অর্থনীতি-আমাদের মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি by ফারুক মঈনউদ্দীন
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মহলে অন্যান্য বছরের মতো শঙ্কা এবং পূর্বাভাষিত বিশ্লেষণের কার্যকলাপ শুরু হয়। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনোভাব এবং আগের কয়েক ষাণ্মাসিকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো থেকে এবারেও প্রত্যাশিত ছিল, মুদ্রানীতির চেহারা কেমন হবে।
সাধারণত আমাদের দেশে যখন মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হয়, তখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রত্যাশা থাকে যে এটি দিয়ে অর্থনীতির সব সমস্যা, যেমন—শেয়ারবাজারের ধস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদেশি বিনিয়োগের ভাটা, অবমূল্যায়িত টাকা সবকিছুর সমাধান করে ফেলা যাবে। আমরা জানি, মুদ্রানীতির কর্মক্ষেত্র হচ্ছে সুদের হার পরিবর্তন ও মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চাহিদা ব্যবস্থাপনা করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা সমুন্নত রাখা। এবারের মুদ্রানীতিতে দেশের চলমান মূল্যস্ফীতিকর পরিস্থিতিতে প্রথাগতভাবে একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যা করণীয়, তার কার্যকারিতা নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও ঠিক সে রকমই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে কারণে চলতি ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি কোনো অর্থেই অপ্রত্যাশিত কোনো দলিল নয়। এমনকি এটি যে আইএমএফের ব্যবস্থাপত্রের বেশির ভাগ শর্ত অনুসরণ করা একটি ঘোষণাপত্র—এ কথা উল্লেখ করার পরও মুদ্রানীতির সংকোচনমুখী পদক্ষেপটির সঙ্গে মতানৈক্য প্রকাশ করেননি অনেকেই।
এবারের মুদ্রানীতির নির্বাহী সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘আগেকার ইস্যুগুলোর মতো মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রের এ ইস্যুটির অভীষ্ট লক্ষ্যও জনসাধারণের মধ্যে মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্য মাত্রার ধারণা সুনিবদ্ধ করা এবং গৃহস্থালি ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য জোগানো।’
১৯১০ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই মূলত দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির একটা আসন্ন ছায়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তখনকার ঋণ ও মুদ্রাপ্রবাহের প্রবণতা লক্ষ করে অর্থনীতিবিদেরা অশনিসংকেত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তখন থেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে অর্থনীতিতে মুদ্রাপ্রবাহ তথা ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সাধারণ পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, মুদ্রা সরবরাহ-তত্ত্বে সংকীর্ণ মুদ্রা (এম-১) বলতে বোঝায়, ব্যাংকের বাইরে সব ধরনের মুদ্রা ও নোট এবং ব্যাংকের চলতি আমানত। আর ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) হচ্ছে এম-১ এবং ব্যাংকের সব সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানতের সমষ্টি। সুতরাং, মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বোঝাতে শুধু মুদ্রার প্রবাহকে বোঝায় না, তার সঙ্গে ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের আমানতকেও বোঝাবে। কারণ, ব্যাংকের আমানত—চলতি কিংবা মেয়াদি, যা-ই হোক না কেন, সময়ভেদে ব্যাংকের বাইরে এসে মুদ্রাপ্রবাহের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে। আমাদের এ কথাও স্মরণ রাখা উচিত, ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান কার্যক্রমের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এম-২। কারণ, কোনো একটি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ পরিণত হয় অন্য কোনো ব্যাংকের চলতি কিংবা সঞ্চয়ী আমানতে। সুতরাং, সংকীর্ণ কিংবা ব্যাপক মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান ক্ষমতা খর্ব করা। এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বহু যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঋণ তথা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষমতা খর্ব করার দ্বিতীয় সহজ বিকল্প আর নেই, যদি সেটি হয় চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতি। তার সঙ্গে এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে, এতে উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত হতে পারে; খর্ব হতে পারে প্রবৃদ্ধির হার। চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ এবং অর্থবছরের প্রথম দিকে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটা ক্ষীণ আশা ও উদ্দীপনা ছিল, সেটি এখন আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিয়ামকগুলোর (যেমন: অপ্রতুল বিদেশি সাহায্য, নিয়ন্ত্রিত ঋণপ্রবাহ) বিরূপ পরিবর্তনের ফলে এই ষাণ্মাসিকের মুদ্রানীতিতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে।
চলতি মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়া হয়েছে, যাতে ঋণ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ক্ষীণতর হবে। গত দুই বছর এ খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল প্রায় লাগামহীন, ফলে সে সময় ঋণ-বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ২০ থেকে ২৬ শতাংশ। এই হারের লাগাম টেনে চলতি বছরের জুনের মধ্যে ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য সুদের হার বৃদ্ধির মতো বিনিয়োগ খর্বকারী পদক্ষেপই ছিল একমাত্র পথ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এ ব্যবস্থার ফলে আমদানির ওপর চাপ কমবে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিপরীতে টাকার যে অধোগতি দেখা গিয়েছিল, সেটি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
এ কথা স্পষ্ট যে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের এই কঠোর সংযমের মূল ভারটা বহন করতে হবে বেসরকারি খাতকেই। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের গৃহীত ঋণের প্রবৃদ্ধির হার যদি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনা না যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ-সংকোচন নীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল হবে না। ২০০৯ সালে সরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১০ সালে এসে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমে যায়, অর্থাৎ এ বছর ঋণপ্রবাহের হার হ্রাস পায়। অথচ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে উদ্বেগজনকভাবে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ শতাংশে। এটিকে ২০১২ সালের জুনের মধ্যে ৩১ শতাংশে নামিয়ে আনার কাজটি হবে দুরূহ, কারণ এটির জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। মুদ্রানীতিতে অবশ্য ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারি খাতের নেওয়া ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য প্রয়োজন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করা, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসম্পদ আহরণের হার বৃদ্ধি করা এবং সরকারি ব্যয় হ্রাস করা। এই ধারণা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয় কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তাঋণসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য ঋণ-সুবিধাকে লাগামবদ্ধ করারও পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্নভাবে, যাতে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ খুব বেশি খর্ব করতে না হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভোক্তাঋণের মোড়কে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক হারে ঋণ সম্প্রসারণ করেছিল গত কয়েক বছর। সহজপ্রাপ্যতার কারণে এই ঋণের একটা বিশাল পরিমাণ ঢুকে পড়েছে শেয়ারবাজারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি যে বিশাল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারের বর্তমান অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন নামের ভোক্তাঋণের গ্রাহক।
ঋণপ্রবাহ হ্রাসের পাশাপাশি এবারের মুদ্রানীতিতে মুদ্রাপ্রবাহের রাশ টেনে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। ২০০৯ অর্থবছরে ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) প্রবাহ বৃদ্ধির হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১০-এ এই হার দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৪ শতাংশে। সে সময় থেকেই মূলত মুদ্রাস্ফীতির অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে ২০১১ সালে গত কয়েক বছরের লাগামহীন ঋণ সম্প্রসারণের রাশ টানা শুরু হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত ৮০ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার জন্য কঠোর নজরদারি শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ২০১১-এর জুনে মুদ্রাপ্রবাহ বৃদ্ধির হার নেমে আসে ২১ দশমিক ৪ শতাংশে, এবং বছর শেষে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশে। বর্তমান মুদ্রানীতির মেয়াদ শেষে এই হার ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে, কারণ মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক ফলাফল। মূল্যস্ফীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সীমিত আয়ের মানুষ, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের স্থায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মূল্যস্ফীতি দমন করতে গিয়ে যদি স্বল্প মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্তও হয়, তবু প্রথমোক্তটি নিশ্চিত করতে চায় অধিকাংশ সরকার। ২০১০-এর মার্চ থেকে শুরু করে ২০১১-এর অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে মোট ১৩ বার সুদের হার পরিবর্তন করেছিল। এর ফলে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে দেশটিতে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে। গত দুই বছরের মধ্যে এটিই ছিল মুদ্রাস্ফীতির সর্বনিম্ন হার। এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা রেখেছে খাদ্যপণ্যের মূল্যহ্রাস এবং ডলারের বিপরীতে রুপির উত্থান। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক খুব শিগগির সুদের হার হ্রাস করবে; কঠোর মুদ্রানীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়েছে।
আমরা আমাদের অর্থনীতিতেও কি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির এ রকম সুফল আশা করতে পারি না? আশঙ্কার কথা এই যে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি মূলত যেহেতু উৎপাদনব্যয় বৃদ্ধিজনিত, তাই মুদ্রা-সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াসটি অতিসহজে ফলপ্রসূ হবে না। তবে এ লক্ষ্যটি যদি অর্জিত না হয়, তার ফলাফল হবে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের পরিত্যাগ করতে হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি, দীর্ঘ মেয়াদে দেখা দেবে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারি ঋণের লাগাম সত্যিকার অর্থে টেনে ধরতে পারে, তাহলে বেসরকারি খাতের জন্য নতুন ঋণের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির গতিতে যোগ করবে বেগ। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যে সরকারের ঋণগ্রহণের প্রবণতা খর্ব করা যাচ্ছে। তাহলে কি বেসরকারি খাতের অমানিশা সহসা ঘুচছে না?
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
এবারের মুদ্রানীতির নির্বাহী সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘আগেকার ইস্যুগুলোর মতো মুদ্রানীতি ঘোষণাপত্রের এ ইস্যুটির অভীষ্ট লক্ষ্যও জনসাধারণের মধ্যে মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্য মাত্রার ধারণা সুনিবদ্ধ করা এবং গৃহস্থালি ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ পরিকল্পনার জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য জোগানো।’
১৯১০ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই মূলত দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির একটা আসন্ন ছায়া পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তখনকার ঋণ ও মুদ্রাপ্রবাহের প্রবণতা লক্ষ করে অর্থনীতিবিদেরা অশনিসংকেত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং তখন থেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে অর্থনীতিতে মুদ্রাপ্রবাহ তথা ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সাধারণ পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, মুদ্রা সরবরাহ-তত্ত্বে সংকীর্ণ মুদ্রা (এম-১) বলতে বোঝায়, ব্যাংকের বাইরে সব ধরনের মুদ্রা ও নোট এবং ব্যাংকের চলতি আমানত। আর ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) হচ্ছে এম-১ এবং ব্যাংকের সব সঞ্চয়ী ও মেয়াদি আমানতের সমষ্টি। সুতরাং, মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বোঝাতে শুধু মুদ্রার প্রবাহকে বোঝায় না, তার সঙ্গে ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের আমানতকেও বোঝাবে। কারণ, ব্যাংকের আমানত—চলতি কিংবা মেয়াদি, যা-ই হোক না কেন, সময়ভেদে ব্যাংকের বাইরে এসে মুদ্রাপ্রবাহের সঙ্গে একীভূত হয়ে যেতে পারে। আমাদের এ কথাও স্মরণ রাখা উচিত, ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান কার্যক্রমের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এম-২। কারণ, কোনো একটি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ পরিণত হয় অন্য কোনো ব্যাংকের চলতি কিংবা সঞ্চয়ী আমানতে। সুতরাং, সংকীর্ণ কিংবা ব্যাপক মুদ্রাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান ক্ষমতা খর্ব করা। এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বহু যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঋণ তথা মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ক্ষমতা খর্ব করার দ্বিতীয় সহজ বিকল্প আর নেই, যদি সেটি হয় চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতি। তার সঙ্গে এ কথাও স্মরণে রাখতে হবে, এতে উৎপাদন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত হতে পারে; খর্ব হতে পারে প্রবৃদ্ধির হার। চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৭ শতাংশ এবং অর্থবছরের প্রথম দিকে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটা ক্ষীণ আশা ও উদ্দীপনা ছিল, সেটি এখন আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিয়ামকগুলোর (যেমন: অপ্রতুল বিদেশি সাহায্য, নিয়ন্ত্রিত ঋণপ্রবাহ) বিরূপ পরিবর্তনের ফলে এই ষাণ্মাসিকের মুদ্রানীতিতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে।
চলতি মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়া হয়েছে, যাতে ঋণ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয়। এতে করে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ক্ষীণতর হবে। গত দুই বছর এ খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল প্রায় লাগামহীন, ফলে সে সময় ঋণ-বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ২০ থেকে ২৬ শতাংশ। এই হারের লাগাম টেনে চলতি বছরের জুনের মধ্যে ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য সুদের হার বৃদ্ধির মতো বিনিয়োগ খর্বকারী পদক্ষেপই ছিল একমাত্র পথ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এ ব্যবস্থার ফলে আমদানির ওপর চাপ কমবে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিপরীতে টাকার যে অধোগতি দেখা গিয়েছিল, সেটি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
এ কথা স্পষ্ট যে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের এই কঠোর সংযমের মূল ভারটা বহন করতে হবে বেসরকারি খাতকেই। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের গৃহীত ঋণের প্রবৃদ্ধির হার যদি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনা না যায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ-সংকোচন নীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল হবে না। ২০০৯ সালে সরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধির হার ছিল ২০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১০ সালে এসে ৫ দশমিক ২ শতাংশে নেমে যায়, অর্থাৎ এ বছর ঋণপ্রবাহের হার হ্রাস পায়। অথচ ২০১১ সালের ডিসেম্বরে উদ্বেগজনকভাবে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ শতাংশে। এটিকে ২০১২ সালের জুনের মধ্যে ৩১ শতাংশে নামিয়ে আনার কাজটি হবে দুরূহ, কারণ এটির জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও থাকতে হবে। মুদ্রানীতিতে অবশ্য ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারি খাতের নেওয়া ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য প্রয়োজন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বৃদ্ধি করা, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসম্পদ আহরণের হার বৃদ্ধি করা এবং সরকারি ব্যয় হ্রাস করা। এই ধারণা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয় কি না, সেটি এখন দেখার বিষয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভোক্তাঋণসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য ঋণ-সুবিধাকে লাগামবদ্ধ করারও পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্নভাবে, যাতে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ খুব বেশি খর্ব করতে না হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভোক্তাঋণের মোড়কে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যাপক হারে ঋণ সম্প্রসারণ করেছিল গত কয়েক বছর। সহজপ্রাপ্যতার কারণে এই ঋণের একটা বিশাল পরিমাণ ঢুকে পড়েছে শেয়ারবাজারে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি যে বিশাল ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারের বর্তমান অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন নামের ভোক্তাঋণের গ্রাহক।
ঋণপ্রবাহ হ্রাসের পাশাপাশি এবারের মুদ্রানীতিতে মুদ্রাপ্রবাহের রাশ টেনে ধরার প্রয়াস লক্ষণীয়। ২০০৯ অর্থবছরে ব্যাপক মুদ্রা (এম-২) প্রবাহ বৃদ্ধির হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, ২০১০-এ এই হার দাঁড়ায় ২২ দশমিক ৪ শতাংশে। সে সময় থেকেই মূলত মুদ্রাস্ফীতির অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছিল। ফলে ২০১১ সালে গত কয়েক বছরের লাগামহীন ঋণ সম্প্রসারণের রাশ টানা শুরু হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত ৮০ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার জন্য কঠোর নজরদারি শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ২০১১-এর জুনে মুদ্রাপ্রবাহ বৃদ্ধির হার নেমে আসে ২১ দশমিক ৪ শতাংশে, এবং বছর শেষে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশে। বর্তমান মুদ্রানীতির মেয়াদ শেষে এই হার ১৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মুদ্রানীতিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে, কারণ মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক ফলাফল। মূল্যস্ফীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সীমিত আয়ের মানুষ, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ যেকোনো রাজনৈতিক সরকারের স্থায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি মূল্যস্ফীতি দমন করতে গিয়ে যদি স্বল্প মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্তও হয়, তবু প্রথমোক্তটি নিশ্চিত করতে চায় অধিকাংশ সরকার। ২০১০-এর মার্চ থেকে শুরু করে ২০১১-এর অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে মোট ১৩ বার সুদের হার পরিবর্তন করেছিল। এর ফলে সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুসারে দেশটিতে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে, ডিসেম্বরে যা ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশে। গত দুই বছরের মধ্যে এটিই ছিল মুদ্রাস্ফীতির সর্বনিম্ন হার। এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা রেখেছে খাদ্যপণ্যের মূল্যহ্রাস এবং ডলারের বিপরীতে রুপির উত্থান। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ধারণা করা হচ্ছে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক খুব শিগগির সুদের হার হ্রাস করবে; কঠোর মুদ্রানীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়েছে।
আমরা আমাদের অর্থনীতিতেও কি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির এ রকম সুফল আশা করতে পারি না? আশঙ্কার কথা এই যে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি মূলত যেহেতু উৎপাদনব্যয় বৃদ্ধিজনিত, তাই মুদ্রা-সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াসটি অতিসহজে ফলপ্রসূ হবে না। তবে এ লক্ষ্যটি যদি অর্জিত না হয়, তার ফলাফল হবে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের পরিত্যাগ করতে হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি, দীর্ঘ মেয়াদে দেখা দেবে যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সরকারি ঋণের লাগাম সত্যিকার অর্থে টেনে ধরতে পারে, তাহলে বেসরকারি খাতের জন্য নতুন ঋণের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির গতিতে যোগ করবে বেগ। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে না যে সরকারের ঋণগ্রহণের প্রবণতা খর্ব করা যাচ্ছে। তাহলে কি বেসরকারি খাতের অমানিশা সহসা ঘুচছে না?
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments