অনেক মহারথী জড়িত-ফের তিন দিনের রিমান্ডে আশরাফ by পিনাকি দাসগুপ্ত ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

রসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হত্যার নীলনকশায় অনেক মহারথী জড়িত। কেউ টাকা দিয়ে সহায়তা দিয়েছেন, কেউ দিয়েছেন সাহস ও প্রশাসনিক সহায়তার আশ্বাস। তবে মহারথীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন নিহত লোকমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোবারক হোসেন মোবা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই জানিয়েছেন লোকমান হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি নরসিংদী শহর যুবলীগের সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার।


গতকাল শনিবার আশরাফ হোসেন সরকারকে ফের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। প্রথম দফায় পুলিশ তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে পুলিশ রিমান্ডে রয়েছে হাজি ফারুক, মাহফুজ হোসেন তাওয়াব ওরফে সবুজ, শাহীন ও নাসির। অপর দিকে মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চুসহ অন্য আসামিদের পুলিশ গতকাল পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের মহাপরিদর্শক
হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যার তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তদন্তে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তদন্ত শেষ হলেই হত্যার উদ্দেশ্য ও নেপথ্যে যারা রয়েছেন তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত ও সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে।
মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেফতার হওয়ার পর আশরাফ লোকমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কত টাকার বিনিময়ে কিলার ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু হত্যার পেছনের নেপথ্য গডফাদারদের ব্যাপারে ছিলেন রীতিমতো নিশ্চুপ। তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা পর থেকে আশরাফ তার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।
আশরাফ বলেছেন, আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন মোবার গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই লোকমানকে হত্যার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। মোবা লোকমানের ঘনিষ্ঠ ও বাল্যবন্ধু। টেন্ডার নিয়ে মোবার সঙ্গে লোকমানের বিরোধ তৈরি হয়। কারণ লোকমান পরপর দু'বার পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় অনেকের স্বপ্নই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। লোকমানকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার কথা অনেকে মনে মনে লালন করলেও প্রকাশ করতে পারছিল না। যখন মোবা এগিয়ে আসে তখনই তৈরি হয় নীলনকশার বাস্তবায়ন।
সূত্র জানায়, মামলার এজাহারভুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা গেলেই পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত কারা কারা জড়িত ছিল তার বিস্তারিত বিবরণ জানা যাবে। মামলার একমাত্র এজহারভুক্ত আসামি আশরাফ গ্রেফতার হওয়ার পর অন্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেছেন। এজাহারভুক্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে কমপক্ষে চার জন দেশের বাইরে রয়েছেন। অপর ৯ জন যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, লোকমান হত্যার নেপথ্য গডফাদারদের জড়িত থাকার প্রমাণ সংগ্রহ অনেক কঠিন ব্যাপার। তাই হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত তাদেরই গ্রেফতারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নিচ থেকেই প্রমাণ সংগ্রহ করে ওপরের দিকে যাওয়া হবে। লোকমান হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ নেই। তাই নিরপেক্ষভাবেই সব কিছু তদন্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত পুলিশ যতদূর পেঁৗছেছে তা নিয়ে মামলার বাদী পক্ষ কোনো ধরনের দ্বিমত পোষণ করেনি।
ফের রিমান্ড : গত ১৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করে যুবলীগ নেতা আশরাফ হোসেন সরকারকে। ১৬ নভেম্বর নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশ আশরাফকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে পাঠায়। আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক মামুনুর রশীদ মণ্ডল দ্বিতীয় দফায় ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে নরসিংদীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল খবিরের আদালতে হাজির করেন। শুনানি শেষে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কড়া নিরাপত্তায় আদালতে হাজির করার সময় আশরাফ সরকারের পরনে ছিল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট।
আদালতে আশরাফের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শরফুদ্দিন মুকুল বলেন, ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তার কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করতে পারেনি। বরং তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি হার্টের রোগী। বর্তমানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার চিকিৎসার প্রয়োজন। তিনি তাকে সুচিকিৎসা নেওয়ার জন্য আবেদন জানান।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি আতিকুল বারী চৌধুরী সুমন বলেন, এ মামলার আরও তদন্ত এবং অন্য আসামিদের গ্রেফতারের জন্য তাকে আরও ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।
শুনানির সময় আদালতের বাইরে আশরাফুল সরকারের ভাই শওকত সরকার ও শরীফ সরকারসহ আত্মীয়স্বজন ও সমর্থকরা ভিড় জমায়। আসামি পক্ষে আরও ছিলেন ঢাকার অ্যাডভোকেট মোহজাদ আহমেদ খান, আমিনুল ইসলাম রাসেল, তাপস চন্দ্র দাস, পলাশ, সুমী এবং নরসিংদীর অ্যাডভোকেট এম এ আউয়ালসহ প্রায় ৩০ জন আইনজীবী।
শোকসভা : মেয়র লোকমান স্মরণে গতকাল শনিবার নরসিংদী চেম্বার অব কমার্সের উদ্যোগে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল ও শোকসভার আয়োজন করা হয়। চেম্বারের সভাপতি এ কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন নরসিংদী সদরের এমপি লে. কর্নেল (অব.) মোঃ নজরুল ইসলাম হিরু বীরপ্রতীক। সভায় বক্তব্য রাখেন নিহত মেয়র লোকমানের ছোট ভাই মামলার বাদী কামরুজ্জামান কামরুল ও ভিপি শামীম নেওয়াজ, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঞা, ব্যবসায়ী নেতা এম এ হালিম, রুহুল আমিন, তৈয়বুর রহমান, অনিল সাহা, নূরে আলম সিদ্দিক প্রমুখ। এদিকে আজ রোববার সকাল ১১টায় মেয়র পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.