নাবিরোপা আমন এবং এ সময়ের কৃষি by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

বার যে খুব আগ্রাসী বন্যা ছিল তা বলা যাবে না। তবে রোপা আমনের ক্ষতির কথা শোনা গেছে কিছু কিছু। কোথাও বীজতলায়, কোথাও বা লাগানোর পরপর। আমি নিজেও এর কিছুটা শিকার। বাড়িতে ব্রি ধান৫১ এবং ব্রি ধান৫২ করার ইচ্ছা ছিল। জাত দুটি লাগানোর পর হঠাৎ বন্যায় ডুবে গেলে অন্তত দুই সপ্তাহ টিকে থাকতে পারে। কিন্তু আমার ভাগ্য খারাপ। জাত দুটি বীজতলায়ই ডুবে গেছে। এমন অনেকেরই হয়েছে বলে মনে হয়। সোজা কথা, আমরা


কাগজে-কলমে একটা পরিবেশের ছক করে যে চাষবাসের পরামর্শ দিই তা অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করে না। তাই সে ব্যাপারেও কিছু প্রস্তুতি থাকা দরকার।
এভাবে আমনে লাগানো ধান যদি কোনোভাবে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তা থেকে উদ্ধারের উপায় খোঁজা ভালো। এ জন্য জমি আবার তৈরি করার জন্য বেশি সময় ব্যয় করা যাবে না। আগাছা পচানোর সময় নেই। তাই আগাছা হাত দিয়েই ভালো করে বেছে ফেলতে হবে। এ সময়ই প্রয়োজনীয় পটাশ, ফসফেট এবং আরো যদি কোনো সার (জিপসাম-দস্তা) দরকার হয়, জমিতে দিয়ে দিতে হবে। সার নির্বাচন জমির পরিস্থিতি বুঝে করতে হবে। জমিতে ফসল বেশি দিন থাকার সুযোগ নেই বিধায় এ ক্ষেত্রে ইউরিয়া একবারে দিয়ে দেওয়া ভালো। সেটা হওয়া উচিত রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিন পর। আবহাওয়া অনুকূল না হলে ইউরিয়া কিছু বিরতিতেও উপরি প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাহলে এ সারের কার্যকারিতা বাড়বে।
এ পরিস্থিতিতে চাষিরা কী জাত ব্যবহার করতে পারেন? নাইজারশাইল, বিআর২২ কিংবা বিআর২৩ বা দেরি করে লাগানোর উপযোগী যেকোনো শাইল ধান ভালো। এ কাতারের সাম্প্র্রতিক সংযোজন ব্রি ধান৪৬। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে ফলন একেবারে না পাওয়ার চেয়ে কিছু পাওয়া ভালো। তবে আয়-ব্যয়ের হিসাব যেন চাষি নিজেই আগাম করে নেন। আমনে এমন উদ্ভট পরিস্থিতির মোকাবিলায় সরকারের কিছু প্রস্তুতি থাকে। চাষিরাও সজাগ থাকেন। উঁচু জায়গায় বীজতলা করা হয়। হাটবাজারে সময়োপযোগী চারা পাওয়া যায়। এগুলো গুছিতে বেশি করে চারা দিয়ে নতুন করে লাগানো যেতে পারে। অনেক সময় গুছিতে বেশি করে লাগানোর মতো যথেষ্ট চারা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতি হলো পেঁকি বাইন করা। প্রথমে কাদাজমি সমান করে নিতে হবে। এরপর সরাসরি বীজ ছিটিয়ে বোনা যেতে পারে। ছিটিয়ে বোনার আগে বীজ সামান্য গজানো হলে ভালো হয়। বীজ বোনার সময় ড্রাম সিডার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে হাত দিয়ে সজোরে ছিটিয়ে বুনলে বীজটা মাটির কিছুটা ভেতরে ঢুকে যাবে। (সে ক্ষেত্রে কাদা থকথকে হওয়া দরকার।)। ফলে গাছ মাটিতে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে। পরে যদি নিম্নচাপের কারণে ঝড়-বাদল হয়, তাহলে গাছ উপড়ে যাবে না বা পাকা ধান শুয়ে পড়বে না। বোনার সময় দেখে নিতে হবে, আকাশ ভালো আছে কি না। বোনার পর জমিতে পানি জমলে ধানের বীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই জমির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দেরিতে ফসল লাগানোর জন্য স্বল্প জীবনকালীন জাত হলে ভালো হয়। এ জন্য ব্রি ধান৩৩ একটা পছন্দের জাত হতে পারে। বিআর১ এবং বিআর২১ আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোনা যায়। তবে ৩০ ভাদ্র্রের মধ্যে বুনতে পারলে বেশি ভালো। ভাদ্র্র মাসের মধ্যে বোনার জন্য আরো যে জাত দুটি মোটামুটি ভালো তাহলো_বিআর১২ এবং বিআর১৪। বিআর১১ একটা ভালো অপশন হতে পারে। এ জাতের কিছুটা আলোকসংবেদনশীলতা আছে। অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে দেখা গেছে, এটা কাদার মধ্যে বুনে দিলে ভালোভাবে গজাতে পারে।
চারা (যদি পাওয়া যায়) লাগাতে পারলে কিছুটা সময় সাশ্রয় করা যায়। ব্রি ধান৪৬, ৩০ ভাদ্রের মধ্যে এক মাসের চারা দিয়ে রোপণ করতে পারলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে বিআর২২ বিআর২৩-এর বেলায় দেখা গেছে, ১৫ আশ্বিন পর্যন্ত একটু বেশি বয়সের চারা গুছিতে বেশি করে লাগালে কিছু ফলন পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস, ব্রি ধান৪৬ও ১৫ আশ্বিন পর্যন্ত একইভাবে লাগিয়ে একই ধরনের ফলন পাওয়া যাবে। বিআর২২ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ব্রি-গাজীপুরে করা এক পরীক্ষায় ২১ আশ্বিনে ৩০ দিনের চারা লাগিয়ে বিঘায় ১২ মণ ফলন পাওয়া গেছে। ভাদ্রের শেষ দিনে বা পহেলা আশ্বিনে লাগিয়ে আমাদের ফলন ছিল বিঘায় ১৬ মণের মতো। হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি একদিন দেরি করে লাগানোর জন্য বিঘায় ৬ কেজি করে ফলন কম হয়।
মোটামুটি ভাদ্র্রের ৩০ তারিখের মধ্যে ফসল লাগানোর প্রস্তুতি সারতে পারলে ভালো। তাহলে আলোক-সংবেদী জাত যেমন বিআর২২, বিআর২৩ বা ব্রি ধান৪৬ অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি নাগাদ ফুলে বেরিয়ে যেতে পারে। এর পরই তো একটু একটু করে ঠাণ্ডা বাড়তে শুরু করে। এ সময় দিনের তাপমাত্রা একটু বেশি থাকলে এ জাতগুলোর তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ফুল ফোটার দিন আরো যদি পিছিয়ে যায় তাহলে ঠাণ্ডায় ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা।
শেষ কথা : যদি রোপা আমন লাগানোর কোনো সুযোগ না থাকে তাহলে যেন ওপর মহল থেকে আমননির্ভর কোনো কর্মসূচি চাপিয়ে না দেওয়া হয়। বিকল্প হিসেবে এখনই রবি ফসলের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ কর্মসূচি থাকতে পারে। রবি ফসল চাষে বিশেষভাবে সাহায্য করা যেতে পারে। কারণ রবি ফসল ধানের চেয়ে সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব। এ জন্য জায়গাভেদে ডাল, তেল, আলু এবং গম, ভুট্টা, মিষ্টি আলু ও শাকসবজির চিন্তা করা উচিত। সরকার বিভিন্ন সময় শস্য বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলছে। তাদের দিয়ে এ কর্মসূচিটা ঝালিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে একটা কথা না বললে নয়।
আমাদের এখন থেকেই ব্যালেন্সড কৃষির কথা ভাবতে হবে। এ জন্য যা দরকার তাহলো, সরকার ও চাষিদের নিয়ে যথাযথ লাগসই চিন্তাভাবনা করা।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
গাজীপুর, বাংলাদেশ

No comments

Powered by Blogger.