উইকিলিকস-উইকিবোমায় আহত বিএনপি by মশিউল আলম
উইকিলিকসের প্রকাশ করা মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তাগুলোর সূত্র ধরে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত সোমবার এক অদ্ভুত বিবৃতি প্রকাশ করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘উইকিলিকসের প্রচারিত বার্তাগুলো বড় কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ। এর মাধ্যমে বিএনপিকে দেশবাসীর কাছে হেয় করার পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও সে দেশের প্রশাসনের নিবিড় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার অপকৌশল নেওয়া হয়েছে।... ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে বিভিন্ন সময়ে কর্মরত কূটনীতিকদের পাঠানো তারবার্তার বরাত দিয়ে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, সেগুলোর তথ্যগত নানা অসংগতি থেকে বোঝা যায়, আদতে ওগুলোর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।’ (প্রথম আলো, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)
বিবৃতিটি অদ্ভুত মনে হচ্ছে এই কারণে যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব উইকিলিকসকে দলটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অংশীদার করে ফেলেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বোধ হয় জানা নেই, গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকসের ভারচুয়াল ভান্ডার থেকে যেসব মার্কিন গোপনীয় কূটনৈতিক তারবার্তা চুরি হয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর সংখ্যা দুই লাখ ৫১ হাজার ২৭৮। পৃথিবীজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ২৭৪টি দূতাবাস, কনস্যুলেট ও কূটনৈতিক মিশন আছে, সেগুলো থেকে তারবার্তাগুলো ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন মার্কিন কূটনীতিকেরা (সাধারণত রাষ্ট্রদূত, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, কনসাল জেনারেলসহ বিভিন্ন উচ্চপদের কর্মকর্তারা)। আড়াই লাখের বেশি এসব তারবার্তা পাঠানো হয়েছে ১৯৬৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে যে বিপুলসংখ্যক তারবার্তা লেখা হয়েছে, সেগুলো কি ২০০৬ সালে উদ্ভূত একটি ছোট্ট ওয়েবসাইটের মাত্র সাত-আটজন কর্মীর পক্ষে তিন-চার বছরে বানিয়ে বানিয়ে লেখা সম্ভব? আর বিশ্বময় ব্যাপ্ত এই বিরাট ব্যাপারের মধ্যে বাংলাদেশের জায়গা কতটুকু, এতে বিএনপি নামের দলটির গুরুত্বই বা কী? উইকিলিকস বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে! কী হাস্যকর!
আরও কী অদ্ভুত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শুধু উইকিলিকসকেই ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করে ক্ষান্ত হননি; একই অভিযোগ এনেছেন এ দেশের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধেও। তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন, ‘দেশকে রাজনীতিশূন্য করতে ষড়যন্ত্রকারীরা উইকিলিকসের অপ্রমাণিত তারবার্তা বেছে নিয়েছেন।’ এই ‘ষড়যন্ত্রকারীরা’ হলো বাংলাদেশের সেই সব সংবাদপত্র, যেগুলো উইকিলিকসের ‘অপ্রমাণিত’ তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে এমন সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে, যা পড়ে বিএনপির ‘শীর্ষস্থানীয় নেতারা’ দেশবাসীর কাছে তো বটেই, এমনকি সম্ভবত নিজেদের কাছেও ‘হেয়’ প্রতিপন্ন হচ্ছেন। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক, উইকিলিকসের প্রকাশ করা মার্কিন তারবার্তাগুলোতে শুধু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাই নয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাও আছে এবং সেগুলো মোটেও প্রশংসাসূচক নয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাঁদের লেখা তারবার্তাগুলোর জন্য বিএনপির নেতাদের মধ্যে এই বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে বিভিন্ন সময়ে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকদের সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তিনি বলেছেন, মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তাগুলোর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এ কথার মানে কী? মার্কিন কূটনীতিকেরা মিথ্যা কথা লিখেছেন? না, মির্জা ফখরুল এমন কথা বলেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন, তারবার্তাগুলো উইকিলিকসের কর্মীদের মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা, মানে বানোয়াট। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, উইকিলিকসের এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কল্পকথা বা ফ্যান্টাসি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এমন খবর কোথায় পেলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? ‘উইকিলিকসের এসব তথ্য’ মানে কী? উইকিলিকস কি কোনো তথ্য দিয়েছে? না, তারা মার্কিন তারবার্তাগুলো হুবহু, অবিকল, যেমন আছে ঠিক তেমন অবস্থায় ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে মাত্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল, এমনকি পাঁচ দেশের যে পাঁচটি মূলধারার পত্রিকা (বিলেতের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, জার্মানির ডের স্পিগেল, ফ্রান্সের লা মঁদ ও স্পেনের আল পাইস) উইকিলিকসের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে গত নভেম্বর থেকে মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন শুরু করে, তারাও যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে উইকিলিকসের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে এই কারণে, ওয়েবসাইটটি গোপনীয় তারবার্তাগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই (বিভিন্ন ব্যক্তির নাম মুছে না দিয়ে)। অর্থা ৎ , তারবার্তাগুলো যে মার্কিন কূটনীতিকদেরই লেখা, এ ব্যাপারে কেউ কোনো সন্দেহই প্রকাশ করেননি। সুতরাং, উইকিলিকসের প্রকাশ করা তারবার্তাগুলো কল্পকথা বা ফ্যান্টাসি—মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই মন্তব্য ঠিক নয়।
বরং তিনি যদি বলতেন, ঢাকা থেকে মার্কিন কূটনীতিকেরা যেসব তারবার্তা ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠিয়েছেন, সেগুলো কল্পকথা, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতা’দের সম্পর্কে ওই কূটনীতিকদের ফ্যান্টাসি, তাহলে তাঁর অবস্থানের একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল না। যুক্তিটা হতো তাঁর দলীয় রাজনৈতিক যুক্তি: দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা দেশবাসীর কাছে হেয়প্রতিপন্ন হোন, তা তিনি চান না; চান না যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির ‘নিবিড় সম্পর্ক’ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। কিন্তু সেটা করতে হলে মির্জা ফখরুলকে খুব সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে যেসব রাষ্ট্রদূত ও চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (হ্যারি কে টমাস, প্যাট্রেসিয়া এ বিউটেনিস, গীতা পাসি, জেমস এফ মরিয়ার্টি) ওই তারবার্তাগুলো পাঠিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে হবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কি পারবেন হিলারি ক্লিনটনকে এমন কথা লিখতে, ‘আমাদের দেশবাসীর কাছে বিএনপিকে হেয় করার হীন লক্ষ্যে এবং আপনার দেশ ও তার প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির যে “নিবিড় সম্পর্ক” রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত করার জঘন্য উদ্দেশ্যে আপনার কূটনীতিকেরা এসব “কল্পকথা” (ফ্যান্টাসি) রচনা করেছেন।’ যদি পারেন, তাহলে সঠিক জায়গায় আঘাত করা হবে এবং সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত। অবশ্য সে রকম সাহস অর্জন করার আগে নিজের মনটাকে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মার্কিন তারবার্তাগুলোতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে ‘কল্পকথা’, নাকি সেগুলোর কিছু ভিত্তি আছে, এ দেশের জনসাধারণ সেসব সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে—এই বিষয়গুলো ভালোভাবে ভেবে নেওয়া উচিত। একটা বিষয় অন্তত অস্বচ্ছ নেই—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, গত চার-পাঁচ বছরের রাজনীতি, জরুরি অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে জনগণের মনে যে সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে, মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তাগুলো তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নয়, বরং অনেক সাধারণ ধারণা সত্য বলে বিশ্বাস জাগায়।
তারবার্তাগুলো অসম্পাদিত অবস্থায় ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়ে পড়ায় অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, এর ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মার্কিন কূটনীতিকেরা বিব্রত হবেন, অনেকে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বোধ করবেন, অনেকে হত্যার শিকারও হতে পারেন। যেসব ব্যক্তি তাঁদের তথ্য দিয়েছেন, সেসব ব্যক্তি আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হবেন, অনেকে আক্রান্তও হতে পারেন। এসব আশঙ্কা কতটা বাস্তবভিত্তিক আর কতটা তাত্ত্বিক (প্রথাগত সাংবাদিকতার নিরিখে), তা খতিয়ে দেখার জন্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) সম্প্রতি এক বড় ধরনের অনুসন্ধান চালিয়েছে। তারা বেশ কিছু মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেছে, ফাঁস হওয়া তারবার্তাগুলোর মধ্যে তাঁদের পাঠানো তারবার্তাও রয়েছে। এপি বলছে, একজন কূটনীতিকও মনে করেন না যে তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি বোধ করছেন, বরং তাঁরা স্বস্তিতেই আছেন (কমফোরটেবল উইথ দেয়ার নেমস ইন দ্য ওপেন অ্যান্ড নো ওয়ান ফিয়ারিং ডেথ)। তাঁরা যদি কল্পকথা রচনা করতেন, তাহলে কি এমন স্বস্তিতে থাকতে পারতেন? বরং তাঁরা স্বস্তিতে আছেন সম্ভবত এই কথা ভেবে, তারবার্তাগুলোর সুবাদে সারা বিশ্বের মানুষ, বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর শাসক। আমরাও আরও ভালো করে জানতে পারছি, আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, জরুরি শাসনসহ যাবতীয় কিছু কতটা মার্কিন কূটনীতিকদের মুখাপেক্ষী।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
বিবৃতিটি অদ্ভুত মনে হচ্ছে এই কারণে যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব উইকিলিকসকে দলটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অংশীদার করে ফেলেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বোধ হয় জানা নেই, গত ৩০ আগস্ট উইকিলিকসের ভারচুয়াল ভান্ডার থেকে যেসব মার্কিন গোপনীয় কূটনৈতিক তারবার্তা চুরি হয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলোর সংখ্যা দুই লাখ ৫১ হাজার ২৭৮। পৃথিবীজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ২৭৪টি দূতাবাস, কনস্যুলেট ও কূটনৈতিক মিশন আছে, সেগুলো থেকে তারবার্তাগুলো ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে পাঠিয়েছেন মার্কিন কূটনীতিকেরা (সাধারণত রাষ্ট্রদূত, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স, কনসাল জেনারেলসহ বিভিন্ন উচ্চপদের কর্মকর্তারা)। আড়াই লাখের বেশি এসব তারবার্তা পাঠানো হয়েছে ১৯৬৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর থেকে ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে যে বিপুলসংখ্যক তারবার্তা লেখা হয়েছে, সেগুলো কি ২০০৬ সালে উদ্ভূত একটি ছোট্ট ওয়েবসাইটের মাত্র সাত-আটজন কর্মীর পক্ষে তিন-চার বছরে বানিয়ে বানিয়ে লেখা সম্ভব? আর বিশ্বময় ব্যাপ্ত এই বিরাট ব্যাপারের মধ্যে বাংলাদেশের জায়গা কতটুকু, এতে বিএনপি নামের দলটির গুরুত্বই বা কী? উইকিলিকস বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে! কী হাস্যকর!
আরও কী অদ্ভুত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শুধু উইকিলিকসকেই ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত করে ক্ষান্ত হননি; একই অভিযোগ এনেছেন এ দেশের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধেও। তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন, ‘দেশকে রাজনীতিশূন্য করতে ষড়যন্ত্রকারীরা উইকিলিকসের অপ্রমাণিত তারবার্তা বেছে নিয়েছেন।’ এই ‘ষড়যন্ত্রকারীরা’ হলো বাংলাদেশের সেই সব সংবাদপত্র, যেগুলো উইকিলিকসের ‘অপ্রমাণিত’ তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে এমন সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলেছে, যা পড়ে বিএনপির ‘শীর্ষস্থানীয় নেতারা’ দেশবাসীর কাছে তো বটেই, এমনকি সম্ভবত নিজেদের কাছেও ‘হেয়’ প্রতিপন্ন হচ্ছেন। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক, উইকিলিকসের প্রকাশ করা মার্কিন তারবার্তাগুলোতে শুধু বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাই নয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাও আছে এবং সেগুলো মোটেও প্রশংসাসূচক নয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাঁদের লেখা তারবার্তাগুলোর জন্য বিএনপির নেতাদের মধ্যে এই বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে বিভিন্ন সময়ে কর্মরত মার্কিন কূটনীতিকদের সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তিনি বলেছেন, মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তাগুলোর বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। এ কথার মানে কী? মার্কিন কূটনীতিকেরা মিথ্যা কথা লিখেছেন? না, মির্জা ফখরুল এমন কথা বলেননি। তিনি বলতে চেয়েছেন, তারবার্তাগুলো উইকিলিকসের কর্মীদের মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা, মানে বানোয়াট। তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, উইকিলিকসের এসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে কল্পকথা বা ফ্যান্টাসি বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এমন খবর কোথায় পেলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? ‘উইকিলিকসের এসব তথ্য’ মানে কী? উইকিলিকস কি কোনো তথ্য দিয়েছে? না, তারা মার্কিন তারবার্তাগুলো হুবহু, অবিকল, যেমন আছে ঠিক তেমন অবস্থায় ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে মাত্র। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল, এমনকি পাঁচ দেশের যে পাঁচটি মূলধারার পত্রিকা (বিলেতের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, জার্মানির ডের স্পিগেল, ফ্রান্সের লা মঁদ ও স্পেনের আল পাইস) উইকিলিকসের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে গত নভেম্বর থেকে মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তাগুলোর ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন শুরু করে, তারাও যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে উইকিলিকসের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে এই কারণে, ওয়েবসাইটটি গোপনীয় তারবার্তাগুলো ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে কোনো ধরনের সম্পাদনা ছাড়াই (বিভিন্ন ব্যক্তির নাম মুছে না দিয়ে)। অর্থা ৎ , তারবার্তাগুলো যে মার্কিন কূটনীতিকদেরই লেখা, এ ব্যাপারে কেউ কোনো সন্দেহই প্রকাশ করেননি। সুতরাং, উইকিলিকসের প্রকাশ করা তারবার্তাগুলো কল্পকথা বা ফ্যান্টাসি—মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই মন্তব্য ঠিক নয়।
বরং তিনি যদি বলতেন, ঢাকা থেকে মার্কিন কূটনীতিকেরা যেসব তারবার্তা ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠিয়েছেন, সেগুলো কল্পকথা, ‘বিএনপির শীর্ষ নেতা’দের সম্পর্কে ওই কূটনীতিকদের ফ্যান্টাসি, তাহলে তাঁর অবস্থানের একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল না। যুক্তিটা হতো তাঁর দলীয় রাজনৈতিক যুক্তি: দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা দেশবাসীর কাছে হেয়প্রতিপন্ন হোন, তা তিনি চান না; চান না যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির ‘নিবিড় সম্পর্ক’ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। কিন্তু সেটা করতে হলে মির্জা ফখরুলকে খুব সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে যেসব রাষ্ট্রদূত ও চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (হ্যারি কে টমাস, প্যাট্রেসিয়া এ বিউটেনিস, গীতা পাসি, জেমস এফ মরিয়ার্টি) ওই তারবার্তাগুলো পাঠিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে হবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কি পারবেন হিলারি ক্লিনটনকে এমন কথা লিখতে, ‘আমাদের দেশবাসীর কাছে বিএনপিকে হেয় করার হীন লক্ষ্যে এবং আপনার দেশ ও তার প্রশাসনের সঙ্গে বিএনপির যে “নিবিড় সম্পর্ক” রয়েছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত করার জঘন্য উদ্দেশ্যে আপনার কূটনীতিকেরা এসব “কল্পকথা” (ফ্যান্টাসি) রচনা করেছেন।’ যদি পারেন, তাহলে সঠিক জায়গায় আঘাত করা হবে এবং সেটাই হবে যুক্তিযুক্ত। অবশ্য সে রকম সাহস অর্জন করার আগে নিজের মনটাকে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মার্কিন তারবার্তাগুলোতে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণভাবে ‘কল্পকথা’, নাকি সেগুলোর কিছু ভিত্তি আছে, এ দেশের জনসাধারণ সেসব সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে—এই বিষয়গুলো ভালোভাবে ভেবে নেওয়া উচিত। একটা বিষয় অন্তত অস্বচ্ছ নেই—আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, গত চার-পাঁচ বছরের রাজনীতি, জরুরি অবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে জনগণের মনে যে সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে, মার্কিন কূটনীতিকদের তারবার্তাগুলো তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নয়, বরং অনেক সাধারণ ধারণা সত্য বলে বিশ্বাস জাগায়।
তারবার্তাগুলো অসম্পাদিত অবস্থায় ইন্টারনেটে প্রকাশিত হয়ে পড়ায় অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, এর ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। মার্কিন কূটনীতিকেরা বিব্রত হবেন, অনেকে চাকরি হারানোর ঝুঁকি বোধ করবেন, অনেকে হত্যার শিকারও হতে পারেন। যেসব ব্যক্তি তাঁদের তথ্য দিয়েছেন, সেসব ব্যক্তি আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হবেন, অনেকে আক্রান্তও হতে পারেন। এসব আশঙ্কা কতটা বাস্তবভিত্তিক আর কতটা তাত্ত্বিক (প্রথাগত সাংবাদিকতার নিরিখে), তা খতিয়ে দেখার জন্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) সম্প্রতি এক বড় ধরনের অনুসন্ধান চালিয়েছে। তারা বেশ কিছু মার্কিন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেছে, ফাঁস হওয়া তারবার্তাগুলোর মধ্যে তাঁদের পাঠানো তারবার্তাও রয়েছে। এপি বলছে, একজন কূটনীতিকও মনে করেন না যে তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি বোধ করছেন, বরং তাঁরা স্বস্তিতেই আছেন (কমফোরটেবল উইথ দেয়ার নেমস ইন দ্য ওপেন অ্যান্ড নো ওয়ান ফিয়ারিং ডেথ)। তাঁরা যদি কল্পকথা রচনা করতেন, তাহলে কি এমন স্বস্তিতে থাকতে পারতেন? বরং তাঁরা স্বস্তিতে আছেন সম্ভবত এই কথা ভেবে, তারবার্তাগুলোর সুবাদে সারা বিশ্বের মানুষ, বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর শাসক। আমরাও আরও ভালো করে জানতে পারছি, আমাদের স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, জরুরি শাসনসহ যাবতীয় কিছু কতটা মার্কিন কূটনীতিকদের মুখাপেক্ষী।
মশিউল আলম: সাংবাদিক
mashiul.alam@gmail.com
No comments