নাগরিক বিড়ম্বনা-সহজে বিল ও ট্যাক্স পরিশোধ by মো. আলী আকবর মল্লিক

অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, পেশায় প্রকৌশলী রেদওয়ান রহমান ঢাকার একটি আবাসিক এলাকায় বাস করেন। চারতলা বাড়ির একটি তলায় নিজে থাকেন, অন্যগুলো ভাড়া দিয়েছেন। অবসর ভাতা আর হাউজ বিল্ডিং লোন নিয়ে শেষজীবনে বাড়িটি করেছেন। একটি ট্রেড লাইসেন্স আছে কিছু কনসালট্যান্সির কাজ করার জন্য।


রেদওয়ান রহমান প্রতি মাসে পাঁচটি খাতে, যথা—হাউজ বিল্ডিং লোনের কিস্তি, গ্যাস, বিদ্যুৎ , পানি ও টেলিফোনের বিল এবং প্রতিবছর সাতটি খাতে যথা জমির খাজনা, ইনকাম ট্যাক্স, ডিসিসির ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ফি, গাড়ির রোড ট্যাক্স, ফিটনেস ফি ও ইনস্যুরেন্স ফি পরিশোধ করেন। এ জন্য তিনি ডজন খানেক জায়গায় ছোটাছুটি করেন। যানজটের কারণে সারা দিনে দু-একটির বেশি কাজ করতে পারেন না। একদিন চলতি বছরের ইনকাম ট্যাক্স পরিশোধ ও রিটার্ন জমা দিতে গিয়ে রাস্তায় মহা যানজটের কবলে পড়ে গাড়ির মধ্যে বসে যা ভাবছিলেন, তা তাঁর কথায়:
ইনকাম ট্যাক্স পরিশোধ ও রিটার্ন জমা দিতে যে কাঠ-খড় পোড়াতে হয়, তা করার সময় কতজনের আছে? কর্মক্ষম সেসব মানুষের কর্মঘণ্টার মূল্য কত? এ সময় বাসায় থাকলে তো কিছু কনসালট্যান্সির কাজ করতে পারতাম! যানজটে মোটরযানগুলোয় যে বাড়তি তেল-গ্যাস পোড়ে, তার মূল্য কত? তা আমদানি করতে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়?
বিল বা ট্যাক্স পরিশোধ করতে আমাকে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নেমে পড়ে যানজটে অংশগ্রহণ করতে হয় কেন? এসব বিল বা ট্যাক্স ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয় (অটো-ডেবিট) পদ্ধতিতে পরিশোধ করার ব্যবস্থা নেই কেন? জাপানে বেড়াতে গিয়ে জামাইয়ের মুখে শুনেছি, তারা সব বিল বা যেকোনো পাওনা একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অটো-ডেবিট পদ্ধতিতে পরিশোধ করে। বাসার পোস্টবক্সে বিলগুলোর ইনভয়েস আসে। বাংলাদেশে এখন প্রায় সব ব্যাংকে অনলাইনের সুবিধা আছে। সুতরাং, এ দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অটো-ডেবিটে বিল বা ট্যাক্স পরিশোধের পদ্ধতি চালু করতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
ঢাকা শহরে এমন কোনো পরিবার নেই, যার কোনো না কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নেই। একটি পরিবারের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সব ধরনের বিল বা ট্যাক্স পরিশোধ করার পদ্ধতি চালু করা কঠিন নয়। যা করতে হবে:
(ক) প্রতিটি পরিবার একটি করে নির্ধারিত ফরম পূরণ করবে। ফরমটি সেবামূলক সব প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওয়া যাবে। ফরমের যথাস্থানে পরিবারপ্রধানের নাম, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম ও নম্বর, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, ন্যাশনাল আইডি নম্বর এবং মোবাইল ও ল্যান্ডফোনের নম্বর লিখতে হবে।
(খ) উদাহরণস্বরূপ, রেদওয়ান রহমানের ক্ষেত্রে (ক)-এর ১২টি কপি করতে হবে, পাঁচটি মাসিক ও সাতটি বাৎ সরিক খাতের জন্য। প্রতিটি কপিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে একটি করে টিকচিহ্ন দিতে হবে, যা মাসিক খাতে: (১) হাউজ বিল্ডিং লোনের কিস্তি, (২) তিতাস গ্যাস, (৩) ডেসকোর বিদ্যুৎ , (৪) ওয়াসার পানি ও (৫) বিটিসিএলের টেলিফোন বিল এবং বাৎ সরিক খাতে: (১) জমির খাজনা, (২) এনবিআরের ইনকাম ট্যাক্স, (৩) ডিসিসির ট্যাক্স, (৪) ডিসিসির ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ফি, (৫) গাড়ির রোড ট্যাক্স, (৬) বিআরটিএর গাড়ির ফিটনেস ফি ও (৭) গাড়ির ইনস্যুরেন্স ফি। প্রত্যেকটি খাতের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কাস্টমার কোড নম্বর উল্লেখ করতে হবে।
(গ) ফরমের শেষভাগে ‘উল্লিখিত খাতে মাসিক বা বাৎ সরিক পাওনা টাকা ওই খাতে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে আমার দেওয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অটো-ডেবিট করার অনুমতি দিলাম’—এমন অঙ্গীকারনামা থাকবে, যার নিচে স্বাক্ষর করতে হবে।
(ঘ) ১২টি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিলসংক্রান্ত হার্ড কপির ইনভয়েস সময়মতো গ্রাহকের বর্তমান ঠিকানায় পাঠাবে, যা এখনো করা হয়।
(ঙ) পাঁচটি মাসিক খাতের প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকে মাসিক বিলের জন্য পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে তাঁদের পাওনা টাকার জন্য ব্যাংকের সার্ভারে ইনভয়েস পাঠাবে। সেখান থেকে তাঁদের প্রত্যেকের কাস্টমার কোড নম্বরের সঙ্গে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর টালি করে পাওনা টাকা ১৫ তারিখের মধ্যে অটো-ডেবিট হবে। একই পদ্ধতিতে বাৎ সরিক প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো তাদের পাওনা টাকার জন্য ব্যাংকের সার্ভারে ইনভয়েস পাঠাবে এবং অটো-ডেবিট হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা অটো-ডেবিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকার পরিমাণ ও খাত ব্যাংকের আইটি সিস্টেম থেকে মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেবে। এ ছাড়া এটিএম কার্ড দিয়ে বা ব্যাংকের কল সেন্টার থেকেও জেনে নেওয়া যাবে।
(চ) যদি কোনো গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত ফান্ড না থাকার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানের পাওনা অটো-ডেবিট করতে না পারে, তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের মোবাইলে তা জানাবে। ১০ দিনের মধ্যে গ্রাহক টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানকে জানাবে। প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, যেমন বর্তমানে নেয়।
(ছ) বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের এই মর্মে চুক্তি থাকবে, তারা দেশের জনগণকে এই গ্রাহকসেবা দিতে বাধ্য থাকবে। ব্যাংক ১২টি প্রতিষ্ঠানকে এই সার্ভিস দেওয়ার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সার্ভিস চার্জ নেবে, যা বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করবে।
রেদওয়ান রহমান নামটি কাল্পনিক, কিন্তু এই চরিত্রটি বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক হতে পারেন। উল্লিখিত ১২টি খাতে পাওনা পরিশোধ করতে যে গলদঘর্ম হতে হয়, তা কল্পনাকেও হার মানায়। সহজ পদ্ধতি ‘একটি পরিবার, একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, অটো-ডেবিটে পাওনা পরিশোধ’ চালু করা দরকার।
ড. মো. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ।
dৎ mollickmaa@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.