পলাশীর যুদ্ধ : স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত নয় পরাধীনতার হাতবদল by ড. তুহিন ওয়াদুদ
বাংলার ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস। এই পরাধীনতার ইতিহাস কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রচলিত অর্থে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাকে পরাধীনতার সময় বলে গণ্য করা হলেও প্রকৃত অর্থে এই পরাধীনতার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ইংরেজরা এ দেশে আসার আগে থেকেই এ দেশ পরাধীনতার গ্রাসে পতিত ছিল।
বঙ্গ থেকে বাংলা নামের উৎপত্তি। প্রাচীন মহাভারতে, ঋগ্বেদে বঙ্গ নামের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদেও বঙ্গ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন_'আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী'। বাংলার প্রাচীন জনপদ বিবেচনায় বাংলা ভূখণ্ড গড়ে ওঠার ইতিহাস আমাদের কাছে সম্পূর্ণ আলো-আঁধারি। বঙ্গ নামে একটি জনপদ ছিল। কিন্তু শুধু ওই জনপদটুকুই বর্তমান বাংলাদেশ নয়। বর্তমান বাংলাদেশের একটি অংশ মাত্র ছিল তৎকালীন বঙ্গ জনপদ। আবার ওই জনপদটুকু যে আলাদা কোনো শাসক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে তার কোনো স্বতন্ত্র রাজার ইতিহাস জানা যায় না। শশাঙ্ককে প্রথমবারের মতো কয়েকটি জনপদকে একত্র করে শাসন করতে দেখা যায়। তখন বাংলাদেশ বঙ্গ নামে শাসিত হয়নি। এমনকি পাল কিংবা সেন আমলেও বাংলা অন্যান্য জনপদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে শাসিত হলেও বাংলা কিংবা বঙ্গ নামে ছিল না। শশাঙ্ক কিংবা পাল রাজারা অথবা সেন রাজারা যে শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন, তার কোথাও বঙ্গ শাসনের কথা উল্লেখ নেই। বরং গৌড় শাসনের কথা উল্লেখ আছে। বাংলা গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিংবা বাংলার অন্য নাম ছিল গৌড়। ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে যে বিজয় অর্জন করেন, তাকে বাংলা বিজয় না বলে গৌড় বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রায় গৌড় উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গ প্রাচীন জনপদের অন্যতম একটি জনপদ হলেও বঙ্গ দেশ হিসেবে শাসনের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার মতো নেই। খিস্টপূর্বকালের ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং পাণিনির অষ্টাধ্যয়ীতে বঙ্গ শব্দের উল্লেখ নেই; কিন্তু গৌড়ের উল্লেখ আছে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বঙ্গ, গৌড়, বরেন্দ্রী, সূক্ষ্ম, সমতট জনপদকে একত্র করে নিজেকে শাহ-ই-বাঙালিয়ান বা সুলতান-ই-বাঙ্গালা বলে ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এই প্রথম বঙ্গ দেশের নামে প্রকৃত অর্থে শাসক পাওয়া গেল। তবে এই শাসক বাঙালি শাসক নয়। ১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবরের বাংলা দখলের মধ্য দিয়ে বাংলায় মোগল আমলের যাত্রা শুরু হয়। মোগল শাসনামলের দীর্ঘকাল বাংলাদেশ পরাধীনতার মধ্যে থেকে শাসিত হয়েছে। ঠিক কবে থেকে বাংলার পরাধীনতা, তারও সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ আমাদের জানা নেই। তবে প্রচলিত অর্থে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সূত্রপাত তার ভেতর দিয়ে বাংলার পরাধীনতা শুরু হয় বলে যে ধারণা আছে, তা অমূলক এবং বিভ্রান্তিকর। অনেক মুসলমান ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করার দিনটিকে মুসলমানদের বিজয়ের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। প্রকৃত অর্থে এ কথাও ঠিক নয়। তুর্কি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি আফগানিস্তান থেকে বাংলা বিজয় করেছিলেন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য থেকে নয়, তিনি রাজ্য জয় করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বখতিয়ার খিলজির শাসনক্ষমতাকে তখনকার সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিজেদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। পাল শাসনামলে প্রায় ৪০০ বছর হিন্দু-বৌদ্ধ যে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যেও ছেদ পড়ে। খিলজি শাসনের পর সুলতানি শাসনামল, মোগল শাসনামলে যাঁরা বাংলা শাসন করেছেন, তাঁরা কেউই বাঙালি ছিলেন না। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ের আগে নবাব সিরাজদ্দৌলা বাংলা শাসন করে আসছিলেন। নবাব যদি বাঙালি হতেন, তাহলে আমরা বলতে পারতাম বাঙালির স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে নবাব ছিলেন একজন তুর্কমেন। তাঁর পিতামহ আলীবর্দী খানও ছিলেন তুর্কমেন। তারই ধারাবাহিকতায় সিরাজদ্দৌলা ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ফলে যৌক্তিকভাবেই বলা যায়, পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে বাংলার পরাধীনতার হাতবদল হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আগমনে যেমন এখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানরা খুশি হয়েছিল, তেমনি ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলে এখানকার হিন্দুরা খুশি হয়েছিল। হিন্দুরা যেহেতু ক্ষমতাসীন ছিল না, তাই তারা তৎকালীন মুসলমান শাসকদের পরাজয়ে খুশি হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পর নব্য ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে শোষণের শক্ত থাবা নিয়ে উপস্থিত হয় পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী। একের পর এক আমাদের শাসক বদলেছে আর শোষণের মাত্রা বেড়েছে। পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাসে আমাদের ভূখণ্ডের গণমানুষ উত্তরোত্তর বেশি শোষিত হয়েছে। যেমন মোগলদের তুলনায় অনেক বেশি শোষণ করেছে ব্রিটিশরা। আবার ব্রিটিশদের শোষণকে শুধু নয়, সব কালের শোষণকে হার মানিয়ে শোষণের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ছিল পাকিস্তান সরকার। সে কারণে বলা যায়, বাংলার যে লিখিত ইতিহাস আমাদের কাছে আছে তাতে যে শাসকদের পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে শক, হুন, কুশাণ, গুপ্ত, শশাঙ্ক, পাল, সেন, খিলজি, সুলতান, মোগল, ব্রিটিশ, পাকিস্তানি কেউই বাঙালি নয়। পাল শাসকরা বাঙালি বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন, তবে পক্ষে সে ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করা যায়নি।
আমাদের শাসক বদলেছে, অধীনতা দূর হয়নি। আমাদের ইতিহাসের সমান আমাদের পরাধীনতা। আর সেই পরাধীনতা থেকে বাঙালিদের মুক্তি ঘটেছে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আজকের বাংলাদেশ বঙ্গ, বাঙ্গাল, বঙ্গাল, পূর্ববঙ্গ_যে নামেই পরিচিতি অর্জন করুক না কেন, বাংলাদেশ নামের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শাসনকালে বলেছিলেন, আমাদের ভূখণ্ডের নাম হবে বাংলাদেশ। যিনি বাংলাদেশের নামকরণ করেছিলেন তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে এবং দীর্ঘকালের পরাধীনতার হাতবদল থেকে নিজেদের মুক্ত করে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com
আমাদের শাসক বদলেছে, অধীনতা দূর হয়নি। আমাদের ইতিহাসের সমান আমাদের পরাধীনতা। আর সেই পরাধীনতা থেকে বাঙালিদের মুক্তি ঘটেছে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। আজকের বাংলাদেশ বঙ্গ, বাঙ্গাল, বঙ্গাল, পূর্ববঙ্গ_যে নামেই পরিচিতি অর্জন করুক না কেন, বাংলাদেশ নামের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক দিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের শাসনকালে বলেছিলেন, আমাদের ভূখণ্ডের নাম হবে বাংলাদেশ। যিনি বাংলাদেশের নামকরণ করেছিলেন তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে এবং দীর্ঘকালের পরাধীনতার হাতবদল থেকে নিজেদের মুক্ত করে।
লেখক : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com
No comments