সমকালীন প্রসঙ্গ-রদবদলের সময় কি এখনও আসেনি by বদিউর রহমান

ন্ত্রীর ভাই আসামিহলে মন্ত্রীর দোষ নেই, ভাইয়ের জন্য ভাই দায়ী হবেন কেন_ অবশ্যই সত্যি কথা; কিন্তু
নৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রী পদত্যাগ করে নজির সৃষ্টি করুন না যে, সুষ্ঠুতদন্তের জন্য তিনি মহত্ত্ব দেখাতে পারেনদেশের রাজনীতিতে গত কয়েক মাসে কিছু চমকপ্রদ কথাবার্তা শোনা গেছে। এগুলোর মধ্যে ছোট দলের সঙ্গে বড় দলের সখ্যের আকুতি এবং তার ফলে আগের গালমন্দের কথা ভুলে গিয়ে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে ভাবীর পদতলে দেবরজির


আত্মসমর্পণ অর্থাৎ খালেদা জিয়ার কাছে অলির বলি হওয়া; রেল লাইনের দৌড় ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর খালেদার ইফতারে যাওয়া এবং কিছু কাজে নৈতিক সমর্থন দেওয়া এবং কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক বিএনপির গলায় গামছা লাগানো যেমন উল্লেখযোগ্য তেমনি এগুলো আবার বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাওয়াও লক্ষণীয়। তারপর বিএনপির রোডমার্চ দিয়ে জনসভায় জনসমাগম দেখানো এবং আওয়ামী লীগের পাল্টা জনসভায় শক্তিমত্তা প্রদর্শনের কাটাকাটি ভাব কিছুটা মাঠ গরম করেছিল বটে; কিন্তু তাও 'ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর' হয়ে পড়েছে, অর্থাৎ এসব জনমনে তেমন 'আসর' করেনি বলা চলে। মনমোহনের সফরের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েও এখন সুনসান নীরবতা, অর্থমন্ত্রীর অনর্থ বক্তব্য_ তিন মাসের মধ্যে তিস্তা চুক্তি আর হলো না, বরং এখন সার্বভৌম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ধরনা দিতে গেলেন রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। ভাবটা যেন ভারতের কেন্দ্র তো মমতাকে বাদ দিয়ে পানি বণ্টন চুক্তি করতে পারল না। অতএব মমতাই ভরসা_ দিদি যদি দয়া করেন। তবুও ভালো কিছু যদি হয় হোক, আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ অন্তত রক্ষা হোক, ট্রানজিট দেওয়ার সমালোচনা অন্তত ব্যালান্সড হোক। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের গডফাদার মনোনয়ন নিয়ে দলটি আরেক ধাক্কা খেল, আঘাতটি হজম করতে না করতেই একই সঙ্গে ঘটল নরসিংদী-বিপর্যয়, খোদ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ড। আসামিদের মধ্যে নিজ দলের লোকই প্রাধান্য পেয়েছে, যে-সে কথা নয়_ একেবারে মন্ত্রীর ভাইও আসামি। লে বাবা, ঠেলা সামলাও। কাকে ধরবে, কাকে ধরবে ঠিক করার আগেই ধরে ফেলে বিএনপির নেতাকে, কী করিৎকর্মা আমাদের পুলিশ! হাইকোর্টে জামিনের জন্য এজাহারভুক্ত তিন আসামি এলেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে না, আইজিপিও সাফাই গেয়ে যান_ 'সময়ের অভাবে ও কৌশলগত কারণে অনেক সময় আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না'। আমরা যদি রাগ করে কিছু বলতে যাই পুলিশ-র‌্যাব ক্ষেপে যেতে পারে_ তারা লিমনের পা নিতে পারে, কাদেরকে হেস্তনেস্ত করতে পারে, হাইকোর্টের জামিনের পরও পাঁচ হাজার টাকার নতুন চাঁদাবাজির মামলায় জেলগেট থেকে শীর্ষ কাগজ সম্পাদক একরামুল হককে টেনে-হিঁচড়ে আটক করতে পারে, অথচ জঘন্য খুনের আসামির বেলায় নতুন ডকট্রিনের ধুয়া তুলে। বিচার ব্যবস্থাও যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে_ একরাম কি পালিয়ে যাওয়ার লোক, তাকে কেন বারবার রিমান্ডে আর জেলে পাঠানো হচ্ছে বুঝি না। দোষী হলে তো শাস্তি পাবেই; কিন্তু বিচারের আগে এভাবে জেলে পুরে রাখা কেন? আর খায়রুল কবীর খোকনও কি ছিঁচকে চোর যে তাকেও আটকে রাখতে হবে, জামিন পেতে অনেক সময় নিতে হবে? এখন তো খবর হচ্ছে লোকমান হত্যাকাণ্ডে 'দুই কোটি টাকায় কিলার ভাড়া' (সমকাল, ১৬ নভেম্বর)। কী আজব কথা! মন্ত্রীর ভাই আসামি হলে মন্ত্রীর দোষ নেই, ভাইয়ের জন্য ভাই দায়ী হবেন কেন_ অবশ্যই সত্যি কথা; কিন্তু নৈতিক বিবেচনায় মন্ত্রী পদত্যাগ করে নজির সৃষ্টি করুন না যে, সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তিনি মহত্ত্ব দেখাতে পারেন! এসব আমাদের কথার কথা, এ দেশে এসব বরং পাগলামো কথাবার্তা। তবে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে এ হত্যাকাণ্ডে নাসিক নির্বাচনের পর আরেক প্রচণ্ড ধাক্কা খেল বলতে হবে। দলটার কপালই মন্দ_ এ মেয়াদে বারবার কেবল অঘটনে পড়ে যাচ্ছে। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগের টেন্ডারবাজি, কারও হল দখল, কারও নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি; তারপর জিয়ার নাম মুছে ফেলার ব্যক্তি আক্রোশে আউলিয়ার নামে বিমানবন্দর করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের অহেতুক প্রতিশোধ নিতে পারলেও বঙ্গবন্ধুর নামে বিমানবন্দর করার আবেগতাড়িত বিলাস কল্পনায় আপাত হোঁচট খেল। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগে আবার একটু বেপর্দা হয়ে পড়ল।
সম্প্রতি আবার ওবায়দুল কাদের এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যেন দলের কর্মকাণ্ডে কেমন কেমন অসন্তোষ ভাব প্রকাশ করছেন। 'দল জোট মন্ত্রিসভার পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন' (যুগান্তর, ১৩ নভেম্বর) বলে সুরঞ্জিত বাবু দস্তুরমতো বাজার গরম করে ফেলেছেন। কিন্তু হাসিনা ভদ্রলোক, এক কথার মানুষ, একবার পাত্রীর বয়স ১৮ বলেছেন তো তাই সই, এবার এক বছর পর হোক, দু'বছর পর হোক, তিন বছর পর হোক ওই পাত্রীর বয়স ১৮_ ভদ্রলোকের এক কথা, সম্বন্ধ করলে করুন, না করলে না করুন। এক মন্ত্রিসভা দিয়ে গিনেজ রেকর্ড বুকে ঠাঁই চাই যেন। অবশ্য কাকে বাদ দিয়ে কাকে নেবেন_ কত সমীকরণ, কত জ্বালা-যন্ত্রণা, তারপর আবার মোসাহেবি আনুগত্যের ব্যাপার রয়েছে না! হাসিনার বলা মতে, দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েই মন্ত্রী হোক আর খালেদার পায়ে মোজা পরিয়ে দিয়েই কেউ দলে টিকে থাকুক_ যাই হোক না কেন, এ দু'দলের দুই নেত্রীকে স্বৈরাচারী বললেও তাদের ঠেকানোর সাধ্য দলের মধ্যে নেই_ এটা মেনেই দু'দলের নেতাদের রাজনীতি করতে হবে। অতএব দল, জোট আর মন্ত্রিসভার পুনর্মূল্যায়ন হাসিনার একক ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, সুরঞ্জিত কিংবা ওবায়দুল কাদেরের কথায় কিছু আসে যায় না।
রাজনীতির বাজারে সবচেয়ে তাজা খবর_ আমার মতে, আশরাফের পদত্যাগ নিয়ে গুঞ্জন। আশরাফের পদত্যাগ নিয়ে দিনভর গুঞ্জন স্রেফ গুজব : আওয়ামী লীগ (আমার দেশ, ১৫ নভেম্বর)। আওয়ামী লীগের মতো একটা বিশাল দলের সাধারণ সম্পাদকের কর্মকাণ্ড আশরাফের আমলে আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি। তাকে সব সময় কেমন জানি শীতল-শীতল মনে হয়, এ শীতলতা ধীরস্থিরতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বিচ্ছুরণ কিংবা জ্ঞানের ভরা কলসির কম নড়া বলে মনে হয় না, মনে হয় কেমন একটা নিস্পৃহতা, কেমন একটা দিন যাক দিন যাক ভাবের। কথাবার্তায় তার প্রাণ চঞ্চলতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা আমরা লক্ষ্য করি না, বরং মনে হয় তিনি যেন কেমন 'বুঁদ' হয়ে আছেন। অতএব গুঞ্জন হোক আর গুজবই হোক, তার পদত্যাগ যেন সত্যি হয়। আগামী দিনের কঠিন সময়ের জন্য আওয়ামী লীগ আরও যোগ্য সাধারণ সম্পাদক পেলেই উত্তম।

বদিউর রহমান : সাবেক চেয়ারম্যান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

No comments

Powered by Blogger.