বিশ্বসভায় বাঙালি-নবজাগরণের প্রত্যাশা
ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণগুলোতে নানা আয়োজনে মুখরিত হয়ে উঠেছে মহানগর ঢাকা। শুধু বাংলাদেশ নয়_ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা কিংবা নিউইয়র্ক, লন্ডনসহ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শহরগুলোতে যেখানেই বাঙালির নিবাস, সেখানেই ক্রমশ নতুন তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি।
পৃথিবীজুড়ে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির যে বিশাল পরিধি গড়ে উঠেছে তার কেন্দ্র বাংলাদেশ, বিশেষভাবে এ দেশের রাজধানী ঢাকা। ১৯৭১ সালের পর বহুবার বহুভাবে এ সত্য উচ্চারিত হয়েছে_ কখনও দ্বিধান্বিত চিত্তে, কখনওবা অকুণ্ঠ ভাষণে বিদ্বজ্জনেরা এ সত্য স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তিতে এ সত্য নতুন তাৎপর্যে ধরা দিচ্ছে প্রতিটি বাঙালির ভাবনা ও ভাষায়। রাষ্ট্র ও সমাজ ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত দায়িত্বগুলো পালন করার ব্যাপারে আন্তরিক মনোভাব প্রদর্শন করছে। বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যেমন ধারণ করছে হাজার বছরের বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো, তেমনিভাবে এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিও নতুন বৈচিত্র্যে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিভাজন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দেশে বা দূরত্বও সমস্ত বাঙালির ঐকতানে সুর কাটতে পারেনি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বসভায় বাঙালির অর্জনগুলো তুলে ধরার ক্ষেত্রে আন্তরিক উদ্যোগ এসেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে, জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করার ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার কথা আবার মনে করিয়ে দিলেন। আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো নিয়েই বিশ্বসভায় আমাদের প্রাপ্য স্থান করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সংকীর্ণতা যেন আমাদের পথের কাঁটা হয়ে না দাঁড়াতে পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শুধু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই নয়_ শিল্পায়ন, বাণিজ্য, উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি নিশ্চিত করা দরকার। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সোমবার ঢাকায় একটি সম্মেলনে আমাদের অতীত বিত্ত-বৈভব ও সমৃদ্ধির ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সাম্প্রতিককালে, দারিদ্র্য ও অভাব যে বাঙালির চিন্তাকে অধিকার করে বসেছে সে কথাও বলেছেন। বর্তমানের এই পশ্চাৎগতি থেকে বাঙালির উত্তরণ কীভাবে সম্ভব? অমর্ত্য সেনের বক্তব্যেই আছে উত্তরণের ইঙ্গিতও। তিনি বাঙালির কিছু অপূর্ব গুণের উল্লেখ করেছেন। যেমন বাঙালির গ্রহণশক্তি ও সমন্বয়প্রীতি। বাঙালির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের পথে এ জাতি যে জাতির সংস্পর্শে এসেছে তার থেকেই গ্রহণ করেছে অকাতরে। কোনো সংকীর্ণতা কখনোই তাকে আচ্ছন্ন করেনি। ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এর অযুত প্রমাণ রয়েছে। আর এ অঞ্চলে বসবাসরত সকল জাতি-সম্প্রদায় ও ধর্মের সঙ্গে মেলবন্ধন সম্ভব করেই এগিয়েছে বাঙালি। গ্রহণ ও সমন্বয়ের এ ধারা কি বর্তমানে কিছুটা স্তিমিত? এ প্রশ্ন উঠবে, কেননা_ স্বাধীন দেশে বাঙালি যখন নিজের সংস্কৃতি সাধনায় মগ্ন তখন এ অঞ্চলের অন্য ভাষা ও সংস্কৃতিগুলো ক্ষীয়মান, তাদের অস্তিত্ব ক্ষেত্র বিশেষে হুমকির মুখে। পুরো পৃথিবীতে ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালি যখন মডেল, তখন তার দেশেই এমন ঘটনা কীভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব? গ্রহণ ও সমন্বয়ের আদর্শ সেখানে ক্রিয়াশীল হচ্ছে না কেন? শুধু বিশ্বসভায় ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই নয়, কিংবা নিজের দেশে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষার প্রশ্নেই নয়_ বাঙালি সংস্কৃতির জন্য বাংলাদেশের দায়িত্বশীলতার মাত্রা আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা ও শিল্পের সেরা অর্জনগুলোর অব্যাহত চর্চা, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা পেঁৗছে দেওয়ার গুরুদায়িত্বও আমাদের ওপরে বর্তায়। উদার মনোভাবাপন্ন গ্রহণশীলতা ও সমন্বয়ের সংস্কৃতিই সে পথে আমাদের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে পারে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্ব বাঙালির কাছে প্রশংসিত হয়েছে। সামনে আরও পথ বাকি। গ্রহণশীলতা ও সমন্বয়ের আদর্শ বাঙালির আরেক নবজাগরণকে সম্ভব করে তুলুক_ ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর পূর্তিতে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments