জাতিসংঘে ফিলিস্তিন-স্বাধীনতা অর্জনের পথে আরেকটি পদক্ষেপ by ইউরি আভনেরি
স্থানীয় এক ব্যক্তি আমার সাক্ষাৎ কার নেওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটাই কি আপনার জীবনের সবচেয়ে খুশির সপ্তাহ হবে?’ তাঁর ইশারা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য ফিলিস্তিনের জাতিসংঘে যাওয়ার দিকে। প্রশ্নটা আমাকে বিস্মিত করল। বললাম, ‘তা কেন হবে?’
‘গত ৬২টি বছর আপনি ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে চলেছেন—আপনার সেই আশা পূর্ণ হতে চলল।’
আমি বললাম, ‘আমি যদি ফিলিস্তিনি হতাম, তাহলে হয়তো খুশিই হতাম। কিন্তু ইসরায়েলি হিসেবে বরং খারাপই লাগছে।’
তাহলে একটু ব্যাখ্যা করে বলি। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরার সময় আমার দৃঢ় উপলব্ধি হয়েছিল: (১) মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনের নাম মুছে ফেলা হলেও ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব আছে। (২) এই ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গেই ইসরায়েলিদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৩) ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনিদের তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না দিলে শান্তি অসম্ভব। (৪) যুদ্ধের ময়দানে বসে আমরা যে আদর্শ ইসরায়েল রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলাম, সেই রাষ্ট্র হবে না শান্তি ছাড়া।
আমি তখনো সেনাবাহিনী ছাড়িনি, আহত অবস্থায় চিকিৎ সা চলছে। তখনই কয়েকজন আরব ও ইহুদি তরুণের সঙ্গে বসি আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। আমরা তখন খুবই আশাবাদী। মনে হলো সবই সম্ভব।
আমাদের ভাবনা তখন মহৎ মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। আরব ও ইহুদিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছে—দুই পক্ষই নিজেদের জাতীয় অধিকার রক্ষার জন্য লড়েছে বলে ভেবেছে। আমরা ভেবেছি, এবার শান্তির লক্ষ্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।
যুদ্ধ শেষে অকুতোভয় লড়াকু দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা সেমিটিক সংস্কৃতির সমান বয়সী। তিন হাজার বছর আগে রচিত মহাকাব্য গিলগামেশ-এ উরুকের (বর্তমানে ইরাক) রাজা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন অসভ্য এনকিবুর বিরুদ্ধে। শক্তি ও সাহসের দিক থেকে উভয়ে সমান। মহাকাব্যিক যুদ্ধ শেষে তাঁরা হয়ে ওঠেন রক্ত-সম্পর্কীয় ভ্রাতৃসম।
ইসরায়েলিরা কঠোর যুদ্ধ শেষে বিজয় লাভ করে। আর ফিলিস্তিনিরা হারায় সবই। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের যে অংশটিকে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে ভাগ করে দিয়েছিল, সেটুকু গ্রাস করে নেয় ইসরায়েল, জর্ডান ও মিসর—ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অর্ধেক ফিলিস্তিনিকে নিজের বাস্তুভিটা থেকে উৎ খাত করা হয়—তারা উদ্বাস্তু হয়ে যায়।
আমরা ভেবেছিলাম, বিজয়ী পক্ষ মহানুভবতা ও বুদ্ধিমত্তায় সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেবে। শান্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সেটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমরা এভাবে এমন মিত্রতা গড়ে তুলতে পারব, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে।
এর ১৮ বছর পর একই রকম পরিস্থিতিতে এই স্বপ্ন আমি আবারও সামনে নিয়ে এলাম। ছয় দিনের যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ইসরায়েলিরা বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করল। মধ্যপ্রাচ্য প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে ইসরায়েল তখন পুরো অঞ্চলে চমক লাগিয়ে দিতে পারত।
এ কাহিনি (আবারও) বলছি শুধু একটা কথা স্পষ্ট করার জন্য: ১৯৪৮ সালের পর প্রথমবারের মতো যখন ‘দুই রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সমাধানের’ বিষয়টি ভাবনায় এল, তখন এটি ছিল মেলবন্ধন গড়ে তোলার, মৈত্রী রচনার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমাদের ভাবনায় ছিল, দুটি রাষ্ট্র থাকবে পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, সীমান্ত থাকবে মানুষ ও পণ্যের অবাধ যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত। অভিন্ন রাজধানী জেরুজালেম হবে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের চেতনার প্রতীক। নতুন ইসরায়েল আর আরব বিশ্ব উভয়ের ভালোর জন্য হবে ঐক্যবদ্ধ, আর সেই সেতুবন্ধ গড়ে তুলবে ফিলিস্তিন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাস্তবায়ন ঘটার বহু আগেই আমরা ‘সেমিটিক ইউনিয়ন’ গড়ে তোলার কথা বলেছিলাম।
অল্প কিছু অত্যুৎ সাহীর স্বপ্ন থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ যখন দুনিয়াব্যাপী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হয়ে ওঠার যে অসাধারণ যাত্রা, সেখানে আমাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্যে ছিল। এটা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত নয়, বরং সত্যিকারের শান্তির একমাত্র টেকসই ভিত্তি।
এই স্বপ্ন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ডেভিড বেন-গুরিয়ন, ইসরায়েলের তৎ কালীন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি তখন আরবদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া বিস্তৃত ভূমি নতুন ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে বণ্টনে ব্যস্ত। কোনোভাবেই আরবদের সঙ্গে শান্তিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি যে যাত্রাপথের দিশা তৈরি করে গিয়েছিলেন, সেই পথই একের পর এক ইসরায়েলি সরকার আজতক অনুসরণ করে চলেছে।
অন্যদিকে, আরবদের মাঝে এই স্বপ্নের পক্ষে সব সময়ই সমর্থন ছিল। ১৯৪৯ সালে লাউসান সম্মেলনে ফিলিস্তিনের এক অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধিদল হাজির হয়েছিল আর তারা গোপনে সরাসরি আলাপ-আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিনিধি এলিয়াহু মাসন অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বেন-গুরিয়নের সরাসরি নির্দেশে তাঁদের মত প্রত্যাখ্যান করেন।
ইয়াসির আরাফাত আমাকে কয়েকবার—১৯৮২ থেকে ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত—বলেছেন, তিনি ‘বেনেলাক্স’ সমাধান (বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গের মধ্যে ইউনিয়ন গঠনের মডেল অনুসারে) সমর্থন করবেন, যেখানে স্থান পাবে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্ডান (আর হয়তো লেবাননও)।
লোকে বলে, ইসরায়েল এত বছর ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট করে চলেছে। ফালতু কথা। আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগোতে গেলে আপনি সুযোগ নষ্ট করতে পারেন, কিন্তু ঘৃণাভরে যে পথ পরিহার করেন, সে পথে গেলে তো নয়।
বেন-গুরিয়নের চোখে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক। তাই তিনি গোপন চুক্তি করলেন বাদশাহ প্রথম আবদুল্লাহর সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন আরব-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের পরিকল্পনায় নির্ধারিত ভূমি। বেন-গুরিয়নের উত্তরসূরিরা একই মতের অনুসারী। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র তাঁদের কাছে সাংঘাতিক বিপজ্জনক। তাই তাঁরা বেছে নিলেন তথাকথিত ‘জর্ডানীয় পন্থা’—ফিলিস্তিনের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা থাকবে জর্ডানি রাজতন্ত্রের জিম্মায়—এই রাজতন্ত্র না ফিলিস্তিনি, না জর্ডানি—বাদশাহের পরিবার মক্কা থেকে আগত।
কয়েক দিন আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেচারা ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ ক্যাথি অ্যাশটনকে বললেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে তিনি কোনোমতেই মেনে নেবেন না। অবাক লাগতে পারে—দুই বছরেরও কম সময় আগের ‘ঐতিহাসিক’ বক্তৃতায় তো তিনি ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ প্রতি তাঁর সমর্থনের কথাই বলেছিলেন।
জাতিসংঘে ভোটের আগের কয়েক সপ্তাহ ইসরায়েল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের বিরুদ্ধে জোর প্রচেষ্টা চালাবে। মার্কিনের পুরো শক্তি তার পেছনে। চলতি সপ্তাহে হিলারি ক্লিনটন তাঁর বাকপটুতার রেকর্ড নিজেই ছাপিয়ে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র দুই রাষ্ট্র সমাধানের সমর্থক, আর তাই জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যেকোনো ভোটের বিরোধী তাঁরা।
জাতিসংঘে ভোটের পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কী ঘটবে, সে ব্যাপারে কিছু সাংঘাতিক হুমকির কথা বলা ছাড়া ইসরায়েলি ও মার্কিন নেতারা শুধু এই নিশ্চয়তাই দিয়েছেন যে ভোটের ফলে কোনো পার্থক্যই রচিত হবে না। তা-ই যদি হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাই বা কেন? ভোটের প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে। দখলদারি চলতেই থাকবে, তবে এবার দখলদারি হবে এক দেশের ওপর আরেক দেশের। ইতিহাসে প্রতীকের মূল্য আছে। বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার মানে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ফিলিস্তিনের আরেকটি পদক্ষেপ।
তার পরের দিন কী ঘটবে? ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিশাল বিক্ষোভ থেকে ইহুদি বসতিগুলোতে হামলা চালানো হতে পারে, তা মোকাবিলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তারা। বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলায় সেটেলারদের আহ্বান করা হবে তাদের ‘দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল’ সক্রিয় করার জন্য। এভাবেই রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে। তারপর মাঠে নামবে সেনাবাহিনী, অন্যান্য কাজে নিয়োজিতদের থেকে নিয়মিত সৈন্যের বহু ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হবে এবং রিজার্ভ বাহিনীকে ডেকে পাঠানো হবে।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি কিছু অশুভ ইঙ্গিতের কথা বলেছিলাম—শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের চেহারা পাল্টে দেওয়ার জন্য গুলি করতে দক্ষ ব্যক্তিদের মাঠে নামানো হবে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল। চলতি সপ্তাহে এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল: গুলি চালাতে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হবে ইসরায়েলি বসতি রক্ষায়। বসতিগুলোর জন্য এত আয়োজন তো যুদ্ধ পরিকল্পনার শামিল। সোজা ভাষায়, পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের না সেটেলারদের, তা নির্ধারণের যুদ্ধ।
সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে রাবার প্রলেপযুক্ত বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ব্যবহার করা হবে, তবে ‘স্কাঙ্ক’ নয়। স্কাঙ্ক হলো এমন এক ডিভাইস, যা অসহনীয় দুর্গন্ধ তৈরি করে—শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালে এটা প্রয়োগ করা হলে বিক্ষোভকারীর সঙ্গে দুর্গন্ধ লেগে থাকে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তা দূর হয় না। আমার ধারণা, যখন এই চ্যাপ্টার শেষ হবে, তখন দুর্গন্ধ লেগে থাকবে শুধু ইসরায়েলিদের সঙ্গেই, আর আসলেই দীর্ঘ সময় দুর্গন্ধমুক্ত হতে পারবে না তারা।
এক মুহূর্তের জন্য কল্পনার রাজ্যে ঘুরে আসা যাক। ধরুন, আসন্ন জাতিসংঘ বিতর্কে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল: ইসরায়েলি প্রতিনিধি ঘোষণা দিলেন, ইসরায়েল যথাযথ বিচার-বিবেচনা শেষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ পরিষদ অবাক হয়ে গেল। মুহূর্তের নীরবতা শেষে তুমুল করতালি। দিনের পর দিন, পৃথিবীর গণমাধ্যমে শুধু একটা কথাই বাজছে।
কল্পনার মুহূর্ত পার হয়ে গেল। বাস্তবতায় ফিরে এলাম। আবার সেই দুর্গন্ধ।
কাউন্টার পাঞ্চ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক ও শান্তিবাদী কর্মী।
আমি বললাম, ‘আমি যদি ফিলিস্তিনি হতাম, তাহলে হয়তো খুশিই হতাম। কিন্তু ইসরায়েলি হিসেবে বরং খারাপই লাগছে।’
তাহলে একটু ব্যাখ্যা করে বলি। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরার সময় আমার দৃঢ় উপলব্ধি হয়েছিল: (১) মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনের নাম মুছে ফেলা হলেও ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্ব আছে। (২) এই ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গেই ইসরায়েলিদের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৩) ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনিদের তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না দিলে শান্তি অসম্ভব। (৪) যুদ্ধের ময়দানে বসে আমরা যে আদর্শ ইসরায়েল রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলাম, সেই রাষ্ট্র হবে না শান্তি ছাড়া।
আমি তখনো সেনাবাহিনী ছাড়িনি, আহত অবস্থায় চিকিৎ সা চলছে। তখনই কয়েকজন আরব ও ইহুদি তরুণের সঙ্গে বসি আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। আমরা তখন খুবই আশাবাদী। মনে হলো সবই সম্ভব।
আমাদের ভাবনা তখন মহৎ মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তোলা। আরব ও ইহুদিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছে—দুই পক্ষই নিজেদের জাতীয় অধিকার রক্ষার জন্য লড়েছে বলে ভেবেছে। আমরা ভেবেছি, এবার শান্তির লক্ষ্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে।
যুদ্ধ শেষে অকুতোভয় লড়াকু দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা সেমিটিক সংস্কৃতির সমান বয়সী। তিন হাজার বছর আগে রচিত মহাকাব্য গিলগামেশ-এ উরুকের (বর্তমানে ইরাক) রাজা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন অসভ্য এনকিবুর বিরুদ্ধে। শক্তি ও সাহসের দিক থেকে উভয়ে সমান। মহাকাব্যিক যুদ্ধ শেষে তাঁরা হয়ে ওঠেন রক্ত-সম্পর্কীয় ভ্রাতৃসম।
ইসরায়েলিরা কঠোর যুদ্ধ শেষে বিজয় লাভ করে। আর ফিলিস্তিনিরা হারায় সবই। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের যে অংশটিকে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে ভাগ করে দিয়েছিল, সেটুকু গ্রাস করে নেয় ইসরায়েল, জর্ডান ও মিসর—ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অর্ধেক ফিলিস্তিনিকে নিজের বাস্তুভিটা থেকে উৎ খাত করা হয়—তারা উদ্বাস্তু হয়ে যায়।
আমরা ভেবেছিলাম, বিজয়ী পক্ষ মহানুভবতা ও বুদ্ধিমত্তায় সারা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেবে। শান্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সেটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। আমরা এভাবে এমন মিত্রতা গড়ে তুলতে পারব, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকবে।
এর ১৮ বছর পর একই রকম পরিস্থিতিতে এই স্বপ্ন আমি আবারও সামনে নিয়ে এলাম। ছয় দিনের যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ইসরায়েলিরা বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করল। মধ্যপ্রাচ্য প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে ইসরায়েল তখন পুরো অঞ্চলে চমক লাগিয়ে দিতে পারত।
এ কাহিনি (আবারও) বলছি শুধু একটা কথা স্পষ্ট করার জন্য: ১৯৪৮ সালের পর প্রথমবারের মতো যখন ‘দুই রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সমাধানের’ বিষয়টি ভাবনায় এল, তখন এটি ছিল মেলবন্ধন গড়ে তোলার, মৈত্রী রচনার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আমাদের ভাবনায় ছিল, দুটি রাষ্ট্র থাকবে পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, সীমান্ত থাকবে মানুষ ও পণ্যের অবাধ যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত। অভিন্ন রাজধানী জেরুজালেম হবে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের চেতনার প্রতীক। নতুন ইসরায়েল আর আরব বিশ্ব উভয়ের ভালোর জন্য হবে ঐক্যবদ্ধ, আর সেই সেতুবন্ধ গড়ে তুলবে ফিলিস্তিন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাস্তবায়ন ঘটার বহু আগেই আমরা ‘সেমিটিক ইউনিয়ন’ গড়ে তোলার কথা বলেছিলাম।
অল্প কিছু অত্যুৎ সাহীর স্বপ্ন থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ যখন দুনিয়াব্যাপী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হয়ে ওঠার যে অসাধারণ যাত্রা, সেখানে আমাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্যে ছিল। এটা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্ত নয়, বরং সত্যিকারের শান্তির একমাত্র টেকসই ভিত্তি।
এই স্বপ্ন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ডেভিড বেন-গুরিয়ন, ইসরায়েলের তৎ কালীন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি তখন আরবদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া বিস্তৃত ভূমি নতুন ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে বণ্টনে ব্যস্ত। কোনোভাবেই আরবদের সঙ্গে শান্তিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি যে যাত্রাপথের দিশা তৈরি করে গিয়েছিলেন, সেই পথই একের পর এক ইসরায়েলি সরকার আজতক অনুসরণ করে চলেছে।
অন্যদিকে, আরবদের মাঝে এই স্বপ্নের পক্ষে সব সময়ই সমর্থন ছিল। ১৯৪৯ সালে লাউসান সম্মেলনে ফিলিস্তিনের এক অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধিদল হাজির হয়েছিল আর তারা গোপনে সরাসরি আলাপ-আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিনিধি এলিয়াহু মাসন অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বেন-গুরিয়নের সরাসরি নির্দেশে তাঁদের মত প্রত্যাখ্যান করেন।
ইয়াসির আরাফাত আমাকে কয়েকবার—১৯৮২ থেকে ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত—বলেছেন, তিনি ‘বেনেলাক্স’ সমাধান (বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ও লুক্সেমবার্গের মধ্যে ইউনিয়ন গঠনের মডেল অনুসারে) সমর্থন করবেন, যেখানে স্থান পাবে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও জর্ডান (আর হয়তো লেবাননও)।
লোকে বলে, ইসরায়েল এত বছর ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট করে চলেছে। ফালতু কথা। আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগোতে গেলে আপনি সুযোগ নষ্ট করতে পারেন, কিন্তু ঘৃণাভরে যে পথ পরিহার করেন, সে পথে গেলে তো নয়।
বেন-গুরিয়নের চোখে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য বিপজ্জনক। তাই তিনি গোপন চুক্তি করলেন বাদশাহ প্রথম আবদুল্লাহর সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন আরব-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য জাতিসংঘের পরিকল্পনায় নির্ধারিত ভূমি। বেন-গুরিয়নের উত্তরসূরিরা একই মতের অনুসারী। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র তাঁদের কাছে সাংঘাতিক বিপজ্জনক। তাই তাঁরা বেছে নিলেন তথাকথিত ‘জর্ডানীয় পন্থা’—ফিলিস্তিনের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা থাকবে জর্ডানি রাজতন্ত্রের জিম্মায়—এই রাজতন্ত্র না ফিলিস্তিনি, না জর্ডানি—বাদশাহের পরিবার মক্কা থেকে আগত।
কয়েক দিন আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেচারা ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ ক্যাথি অ্যাশটনকে বললেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে তিনি কোনোমতেই মেনে নেবেন না। অবাক লাগতে পারে—দুই বছরেরও কম সময় আগের ‘ঐতিহাসিক’ বক্তৃতায় তো তিনি ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ প্রতি তাঁর সমর্থনের কথাই বলেছিলেন।
জাতিসংঘে ভোটের আগের কয়েক সপ্তাহ ইসরায়েল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের বিরুদ্ধে জোর প্রচেষ্টা চালাবে। মার্কিনের পুরো শক্তি তার পেছনে। চলতি সপ্তাহে হিলারি ক্লিনটন তাঁর বাকপটুতার রেকর্ড নিজেই ছাপিয়ে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, যুক্তরাষ্ট্র দুই রাষ্ট্র সমাধানের সমর্থক, আর তাই জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার যেকোনো ভোটের বিরোধী তাঁরা।
জাতিসংঘে ভোটের পর ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কী ঘটবে, সে ব্যাপারে কিছু সাংঘাতিক হুমকির কথা বলা ছাড়া ইসরায়েলি ও মার্কিন নেতারা শুধু এই নিশ্চয়তাই দিয়েছেন যে ভোটের ফলে কোনো পার্থক্যই রচিত হবে না। তা-ই যদি হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাই বা কেন? ভোটের প্রভাব পড়বে নিঃসন্দেহে। দখলদারি চলতেই থাকবে, তবে এবার দখলদারি হবে এক দেশের ওপর আরেক দেশের। ইতিহাসে প্রতীকের মূল্য আছে। বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার মানে স্বাধীনতা অর্জনের পথে ফিলিস্তিনের আরেকটি পদক্ষেপ।
তার পরের দিন কী ঘটবে? ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের বিশাল বিক্ষোভ থেকে ইহুদি বসতিগুলোতে হামলা চালানো হতে পারে, তা মোকাবিলার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে তারা। বিক্ষোভকারীদের মোকাবিলায় সেটেলারদের আহ্বান করা হবে তাদের ‘দ্রুত প্রতিক্রিয়া দল’ সক্রিয় করার জন্য। এভাবেই রক্তবন্যা বইয়ে দেওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হবে। তারপর মাঠে নামবে সেনাবাহিনী, অন্যান্য কাজে নিয়োজিতদের থেকে নিয়মিত সৈন্যের বহু ব্যাটালিয়ন তৈরি করা হবে এবং রিজার্ভ বাহিনীকে ডেকে পাঠানো হবে।
কয়েক সপ্তাহ আগে আমি কিছু অশুভ ইঙ্গিতের কথা বলেছিলাম—শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের চেহারা পাল্টে দেওয়ার জন্য গুলি করতে দক্ষ ব্যক্তিদের মাঠে নামানো হবে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল। চলতি সপ্তাহে এর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল: গুলি চালাতে দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হবে ইসরায়েলি বসতি রক্ষায়। বসতিগুলোর জন্য এত আয়োজন তো যুদ্ধ পরিকল্পনার শামিল। সোজা ভাষায়, পশ্চিম তীর ফিলিস্তিনের না সেটেলারদের, তা নির্ধারণের যুদ্ধ।
সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে রাবার প্রলেপযুক্ত বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ব্যবহার করা হবে, তবে ‘স্কাঙ্ক’ নয়। স্কাঙ্ক হলো এমন এক ডিভাইস, যা অসহনীয় দুর্গন্ধ তৈরি করে—শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলাকালে এটা প্রয়োগ করা হলে বিক্ষোভকারীর সঙ্গে দুর্গন্ধ লেগে থাকে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তা দূর হয় না। আমার ধারণা, যখন এই চ্যাপ্টার শেষ হবে, তখন দুর্গন্ধ লেগে থাকবে শুধু ইসরায়েলিদের সঙ্গেই, আর আসলেই দীর্ঘ সময় দুর্গন্ধমুক্ত হতে পারবে না তারা।
এক মুহূর্তের জন্য কল্পনার রাজ্যে ঘুরে আসা যাক। ধরুন, আসন্ন জাতিসংঘ বিতর্কে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল: ইসরায়েলি প্রতিনিধি ঘোষণা দিলেন, ইসরায়েল যথাযথ বিচার-বিবেচনা শেষে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ পরিষদ অবাক হয়ে গেল। মুহূর্তের নীরবতা শেষে তুমুল করতালি। দিনের পর দিন, পৃথিবীর গণমাধ্যমে শুধু একটা কথাই বাজছে।
কল্পনার মুহূর্ত পার হয়ে গেল। বাস্তবতায় ফিরে এলাম। আবার সেই দুর্গন্ধ।
কাউন্টার পাঞ্চ থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক ও শান্তিবাদী কর্মী।
No comments