মধ্যবিত্ত জীবন-শাহরিক পাবলিকের ব্যথা ও বিচ্ছেদ by ফারুক ওয়াসিফ
শিশুদের বলা হয়েছিল গ্রামের ছবি আঁকতে। সবাই আঁকল গাছসহ একটি কুঁড়েঘর, সামনে চিকন নদী; আকাশে দু-চারটা খুদে পাখি। একজন আঁকল আরও কিছু। তার কুঁড়েঘর একটি নয়, কয়েকটি; গাছও একাধিক, উড়াল পাখিও তার বেশি। বাড়তি ঘরগুলো সে কেন এঁকেছে। শিশুটির জবাব, ‘বারে, প্রতিবেশী ছাড়া গ্রাম হয় নাকি?’
গ্রামের শিশুটি শহরে বসে ছবি আঁকতে গিয়েও মনে রেখেছে, অনেক ঘরের প্রতিবেশী ছাড়া গ্রাম হয় না, বসতি হয় না।
হয়তো এ ধরনেরই কিছু শিশু, আর তাদের বাবা-মা, প্রতিবেশিতার ক্ষুধা যারা ভোলেনি, মাঝেমধ্যে তাদের দেখি রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে। ঢাকার বাসাবোতে একটি মাঠ দখলের হাত থেকে রক্ষার দাবিতে দাঁড়িয়েছে এ রকম কিছু মানুষ। ধানমন্ডিবাসীকেও এলাকার আবাসিক চরিত্র রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হামেশাই মাঠ-পার্ক দখল করে মার্কেট-অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। সারা দেশেই বানের জলের মতো বাণিজ্যের আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার, বেড়ানোর আর মেলামেশা করার মুক্ত জায়গাগুলো। বাজার ঘিরে ফেলছে বসতিকে। এসবের চাপে হাঁসফাঁস করা মানুষের প্রতিবাদে কেবল মাঠ-ময়দান রক্ষার আকুতিই নেই, আছে হারানো প্রতিবেশিতার জন্য আহাজারি। এ রকম অবস্থাতেই ঢাকার বাইরে মনোরম আবাসিক প্রকল্পের বাজার রমরমা হয়। কিন্তু সমাজের বাইরে দ্বীপের মতো থাকাটা কি সমাধান?
মানবজাতির ইতিহাসে কেউ কখনো যেখানে থাকার কথা কল্পনা করেনি, আমরা এখন সেখানকারই বাসিন্দা। যা ছিল আগে অভিশাপ, এখন তাকেই সুযোগ ভাবছি আমরা। যে শহর আমাদের দিয়েছিল অবারিত সুযোগের বিজ্ঞাপনী হাতছানি, বাস্তবে তা এক শাহরিক মরুভূমি। মানবিক সম্পর্ক হটিয়ে যখন বাজারি সম্পর্ক জায়গা নেয়, তখন সেই সম্পর্কে আর প্রাণ থাকে না। সামাজিক শিকড় শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই শহর পরিণত হয় সম্পর্কের মরুভূমিতে। অন্যদিকে, মানুষ আছে কিন্তু সমাজ নেই এমন জায়গা হলো বাজার। পরস্পরের ভাষা বোঝারও দরকার নেই, কথা হবে মুদ্রার ভাষায়। আমরা কেবল একত্র হই বাজারে বা বাসে। পাবলিক টয়লেট ছাড়া পাবলিকের কোনো নিজস্ব জায়গা নেই এই শহরে।
বাজারিকতার তীর্থ হলো শপিং মল। দরকারে বা অদরকারে, আনন্দে বা দুঃখে, একা থাকতে বা মানুষ দেখতে সেখানে যাওয়া হয়। আগে অবসাদগ্রস্ত বা সমস্যাগ্রস্ত মানুষ প্রতিবেশী বা বন্ধুর কাছে যেত। এখন শুনি, মন খারাপ থাকলে বা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হলে অনেকে শপিং মলে যায়, জিনিস কিনে মন ‘ভালো’ করে। দায়িত্ব নেওয়ার মতো বন্ধু মেলা ভার। বাংলাদেশে এখন তাই বাজার জাগ্রত, সমাজ মৃতপ্রায়। সমাজ-সামাজিকতা যেন পুরাকালের রূপকথা।
ক্রেতা-বিক্রেতা পরস্পরের সঙ্গে যত কথা বলে, তত কথা বাজারি-প্রয়োজনের বাইরের কারও সঙ্গে বলা যায় কি? তেমন কাউকে পায় কি? বলার জায়গাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, জগতে যোগ্য মানুষ রয়েছে, কিন্তু তাকে চেনানোর যোগ্য মঞ্চ নেই। পাবলিক স্পেস, প্রতিবেশিতা ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলো হলো সেই মঞ্চ। আগে মানুষ দল বেঁধে পার্কে বা নদীর তীরে বেড়াতে যেত। কয়েক বাড়ির গিন্নিরা বা বন্ধুবান্ধব যেত সিনেমা হলে। খেলার মাঠে, পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকান, বসতির মাঝখানের খোলা চত্বরে জানাশোনা-কথাবার্তা চলত। এসব জায়গাও দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। তার জায়গা নিচ্ছে পেশা বা অঞ্চলভিত্তিক সোসাইটি এবং অভিজাত ক্লাব।
এখন যার কেউ নেই তার আছে টেলিভিশন, ফেসবুক-ইন্টারনেট। একমাত্র টেলিভিশনেই আমরা অন্য মানুষের জীবন দেখি। কর্মস্থল থেকে বাজার বা শপিং মল হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসি, কিংবা কম্পিউটারে খুলি ফেসবুক। সেটাও তো নিজেকে নিয়েই থাকা। শহরের রাস্তাঘাটে অনেককেই দেখি, বিড়বিড় করে কথা বলে চলেছে। শোনার কেউ নেই, তাই নিজের সঙ্গেই নিরন্তর কথোপকথন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কমবেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
সমাজহীন প্রতিবেশিতাহীন আমাদের নতুন পরিচয় হলো ক্রেতা, আমরা ক্রেতাসমাজের ‘সম্মানিত’ সদস্য। আমাদের মানসিক চাওয়া-পাওয়ার জন্য আছে টিভি-ফেসবুক-ইন্টারনেটের কল্পিত সমাজ; আমরা টিভি-জেনারেশন, সিটিজেনের বদলে নেটিজেন। বাস্তব কমিউনিটি হারিয়ে আমরা ভার্চুয়াল কমিউনিটিতে অশরীরী ভূতের মতো ঘুরে বেড়াই। শিখে ফেলছি একা বাঁচতে, কারও মুখাপেক্ষী না থাকতে, সঙ্গ না চাইতে, নিজের সমস্যা নিজেই মেটাতে। এটাই আধুনিকতা, এটাই ম্যাচিউরড পারসোনালিটি বা পাকা মানুষ হওয়ার শর্ত। তাহলে কি আমরা আমাদের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকেও বলব ‘সেলফ হেল্প ইজ বেস্ট হেল্প’? দায় নেব না দেব না—এই পাতলা পিরিতির মধ্যেই আটকে থাকবে মানবিক আবেগ ও ভালোবাসার প্রবৃত্তি?
এই সম্পর্ক লাভালাভের সম্পর্ক, বাজারের সম্পর্ক। এই স্বার্থপরতার ফল আত্মপরতা, আমরা আত্মতুষ্ট ও অহমিকাসর্বস্ব হয়ে উঠি। পণ্য কিনে সুখে ফুলে উঠি, টিভি-বিজ্ঞাপন-বিলবোর্ড আর ফেসবুকের আয়নায় নিজেদের ফাঁপানো ভাবমূর্তি দেখে চিত্ত ফুরফুরা করি। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বৌম্যান যেমন বলেন, সর্বক্ষণ নিজের মনের কুয়াশার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকা অহংসর্বস্ব ব্যক্তিটি খেয়াল করে না, সে আসলে এক সলিটারি প্রিজনের মধ্যে বন্দী। পাশের খোপের নিঃসঙ্গ বন্দীটিকেও সে দেখে না, দেখে না ঘরের বা মনের খোপে আটক আরও অজস্র বন্দীকে। এই অবস্থায় একটাই পরিত্রাণ, ‘আপন মনের খেয়ালে, মুরগি এঁকে দেয়ালে...’। শপিং মল সেই খেয়াল চরিতার্থতার জায়গা, ইন্টারনেট সেই আনন্দমূর্তি আঁকার পর্দা। অথচ আমরা জানতেও পারি না, আমরা সবাই গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদি। আধুনিক শাহরিকতার এই বিচ্ছেদ আর এই শাস্তি নিয়ে তবু আমরা মোরগের মতো গর্বিত।
নিঃসঙ্গ মানুষের ভয় বেশি। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তার নিত্যসঙ্গী। হারানোর ভয়, বাদ পড়ার ভয়, চাকরি হারানোর ভয়, আয় কমে যাওয়া অথবা শেয়ার বা ব্যবসায় মার খাওয়ার ভয় আমাদের আত্মাকে কুরে কুরে খায়। শাহরিক গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে অনেকে। না পেরে মানিয়ে নিতে শিখি। শিখতে চাই সহ্যক্ষমতা বাড়ানো, পিছলে যাওয়ার চালাকি, বাড়তি দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের ব্যাকরণ। আমাদের শেখাতেন আগে ডেল কার্নেগি, এখন আছেন শিব খেরা। মনের ব্যায়াম, শরীরের ব্যায়ামও বাদ রাখি না। খুঁজি অরগানিক খাদ্য, শিখি ইয়োগা বা সালসা নৃত্য। আত্মাহীন পরিবেশে আধ্যাত্মিক ক্ষুধাও বাড়ে আমাদের। বাজার তখন এগিয়ে দেয় ভগবান রজনীশ বা জাকির নায়েক কিংবা কোয়ান্টাম গুরু দীপক চোপড়াকে।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রকৃতির যে শক্তিগুলোকে আমরা ভয় পাই, সেগুলো রহস্যময় হয়ে ধরা দেয় আমাদের চোখে। সেগুলোর কার্যকারণ কী, তাদের চাবিকাঠি কাদের হাতে, তা জানতে পারি না। এসবের উত্তর বাজারে মেলে না। যদিও জানি, অনেকেই এ রকম নিঃসঙ্গ ও সমস্যাগ্রস্ত, তবু কোনো সামষ্টিক সমাধানের সুযোগ আমাদের হাতে নেই। অনেকেই চেষ্টা করছেন এই নাগরিক মরুভূমি ছেড়ে মফস্বলে কিংবা বিদেশে চলে যেতে। অথচ ঢাকাই ধরন গ্রাম-মফস্বলকেও গ্রাস করছে, যেমন ঢাকাকে গ্রাস করছে আরও যান্ত্রিক পশ্চিমা জীবনধারা। সেই ‘যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব...সম্ভবত গড়িয়াহাটার দিকে’। পালাবে কোথায়, সব তো একই!
সামষ্টিক সমস্যার ব্যক্তিগত সমাধান হয় না। আবার বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের পক্ষে সবাই মিলে কিছু করাও কঠিন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান একসঙ্গে কোটি মানুষ দেখে বটে, কিন্তু অনুষ্ঠান বিষয়ে কোটি দর্শকের মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। সত্যিকার দিনবদলের চেষ্টার ঝুঁকিও অনেক, তাতে কষ্টার্জিত ব্যক্তিস্বাধীনতা কাটা পড়তে পারে! স্বাধীনতার মূল্যেই তাই আমরা নিরাপদ তন্দ্রা খরিদ করি। এটা কেমন স্বাধীনতা যেখানে পাবলিকের মতামত দেওয়ার বা অবস্থা বদলাবার সুযোগ নেই, যেমন নেই একদামের দোকানে দর-কষাকষির সুযোগ!
পাবলিক প্লেসহীন পাবলিকের ইচ্ছা মার্কেটপ্লেসে মরে যায়। এইভাবে ছাড়া অন্য কোনোভাবে বাঁচার অপশন যেখানে নেই, সেটা কেমন নগর, কেমন ব্যক্তিস্বাধীনতা, কেমন তার নাগরিকতা? তাই শাহরিক স্বাধীনতা ও সুযোগ একটা রংদার বিজ্ঞাপনী ফানুস ছাড়া আর কী? ফানুসটা ফেটে গেলে দেখতে পাই, কী একা, অক্ষম ও অনিরাপদ আমাদের এই শাহরিকতা। পাবলিক পরিসরগুলো রক্ষা ও বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই পাবলিকের। ব্যথা ও বিচ্ছেদের এই শাহরিকতার ব্যাকরণও কি নতুন করে ভাবার সময় আসেনি?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
হয়তো এ ধরনেরই কিছু শিশু, আর তাদের বাবা-মা, প্রতিবেশিতার ক্ষুধা যারা ভোলেনি, মাঝেমধ্যে তাদের দেখি রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে। ঢাকার বাসাবোতে একটি মাঠ দখলের হাত থেকে রক্ষার দাবিতে দাঁড়িয়েছে এ রকম কিছু মানুষ। ধানমন্ডিবাসীকেও এলাকার আবাসিক চরিত্র রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হামেশাই মাঠ-পার্ক দখল করে মার্কেট-অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। সারা দেশেই বানের জলের মতো বাণিজ্যের আগ্রাসনে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার, বেড়ানোর আর মেলামেশা করার মুক্ত জায়গাগুলো। বাজার ঘিরে ফেলছে বসতিকে। এসবের চাপে হাঁসফাঁস করা মানুষের প্রতিবাদে কেবল মাঠ-ময়দান রক্ষার আকুতিই নেই, আছে হারানো প্রতিবেশিতার জন্য আহাজারি। এ রকম অবস্থাতেই ঢাকার বাইরে মনোরম আবাসিক প্রকল্পের বাজার রমরমা হয়। কিন্তু সমাজের বাইরে দ্বীপের মতো থাকাটা কি সমাধান?
মানবজাতির ইতিহাসে কেউ কখনো যেখানে থাকার কথা কল্পনা করেনি, আমরা এখন সেখানকারই বাসিন্দা। যা ছিল আগে অভিশাপ, এখন তাকেই সুযোগ ভাবছি আমরা। যে শহর আমাদের দিয়েছিল অবারিত সুযোগের বিজ্ঞাপনী হাতছানি, বাস্তবে তা এক শাহরিক মরুভূমি। মানবিক সম্পর্ক হটিয়ে যখন বাজারি সম্পর্ক জায়গা নেয়, তখন সেই সম্পর্কে আর প্রাণ থাকে না। সামাজিক শিকড় শুকিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই শহর পরিণত হয় সম্পর্কের মরুভূমিতে। অন্যদিকে, মানুষ আছে কিন্তু সমাজ নেই এমন জায়গা হলো বাজার। পরস্পরের ভাষা বোঝারও দরকার নেই, কথা হবে মুদ্রার ভাষায়। আমরা কেবল একত্র হই বাজারে বা বাসে। পাবলিক টয়লেট ছাড়া পাবলিকের কোনো নিজস্ব জায়গা নেই এই শহরে।
বাজারিকতার তীর্থ হলো শপিং মল। দরকারে বা অদরকারে, আনন্দে বা দুঃখে, একা থাকতে বা মানুষ দেখতে সেখানে যাওয়া হয়। আগে অবসাদগ্রস্ত বা সমস্যাগ্রস্ত মানুষ প্রতিবেশী বা বন্ধুর কাছে যেত। এখন শুনি, মন খারাপ থাকলে বা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হলে অনেকে শপিং মলে যায়, জিনিস কিনে মন ‘ভালো’ করে। দায়িত্ব নেওয়ার মতো বন্ধু মেলা ভার। বাংলাদেশে এখন তাই বাজার জাগ্রত, সমাজ মৃতপ্রায়। সমাজ-সামাজিকতা যেন পুরাকালের রূপকথা।
ক্রেতা-বিক্রেতা পরস্পরের সঙ্গে যত কথা বলে, তত কথা বাজারি-প্রয়োজনের বাইরের কারও সঙ্গে বলা যায় কি? তেমন কাউকে পায় কি? বলার জায়গাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, জগতে যোগ্য মানুষ রয়েছে, কিন্তু তাকে চেনানোর যোগ্য মঞ্চ নেই। পাবলিক স্পেস, প্রতিবেশিতা ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলো হলো সেই মঞ্চ। আগে মানুষ দল বেঁধে পার্কে বা নদীর তীরে বেড়াতে যেত। কয়েক বাড়ির গিন্নিরা বা বন্ধুবান্ধব যেত সিনেমা হলে। খেলার মাঠে, পাড়ার মোড়ে, চায়ের দোকান, বসতির মাঝখানের খোলা চত্বরে জানাশোনা-কথাবার্তা চলত। এসব জায়গাও দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। তার জায়গা নিচ্ছে পেশা বা অঞ্চলভিত্তিক সোসাইটি এবং অভিজাত ক্লাব।
এখন যার কেউ নেই তার আছে টেলিভিশন, ফেসবুক-ইন্টারনেট। একমাত্র টেলিভিশনেই আমরা অন্য মানুষের জীবন দেখি। কর্মস্থল থেকে বাজার বা শপিং মল হয়ে টেলিভিশনের সামনে বসি, কিংবা কম্পিউটারে খুলি ফেসবুক। সেটাও তো নিজেকে নিয়েই থাকা। শহরের রাস্তাঘাটে অনেককেই দেখি, বিড়বিড় করে কথা বলে চলেছে। শোনার কেউ নেই, তাই নিজের সঙ্গেই নিরন্তর কথোপকথন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কমবেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
সমাজহীন প্রতিবেশিতাহীন আমাদের নতুন পরিচয় হলো ক্রেতা, আমরা ক্রেতাসমাজের ‘সম্মানিত’ সদস্য। আমাদের মানসিক চাওয়া-পাওয়ার জন্য আছে টিভি-ফেসবুক-ইন্টারনেটের কল্পিত সমাজ; আমরা টিভি-জেনারেশন, সিটিজেনের বদলে নেটিজেন। বাস্তব কমিউনিটি হারিয়ে আমরা ভার্চুয়াল কমিউনিটিতে অশরীরী ভূতের মতো ঘুরে বেড়াই। শিখে ফেলছি একা বাঁচতে, কারও মুখাপেক্ষী না থাকতে, সঙ্গ না চাইতে, নিজের সমস্যা নিজেই মেটাতে। এটাই আধুনিকতা, এটাই ম্যাচিউরড পারসোনালিটি বা পাকা মানুষ হওয়ার শর্ত। তাহলে কি আমরা আমাদের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকেও বলব ‘সেলফ হেল্প ইজ বেস্ট হেল্প’? দায় নেব না দেব না—এই পাতলা পিরিতির মধ্যেই আটকে থাকবে মানবিক আবেগ ও ভালোবাসার প্রবৃত্তি?
এই সম্পর্ক লাভালাভের সম্পর্ক, বাজারের সম্পর্ক। এই স্বার্থপরতার ফল আত্মপরতা, আমরা আত্মতুষ্ট ও অহমিকাসর্বস্ব হয়ে উঠি। পণ্য কিনে সুখে ফুলে উঠি, টিভি-বিজ্ঞাপন-বিলবোর্ড আর ফেসবুকের আয়নায় নিজেদের ফাঁপানো ভাবমূর্তি দেখে চিত্ত ফুরফুরা করি। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক জিগমুন্ট বৌম্যান যেমন বলেন, সর্বক্ষণ নিজের মনের কুয়াশার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকা অহংসর্বস্ব ব্যক্তিটি খেয়াল করে না, সে আসলে এক সলিটারি প্রিজনের মধ্যে বন্দী। পাশের খোপের নিঃসঙ্গ বন্দীটিকেও সে দেখে না, দেখে না ঘরের বা মনের খোপে আটক আরও অজস্র বন্দীকে। এই অবস্থায় একটাই পরিত্রাণ, ‘আপন মনের খেয়ালে, মুরগি এঁকে দেয়ালে...’। শপিং মল সেই খেয়াল চরিতার্থতার জায়গা, ইন্টারনেট সেই আনন্দমূর্তি আঁকার পর্দা। অথচ আমরা জানতেও পারি না, আমরা সবাই গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদি। আধুনিক শাহরিকতার এই বিচ্ছেদ আর এই শাস্তি নিয়ে তবু আমরা মোরগের মতো গর্বিত।
নিঃসঙ্গ মানুষের ভয় বেশি। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তার নিত্যসঙ্গী। হারানোর ভয়, বাদ পড়ার ভয়, চাকরি হারানোর ভয়, আয় কমে যাওয়া অথবা শেয়ার বা ব্যবসায় মার খাওয়ার ভয় আমাদের আত্মাকে কুরে কুরে খায়। শাহরিক গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে অনেকে। না পেরে মানিয়ে নিতে শিখি। শিখতে চাই সহ্যক্ষমতা বাড়ানো, পিছলে যাওয়ার চালাকি, বাড়তি দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের ব্যাকরণ। আমাদের শেখাতেন আগে ডেল কার্নেগি, এখন আছেন শিব খেরা। মনের ব্যায়াম, শরীরের ব্যায়ামও বাদ রাখি না। খুঁজি অরগানিক খাদ্য, শিখি ইয়োগা বা সালসা নৃত্য। আত্মাহীন পরিবেশে আধ্যাত্মিক ক্ষুধাও বাড়ে আমাদের। বাজার তখন এগিয়ে দেয় ভগবান রজনীশ বা জাকির নায়েক কিংবা কোয়ান্টাম গুরু দীপক চোপড়াকে।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রকৃতির যে শক্তিগুলোকে আমরা ভয় পাই, সেগুলো রহস্যময় হয়ে ধরা দেয় আমাদের চোখে। সেগুলোর কার্যকারণ কী, তাদের চাবিকাঠি কাদের হাতে, তা জানতে পারি না। এসবের উত্তর বাজারে মেলে না। যদিও জানি, অনেকেই এ রকম নিঃসঙ্গ ও সমস্যাগ্রস্ত, তবু কোনো সামষ্টিক সমাধানের সুযোগ আমাদের হাতে নেই। অনেকেই চেষ্টা করছেন এই নাগরিক মরুভূমি ছেড়ে মফস্বলে কিংবা বিদেশে চলে যেতে। অথচ ঢাকাই ধরন গ্রাম-মফস্বলকেও গ্রাস করছে, যেমন ঢাকাকে গ্রাস করছে আরও যান্ত্রিক পশ্চিমা জীবনধারা। সেই ‘যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব...সম্ভবত গড়িয়াহাটার দিকে’। পালাবে কোথায়, সব তো একই!
সামষ্টিক সমস্যার ব্যক্তিগত সমাধান হয় না। আবার বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের পক্ষে সবাই মিলে কিছু করাও কঠিন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান একসঙ্গে কোটি মানুষ দেখে বটে, কিন্তু অনুষ্ঠান বিষয়ে কোটি দর্শকের মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। সত্যিকার দিনবদলের চেষ্টার ঝুঁকিও অনেক, তাতে কষ্টার্জিত ব্যক্তিস্বাধীনতা কাটা পড়তে পারে! স্বাধীনতার মূল্যেই তাই আমরা নিরাপদ তন্দ্রা খরিদ করি। এটা কেমন স্বাধীনতা যেখানে পাবলিকের মতামত দেওয়ার বা অবস্থা বদলাবার সুযোগ নেই, যেমন নেই একদামের দোকানে দর-কষাকষির সুযোগ!
পাবলিক প্লেসহীন পাবলিকের ইচ্ছা মার্কেটপ্লেসে মরে যায়। এইভাবে ছাড়া অন্য কোনোভাবে বাঁচার অপশন যেখানে নেই, সেটা কেমন নগর, কেমন ব্যক্তিস্বাধীনতা, কেমন তার নাগরিকতা? তাই শাহরিক স্বাধীনতা ও সুযোগ একটা রংদার বিজ্ঞাপনী ফানুস ছাড়া আর কী? ফানুসটা ফেটে গেলে দেখতে পাই, কী একা, অক্ষম ও অনিরাপদ আমাদের এই শাহরিকতা। পাবলিক পরিসরগুলো রক্ষা ও বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই পাবলিকের। ব্যথা ও বিচ্ছেদের এই শাহরিকতার ব্যাকরণও কি নতুন করে ভাবার সময় আসেনি?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments