রশীদ করিম আর নেইঃ নিভৃতচারী কথাশিল্পীর বিদায় by আশীষ-উর-রহমান
লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন তিনি অনেকদিন থেকে, তা প্রায় ২০ বছর; চলেও গেলেন অনেকটা নিভৃতেই। গতকাল শনিবার ভোর চারটায় ইব্রাহিম কার্ডিয়াক সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাশিল্পী রশীদ করিম (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। গতকালই অপরাহ্নে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে রশীদ করিমকে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
১৯৯২ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে রশীদ করিম ধানমন্ডির বাড়িতে নিভৃত জীবন যাপন করছিলেন; লেখালেখিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্ত্রী, কন্যা ও এক নাতনি ছাড়াও অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠক রেখে গেছেন তিনি।
একমাত্র সন্তান মনোরোগ চিকিৎসক নাভিলা মোর্শেদ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় থাকেন। তিনি জানালেন, বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে শুক্রবারই দেশে পৌঁছেছেন।
ধানমন্ডি ৭ নম্বরের বায়তুল আমান মসজিদে কথাশিল্পীর প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হয় বাংলা একাডেমীতে।
রশীদ করিমের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বন্ধু ও গুণমুগ্ধ ব্যক্তিরা তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে যান। অনেকে বাংলা একাডেমীতেও শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান। তবে সে অর্থে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না বলেই হয়তো উপচে পড়া লোকসমাগম ছিল না। কাছের মানুষের নিবেদন করা ফুল আর তাঁদের অন্তরের নিখাদ বেদনায় কথাশিল্পীর অন্তিমযাত্রাটিও হলো তাঁর জীবনযাত্রার মতোই নিভৃতে।
বাংলা একাডেমীতে রশীদ করিমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, ‘রশীদ করিম ছিলেন খুব বন্ধুবৎসল। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে তিনি নিজস্ব ধারায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন।’
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘আমাদের দেশের তিন প্রধান কথাশিল্পীর একজন রশীদ করিম। অন্য দুজন হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শওকত ওসমান।’
মফিদুল হক বলেন, ‘নিজের রচনার ওপর তাঁর প্রবল আস্থা ছিল। তবে তা নিয়ে কখনো বাগাড়ম্বর করেননি। অত্যন্ত পরিশীলিত মানুষ ছিলেন তিনি।’
বাংলা একাডেমীতে একাডেমী, তথ্য মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের পক্ষ থেকে লেখকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। ধানমন্ডির বাসা এবং বাংলা একাডেমীতে আরও শ্রদ্ধা জানান রশীদ করিমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আবুল হাসনাত, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আতাউস সামাদ প্রমুখ। বাংলা একাডেমীতে দ্বিতীয় জানাজার পর তাঁর মরদেহ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
রশীদ করিমের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতায়। দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে সপরিবারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। পঞ্চাশের দশকেই লেখালেখির সূচনা গল্প দিয়ে। ১৯৪২ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘আয়েশা’ গল্পটি। প্রথম উপন্যাসেই তিনি বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসনটি পাকাপোক্ত করে ফেলেন। ভারত ভাগের প্রেক্ষাপট নিয়ে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত উত্তম পুরুষ উপন্যাসটির জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘তাঁর উত্তম পুরুষ উপন্যাসের ভাষা আশ্চর্য সহজ সরল ও আধুনিক। রশীদ করিমকে আমি আমার সেরা বন্ধু মনে করি।’ রশীদ করিমের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে: প্রসন্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, সোনার পাথরবাটি, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত, লাঞ্চবক্স। তাঁর একমাত্র গল্পগ্রন্থ প্রথম প্রেম। প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে আছে: আর এক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নূতন পুনরায়, মনের গহনে তোমার মুরতিখানি প্রভৃতি। তাঁর প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ জীবনমরণ নামের আত্মজীবনী। বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রশীদ করীম বাংলা একাডেমী পুরস্কার, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, লেখিকা সংঘ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন।
রশীদ করীম ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক উপন্যাস নির্মাণকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী। তাঁর নির্মেদ সাবলীল গদ্য কাব্যিক দ্যোতনাময়। উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রেও ছিলেন অনন্য। সমৃদ্ধ জীবনাভিজ্ঞতা, অনন্য ভাষাভঙ্গি এবং স্বকীয় গদ্যশৈলীর মধ্য দিয়ে রশীদ করীম বাংলা কথাসাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। তাঁর অগ্রজ আবু রুশদও ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া রশীদ করিমের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘তাঁর লেখায় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুর কথা জোরালোভাবে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক রশীদ করিমের লেখায় মানবাত্মার অন্তর্গত ভাষা ফুটে উঠেছে।’
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সমাজ সচেতন ও জীবনধর্মী উপন্যাস রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।’
শোকসভা: আগামী বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে কথাশিল্পী রশীদ করিমের স্মরণে জাতীয় শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে।
No comments