জ্বালানি-পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উ ৎপাদন ব্যয় কমায় by মুশফিকুর রহমান

দেশে বাণিজ্যিক জ্বালানির ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় এবং শিল্প-বাণিজ্যের জন্যও ব্যয় বাড়ছে। বর্ধিত চাহিদার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বারবার ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।


দীর্ঘদিন ধরে বিপিসি বছরে ৩০-৩৫ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে এলেও গত বছর বিপিসিকে ৫৪ লাখ টন তেল আমদানি করতে হয়েছে। এ বছর ৬৮ থেকে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করতে হবে বলে বিপিসির অনুমান। প্রধানত জ্বালানি তেলনির্ভর নতুন নতুন বিদ্যু ৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণের জন্যই এই বর্ধিত তেলের চাহিদা তৈরি হয়েছে। আবার উচ্চমূল্যে আমদানি করা জ্বালানি তেল উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে বাজারজাত করায় বিপিসি গত বছর প্রায় আট হাজার ১৯৪ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এ বছর ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে আশঙ্কা করছে বিপিসি। সরকারি মালিকানার বিপিসির বিশাল ভর্তুকির দায়ভার প্রকৃত বিচারে দেশের মানুষকেই গুনতে হচ্ছে।
কিন্তু তাই বলে দেশের শিল্পকারখানা, বিদ্যু ৎকেন্দ্র, গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক খাতে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা দ্রুত বাড়ছে না; বরং সস্তা গ্যাস-তেল-বিদ্যুতের অপচয় প্রকট। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহার ও পুনরায় ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও উপযুক্ত প্রণোদনার অভাবে তেমন উদ্যোগের সম্প্রসারণ ঘটছে না।
জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে পৃথিবীজুড়ে উ ৎসাহিত করা হচ্ছে। উন্নত পৃথিবীর এমন উদাহরণ এ দেশে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে যেসব প্রতিষ্ঠান, ঢাকা ইপিজেডে কর্মরত ইওএস টেক্সটাইল মিলস তার অন্যতম। ইওএস টেক্সটাইল মিলস বাংলাদেশে এসেছে ইতালি থেকে বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে। বাংলাদেশে ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে এটি কারখানা প্রতিষ্ঠা শুরু করে। ২০০২ সাল থেকে রপ্তানির জন্য প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিক উ ৎপাদন শুরু করে। এখন প্রতি মাসে ইওএস টেক্সটাইল মিলস ছয় লাখ মিটার বিভিন্ন ধরনের রপ্তানি উপযোগী সুতি কাপড় তৈরি করে। কারখানার উ ৎপাদিত কাপড় সরাসরি রপ্তানি বাজারে বা বাংলাদেশে কর্মরত রপ্তানিমুখী পোশাক উ ৎপাদনকারী কারখানার কাছে বিক্রি করে। ইতিমধ্যে ইওএস টেক্সটাইল মিলস বাংলাদেশে ব্যবসা সংহত করেছে। বিদ্যমান কারখানার সঙ্গেই ইওএস নির্মাণ করছে কারখানার সম্প্রসারিত অংশ। চালু হলে ইওএসের উ ৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে।
দিনরাত বিরতিহীন এ কারখানার উ ৎপাদন চলছে। ঢাকার ইওএস টেক্সটাইল মিলস পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সব কর্মকাণ্ডের জন্য একজন মাত্র বিদেশি কর্মকর্তা ছাড়া কারখানার অন্য সব কাজ বাংলাদেশের প্রায় ২০০ কর্মী সুচারুভাবে সম্পন্ন করছেন। ইওএস টেক্সটাইল কারখানায় আমদানি করা সুতা থেকে বিভিন্ন ধরনের কাপড় বুনন, রং করা, শুকানো এবং প্রয়োজনীয় গুণগত মান পরীক্ষার পর তা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়।
সাদা রঙের সুতা থেকে নির্দিষ্ট আকৃতির কাপড় বুননের পুরো কাজই এই কারখানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পাদিত হয়। এরপর সেই কাপড়ের সঙ্গে লেগে থাকা তুলো, সুতার অপ্রয়োজনীয় অংশ সরিয়ে তা পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার করা কাপড় পর্যায়ক্রমে নির্ধারিত রঙে রঙিন করার পর তা শুকাতে হয়। বলাই বাহুল্য, কারখানার উ ৎপাদন কর্মকাণ্ডের প্রতিটি ধাপে বিদ্যু ৎ এবং তাপশক্তি ব্যবহূত হচ্ছে। তা ছাড়া ঠান্ডা পানি ও বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে, পানি গরম করা, বাষ্প উ ৎপাদন ও তা সঞ্চালন করতে প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। আবার কারখানার পরিবেশ কাজের উপযোগী রাখতে নির্দিষ্ট অংশে এয়ারকন্ডিশনিং সুবিধা দরকার।
ইওএস টেক্সটাইল মিলসের বিদ্যু ৎ চাহিদা পূরণের জন্য কারখানায় দুই মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসচালিত জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণভাবে বিদ্যু ৎকেন্দ্রের বিদ্যু ৎ উ ৎপাদন-প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তি অব্যবহূত ও অপচয় হয়। ব্যাপারটা অনেকটা মোটরগাড়ির উ ৎপাদিত তাপের উল্লেখযোগ্য অংশ তপ্ত রেডিয়েটর ও ধোঁয়া আকারে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো। ইওএস টেক্সটাইল মিলস কর্তৃপক্ষ অধিকাংশের মতো শক্তি অপচয় না করে তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যু ৎ উ ৎপাদনের সময় যে তপ্ত ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, তা একই সঙ্গে গরম এবং এর ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস থাকে। ক্ষতিকর এই ধোঁয়া বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে তা দিয়ে কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় পানি গরম করা, বাষ্প উ ৎপাদন করা যায়। সে কারণে, এখানে বিদ্যু ৎকেন্দ্রের ৫০০-৬০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পরিমাণ তপ্ত ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে পেঁচানো পাইপ দিয়ে এনে পানি গরম করার বয়লারে যুক্ত করা হয়েছে। কারখানার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জলীয় বাষ্পের বেশির ভাগ দুটি বয়লারে এভাবে বর্জ্য ধোঁয়া দিয়ে তৈরি ও ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে।
বিদ্যু ৎকেন্দ্রের বর্জ্য তপ্ত ধোঁয়া বয়লারে পানি ফুটিয়ে প্রয়োজনীয় জলীয় বাষ্প তৈরির পর তার তাপ হারিয়ে প্রায় ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে আসে। বয়লার থেকে বের হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত শীতল ধোঁয়া বিশেষভাবে স্থাপিত ’হিট এক্সচেঞ্জার’-এর সাহায্যে আবার পানি গরম করার কাজে ব্যবহূত হয়। এতে ধোঁয়ার তাপ হ্রাস পেয়ে ৮০-১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে আসে। আবার এই ধোঁয়াতে যেহেতু কার্বন ডাই-অক্সাইড আছে, সে কারণে বায়ুমণ্ডলে তা নিঃসরণ না করে কারখানার বর্জ্য-পানি শোধনাগারে সঞ্চালন করা হচ্ছে।
অপরদিকে, বৈদ্যুতিক জেনারেটর চালাতে যে গ্যাসচালিত ইঞ্জিন ব্যবহূত হয়, সেগুলো ঠান্ডা করতে ব্যবহূত পানি গরম হলে সেই গরম পানি ব্যবহূত হচ্ছে ইওএস টেক্সটাইল মিলসের উইভিং প্ল্যান্টে এয়ারকন্ডিশনিংয়ের কাজে। এতে পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে এবং গরম হয়ে ওঠা পানিকে এবজরপশন চিলারের সহায়তায় এয়ারকন্ডিশনিংয়ের কাজে লাগানো হচ্ছে।
এভাবে ইওএস কারখানার দুই মেগাওয়াট ক্ষমতার জেনারেটর দিয়ে উ ৎপাদিত বিদ্যু ৎশক্তির ৯৭ শতাংশ কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে। পক্ষান্তরে, ঢাকা ইপিজেডের প্রবেশমুখে স্থাপিত ৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যু ৎকেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ শক্তি অপচয় হচ্ছে।
টেক্সটাইল ও ডায়িং কারখানার বর্জ্য-পানিতে কেবল বিভিন্ন রংই মিশ্রিত থাকে না, এজাতীয় বর্জ্য-পানি তীব্রভাবে ক্ষারযুক্ত। পরিবেশের জন্যও তা ক্ষতিকর। তাই পরিশোধন করে এ ধরনের দূষিত পানি ক্ষারমুক্ত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ক্ষারযুক্ত দূষিত পানিকে পরিশোধন করতে অম্ল বা এসিড ব্যবহার করতে হয়। বর্জ্য ধোঁয়ার কার্বন ডাই-অক্সাইড পানির সঙ্গে মেশালে তা এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং ক্ষারযুক্ত দূষিত পানিকে ক্ষারমুক্ত করে। ইওএস কারখানায় বর্জ্য-পানি পরিশোধন প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এখানে ক্ষারযুক্ত পানিকে প্রশমিত পানিতে রূপান্তরের জন্য সচরাচর ব্যবহূত সালফিউরিক এসিডের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। বর্তমানে ইওএস কারখানায় বিভিন্ন রং ও রাসায়নিক মিশ্রিত হয়ে যে দূষিত বর্জ্য-পানি উ ৎপন্ন হচ্ছে, প্রচলিত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে তা পরিশোধন করতে বছরে প্রায় ৬৪ হাজার ডলার মূল্যের সালফিউরিক এসিড প্রয়োজন হতো। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করায় একই সময়ে ইওএস কারখানায় বর্জ্য-পানি শোধনে সালফিউরিক এসিডের জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে মাত্র চার হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার। অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
এভাবে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার কেবল কারখানা সন্নিহিত পরিবেশ রক্ষা, বায়ুমণ্ডলের দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজেই লাগে না, একই সঙ্গে কারখানার উ ৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইওএস টেক্সটাইল মিলস তার উদ্ভাবনী উদ্যোগ পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিবেশ পুরস্কার-২০১১ পেয়েছে।
বাংলাদেশের ‘অতি সস্তা’ জ্বালানি গ্যাস বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে। একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী হিসেবে ইওএস টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইতালির মি. জুজেপ্পে বেরতো স্পষ্ট বোঝেন যে সস্তা গ্যাস অনন্তকাল সস্তায় পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যেই গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠায় ইওএস কারখানা কর্তৃপক্ষ ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যু ৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। গ্যাসের বর্তমান মূল্য বিবেচনায় ফার্নেস তেল ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উ ৎপাদন ব্যয় প্রায় ছয় গুণ বেশি হবে। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার ও তার পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে উ ৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার তাগিদ সংগত কারণেই দক্ষ বিনিয়োগকারীর জন্য একটি অগ্রাধিকার হয়ে সামনে এসেছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.