নদীর পানি ভাগাভাগি-মমতাহীন মমতা, মমতাহীন ভারত by নজরুল ইসলাম
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠকের আশানুরূপ সাফল্যের অভাবের জন্য অনেকেই পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে দায়ী করেছেন। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি মমতাহীনা কি না, সে প্রশ্ন এখানে নিরর্থক। একজন চৌকস রাজনীতিবিদের মতো তিনি তাঁর স্বার্থ দেখেছেন এবং তা দেখতে গিয়ে নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রত এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহের মুখ্যমন্ত্রীদের এবং জনগণকে হতাশ করতে দ্বিধা করেননি।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কীভাবে তার স্বার্থ রক্ষা করতে পারে।
প্রথমেই বলা দরকার, প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি; এবং মমতা ব্যানার্জি এ চুক্তি সম্পর্কে কখন কী বলেছেন বা করেছেন, তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই। সুতরাং এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকার বিবরণের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। এ বিবরণ অনুযায়ী, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশ সরকার তিস্তার পানি অর্ধেক অর্ধেক বিভক্তিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি তাতে সন্তুষ্ট নন; তিনি চান ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশ পানি। তাই তিস্তা চুক্তি আর সম্ভব হয়নি।
এদিকে সম্ভবত মমতা ব্যানার্জির অবস্থান দ্বারা উৎ সাহিত হয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার সম্প্রতি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি চুক্তি পর্যালোচনার দাবি জানিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বিহারের জন্য আরও বেশি গঙ্গার পানি চান এবং মনে করেন, এ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশকে বেশি পানি দেওয়া হয়ে গেছে। এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে অভিন্ন নদ-নদীর পানির ওপর অনেক ভারতীয় রাজনীতিবিদের দাবি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৩০-৪০ শতাংশ থেকে তাঁদের দাবি এখন ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে।
বলা বাহুল্য, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের এসব অযৌক্তিক দাবির ভিত্তি হলো ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান। উজান-অবস্থানের সুযোগে ভারত একে একে বাংলাদেশের নদ-নদীসমূহ থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। গঙ্গার ওপর ফারাক্কা এবং তিস্তার ওপর গজলডোবা থেকে শুরু করে ভারত প্রায় সব অভিন্ন নদ-নদীর ওপর পানি প্রত্যাহারমূলক কাঠামো হয় ইতিমধ্যে নির্মাণ করেছে, নির্মাণে রত, অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারত এসব কাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের সম্মতির অপেক্ষা করেনি; অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যথাযথভাবে অবহিত করারও প্রয়োজন মনে করেনি। একবার নির্মাণ করে প্রত্যাহূত পানি ব্যবহার শুরু করে দিলে স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রকল্পের পক্ষে একটি স্বার্থগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যায়; এবং তখন নানা অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশকে সেই প্রকল্প মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
অথচ ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ (দ্রষ্টব্য: প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১১) প্রবন্ধে আমরা দেখিয়েছে যে নদ-নদীর প্রতি ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ (Ecological appৎ oach) অনুযায়ী নদীর পূর্ণ প্রবাহই বাংলাদেশের প্রাপ্য। এটা এ জন্য নয় যে বাংলাদেশ লোভী এবং ভারতকে বঞ্চিত করতে চায়। এটা এ জন্য যে প্রকৃতির বিধান অনুযায়ীই নদ-নদীসমূহ তিব্বত থেকে শুরু হয়ে চীন, নেপাল, সিকিম, ভুটান, ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অবশেষে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। যুগ যুগ ধরে নদ-নদীর এই স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের ওপর নির্ভর করেই তীরবর্তী অঞ্চলের প্রকৃতি, অর্থনীতি ও জীবনধারা গড়ে উঠেছে। এখন ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৌশল শক্তিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে বাঁধ কিংবা ব্যারাজ নির্মাণ করে এই স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত করে নদীর পানি ব্যাপক হারে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা একটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ পদক্ষেপ। এ রকম পদক্ষেপ নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’র (Commeৎ cial appৎ oach) প্রকাশ। এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর জন্য প্রযোজ্য হলেও একবিংশ শতাব্দীর জন্য উপযোগী নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ উপায়ে নদীর পানির গতিপথের পরিবর্তন সাময়িক ও সংকীর্ণ কিছু সুবিধা দিলেও তা বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি বিচারে সফল হয় না; বরং প্রকৃতি-পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি ডেকে আনে। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘বাঁধবিষয়ক বিশ্ব কমিশনে’র (Woৎ ld Commission on Dams) প্রতিবদনে এ বিষয়ে প্রচুর সাক্ষ্য সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহার নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন-বিরোধী। সর্বোপরি, ভারতের এসব প্রকল্প নদীর ওপর বাংলাদেশের জনগণের ‘প্রচলিত ও পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারের অধিকারে’র পরিষ্কার লঙ্ঘন।
যেহেতু ভারত কোনো যুক্তিই মানছে না, সেহেতু আমরা ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিটে’র প্রস্তাব করেছিলাম এবং পাঠকেরা সেই প্রস্তাব ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, কোনো উচ্চপদস্থ আমলা নদীর সঙ্গে ট্রানজিটের ইস্যু-সম্পর্কিত করাকে ‘ছেলেমানুষি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আরেক আমলা-উপদেষ্টা ভারতকে ট্রানজিট না দেওয়া অথবা ট্রানজিট সুযোগের বিনিময়ে মাশুল দাবি করাকে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এ ধরনের মনোভঙ্গি নিয়ে ভারতের সঙ্গে লেনদেনে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করা দুরূহ। সৌভাগ্যবশত দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নদী এবং ট্রানজিটের ইস্যুর মধ্যকার সংযোগের বিষয়টি অনেকটা স্বজ্ঞাগতভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ভারত যখন নদীবিষয়ক চুক্তিতে অসম্মত হয়, তখন বাংলাদেশেও ট্রানজিট চুক্তিতে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে এক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ আপাতত রক্ষা পায়।
অতঃপর কী করণীয়? প্রথমত, বাংলাদেশকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে এবং সেই অবস্থান থেকে ভারতের সঙ্গে নদীবিষয়ক আলোচনা পরিচালনা করতে হবে। অর্থাৎ পানি ভাগাভাগির খেলা আর নয়; এ খেলায় বাংলাদেশ ক্রমাগত হেরেই চলেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হারবে। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যে নদ-নদীর পূর্ণ প্রবাহ তার প্রাপ্য এবং এ প্রাপ্য তাকে সাহসের সঙ্গে দাবি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদীর ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কাঠামোতে সীমাবদ্ধ থাকার বাধ্যবাধকতা অনুভব করার কোনো কারণ নেই। ভারত বাংলাদেশের ওপর এ দ্বিপক্ষীয় কাঠামো আরোপ করেছে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার বিনিময়ে বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দেয়নি। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ইস্যুতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয়েছে। নদীর ইস্যুতেও বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের শরণাপন্ন হতে পারে। ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীয় ভাবমূর্তি উন্নয়নে ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে আগ্রহী। সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জানা প্রয়োজন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নদীর ইস্যুতে কী ধরনের আচরণ করছে। বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই। কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামই ভাটির দেশের কাছ থেকে নদীর ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশ পানি প্রত্যাহারমূলক মমতা ব্যানার্জির দাবি সমর্থন করবে না।
তৃতীয়ত, সংবাদে প্রকাশ যে এখন চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি উত্তরাভিমুখী করার একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করছে। ভারত এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করছে এবং চায় যে বাংলাদেশও তার সঙ্গে এ বিরোধিতায় যোগ দিক। ভারতের এই অবস্থান যে কতখানি স্ববিরোধী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ভারতকে জানাতে পারে যে পানি প্রত্যাহারমূলক স্বীয় সব স্থাপনা অপসারণ এবং ভবিষ্যতে এ রকম স্থাপনা নির্মাণ না করায় প্রতিশ্রুত হলেই কেবল বাংলাদেশ এ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে চীনের অবস্থানের বিরোধিতায় যোগ দিতে পারে।
চতুর্থত, ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিটে’র যে ফর্মুলা বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সে ফর্মুলায় একনিষ্ঠ থাকতে হবে। অর্থাৎ , যদি ভারত ট্রানজিট-সুবিধা চায়, তবে বিনিময়ে বাংলাদেশকে নদ-নদীসমূহের পূর্ণ প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে।
উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ ভারতের একটি স্পর্শকাতর অংশ। এই অংশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের বিশেষভাবে প্রয়োজন। যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি নিয়ে নিতে পারছে, সেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারতের বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট প্রয়োজন। এটাই ভারতের আপেক্ষিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক দুর্বলতার শক্তির দিক। এটাই ভারতের ওপর বাংলাদেশের প্রভাব খাটানোর একমাত্র অবলম্বন। এই অবলম্বন হারালে নদ-নদীসমূহ ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায়ই বাংলাদেশের খোলা থাকবে না।
বিগত সময়কালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ বাংলাদেশের কিছু কিছু সংস্থা ও স্থানকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎ পরতাকে উৎ সাহিত করায় ব্যবহার করছিল। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মোটামুটি একতরফাভাবে এসব সুযোগ ও তৎ পরতা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের উচিত, বাংলাদেশের এ সহযোগিতাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা। ভারত যদি ট্রানজিটের সুযোগ পায় এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হয়, তাহলে সত্যিই ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহের জন্য উন্নয়নের এক নতুন যুগের সূচনা হবে। সুতরাং ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলায় ভারতের স্বার্থ প্রবল।
সুতরাং, নদীর ইস্যু মমতার নয়, স্বার্থের। তবে স্বার্থ আবার বিভিন্ন ধরনের হয়। প্রত্যক্ষ, উপস্থিত ও দৃশ্যমান স্বার্থ ছাড়াও আরেক ধরনের স্বার্থ রয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উদ্দীপ্ত আত্মস্বার্থ’ (ইংরেজিতে, Enlightened self-inteৎ est)। ট্রানজিটের মধ্যে নিশ্চয়ই ভারতের প্রত্যক্ষ, উপস্থিত ও দৃশ্যমান স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যেও ভারতের উদ্দীপ্ত স্বার্থ রয়েছে। কারণ, এ দেশের স্থিতিশীলতা ভঙ্গ হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের ওপর তার প্রভাব পড়বে।
যেমন—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা। এ নিমজ্জন প্রতিরোধে বাংলাদেশের মূল বর্ম হলো পলিমাটিভরণ। অথচ ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পলিমাটিভরণও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বার্ষিক পলির পরিমাণ ২০০ কোটি টন থেকে ইতিমধ্যেই ১০০ কোটি টনে কমেছে। মমতা ব্যানার্জির দাবি পূরণ হলে এর পরিমাণ আরও কমবে এবং বাংলাদেশের নিমজ্জনের মাত্রা আরও বাড়বে। কাজেই নদীর প্রবাহ অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকায় সহায়তা করার মধ্যে ভারতের ও পশ্চিম বাংলার উদ্দীপ্ত স্বার্থ আছে।
একইভাবে মনে রাখা দরকার, যে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সেই জনগণই ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। কাজেই নদী বিষয়ে ভারতের বৈরী আচরণ বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোণঠাসা করে এবং সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী শক্তিকে শক্তিশালী করে। কাজেই নদীর প্রবাহ অবারিত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত-বিরোধিতা প্রশমিত করার মধ্যেও ভারত ও পশ্চিম বাংলার উদ্দীপ্ত স্বার্থ নিহিত আছে।
সুতরাং আমরা আশা করতে চাই, মমতা ব্যানার্জি ও অন্য ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা নদীর প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য মমতা দ্বারা পরিচালিত না হলেও, অন্তত উদ্দীপ্ত আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবেন। তাহলেই নদ-নদীসমূহ বিরোধের উৎ স না হয়ে বন্ধুত্বের রাখিবন্ধন হতে পারবে।
আর বাংলাদেশের জনগণকে বুঝতে হবে, নদীর পূর্ণ প্রবাহ আমাদের প্রাপ্য, এই বোধ নিয়ে ঘরে বসে থাকলে সে প্রাপ্য আদায় হবে না। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ইস্যুতে যতটা মাঠে নামতে ইচ্ছুক, নদীর মতো দেশের বহত্তর ইস্যুতে ততটা নয়। এই অবস্থায় পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাই।
ড. নজরুল ইসলাম: বিশ্ব-সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন); সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
ben.editoৎ @yahoo.com
প্রথমেই বলা দরকার, প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির খসড়া জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি; এবং মমতা ব্যানার্জি এ চুক্তি সম্পর্কে কখন কী বলেছেন বা করেছেন, তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই। সুতরাং এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকার বিবরণের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। এ বিবরণ অনুযায়ী, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশ সরকার তিস্তার পানি অর্ধেক অর্ধেক বিভক্তিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি তাতে সন্তুষ্ট নন; তিনি চান ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশ পানি। তাই তিস্তা চুক্তি আর সম্ভব হয়নি।
এদিকে সম্ভবত মমতা ব্যানার্জির অবস্থান দ্বারা উৎ সাহিত হয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার সম্প্রতি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি চুক্তি পর্যালোচনার দাবি জানিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বিহারের জন্য আরও বেশি গঙ্গার পানি চান এবং মনে করেন, এ চুক্তির অধীনে বাংলাদেশকে বেশি পানি দেওয়া হয়ে গেছে। এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে অভিন্ন নদ-নদীর পানির ওপর অনেক ভারতীয় রাজনীতিবিদের দাবি দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৩০-৪০ শতাংশ থেকে তাঁদের দাবি এখন ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশে পৌঁছেছে।
বলা বাহুল্য, ভারতীয় রাজনীতিবিদদের এসব অযৌক্তিক দাবির ভিত্তি হলো ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান। উজান-অবস্থানের সুযোগে ভারত একে একে বাংলাদেশের নদ-নদীসমূহ থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। গঙ্গার ওপর ফারাক্কা এবং তিস্তার ওপর গজলডোবা থেকে শুরু করে ভারত প্রায় সব অভিন্ন নদ-নদীর ওপর পানি প্রত্যাহারমূলক কাঠামো হয় ইতিমধ্যে নির্মাণ করেছে, নির্মাণে রত, অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারত এসব কাঠামো নির্মাণের জন্য বাংলাদেশের সম্মতির অপেক্ষা করেনি; অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যথাযথভাবে অবহিত করারও প্রয়োজন মনে করেনি। একবার নির্মাণ করে প্রত্যাহূত পানি ব্যবহার শুরু করে দিলে স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রকল্পের পক্ষে একটি স্বার্থগোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যায়; এবং তখন নানা অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশকে সেই প্রকল্প মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।
অথচ ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ (দ্রষ্টব্য: প্রথম আলো, ২৭ জুলাই ২০১১) প্রবন্ধে আমরা দেখিয়েছে যে নদ-নদীর প্রতি ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ (Ecological appৎ oach) অনুযায়ী নদীর পূর্ণ প্রবাহই বাংলাদেশের প্রাপ্য। এটা এ জন্য নয় যে বাংলাদেশ লোভী এবং ভারতকে বঞ্চিত করতে চায়। এটা এ জন্য যে প্রকৃতির বিধান অনুযায়ীই নদ-নদীসমূহ তিব্বত থেকে শুরু হয়ে চীন, নেপাল, সিকিম, ভুটান, ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অবশেষে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। যুগ যুগ ধরে নদ-নদীর এই স্বাভাবিক গতিপ্রবাহের ওপর নির্ভর করেই তীরবর্তী অঞ্চলের প্রকৃতি, অর্থনীতি ও জীবনধারা গড়ে উঠেছে। এখন ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৌশল শক্তিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে বাঁধ কিংবা ব্যারাজ নির্মাণ করে এই স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত করে নদীর পানি ব্যাপক হারে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা একটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ পদক্ষেপ। এ রকম পদক্ষেপ নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’র (Commeৎ cial appৎ oach) প্রকাশ। এই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর জন্য প্রযোজ্য হলেও একবিংশ শতাব্দীর জন্য উপযোগী নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে প্রকৃতিবিরুদ্ধ উপায়ে নদীর পানির গতিপথের পরিবর্তন সাময়িক ও সংকীর্ণ কিছু সুবিধা দিলেও তা বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি বিচারে সফল হয় না; বরং প্রকৃতি-পরিবেশ ও অর্থনীতির ক্ষতি ডেকে আনে। ২০০০ সালে প্রকাশিত ‘বাঁধবিষয়ক বিশ্ব কমিশনে’র (Woৎ ld Commission on Dams) প্রতিবদনে এ বিষয়ে প্রচুর সাক্ষ্য সংকলিত হয়েছে। এ ছাড়া ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহার নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন-বিরোধী। সর্বোপরি, ভারতের এসব প্রকল্প নদীর ওপর বাংলাদেশের জনগণের ‘প্রচলিত ও পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবহারের অধিকারে’র পরিষ্কার লঙ্ঘন।
যেহেতু ভারত কোনো যুক্তিই মানছে না, সেহেতু আমরা ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিটে’র প্রস্তাব করেছিলাম এবং পাঠকেরা সেই প্রস্তাব ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো, কোনো উচ্চপদস্থ আমলা নদীর সঙ্গে ট্রানজিটের ইস্যু-সম্পর্কিত করাকে ‘ছেলেমানুষি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আরেক আমলা-উপদেষ্টা ভারতকে ট্রানজিট না দেওয়া অথবা ট্রানজিট সুযোগের বিনিময়ে মাশুল দাবি করাকে ‘প্রাগৈতিহাসিক’ আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এ ধরনের মনোভঙ্গি নিয়ে ভারতের সঙ্গে লেনদেনে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করা দুরূহ। সৌভাগ্যবশত দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নদী এবং ট্রানজিটের ইস্যুর মধ্যকার সংযোগের বিষয়টি অনেকটা স্বজ্ঞাগতভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং ভারত যখন নদীবিষয়ক চুক্তিতে অসম্মত হয়, তখন বাংলাদেশেও ট্রানজিট চুক্তিতে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে এক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশ আপাতত রক্ষা পায়।
অতঃপর কী করণীয়? প্রথমত, বাংলাদেশকে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে অবস্থান নিতে হবে এবং সেই অবস্থান থেকে ভারতের সঙ্গে নদীবিষয়ক আলোচনা পরিচালনা করতে হবে। অর্থাৎ পানি ভাগাভাগির খেলা আর নয়; এ খেলায় বাংলাদেশ ক্রমাগত হেরেই চলেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হারবে। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যে নদ-নদীর পূর্ণ প্রবাহ তার প্রাপ্য এবং এ প্রাপ্য তাকে সাহসের সঙ্গে দাবি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদীর ইস্যুতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার কাঠামোতে সীমাবদ্ধ থাকার বাধ্যবাধকতা অনুভব করার কোনো কারণ নেই। ভারত বাংলাদেশের ওপর এ দ্বিপক্ষীয় কাঠামো আরোপ করেছে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে তার বিনিময়ে বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দেয়নি। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা ইস্যুতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয়েছে। নদীর ইস্যুতেও বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের শরণাপন্ন হতে পারে। ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীয় ভাবমূর্তি উন্নয়নে ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভে আগ্রহী। সুতরাং, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জানা প্রয়োজন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নদীর ইস্যুতে কী ধরনের আচরণ করছে। বাংলাদেশের হারানোর কিছু নেই। কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামই ভাটির দেশের কাছ থেকে নদীর ৭৫ কিংবা ৮০ শতাংশ পানি প্রত্যাহারমূলক মমতা ব্যানার্জির দাবি সমর্থন করবে না।
তৃতীয়ত, সংবাদে প্রকাশ যে এখন চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি উত্তরাভিমুখী করার একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করছে। ভারত এসব প্রকল্পের বিরোধিতা করছে এবং চায় যে বাংলাদেশও তার সঙ্গে এ বিরোধিতায় যোগ দিক। ভারতের এই অবস্থান যে কতখানি স্ববিরোধী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ভারতকে জানাতে পারে যে পানি প্রত্যাহারমূলক স্বীয় সব স্থাপনা অপসারণ এবং ভবিষ্যতে এ রকম স্থাপনা নির্মাণ না করায় প্রতিশ্রুত হলেই কেবল বাংলাদেশ এ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে চীনের অবস্থানের বিরোধিতায় যোগ দিতে পারে।
চতুর্থত, ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিটে’র যে ফর্মুলা বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সে ফর্মুলায় একনিষ্ঠ থাকতে হবে। অর্থাৎ , যদি ভারত ট্রানজিট-সুবিধা চায়, তবে বিনিময়ে বাংলাদেশকে নদ-নদীসমূহের পূর্ণ প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে।
উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ ভারতের একটি স্পর্শকাতর অংশ। এই অংশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা ভারতের বিশেষভাবে প্রয়োজন। যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি নিয়ে নিতে পারছে, সেই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারতের বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট প্রয়োজন। এটাই ভারতের আপেক্ষিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক দুর্বলতার শক্তির দিক। এটাই ভারতের ওপর বাংলাদেশের প্রভাব খাটানোর একমাত্র অবলম্বন। এই অবলম্বন হারালে নদ-নদীসমূহ ফিরে পাওয়ার আর কোনো উপায়ই বাংলাদেশের খোলা থাকবে না।
বিগত সময়কালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ বাংলাদেশের কিছু কিছু সংস্থা ও স্থানকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎ পরতাকে উৎ সাহিত করায় ব্যবহার করছিল। চট্টগ্রামের ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনা তারই সাক্ষ্য বহন করে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মোটামুটি একতরফাভাবে এসব সুযোগ ও তৎ পরতা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের উচিত, বাংলাদেশের এ সহযোগিতাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা। ভারত যদি ট্রানজিটের সুযোগ পায় এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হয়, তাহলে সত্যিই ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহের জন্য উন্নয়নের এক নতুন যুগের সূচনা হবে। সুতরাং ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ফর্মুলায় ভারতের স্বার্থ প্রবল।
সুতরাং, নদীর ইস্যু মমতার নয়, স্বার্থের। তবে স্বার্থ আবার বিভিন্ন ধরনের হয়। প্রত্যক্ষ, উপস্থিত ও দৃশ্যমান স্বার্থ ছাড়াও আরেক ধরনের স্বার্থ রয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উদ্দীপ্ত আত্মস্বার্থ’ (ইংরেজিতে, Enlightened self-inteৎ est)। ট্রানজিটের মধ্যে নিশ্চয়ই ভারতের প্রত্যক্ষ, উপস্থিত ও দৃশ্যমান স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো জনবহুল প্রতিবেশী দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যেও ভারতের উদ্দীপ্ত স্বার্থ রয়েছে। কারণ, এ দেশের স্থিতিশীলতা ভঙ্গ হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের ওপর তার প্রভাব পড়বে।
যেমন—জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা। এ নিমজ্জন প্রতিরোধে বাংলাদেশের মূল বর্ম হলো পলিমাটিভরণ। অথচ ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে পলিমাটিভরণও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বার্ষিক পলির পরিমাণ ২০০ কোটি টন থেকে ইতিমধ্যেই ১০০ কোটি টনে কমেছে। মমতা ব্যানার্জির দাবি পূরণ হলে এর পরিমাণ আরও কমবে এবং বাংলাদেশের নিমজ্জনের মাত্রা আরও বাড়বে। কাজেই নদীর প্রবাহ অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকায় সহায়তা করার মধ্যে ভারতের ও পশ্চিম বাংলার উদ্দীপ্ত স্বার্থ আছে।
একইভাবে মনে রাখা দরকার, যে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সেই জনগণই ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। কাজেই নদী বিষয়ে ভারতের বৈরী আচরণ বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোণঠাসা করে এবং সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী শক্তিকে শক্তিশালী করে। কাজেই নদীর প্রবাহ অবারিত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত-বিরোধিতা প্রশমিত করার মধ্যেও ভারত ও পশ্চিম বাংলার উদ্দীপ্ত স্বার্থ নিহিত আছে।
সুতরাং আমরা আশা করতে চাই, মমতা ব্যানার্জি ও অন্য ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা নদীর প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণ ও প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য মমতা দ্বারা পরিচালিত না হলেও, অন্তত উদ্দীপ্ত আত্মস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবেন। তাহলেই নদ-নদীসমূহ বিরোধের উৎ স না হয়ে বন্ধুত্বের রাখিবন্ধন হতে পারবে।
আর বাংলাদেশের জনগণকে বুঝতে হবে, নদীর পূর্ণ প্রবাহ আমাদের প্রাপ্য, এই বোধ নিয়ে ঘরে বসে থাকলে সে প্রাপ্য আদায় হবে না। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ইস্যুতে যতটা মাঠে নামতে ইচ্ছুক, নদীর মতো দেশের বহত্তর ইস্যুতে ততটা নয়। এই অবস্থায় পরিবেশ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাই।
ড. নজরুল ইসলাম: বিশ্ব-সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন); সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
ben.editoৎ @yahoo.com
No comments