বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-ছায়ানট : যেন আমাদের শান্তিনিকেতন by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

মরা যাঁরা এ প্রজন্মের সদস্য, তাঁদের অনেকের কাছেই ছায়ানট শুধু একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ছায়ানট তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপ্তিতে কতটা বিস্তৃত এবং আমাদের সাংস্কৃতিক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনে কতটা শক্তিদাতা_এটুকু প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়জন তেমনভাবে জানেন? এ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সংস্কৃতির বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি দেশের সমাজ, রাজনীতি ও সামগ্রিক ক্ষেত্রে কতটা ইতিবাচক


প্রভাব ফেলতে পারে, এর নজির আমাদের সামনে আছে। যেমন_উদীচী, ক্রান্তি, সৃজনী, উন্মেষ প্রভৃতি। এই সংগঠনগুলো এ দেশের সামগ্রিক ক্ষেত্রে জাতির ক্রান্তিলগ্নে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেছে। আর ছায়ানট সাংস্কৃতিক বোধসম্পন্ন জাতি গঠন ও শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে। ছায়ানট তার স্থির প্রত্যয়ে যাত্রার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। এ পথ কখনো ছিল বন্ধুর, কখনো বা প্রতিবন্ধকতার কাঁটাযুক্ত।
২৫ ও ২৬ নভেম্বর ২০১১ ছায়ানট আয়োজন করেছিল দুই দিনব্যাপী বর্ণিল অনুষ্ঠানমালার। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন সময়ে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল পুনর্মিলনীর, যেখানে 'নস্টালজিয়া' সংগত কারণেই খুব জেঁকে বসেছিল। রাজধানীর ধানমণ্ডির শংকর বাসস্ট্যান্ডের প্রায় বিপরীতে লাল-খয়েরি ইটের যে বিশাল ভবনটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তা বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই। প্রায় সারাটা দিন দেবদারুগাছসহ ছোট বা বিভিন্ন ধরনের গাছপালায় ঘেরা এ ভবনটি সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষার্থী আর গুণীজনদের পদচারণে মুখরিত থাকে। দীর্ঘ ৫০ বছর যে পথে ছায়ানট এগিয়েছে, সে পথটি মসৃণ ছিল না বটে; কিন্তু এত সব চড়াই-উতরাই পেরিয়েও ছায়ানট সাফল্য, গৌরব আর অনুকরণের অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে। আমরা অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধায় তাঁদের স্মরণ করব, যাঁদের শ্রমে-ঘামে ছায়ানট আজ আমাদের শান্তিনিকেতনে পরিণত হয়েছে। শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে গড়া আলোকিত একটি প্রতিষ্ঠান আর ছায়ানট রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করে চর্চার ধারা অব্যাহত রেখে এগিয়ে চলা আমাদের শক্তিদাতা প্রতিষ্ঠান, এককথায় যাকে বলা যায় সংস্কৃতির পীঠস্থান। মনে পড়ছে পরম শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক, শিল্পী, গবেষক, দক্ষ সংগঠক, সাহসী প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ওয়াহিদুল হকের কথা, যাঁর সানি্নধ্যে কয়েকটি বছর কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি ছায়ানটের বিকাশে অনেকের মধ্যে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৯৬১ সালে এ দেশের কিছু আলোকিত মানুষ, যেমন_সুফিয়া কামাল, মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই), কামাল লোহানী, সাবেরা মুস্তাফা, শামসুন্নাহার রহমান (রোজ বু), আহমেদুর রহমান (ইত্তেফাকের কলামিস্ট 'ভীমরুল'), মিজানুর রহমান (ছানা), ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন প্রমুখ এই সংগঠন গড়ার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তখন যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছিল, পরবর্তীতে সেই প্রতিষ্ঠানটি অগণিত প্রগতিশীল মানুষের নানামুখী সহযোগিতায় জন্মলগ্ন থেকে বাঙালি সংস্কৃতির বহুমুখী ক্ষেত্র ও অভিব্যক্তিতে অবদান রেখে চলেছে। কত বিরুদ্ধ পরিবেশ-পরিস্থিতি ছায়ানটকে দমিয়ে দিতে চেয়েছে; কিন্তু ছায়ানটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কর্মোদ্যোগ, আদর্শ আর তাঁদের দৃঢ় প্রত্যয় থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এ জন্যই ছায়ানট যেন আমাদের শান্তিনিকেতনে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার সড়ক নির্মাণে ছায়ানট কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, আমরা ইতিহাসে তাও পাই।
১৯৬৩ ও ১৯৭০ সালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত এই দেশটির মানুষের জন্য ছায়ানট রাজপথে বেরিয়েছিল ভিক্ষা করতে, 'ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী' গান নিয়ে। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলার চক্রান্তের বিরুদ্ধে ছায়ানট রাস্তায় নেমেছিল পরম বিক্রমে অন্যদের সঙ্গে। দৃষ্টান্ত আছে আরো অনেক। দূর থেকেও ছায়ানটকে অসংখ্য মানুষ নানাভাবে সহযোগিতা জুগিয়েছেন, এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। দৃশ্য ও দৃশ্যের অন্তরালে থাকা সেই গুণীজনদের কাছে প্রজন্মের ঋণের শেষ নেই। শেষ নেই কৃতজ্ঞতারও। আজ ধানমণ্ডির শংকরে ছায়ানট ভবন দাঁড়িয়ে আছে, তা বিগত ৫০ বছরের চলমানতার একটি অংশ মাত্র। ছায়ানটের ব্যাপ্তি আরো অনেক অনেক বিস্তৃত। ছায়ানটের অতীত আমাদের প্রয়োজনেই জানা বড় বেশি প্রয়োজনীয়। প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ছায়ানটের প্রধান শক্তি তার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ কর্মিবাহিনী, যেখানে নেতৃত্বের ব্যাপারটি সব সময়ই থেকেছে খুব গৌণ এবং এর সাক্ষ্য মেলে ইতিহাসেই। এক লক্ষ্যের অর্থাৎ এক মন্ত্রে দীক্ষিত এই কর্মিবাহিনীর সাংগঠনিক দক্ষতা ও সংকল্প থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। ছায়ানট এ দেশে শুধু রবীন্দ্রসংগীত চর্চারই কেন্দ্রবিন্দু নয়, ছায়ানট বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে চলার এক মহাশক্তি_এটুকুও প্রজন্মের সদস্যদের জানা দরকার। এই দরকারই কল্যাণকামী চিন্তার প্রসার ঘটাবে, অনুপ্রাণিত করবে এবং ইতিহাস থেকে অনেক কিছু চয়ন করে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তিও জোগাবে। এই আশাই ভরসা হয়ে থাক।
ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ 'পহেলা বৈশাখ' উৎসব উদ্যাপন বাঙালি সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। এর আলো সমাজের অন্ধকার দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আসছে বিধায় অন্ধকারের কীটরা হামলে পড়েছিল এক পহেলা বৈশাখের সূর্যরাঙা সকালে। তছনছ করে দিতে চেয়েছিল প্রগতির মন্ত্র ছড়ানো সব কর্মকাণ্ড। কিন্তু না, তারা পারেনি। কয়েকটি তরতাজা প্রাণ তারা কেড়ে নিয়েছিল এবং অনেকেই এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতিক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন; কিন্তু তাঁদের রক্তঋণ শোধ করতেই প্রতিবাদী মানুষ আরো বেশি স্থির প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী হয়েছেন। উন্মুক্ত অঙ্গনে প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে ছায়ানট এ রকম আরো বহু সাংস্কৃতিক যজ্ঞই সম্পন্ন করে চলেছে সফলতার সঙ্গে। সন্জীদা খাতুন, কামাল লোহানীসহ জীবিত-প্রয়াত অনেকের নামই এসব প্রসঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের স্মরণ করতে হবে জীবদ্দশার প্রতিটি দিনের ক্ষণে ক্ষণে এবং 'আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে' গাইতে গাইতে মানবসমাজের আরো কাছে যাওয়ার জন্য নতুন শপথ নিয়ে ভক্তিনত চিত্তে। যাঁরা ছায়ানটের জন্মলগ্নে এমন একটি সুন্দরের কিংবা অনন্ত বৈভবের স্বপ্ন দেখে যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাঁদের অনেককেই আমরা দেখিনি বটে; কিন্তু এই প্রাতঃস্মরণীয়জনদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রজন্মের প্রতিনিধিদের বলতে হবে, আপনারা আমাদের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, আপনারা আমাদের বাতিঘর, আপনারা আমাদের নির্মাণের পথে, সুন্দরের পথে ধাবিত করে দিয়ে গেছেন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মুখ্য করে ধর্মাচরণকে ব্যক্তিগত গণ্ডিতে আটকে দিয়ে। ধর্মাচরণ খণ্ড খণ্ড গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান, কিন্তু সংস্কৃতি অখণ্ড এবং সবাইকে সাংস্কৃতিক স্রোতই গেঁথে দিতে পারে এক সুতায়। ছায়ানট এখনো সে কাজই করে চলেছে এবং শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চাসহ পঙ্কিলতামুক্ত রাজনৈতিক মননশীলতায় পুষ্ট হতে সাহায্য করছে। কারণ সংস্কৃতিচর্চা যত বেশি হবে, শুদ্ধ রাজনীতির পথও ততটাই মসৃণ হবে। যারা এর বিপরীতে, তারা বাঙালির সামগ্রিক মুক্তি ও বিকাশমান চেতনার বিরোধী। তারা গোটা বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধবাদী। তাদের চিহ্নিত করা, প্রতিহত করা প্রজন্মের দায় প্রজন্মেরই প্রয়োজনে।
ছায়ানটের নিয়মিত নানা কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে_সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয় 'নালন্দা' এবং শিশুদের মনোজাগতিক বিকাশের কার্যক্রম 'শিকড়'। উল্লেখ করতে হয়, অটিস্টিক শিশুদের কর্মকাণ্ড 'সুরের জাদু-রঙের জাদু' এবং বাংলা ভাষা অনুশীলন কার্যক্রম 'ভাষার আলাপ'-এর মতো বিষয়গুলোও। শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষাচর্চা, সমাজ অধ্যয়ন ও কর্ষণের ক্ষেত্রে ছায়ানট অব্যাহত রেখেছে তার পথচলা। দায় ও ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে যে ছায়ানট, এর আরো বিকাশ ঘটুক, মুক্তচিন্তার দিগন্ত প্রসারে এর কর্মকাণ্ড হোক আরো ব্যাপৃত এবং সরকার এ প্রতিষ্ঠানটিকে সার্বিক প্রয়োজনেই সহায়তা করুক_এ প্রত্যাশা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবার। মহাজোট সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রতিবাদী মানুষের এই দাবি আমলে নিয়ে ছায়ানটের জন্য একটি বিশেষ তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিলে আখেরে এর ফল ভোগ করবে এ দেশের মানুষই। রক্তস্নাত এবং বর্তমানে অবক্ষয়ী বাংলাদেশকে আলোকিত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বেগবান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আবারও বলতে হয়, জোরদার সাংস্কৃতিক আন্দোলনই অপরাজনীতির পঙ্কিল গণ্ডি থেকে মানুষকে মুক্ত করে আনতে পারবে। তাই ছায়ানট তো বটেই, পাশাপাশি দেশের প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনকে সরকারসহ সবার বিশেষভাবে সহযোগিতা করা উচিত। আমরা ফিরে পেতে চাই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সেই বাংলাদেশকে, যে বাংলাদেশের জন্ম অগ্র প্রজন্মের শ্রদ্ধাভাজনরা দিয়ে গেছেন ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে, সব রকম প্রতিক্রিয়াশীলতার কবর রচনা করে। আলোর পথের যাত্রীদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.