রঙ্গব্যঙ্গ-নাকে তেল দিয়ে ঘুমা by মোস্তফা কামাল

শিয়ান সিটির একটি বিজ্ঞাপনের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে! সেই বিজ্ঞাপনের একটি লাইন আমি আজকের লেখার শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করলাম। বিজ্ঞাপনটি ছিল এ রকম_জনৈক ভদ্রলোকের তিন ছেলে। তাঁদের একজন আমেরিকায়, একজন কানাডায় এবং একজন জার্মানিতে থাকেন। তাঁরা দেশে জমি কিংবা প্লট কেনার জন্য তাঁদের বাবাকে অনুরোধ করেন। তবে জমি হতে হবে নির্ভেজাল ও নিষ্কণ্টক। বৃদ্ধ বাবা তো ভীষণ মুশকিলে পড়লেন।


কোথায় পাবেন নিষ্কণ্টক জমি! খুঁজতে খুঁজতে পেলেন আশিয়ান সিটির খবর। সেখান থেকে তিন ছেলের জন্য তিনি তিনটি প্লট বুকিং দিলেন। নির্ভেজাল জমি কিনে বৃদ্ধ বাবা তো মহা খুশি। এরপর তিনি তিন শিশি সরিষার তেল কিনে পাঠিয়ে দিলেন ছেলেদের কাছে।
বিদেশে তেল পাঠানোর দৃশ্য দেখে জনৈক সাইফুদ্দিন সাহেব (কাল্পনিক নাম) বৃদ্ধ লোকটির কাছে জানতে চাইলেন, 'একি ভাই! তেল পাঠাচ্ছেন বিদেশে? ঘটনা কী?'
জবাবে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, "আর বলবেন না ভাই! তিন ছেলের জন্য আশিয়ান সিটির তিনটি প্লট বুকিং দিলাম। এমন নির্ভেজাল জমি তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না! তাই ছেলেদের নিশ্চিন্ত থাকতে বললাম। তাদের কাছে সরিষার তেল পাঠিয়ে দিয়ে বললাম, 'নে বাবা, এবার নাকে তেল দিয়ে ঘুমা'।"
'তাই নাকি! তাহলে তো এই প্লটই আমার বুকিং দিতে হয়!'
'দেন না! হট কেকের মতো চলছে। তাড়াতাড়ি বুকিং দেন! নইলে শেষ হয়ে যাবে!'
সাইফুদ্দিন সাহেব বললেন, 'বুকিং তো দেব! কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।'
'সেটা আবার কী!'
'আমি তো ভাবছি, চাঁদের দেশে প্লট বুকিং দেব।'
'কী বলেন! আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?'
'কেন? আপনি বিজ্ঞাপন দেখেননি? কয়েক দিন আগে টিভি বিজ্ঞাপনে দেখলাম, চাঁদের দেশে নাকি প্লট বুকিং চলছে। উহ! চাঁদের দেশে জমি কেনা! খুব মজার ব্যাপার না!'
'মজার ব্যাপার বটে! কিন্তু এটা কি সম্ভব!'
'কেন সম্ভব না! আমেরিকানরা হরদম চাঁদের দেশে জমি কিনছে। তারা পারলে আমরা পারব না কেন? আমাদের কি টাকা-পয়সা কম আছে!'
'হক কথা। আচ্ছা, ওখানে ভেজাল জমি নাই তো?'
'চাঁদের দেশে ভেজাল করার লোক কোথায়!'
'ভাই, তাহলে আমিও তিনটা প্লট বুকিং দেব। বিজ্ঞাপনটা কী, বলেন তো!'
'বিজ্ঞাপনটা হচ্ছে, এক লোক টিভিতে চটকদার বিজ্ঞাপন আর দৃষ্টিনন্দন নকশা দেখে প্লট বুকিং দিয়েছেন। কিন্তু সেই প্লট আর বুঝে পাচ্ছেন না। একদিন তিনি নিজের আগ্রহে দেখতে গেলেন, কোথায় তিনি প্লট বুকিং দিয়েছেন। প্রকল্পের জায়গা দেখতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পানি আর পানি। অথই পানির মাঝখানে একটি সাইনবোর্ড। এই দৃশ্য দেখে লোকটির মাথায় হাত! তিনি দুশ্চিন্তায় সেখানেই বসে পড়লেন। এ সময় সেখানে আরেকজন লোক এলেন। তিনি এসে বললেন, 'কী ভাই, আপনার মাথায় হাত কেন?'
জবাবে লোকটি বলল, 'আর বলবেন না ভাই! নকশা দেখে প্লট কিনেছিলাম। নকশাটি এত সুন্দর সাজানো-গোছানো ছিল যে লোভ সামলাতে পারলাম না। ভাবলাম, এখনই বুঝি বাড়ি করা যাবে। এখন এসে দেখি, এখানে পানি আর পানি।'
'এই তো! যাচাই-বাছাই না করে প্লট কিনলে তো এ রকম অবস্থা হবেই। আহা রে, টাকাগুলোই জলে গেল! আসেন, আমি আপনাকে বাড়ি করার উপযুক্ত প্লট দেব।'
লোকটি সরল বিশ্বাসে তাঁর সঙ্গে গেলেন। প্লট বুকিং দিলেন। তারপর তাঁর কপালে একটি সিল দেওয়া হলো। লোকটি জানতে চাইলেন, 'ভাই, আমার প্লট?'
'প্লট, প্লট তো চাঁদের দেশে!'
লোকটি অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, এত অল্প টাকায় চাঁদের দেশে জমি!
কিছুক্ষণ পর প্লট বিক্রেতা জানতে চাইলেন, 'কী ভাই, তাকিয়ে আছেন কেন?'
'ভাই, আমি যে চাঁদের দেশে জমি কিনেছি। তা বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার দীর্ঘদিনের শখ ছিল চাঁদের দেশে একটুকরো জমি কিনব। আমার বড় শখ পূরণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমার কথা শুনছে।'
এবার বৃদ্ধ লোকটি মহা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেন, 'ভাই, আমিও চাঁদের দেশে প্লট কিনব।'
সাইফুদ্দিন সাহেব বললেন, 'দাঁড়ান দাঁড়ান! চাঁদের দেশে প্লট বুকিং আমি দিয়ে দেব। কোনো চিন্তা করবেন না। কিন্তু তার আগে আমাকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন। আগে দেশে তো একটা প্লট কিনি! তারপর চাঁদের দেশে বুকিং দিয়ে রাখব।'
'তাহলে দেরি করছেন কেন? চলেন যাই।'
'কিন্তু একটা কথা।'
'কী কথা, বলে ফেলেন।'
'টাকাটা আবার জলে যাবে না তো!'
'সে জন্যই তো বলছি, আশিয়ান সিটির জমি কিনলে টাকা জলে যাবে না।'
সাইফুদ্দিন সাহেবও আশিয়ান সিটির একটি প্লট বুকিং দিয়েছেন। নিয়মিত কিস্তিও দিচ্ছেন। হঠাৎ আশিয়ান সিটি সম্পর্কে পত্রিকায় প্রতিবেদন দেখে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়লেন। তিনি দৌড়ে গেলেন সেই বৃদ্ধ লোকটির কাছে। তাঁকে বললেন, 'ভাই, আপনার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে আমি প্লট কিনেছিলাম। এখন তো দেখছি, টাকাটাই আমার জলে গেল!
সাইফুদ্দিন সাহেব বৃদ্ধ লোকটির সামনে কয়েকটি পত্রিকা তুলে ধরে বললেন, 'এই যে দেখেন, তিনি মানুষের জমি, জলাভূমি জবরদখল করে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন। এখন সেখান থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতারণার দায়ে আশিয়ান সিটির এমডির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে। এসব নিউজ দেখেননি?'
'এসব আপনি কী বলেন ভাই! ছেলেদের কাছে আমার মান-ইজ্জত থাকবে! আমি যে তাদের নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে বললাম! এখন কী হবে! হায় হায় আল্লাহ! এত বড় প্রতারণার ফাঁদে পড়লাম!'
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : জেগে উঠুন
প্রিয় পাঠক, এভাবেই চটকদার বিজ্ঞাপন এবং দৃষ্টিনন্দন নকশা দেখিয়ে বোকা বানানো হয় হুজুগে বাঙালিকে। আর বাঙালি জমি কেনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। একবার চিন্তাও করে না, সে কোথায় জমি কিনছে! আদৌ জমি আছে কি না, তা খতিয়েও দেখে না। আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে হুজুগে পড়া হাজার হাজার গ্রাহককে। আচ্ছা বাবা, এত টাকা দিয়ে জমি কিনবে, একটু দেখেশুনে নেবে না! যাচাই-বাছাই করবে না! না, তা করবে না। নকশা দেখেই পাগলের মতো টাকা ঢালতে থাকে।
আমি অনেককে জানি, সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে প্লট কিনে পথে বসেছেন। এমনও আছে, চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করে চাট্টিপাট্টি গোল করে উধাও হয়ে গেছে। কাজেই জলে টাকা ফেলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে চলবে না। জেগে উঠুন। অর্ধ কোটি বা তার চেয়েও বেশি টাকা দিয়ে যে প্লটটি কিনছেন, তা আরেকবার যাচাই-বাছাই করে নিন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.