সনদ বিড়ম্বনা-আইন পেশার উৎকর্ষসাধন অতি জরুরি by শাহ্দীন মালিক
১২ এপ্রিল ২০১২ সালের প্রথম আলোর ১২ পৃষ্ঠায় ‘বার কাউন্সিলের সনদ-বিড়ম্বনা’ শিরোনামের লেখাটির শেষে লেখক-পরিচয়ে আছে ‘লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী’।আদিলুর রহমান, নীলা চৌধুরী, কণা ভৌমিক, মো. সাইফুল ইসলাম, আশরাফুজ্জামান সেলিম ও রিক্তা পালের যৌথ লেখাটি তাদের বক্তব্য ও যুক্তি খুবই
সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। যে শিক্ষার্থীরা এত গুছিয়ে অল্প কথায় সব যুক্তি তুলে ধরতে পারে, তারা ভবিষ্যতে পেশায় নিশ্চয় সাফল্য পাবে। স্পষ্টত, বার কাউন্সিলের আইনজীবী-সনদ পরীক্ষা-সংক্রান্ত বেশকিছু ব্যাপার তাদের কাছে বিড়ম্বনা মনে হয়েছে এবং একই অবস্থায় বা একই ধরনের বিড়ম্বনার শিকার অন্য বহুজনের মতো আমার কিছু করার নাই বলে চুপচাপ তারা বসে ছিল। না না এতে আমার নিজের স্বার্থ জড়িত তাই আমি ঝামেলায় কেন জড়াব—এ গোছের অবস্থান না নিয়ে ‘বার কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সযত্ন দৃষ্টি আকর্ষণ’ করার চেষ্টা করেছে। এটা খুবই ভালো কাজ।
আমি কোনো কর্তৃপক্ষ নই, বার কাউন্সিলেরও কেউ না, বার্ষিক চাঁদা দেওয়া সদস্য ছাড়া। তবে আইন শিক্ষা, আইন পেশা, আইন ও বিচার সম্পর্কে যেহেতু প্রায়শই অযথা চেঁচামেচি করতে করতে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেহেতু অভ্যাস দোষেই এই প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার কিছু না কিছু অংশ কোনো শিক্ষার্থী আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের সদস্যের মতের সঙ্গে মিলবে না, হয়তো তাঁরা গোস্সা করবেন। কী আর করা!
২.
আইন পেশা ও আইন শিক্ষা—দুটোর অবস্থাই ভালো না। ভালো না মানে খারাপ—সে অর্থে না। ভালো না মানে—আরও অনেক ভালো করতে হবে। এখন বার কাউন্সিলে আইনজীবী-সনদ পরীক্ষার মৌখিক পর্ব চলছে। সনদ পাওয়ার পর নামের পাশে ‘অ্যাডভোকেট’ কথাটা লেখা যাবে। ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দটা লিখতে হবে নামের পরে। আজকালকার মন্ত্রীদের মতো নামের আগে না। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় নামের আগে ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দ অর্থাৎ আইন পেশায় অ্যাডভোকেট হিসেবে নিয়োজিত আছেন বলে জাহির করা বার কাউন্সিলের বিধান লঙ্ঘন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ দেশে মন্ত্রী হওয়া মানে তো আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া। হয়তো মন্ত্রীদের তোষামোদকারী ও চাটুকারেরা তাঁদের মন্ত্রীদের ‘নাম কাটাবার জন্য’ মন্ত্রীর নমের আগে অ্যাডভোকেট কথাটা জুড়ে দিতে গিয়ে ভুলে গেছে যে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আইনজীবী সনদ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার কথা। অর্থাৎ যত দিন মন্ত্রী তত দিন অ্যাডভোকেট হিসেবে কোর্টে মামলা করা যাবে না। বার কাউন্সিলের বিধানে নিষেধ আছে।
যাক গে। আইন শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এখন সাকল্যে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা আইনের ডিগ্রি লাভ করেছে। বছর তিনেক আগে জগন্নাথ আর এ বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর অর্থাৎ এখন সাকল্যে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, বড় সরকারি কলেজ, কোথাও সরকার আইন পড়ানোর ব্যবস্থা করেনি। আইন শিক্ষায় সরকারের অনীহার ফলে সৃষ্ট সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ভূরি ভূরি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। টাকা নিয়ে গেলেই ভর্তি হওয়া যায় আর চার বছর পর এলএলবি ডিগ্রি পাওয়া যায়। এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমী মেধাবী শিক্ষার্থী ও কিছু শিক্ষক নিশ্চয়ই আছেন। তবে যে লেখার প্রতিক্রিয়ায় আমার এ লেখা, সেটাতে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যেটা বলা হয়নি তা হলো বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট সনদ প্রার্থী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংখ্যাধিক্যতাই এখন বার কাউন্সিলেরও সম্ভবত বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের ২২ এপ্রিল বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের এই জানুয়ারি। সেই লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল আইনের ডিগ্রি পাওয়া কম-বেশি আট হাজার পরীক্ষার্থী। যত দূর শুনেছি, আট হাজারের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় হাজার তিনেক। প্রায় ১০টা বোর্ড এখন প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাজার তিনেক সনদপ্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছে। বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যই মাননীয় বিচারপতিরা। এত ‘ইন্টারভিউ’ নিতে নিতে তাঁরা হয়তো গলদঘর্ম। তবে দৈনন্দিন বিচারিক কাজের পর আগে পরীক্ষার খাতা দেখা, এখন মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া—এ দায়িত্ব তাঁরা যে নিয়েছেন এ জন্য আমরা নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ।
গতবার যেহেতু পরীক্ষার্থী ছিল আট হাজার, এবার সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজারে দাঁড়ালে মোটেও বিস্মিত হব না। আগেই বলেছি, এলএলবি সার্টিফিকেট দেওয়ার লোকের অভাব নেই। ইদানীং আবার ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ল কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে একবারে খাস বিলেতি এলএলবি ডিগ্রিও দিচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো আইন না পড়েই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে সনদ পেয়ে বাংলাদেশের কোর্টে কাজ করবে।
দেশে এখন নিবন্ধিত আইনজীবীর সংখ্যা ৪৬ হাজারের কিছু বেশি। এবার যারা মৌখিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ আসছে মার্চে বার কাউন্সিলের পরবর্তী যে পরীক্ষা-প্রক্রিয়া শুরু হবে, তাতে পরীক্ষার্থী ১০ হাজার হলে দেশে নিবন্ধিত আইনজীবীর সংখ্যা শিগগিরই ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এত জায়গা থেকে এত সহজে ল ডিগ্রি পাওয়া গেলে প্রতিবছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হু হু করে বাড়বে।
কিন্তু দেশে মামলার সংখ্যা কি বাড়ছে? বাড়ছে না। সারা দেশের সব আদালতে সব ধরনের যত মামলা দায়ের হয় তার সংখ্যা গত পাঁচ বছর ধরে ১০ থেকে ১১ লাখের মধ্যে ওঠানামা করছে। বড় দাগে হিসাব মেলানোর সুবিধার্থে যদি বলি তাহলে বলব, প্রতিবছর নতুন ১০ লাখ মামলা দায়ের হয়। এর অন্তত অর্ধেক মামুলি মামলা। ছোটখাটো অপরাধ, ৫০-৭০ হাজার টাকার দাবিদাওয়া, মাসিক দুই হাজার টাকা খোরপোশ ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব মামলার পেছনে মক্কেল হাজার হাজার টাকা খরচ করে না—কিছু ব্যতিক্রমী ছাড়া।
১০ লাখ মামলার পেছনে আছে—আবার বড় দাগে—৫০ হাজার আইনজীবী। গড়ে বছরে জুটবে ২০ মামলা। আইনজীবী-প্রতি মাসে দুটোরও কম মামলা।
মোদ্দা কথা, যদি গত পাঁচ বছরে দেশে মোট মামলার সংখ্যা না বাড়ে তাহলে আইনজীবীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?
দুনিয়ার অন্যান্য দেশের বার কাউন্সিল এসবের হিসাব রাখে। যারা পেশায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, তাদের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। নবীন কোনো আইনজীবী সনদ পাওয়ার দুই-তিন বছর পরে যদি উচ্চতর কোনো ট্রেনিং অথবা আরও পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে তার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ পেশাগত উৎকর্ষের কোনো পথ কারও জন্য খোলা নেই।
বার কাউন্সিল এসব ব্যাপারে কিছুই করে না বা করতে পারে না। তার প্রধান এবং সম্ভবত একমাত্র কারণ হলো, সারা দেশের সব আইনজীবীর ভোটে তিন বছরের যে ১৪ জন আইনজীবী নির্বাচিত হয়ে বার কাউন্সিল গঠন করেন, তাঁরা তাঁদের তিন বছরের মেয়াদকালে পূর্ণোদ্যমে আইন পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এমনিতেই প্রসিদ্ধ-খ্যাত-বিখ্যাত আইনজীবী, তারপর বার কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতা। তিন বছরের মেয়াদকালে, বলা বাহুল্য, পেশাগত ব্যস্ততা অন্তত দ্বিগুণ হয়।
আগেও ব্যস্ত ছিলেন এখন অতি ব্যস্ত। বার কাউন্সিলের কাজে সময় দেওয়ার সময় কোথায়? বরং চেষ্টা-তদবির করে নবীনদের আইনজীবীর কাতারে তালিকাভুক্ত করলে নিজের ও দলের ভোট বাড়বে।
বার কাউন্সিল এভাবে চলতে পারে না। ১৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে যে পাঁচজন বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, অন্তত তাঁদের মেয়াদকালে পেশা থেকে বিরত থেকে বার কাউন্সিল তথা সব আইনজীবী, দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার মঙ্গল ও উন্নতি সাধনে মনোনিবেশ করা উচিত। অন্তত মেয়াদের তিন বছরে নতুন কোনো মামলা নেবেন না এই নিষেধাজ্ঞা অত্যাবশ্যক। জানামতে, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা বেশ কয়েক বছর ধরে পদে থাকা অবস্থায় নতুন মামলা না নেওয়ার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বার কাউন্সিলের, সুপ্রিম কোর্ট এবং ঢাকা বার সমিতির নির্বাচিত নেতাদের এখনই মেনে চলা দরকার। যাঁরা এতটুকু স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না, তাঁদের সঙ্গে চাঁদাবাজি করা আর ফায়দা লোটা তথাকথিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কী পার্থক্য থাকল।
নেতার বার কাউন্সিলে সময় কাটালে বিচারব্যবস্থায় কীভাবে উন্নতি হবে, মামলা-জট কীভাবে কমবে, সংসদে কোন আইন পাস হওয়া দরকার আর বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষা কীভাবে ভালো হয়—সবই হবে।
৩.
যে লেখার প্রতিক্রিয়ায় এত কথা, সেই আইন শিক্ষার্থী-লেখকেরা মোটেও প্রীত হবেন না যদি বলি আইন পেশায় অন্তত তিন বছর সঠিকভাবে নিয়োজিত না থেকে বিচারক পদে পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হওয়া উচিত নয়। এলএলবি পাস করে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উতরে গিয়ে ২৩-২৪ বছরে বিচারক হয়ে যাওয়া—বাস্তবতার নিরিখে খুবই বেমানান। ২৩ বছরে অনেক আইন মুখস্থ করা যায়, আইনের বড় বড় বইও রপ্ত করা যায় কিন্তু জীবন বোঝা যায় না। জীবন বোঝা না গেলে ন্যায়বিচার করা যায় না। ন্যায়বিচার না হলে সমাজ টেকে না। ২৫ বছর বয়সে কোর্টে ২৫ বছর প্র্যাকটিস করা পঞ্চাশোর্ধ্ব আইনজীবীকে মোকাবিলা করা যায় না।
যা হওয়ার হয়েছে এখন নিম্ন আদালতে বিচারকের ন্যূনতম বয়স বা তিন বছরের আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা, উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে।
আগামী বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার দশেক হবে। চাকরির অন্যান্য পরীক্ষার জন্য প্রথমে এমসিকিউ অর্থাৎ মালটিপল চয়েস পরীক্ষা নিয়ে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। এখনকার ছেলেমানুষী তিন ঘণ্টার শুধু একটা পরীক্ষার পরিবর্তে অন্তত পাঁচটা বিষয়ে ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হবে। সব চাকরিতে যেমন আগেভাগেই ঘোষণা করা হয় ১০০ বা ২০০ জন নিয়োগ করা হবে, সেভাবে প্রতিবছর হিসাব করে বার কাউন্সিলকে ঘোষণা দিতে নতুন কতজন আইনজীবীকে সনদ দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি সবই মেধার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ প্রথম ১০০ বা ৫০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, বার কাউন্সিলকেও সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বার কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতাদের তাঁদের মেয়াদকালে নতুন কোনো মামলা না নিয়ে বার কাউন্সিলের কাজে সময় দেওয়া। সময় দিতে না পারলে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
মামলা থেকে আইনজীবীর সংখ্যা বেশি। আইন পড়ানোর সবটাই তাত্ত্বিক। আদালতের আইনের সঙ্গে যা পড়ানো হয়, তার মিল নেই বললেই চলে। আইনজীবী এ মাসে নতুন কোন মক্কেল পাননি, তাই পুরোনো মামলা জিইয়ে রাখতে হবে। ফলে মিথ্যা মামলা বাড়ছে, মামলা দীর্ঘায়িত হচ্ছে, দুর্নীতি বাড়ছে। মামলার খোঁজে দিগিবদিক শূন্য হয়ে দৌড়াদৌড়ি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে না জেনে, না বুঝে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ৭০-৮০টা প্রাইভেট ল কলেজে ভর্তি হচ্ছে।
পেশাটার বারোটা বাজার আগে নেতাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে কোর্টে রাজনৈতিক নেতাদের মামলার দিনে মিছিল, বিক্ষোভ এবং এসব ঘটনায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ব্যস্ত আইনজীবীদের সংখ্যাই কেবল বাড়বে। কোর্টে আসা আইনের আশ্রয়প্রার্থী মক্কেল হয়ে যাবে খদ্দের।
ব্যবস্থাপত্র কম-বেশি সবারই জানা। দরকার ব্যবস্থাপত্র বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত।
ড. শাহ্দীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট; পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি কোনো কর্তৃপক্ষ নই, বার কাউন্সিলেরও কেউ না, বার্ষিক চাঁদা দেওয়া সদস্য ছাড়া। তবে আইন শিক্ষা, আইন পেশা, আইন ও বিচার সম্পর্কে যেহেতু প্রায়শই অযথা চেঁচামেচি করতে করতে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেহেতু অভ্যাস দোষেই এই প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার কিছু না কিছু অংশ কোনো শিক্ষার্থী আইনজীবী ও বার কাউন্সিলের সদস্যের মতের সঙ্গে মিলবে না, হয়তো তাঁরা গোস্সা করবেন। কী আর করা!
২.
আইন পেশা ও আইন শিক্ষা—দুটোর অবস্থাই ভালো না। ভালো না মানে খারাপ—সে অর্থে না। ভালো না মানে—আরও অনেক ভালো করতে হবে। এখন বার কাউন্সিলে আইনজীবী-সনদ পরীক্ষার মৌখিক পর্ব চলছে। সনদ পাওয়ার পর নামের পাশে ‘অ্যাডভোকেট’ কথাটা লেখা যাবে। ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দটা লিখতে হবে নামের পরে। আজকালকার মন্ত্রীদের মতো নামের আগে না। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় নামের আগে ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দ অর্থাৎ আইন পেশায় অ্যাডভোকেট হিসেবে নিয়োজিত আছেন বলে জাহির করা বার কাউন্সিলের বিধান লঙ্ঘন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ দেশে মন্ত্রী হওয়া মানে তো আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া। হয়তো মন্ত্রীদের তোষামোদকারী ও চাটুকারেরা তাঁদের মন্ত্রীদের ‘নাম কাটাবার জন্য’ মন্ত্রীর নমের আগে অ্যাডভোকেট কথাটা জুড়ে দিতে গিয়ে ভুলে গেছে যে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের আইনজীবী সনদ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার কথা। অর্থাৎ যত দিন মন্ত্রী তত দিন অ্যাডভোকেট হিসেবে কোর্টে মামলা করা যাবে না। বার কাউন্সিলের বিধানে নিষেধ আছে।
যাক গে। আইন শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। এখন সাকল্যে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা আইনের ডিগ্রি লাভ করেছে। বছর তিনেক আগে জগন্নাথ আর এ বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর অর্থাৎ এখন সাকল্যে ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, বড় সরকারি কলেজ, কোথাও সরকার আইন পড়ানোর ব্যবস্থা করেনি। আইন শিক্ষায় সরকারের অনীহার ফলে সৃষ্ট সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ভূরি ভূরি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। টাকা নিয়ে গেলেই ভর্তি হওয়া যায় আর চার বছর পর এলএলবি ডিগ্রি পাওয়া যায়। এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমী মেধাবী শিক্ষার্থী ও কিছু শিক্ষক নিশ্চয়ই আছেন। তবে যে লেখার প্রতিক্রিয়ায় আমার এ লেখা, সেটাতে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যেটা বলা হয়নি তা হলো বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট সনদ প্রার্থী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংখ্যাধিক্যতাই এখন বার কাউন্সিলেরও সম্ভবত বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের ২২ এপ্রিল বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের এই জানুয়ারি। সেই লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল আইনের ডিগ্রি পাওয়া কম-বেশি আট হাজার পরীক্ষার্থী। যত দূর শুনেছি, আট হাজারের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে প্রায় হাজার তিনেক। প্রায় ১০টা বোর্ড এখন প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাজার তিনেক সনদপ্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছে। বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্যই মাননীয় বিচারপতিরা। এত ‘ইন্টারভিউ’ নিতে নিতে তাঁরা হয়তো গলদঘর্ম। তবে দৈনন্দিন বিচারিক কাজের পর আগে পরীক্ষার খাতা দেখা, এখন মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া—এ দায়িত্ব তাঁরা যে নিয়েছেন এ জন্য আমরা নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ।
গতবার যেহেতু পরীক্ষার্থী ছিল আট হাজার, এবার সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজারে দাঁড়ালে মোটেও বিস্মিত হব না। আগেই বলেছি, এলএলবি সার্টিফিকেট দেওয়ার লোকের অভাব নেই। ইদানীং আবার ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ল কলেজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে একবারে খাস বিলেতি এলএলবি ডিগ্রিও দিচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো আইন না পড়েই বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়ে বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে সনদ পেয়ে বাংলাদেশের কোর্টে কাজ করবে।
দেশে এখন নিবন্ধিত আইনজীবীর সংখ্যা ৪৬ হাজারের কিছু বেশি। এবার যারা মৌখিক পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ আসছে মার্চে বার কাউন্সিলের পরবর্তী যে পরীক্ষা-প্রক্রিয়া শুরু হবে, তাতে পরীক্ষার্থী ১০ হাজার হলে দেশে নিবন্ধিত আইনজীবীর সংখ্যা শিগগিরই ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এত জায়গা থেকে এত সহজে ল ডিগ্রি পাওয়া গেলে প্রতিবছর পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হু হু করে বাড়বে।
কিন্তু দেশে মামলার সংখ্যা কি বাড়ছে? বাড়ছে না। সারা দেশের সব আদালতে সব ধরনের যত মামলা দায়ের হয় তার সংখ্যা গত পাঁচ বছর ধরে ১০ থেকে ১১ লাখের মধ্যে ওঠানামা করছে। বড় দাগে হিসাব মেলানোর সুবিধার্থে যদি বলি তাহলে বলব, প্রতিবছর নতুন ১০ লাখ মামলা দায়ের হয়। এর অন্তত অর্ধেক মামুলি মামলা। ছোটখাটো অপরাধ, ৫০-৭০ হাজার টাকার দাবিদাওয়া, মাসিক দুই হাজার টাকা খোরপোশ ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব মামলার পেছনে মক্কেল হাজার হাজার টাকা খরচ করে না—কিছু ব্যতিক্রমী ছাড়া।
১০ লাখ মামলার পেছনে আছে—আবার বড় দাগে—৫০ হাজার আইনজীবী। গড়ে বছরে জুটবে ২০ মামলা। আইনজীবী-প্রতি মাসে দুটোরও কম মামলা।
মোদ্দা কথা, যদি গত পাঁচ বছরে দেশে মোট মামলার সংখ্যা না বাড়ে তাহলে আইনজীবীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?
দুনিয়ার অন্যান্য দেশের বার কাউন্সিল এসবের হিসাব রাখে। যারা পেশায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, তাদের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। নবীন কোনো আইনজীবী সনদ পাওয়ার দুই-তিন বছর পরে যদি উচ্চতর কোনো ট্রেনিং অথবা আরও পড়াশোনা করতে চায়, তাহলে তার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ পেশাগত উৎকর্ষের কোনো পথ কারও জন্য খোলা নেই।
বার কাউন্সিল এসব ব্যাপারে কিছুই করে না বা করতে পারে না। তার প্রধান এবং সম্ভবত একমাত্র কারণ হলো, সারা দেশের সব আইনজীবীর ভোটে তিন বছরের যে ১৪ জন আইনজীবী নির্বাচিত হয়ে বার কাউন্সিল গঠন করেন, তাঁরা তাঁদের তিন বছরের মেয়াদকালে পূর্ণোদ্যমে আইন পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এমনিতেই প্রসিদ্ধ-খ্যাত-বিখ্যাত আইনজীবী, তারপর বার কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতা। তিন বছরের মেয়াদকালে, বলা বাহুল্য, পেশাগত ব্যস্ততা অন্তত দ্বিগুণ হয়।
আগেও ব্যস্ত ছিলেন এখন অতি ব্যস্ত। বার কাউন্সিলের কাজে সময় দেওয়ার সময় কোথায়? বরং চেষ্টা-তদবির করে নবীনদের আইনজীবীর কাতারে তালিকাভুক্ত করলে নিজের ও দলের ভোট বাড়বে।
বার কাউন্সিল এভাবে চলতে পারে না। ১৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে যে পাঁচজন বিভিন্ন কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন, অন্তত তাঁদের মেয়াদকালে পেশা থেকে বিরত থেকে বার কাউন্সিল তথা সব আইনজীবী, দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার মঙ্গল ও উন্নতি সাধনে মনোনিবেশ করা উচিত। অন্তত মেয়াদের তিন বছরে নতুন কোনো মামলা নেবেন না এই নিষেধাজ্ঞা অত্যাবশ্যক। জানামতে, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা বেশ কয়েক বছর ধরে পদে থাকা অবস্থায় নতুন মামলা না নেওয়ার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা বার কাউন্সিলের, সুপ্রিম কোর্ট এবং ঢাকা বার সমিতির নির্বাচিত নেতাদের এখনই মেনে চলা দরকার। যাঁরা এতটুকু স্বার্থ ত্যাগ করতে পারবেন না, তাঁদের সঙ্গে চাঁদাবাজি করা আর ফায়দা লোটা তথাকথিত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কী পার্থক্য থাকল।
নেতার বার কাউন্সিলে সময় কাটালে বিচারব্যবস্থায় কীভাবে উন্নতি হবে, মামলা-জট কীভাবে কমবে, সংসদে কোন আইন পাস হওয়া দরকার আর বার কাউন্সিলের আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষা কীভাবে ভালো হয়—সবই হবে।
৩.
যে লেখার প্রতিক্রিয়ায় এত কথা, সেই আইন শিক্ষার্থী-লেখকেরা মোটেও প্রীত হবেন না যদি বলি আইন পেশায় অন্তত তিন বছর সঠিকভাবে নিয়োজিত না থেকে বিচারক পদে পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হওয়া উচিত নয়। এলএলবি পাস করে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উতরে গিয়ে ২৩-২৪ বছরে বিচারক হয়ে যাওয়া—বাস্তবতার নিরিখে খুবই বেমানান। ২৩ বছরে অনেক আইন মুখস্থ করা যায়, আইনের বড় বড় বইও রপ্ত করা যায় কিন্তু জীবন বোঝা যায় না। জীবন বোঝা না গেলে ন্যায়বিচার করা যায় না। ন্যায়বিচার না হলে সমাজ টেকে না। ২৫ বছর বয়সে কোর্টে ২৫ বছর প্র্যাকটিস করা পঞ্চাশোর্ধ্ব আইনজীবীকে মোকাবিলা করা যায় না।
যা হওয়ার হয়েছে এখন নিম্ন আদালতে বিচারকের ন্যূনতম বয়স বা তিন বছরের আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা, উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে।
আগামী বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হাজার দশেক হবে। চাকরির অন্যান্য পরীক্ষার জন্য প্রথমে এমসিকিউ অর্থাৎ মালটিপল চয়েস পরীক্ষা নিয়ে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। এখনকার ছেলেমানুষী তিন ঘণ্টার শুধু একটা পরীক্ষার পরিবর্তে অন্তত পাঁচটা বিষয়ে ৪০০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হবে। সব চাকরিতে যেমন আগেভাগেই ঘোষণা করা হয় ১০০ বা ২০০ জন নিয়োগ করা হবে, সেভাবে প্রতিবছর হিসাব করে বার কাউন্সিলকে ঘোষণা দিতে নতুন কতজন আইনজীবীকে সনদ দেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি সবই মেধার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ প্রথম ১০০ বা ৫০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, বার কাউন্সিলকেও সে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বার কাউন্সিলের নির্বাচিত নেতাদের তাঁদের মেয়াদকালে নতুন কোনো মামলা না নিয়ে বার কাউন্সিলের কাজে সময় দেওয়া। সময় দিতে না পারলে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
মামলা থেকে আইনজীবীর সংখ্যা বেশি। আইন পড়ানোর সবটাই তাত্ত্বিক। আদালতের আইনের সঙ্গে যা পড়ানো হয়, তার মিল নেই বললেই চলে। আইনজীবী এ মাসে নতুন কোন মক্কেল পাননি, তাই পুরোনো মামলা জিইয়ে রাখতে হবে। ফলে মিথ্যা মামলা বাড়ছে, মামলা দীর্ঘায়িত হচ্ছে, দুর্নীতি বাড়ছে। মামলার খোঁজে দিগিবদিক শূন্য হয়ে দৌড়াদৌড়ি। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে না জেনে, না বুঝে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ৭০-৮০টা প্রাইভেট ল কলেজে ভর্তি হচ্ছে।
পেশাটার বারোটা বাজার আগে নেতাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে কোর্টে রাজনৈতিক নেতাদের মামলার দিনে মিছিল, বিক্ষোভ এবং এসব ঘটনায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় ব্যস্ত আইনজীবীদের সংখ্যাই কেবল বাড়বে। কোর্টে আসা আইনের আশ্রয়প্রার্থী মক্কেল হয়ে যাবে খদ্দের।
ব্যবস্থাপত্র কম-বেশি সবারই জানা। দরকার ব্যবস্থাপত্র বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত।
ড. শাহ্দীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট; পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments