চরাচর-বস্তির অন্য জগৎ by সাইফুল ইসলাম খান
'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' সভ্যতার ক্রমবিকাশে এভাবেই নারীর বন্দনা করেছেন কবি। কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা নারীর এ অবদানকে বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। নানা বৈষম্যের মধ্য দিয়ে নারী যুগে যুগে হয়েছে সহিংসতার শিকার।
সমাজের অভিজাত শ্রেণী থেকে শুরু করে বস্তিতে বসবাসকারী নারীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তুলনামূলক চিত্রে ধনী, উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের চেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীরা বৈষম্যের শিকার হয় বেশি। এর মধ্যে বস্তিতে বসবাসকারী নারীরা অন্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার। অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ, অপুষ্টি, চিকিৎসাহীনতা, শিক্ষা ও চিত্তবিনোদন-বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপনের পাশাপাশি এই নারীরা শিকার হয় পারিবারিক সহিংসতার। এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার এসব নারীর বেশির ভাগ নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয় তাদের স্বামীদের দ্বারা। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকার চারটি বস্তিতে নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সহিংসতার শিকার অর্ধেকের বেশি নারী নির্যাতিত হয় স্বামীদের দ্বারা। কমলাপুর টিটিপাড়া বস্তি, আগারগাঁও তালতলা বস্তি, কামরাঙ্গীরচর বস্তি ও তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে এই গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয়। নির্যাতনকারী অন্যদের মধ্যে আছে শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-জা, দেবর-ভাশুর। নির্যাতনের ৮৫ শতাংশ ঘটনা ঘটে স্বামীদের দ্বারা। যৌতুক, নেশার টাকা সংগ্রহ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি কারণে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালায়। অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত সন্তানদের দ্বারাও নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। ২০০৯ সালে যৌতুকের কারণে ১৬৯ জন নারীকে হত্যা করা হয় এবং একই কারণে নির্যাতিত হয় ১১৬ নারী। নেশার টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে স্ত্রীদের অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করার মতো স্পর্শকাতর চিত্রও উঠে এসেছে। পারিবারিক সহিংসতার কারণ ও ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ নারী দরিদ্রতার কারণে, ২৩ শতাংশ অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার অভাবে, ২০ শতাংশ যৌতুকের কারণে ও ৫ শতাংশ নারী অসচেতনতা এবং স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়। গবেষণাপত্রে নির্যাতনের যেসব কারণ ও ধরন উল্লেখ করা হয়, তাতে বস্তিবাসী নারীর মানবেতর ও করুণ পারিবারিক জীবনচিত্র উঠে এসেছে। চড়-থাপ্পড়, চুল ধরে টানা, কিল-ঘুষি-লাথি মারা, লাঠি দ্বারা আঘাত, গরম খুন্তি দিয়ে আঘাত, তালাকের হুমকি, খাবার না দেওয়া প্রভৃতি ধরনের নির্যাতনের উল্লেখ করা হয়। ঢাকা শহরের বস্তিতে যে বিশাল জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তার অর্ধেক নারী। আমাদের দেশের নারীরা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করে। এর ওপর পারিবারিক এ ধরনের সহিংসতা তাদের স্বাভাবিক জীবনকে অসহনীয় ও দুর্বিষহ করে তোলে, তা বলাই বাহুল্য। পরিণতিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অনেকে। নারীর প্রতি সব বৈষম্য দূর করা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সংস্থাভিত্তিক সব ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের 'সিডও' সনদ ও ২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) সম্পর্কিত আইন বাস্তবায়নের পাশাপাশি পারিবারিক পর্যায়ে সহিংসতা বন্ধে সরকারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।
সাইফুল ইসলাম খান
সাইফুল ইসলাম খান
No comments