আজিজ-মায়া দ্বন্দ্বে স্থবির ঢাকা মহানগর আ. লীগ-সম্মেলন সিটি ভাগের পর : আশরাফ by পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য

ত বছরের ৩০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সদস্য পদ নবায়নের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। এরপর প্রায় দুই বছর পার হলেও তা শুরু করতে পারেনি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। বলা হয়, সংগঠনের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিদ্রোহই এ জন্য দায়ী।


দিবসভিত্তিক আওয়ামী লীগের জাতীয় কর্মসূচির বাইরে মহানগরের নেই কোনো নিজস্ব কর্মসূচি। কয়েক দিন পর পর বর্ধিত সভা ডেকে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেই শেষ হয় সভা। বর্ধিত সভার আয়োজন করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা শেষ হয় আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছাড়া। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় শুধু নামেই আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় কোনো নেতার পদধূলি পড়ে না এখানে। এমনকি মহানগর নেতারাও তেমন যান না দলীয় কার্যালয়ে।
সূত্র জানায়, মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আবদুল আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার অনুসারীদের কোন্দলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের এই হাল। এ বিভেদের কারণে দেওয়া হচ্ছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও।
বিভিন্ন সূত্র মতে, ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনকে সামনে রেখে এ দুই নেতার বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। মহানগরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারে অঘোষিত লড়াই শুরু হয় মায়া-আজিজের মধ্যে। প্রভাব বিস্তারের লড়াই বিস্তৃত হয় মহানগরের যুগ্ম সম্পাদক, সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম পর্যন্ত। তবে বর্তমানে কামরুল ইসলাম মহানগরের রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি আর মহানগরের রাজনীতি করতে ইচ্ছুক নন। সংগঠনের বর্তমান পরিবেশ রাজনীতির অন্তরায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'বর্তমানে যাঁরা মূল দায়িত্বে আছেন, তাঁদের সংগঠন চালানোর অভিপ্রায় আছে বলে মনে হয় না।' মূল দায়িত্বে থাকা নেতাদের আন্তরিকতার অভাবেই সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি বলে অভিযোগ করেন কামরুল।
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আবদুল আজিজ বলেন, মহানগরের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন অভিযান শুরু করার ইচ্ছা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে দিয়ে। সভাপতির ব্যস্ততার কারণে এটা করা যাচ্ছে না। তবে শুরু হলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এটা শেষ করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে বারবার সম্মেলনের কথা বলা হলেও এ মুহূর্তে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন সম্ভব নয়। মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ক্ষেত্রে ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে মূল দল আওয়ামী লীগ। সিটি করপোরেশন ভাগের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এলে সেই অনুযায়ী সংগঠনকে সাজাবে আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, সংসদ ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মহানগরের সম্মেলনের প্রস্তুতি নেবে দল। তিনি বলেন, দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পর নির্বাচনকে সামনে রেখে সেভাবে সংগঠন সাজাবে আওয়ামী লীগ। এখন সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেয়, এর জন্য অপেক্ষায় আছে দল।
এদিকে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করার বিরুদ্ধে মহানগরের প্রায় সব নেতা-কর্মীই। নাম প্রকাশে ইচ্ছুক না হলেও বেশির ভাগ নেতাই এর বিরোধিতা করে বলেছেন, এতে মহানগরে সংগঠনের ক্ষতি হবে। তবে প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে কেউ মন্তব্য করতে নারাজ। বরং সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পোস্টার এখন মহানগরের যত্রতত্র চোখে পড়ছে।
মহানগরের রাজনীতির এ অবস্থায় সবাই চায় সম্মেলন। নতুন বছরের প্রথমে সম্মেলন হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ। তবে কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান তিনি। মায়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের অভিযোগ প্রসঙ্গে আজিজ বলেন, 'এটা ভুল ধারণা। আমার সঙ্গে মায়ার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।' তবে তিনি বলেন, সবারই ভিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা সব জায়গায় থাকে_এটা দ্বন্দ্ব নয়।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের কথা অস্বীকার করে বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সংগঠন এক ও অভিন্ন। 'কিসের দ্বন্দ্ব করব তাঁর (আজিজের) সঙ্গে?' উত্তর দেন তিনি।
সম্মেলন প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, সম্মেলন হলে মহানগর আওয়ামী লীগের ছোটখাটো সমস্যা কেটে যাবে। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি এলে এবং নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হলে মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গতি আসবে বলে মনে করেন এ নেতা।
আজিজ-মায়ার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ পায় গত বছরের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সংকটকে ইস্যু করে বিরোধী দল বিএনপির ডাকা আন্দোলন কর্মসূচির বিরুদ্ধে মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজধানীর ৪১টি স্পটে কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এসব কর্মসূচি মায়ার একক সিদ্ধান্তে ডাকা হয়েছে অভিযোগ এনে আজিজ সমর্থিত গ্রুপ সমাবেশে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। শুধু তা-ই নয়, এসব সমাবেশের পাল্টা হিসেবে আজিজ তাঁর সমর্থক নেতাদের নিয়ে পাল্টা জনসভার আয়োজন করেন। এখন পর্যন্ত শুধু মহানগরের নিজস্ব বৈঠক ছাড়া এ দুই শীর্ষ নেতা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে এক হন না। এ পরিস্থিতিতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার পরামর্শ নিয়ে মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী।
মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৩ সালের ১৮ জুন। ওই কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ হানিফ এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। তিন বছর মেয়াদি এ কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে আরো ছয় বছর। এর মধ্যে ওই কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ, আইন সম্পাদক খোরশেদ আলম বাচ্চু এবং তাঁর পরবর্তী আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান নিলু, উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম আদা চাচাসহ আরো কয়েকজন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মোস্তাক এলেন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বিএনপি নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে দেশে যে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তা মোকাবিলা করতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগ। গতকাল মহানগর আওয়ামী লীগ এ লক্ষ্যে বৈঠক করে। বৈঠকে বিএনপির কর্মসূচি মোকাবিলার পাশাপাশি মহানগর আওয়ামী লীগ নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করবে। এর মধ্য দিয়ে সংগঠনের স্থবিরতা কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সভায় এ নিয়ে মুখ খোলেন মহানগরের ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ের নেতারা। সূত্র জানায়, বৈঠকে নেতারা অভিযোগ করে বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে মহানগরের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব ও গ্রুপিং বেড়েছে এবং এর ফলে সংগঠনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা মহানগর নেতাদের গুরুত্ব দেন না, দেখা করলে ভালো ব্যবহারও করেন না। তবে তাঁরা দ্রুত সিটি নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন।
মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় মহানগরের ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের অফিসের বেহাল অবস্থার কথাও তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, কেন্দ্রীয় নেতারা, মন্ত্রীরা এবং দলীয় সংসদ সদস্যরা এখন আর আসেন না দলের প্রধান অফিসে।
গতকালের বৈঠকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সংসদ সদস্য সানজিদা খানম, ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আগামী ২৯ নভেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগের পরবর্তী বর্ধিত সভায় নতুন কর্মসূচি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.