কম সময়ে ধান উৎপাদন by এ এম এম শওকত আলী

কটি ইংরেজি দৈনিকে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে ধান উৎপাদনের বিষয়ে একই দিনে (৩১ অক্টোবর) দুটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। একটির শিরোনামে বলা হয়েছে, এ-সংক্রান্ত উদ্ভাবিত বীজের উৎপাদন খরচও অন্যান্য ধানবীজের তুলনায় কম। সরকারি বীজ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিএডিসিও সংশ্লিষ্ট জাতের বীজ উৎপাদন ও বিতরণ বৃদ্ধি করেছে। উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজ উদ্ভাবন এবং বিতরণপ্রক্রিয়া শুরু হয় ষাট বা সত্তরের দশকের সবুজ বিপ্লবের


সময়। গবেষকদের মতে, ওই সময় উফশী বীজের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত উত্তম কৃষি পরিবেশ অঞ্চলেই সীমিত ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে এর ব্যবহারের কোনো উদ্যোগ ছিল না। অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল_উফশী ব্যবহারের জন্য সেচ ও রাসায়নিক সারও প্রয়োজন ছিল। দেশের সব অঞ্চলে সেচের পানির প্রাপ্যতা ছিল না। এ ছাড়া ১৯৪৭-পরবর্তী সময় থেকেই কৃষি উন্নয়নে গৃহীত নীতি ছিল, এখনো আছে_খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এর ফলে বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন ধানের এলাকা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। বেশির ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় উত্তরাঞ্চলের কথা। এই এলাকা প্রথাগতভাবে আউশ ও আমন চাষের উপযোগী ছিল। এখনো বেশ কিছু আমন ধানের এলাকা বিদ্যমান। আউশের এলাকা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। নীতিনির্ধারকদের মতে, বৃষ্টিনির্ভর ধানচাষ ঝুঁকিপূর্ণ। শীত মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকলেও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। এ কারণেই বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীসহ নীতিনির্ধারকরা এ কৌশল বাস্তবায়নে অধিকতর মনোযোগী ছিলেন। এর ফল ভালো হয়নি। এ বিষয়ে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। ১৯৮২-৮৩ সালে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ অগভীর নলকূপ পানি উত্তোলনে ব্যর্থ হয়। কারণ মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যায়। বর্তমান সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ওই সময়কার উদ্ভাবিত বীজ ব্যবহার করে ধান উৎপাদন করতে যে সময় প্রয়োজন, তা বর্তমানে উদ্ভাবিত কয়েকটি বীজের তুলনায় অধিকতর ছিল। এর বিরূপ প্রভাব দেখা দেয় মঙ্গা এলাকা হিসেবে খ্যাত বৃহত্তর রংপুর জেলায়। রোপা আমন ধান বপনের পর ফসল কাটার সময় হলো ডিসেম্বর। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দরিদ্র ও হতদরিদ্র কৃষি শ্রমিকরা বেকার হয়ে যায়। ফলে দুই বেলা ভাত খাওয়াও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ২০০২ সালে ওই অঞ্চলে দারিদ্র্যের প্রকোপ নিরূপণের জন্য কিছু গবেষক ওই অঞ্চল ভ্রমণ করেন। রংপুরের জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মঙ্গা প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করার জন্য মতবিনিময় করা হয়েছিল। ওই সময় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের একজন মাঠকর্মীসহ আরডিআরএসের একজন প্রতিনিধি কম সময়ে আমন ধান উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবনের সুপারিশ করেন।
এর পর থেকেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ কাজে লিপ্ত হয়। ব্রি-৩৩ নামের বীজও উদ্ভাবন করা হয়। এর সঙ্গে যোগ করতে হয় ১৯৯৬-২০০১ সালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের কথা। ওই সময় মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে তিন ধরনের বীজ উদ্ভাবনের জন্য ব্রিকে অনুরোধ জানায়_১. পানিসহিষ্ণু বীজ ২. খরাসহিষ্ণু বীজ ও ৩. লবণাক্ততাসহিষ্ণু বীজ। প্রথমোক্ত বীজের প্রয়োজন ছিল বন্যাপীড়িত অঞ্চলের জন্য। দ্বিতীয়টির উৎস ছিল বিএআরসির ১৯৮২ সালের এক গবেষণার ফলাফল। এতে দেখা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২ দশমিক ৮ মিলিয়ন হেক্টর এলাকায় নীরব খরা বিরাজ করে। এর ফলে প্রচলিত উফশী ধানের উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস প্রায়। ওই গবেষণায় সম্পূরক সেচের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার সুপারিশ ছিল। একই সঙ্গে খরাসহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবনের বিষয়টির ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বছর বছর শুধু কম সময়েই নয়, বরং খরাসহিষ্ণু বীজও উদ্ভাবিত হয়েছে; এবং মাঠপর্যায়ে কৃষকরা তা ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত বিনা-৭ নামীয় বীজের ব্যবহার বর্তমানে ৮৩ হাজার ৯৪৪ হেক্টর জমিতে করা হচ্ছে। সময় লাগে মাত্র ১২০ দিন। অন্যদিকে কম সময়ে এবং কম খরচে উৎপাদনশীল বীজ, যথা_ব্রি-৩৯ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভাবিত বিএইউ-১ রংপুরে ১ দশমিক ১৪ লাখ হেক্টর জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রি-২৮ জাতীয় ধানের জনপ্রিয়তাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় ব্রি-৫১ ও ৫২ জাতের ধান। সম্প্রতি কম সময়ে ধানের বীজ ব্রি-৫৬ ও ৫৭ উদ্ভাবিত হয়েছে।
লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানবীজ উদ্ভাবনের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ব্রির একটি আঞ্চলিক গবেষণাকেন্দ্র মেহেরপুর থেকে সাতক্ষীরা জেলায় স্থানান্তর করে। এর মধ্যে লবণাক্ততাসহিষ্ণু একাধিক বীজও পরীক্ষামূলকভাবে সাতক্ষীরাসহ বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা ব্যবহার শুরু করেছে। এর জন্য অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার প্রকোপ একেক জেলায় একেক রকম।
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কৃষি গবেষকদের মতে, এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের। তাই গবেষকরা নীতি ও কৌশল পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন। এর আওতায় বলা হয়েছে, অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুন্নত অঞ্চলে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় বর্তমানে দুটি কৌশল অবলম্বন করে_১. আইলা ও সিডর-বিধ্বস্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ২. বৃষ্টিনির্ভর আউশ ও আমন ধান চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা। অধিক আউশ উৎপাদনের জন্য বর্তমান বছরে কৃষকদের কিছু প্রণোদনারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে উপযুক্ত ফসল অঞ্চলের (ঈৎড়ঢ়ঢ়রহম তড়হবং) মানচিত্রও তৈরি করা হয়েছে।
কৃষি উৎপাদনের জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ২২টি জেলায় প্রথমে ইলশাফার্ম প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে আপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতায় গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারও উৎসাহিত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৮২ সাল থেকেই এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক সার গবেষণাকেন্দ্র বা আইএফডিসি ব্রি ও বিএডিসির সহযোগিতায় এ সম্পর্কে গবেষণা শুরু করে। বর্তমানে আপি প্রকল্পের আওতায় এর ব্যবহার উৎসাহিত করা হবে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ফলন অর্জন করা সম্ভব। এই প্রযুক্তি পরীক্ষিত এবং সফলতা অর্জন করেছে। একই সঙ্গে মিশ্র সারেরও উদ্ভাবন করা হয়েছে। ডিএপি ও এমওপি সারের সমন্বয়ে তৈরি এই সারের নাম Fertilizer Deep Placement (FDP)। এই মিশ্র সারে ডিএপিতে ইউরিয়াসহ টিএসপির সঙ্গে মিউরেট অব পটাশ (এমওপি) যোগ করতে হয়। গুটি ইউরিয়ার মতো এই সারকেও মাটির গভীরে দিয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। বর্তমানে এ ব্যাপারে অধিকতর গবেষণা করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় আইএফডিসি আপি প্রকল্পে এর ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে।
গুটি ইউরিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে একাধিক সুফল অর্জন সম্ভব। প্রধান সুফল হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অধিকতর ইউরিয়ার ব্যবহার রোধ করে ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। এতে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় এবং কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত. গুটি ইউরিয়া পরিবেশবান্ধব। কারণ মাটির নিচে অবস্থান করায় ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া বাতাসে মিশতে পারে না। অতএব, বায়ুদূষণ রোধে এর ব্যবহার উপযুক্ত।
কম সময়ে উৎপাদনক্ষমতার অধিকারী উদ্ভাবিত উফশী বীজ বিতরণ ত্বরান্বিত করা একমাত্র বিএডিসির মাধ্যমে সম্ভব নয়। এসব বীজের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একাধিক কৌশল প্রয়োগ করা প্রয়োজন। ১৯৯৬-২০০১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় ব্রিডার বীজের প্রাপ্যতা উন্মুক্ত করে। বর্তমানে এক দশক ধরে ব্রি ও বারি এই নীতি বাস্তবায়ন করছে। এর আওতায় বিএডিসির ব্রিডার বীজ পাওয়ার একচেটিয়া অধিকার রহিত করা হয়। ফলে ওই সময় থেকে বেসরকারি খাতসহ এনজিও, কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ব্রিডার বীজ নিয়ে তা ভিত্তিবীজ এবং উফশীতে রূপান্তর করে। বর্তমানে ব্রির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের সরবরাহকৃত বীজই অধিকতর। এরপর বিএডিসি এবং এনজিওদের অংশ।
অতএব, এই নীতি বাস্তবায়নে অধিকতর সচেষ্ট হতে হবে। খসড়া কৃষিনীতিসহ ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কৌশল হিসেবে আউশ ও আমন ধানের বৃষ্টিনির্ভর ধান চাষ উৎসাহিত করার বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সেচনির্ভর বোরো ধান চাষের এলাকা থেকে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নীতিনির্ধারকসহ বাস্তবায়নকারী সংস্থার জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। এর জন্য সঠিক পরিকল্পনাসহ কৌশল এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ জরুরি।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.