়ে ৭০-৮০ কোটি টাকার বেশি লাগে না। বাপেক্সের সুনেত্র প্রস্তাবে সম্ভাব্য ৭৯ কোটি টাকার খরচের হিসাব ছাড়াও দেখা যায় সম্প্রতি সমাপ্ত সুন্দলপুর অনুসন্ধান কূপ খননের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৭৩ কোটি টাকা। এভাবে বিদেশি কোম্পানি সিসমিক সার্ভে থেকে শুরু করে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কূপ খনন পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই কয়েক গুণ বাড়তি অর্থ আদায় করে। যেমন প্রতি লাইন কিলোমিটার সিসমিক সার্ভের জন্য বিদেশি কোম্পানি যেখানে ছয় লাখ ৫৩ হাজার টাকা করে খরচ দেখায়, বাপেক্সের সেখানে খরচ হয় গড়ে এক লাখ টাকা করে। সুনেত্র ক্ষেত্রের বেলায় মোট ২৫৯ লাইন-কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক সিসমিক সার্ভের জন্য বাপেক্সের মোট খরচ হয়েছে ৩ দশমিক ৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি লাইন-কিলোমিটারে খরচ এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে এ কাজটি করানো হলে কমপক্ষে ১৭ কোটি টাকা লাগত।
কাজেই ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত সালদা নদী, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন ছাড়াও সামপ্রতিক সুন্দলপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে বাপেক্সের পরীক্ষামূলক গ্যাস উত্তোলন কিংবা বহুজাতিক টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় সিসমিক সার্ভে ও বাঙ্গোরায় ওয়ার্কওভার কূপ খননের সফলতা, বিদেশি কোম্পানির তুলনায় বহুগুণ কম খরচ, বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, মাগুরছড়া-টেংরাটিলার মতো দুর্ঘটনা না ঘটানো ইত্যাদি বিষয় যদি বিবেচনায় রাখি, তাহলে কেবল সুনেত্র নয়, বাংলাদেশের কোনো গ্যাসক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের বদলে বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে কোনো ধরনের কাজ করানোর যৌক্তিকতা থাকে না। সে হিসেবে জাতীয় স্বার্থে বিপুল সম্ভাবনাময় সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্রের সম্পূর্ণ কাজের জন্য বাপেক্সের নিয়োগ নিশ্চিত করে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়াই প্রত্যাশিত।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী।
No comments