সদরে অন্দরে-সবুজ পাতারা এভাবে ঝরে পড়বে কেন? by মোস্তফা হোসেইন
যে শিশুটি ভর্তি হয় স্কুলে, তার সামনে বিশাল ভবিষ্যৎ। দেশকে তার দেওয়ার কথা অনেক কিছু। পাওয়ার হিসাবটাও কম নয়। দেশকে দেবে, দেশও তাকে দেবে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও তাদেরই হাতে। এই তো হিসাব হওয়ার কথা স্বাভাবিক মাত্রায়। সেসব চিন্তা করতে গিয়ে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে তাকাই, খুব আহ্লাদিত হই আমরা। কারণ স্কুলমুখী হওয়ার প্রবণতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেড়েছে। যার প্রতিফলন আমরা দেশের
শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি থেকেও দেখতে পাই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার দেখে আমাদের ভালো না লেগে পারে না। যে শিশুর বয়স ছয় থেকে ১০, তার তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স। এমন শিশুর প্রায় সবাই কিন্তু এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সরকারের হিসাব মতে, তাদের ৯৯ দশমিক ৪৭ শতাংশই এখন স্কুলের আওতায় এসেছে। অর্থাৎ তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভর্তি হচ্ছে কাছের স্কুলটিতে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক মাত্রায়ই ছেদ পড়ে আমাদের এখানে। পরক্ষণে আমরা যে চিত্রটি দেখতে পাই, তা কিন্তু ভয়াবহ। শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি এবং যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর তুলনা করলে আমাদের এই আহ্লাদিত হওয়ার কারণগুলো ম্লান হয়ে যায়। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেকই স্কুল ছেড়ে চলে যায়। প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগবঞ্চিত এসব শিশু অকালেই তাই হয়ে পড়ে সমাজের বোঝা। মা-বাবা ভরণপোষণের চিন্তায় থাকেন অস্থির। তাদের হার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি গবেষণা প্রতিবেদনে সেই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। দেখা গেছে, প্রাথমিক স্তরেই এই ঝরে পড়াদের হার ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটা অবশ্যই ভয়াবহ একটি ব্যাপার। আমাদের দেশ ও প্রশাসনের যে দিকটিতে এই মুহূর্তেই অতিমাত্রায় নজর দেওয়া উচিত, সেটি যে প্রাথমিক শিক্ষা, এটা অনায়াসেই বলা যায়।
কেন ঝরে যায় শিক্ষার্থীরা? আর ভর্তির হারও কিভাবে বেড়ে গেল এত বেশি? দুটো দিকেরই বিশ্লেষণ হওয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতে। আর সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ভর্তির হার বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি আছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে একটা বোধ কিন্তু জেগেছে। তাঁরা ভাবতে ভালোবাসেন, নিজেদের সন্তানকে স্কুলে দেওয়া তাঁদের কর্তব্য। সেই বোধ থেকে অনেকেই চান তাঁর শিশুটি স্কুলে ভর্তি হোক। হচ্ছেও তা-ই। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, উপবৃত্তি আছে মেয়েদের। প্রাইমারি ছেড়ে হাই স্কুলে গিয়ে তাই মেয়ে-সন্তানটি বোঝা হয়ে ওঠে না মেয়ের মা-বাবার কাছে। উপবৃত্তির টাকাটা তাই শিক্ষার্থীর পরিবারকেও সহযোগিতা করে। বাড়তি লাভ পায় শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত সনদ। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক পরিবর্তনও হয়েছে একটা। বিয়ের সময় ছেলের চাহিদা থাকে মেয়ের শিক্ষার বিষয়টি। ফলে মেয়ে-শিশুর পড়ালেখার দিকে মা-বাবার নজর দিতে হয় সামাজিক কারণে। এই পরিবর্তনগুলো শিশুদের স্কুলমুখী করার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু অন্যদিকে স্কুলে ঢুকে আবার এই শিশুদের বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা যখন অস্বাভাবিক, তখন বলতেই হয়_স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের আনন্দ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা সেখানে যাওয়াটা তাদের জন্য লাভজনক বলে মনে হচ্ছে না। যে কারণে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ৩২ দশমিক ৬ ভাগ শিশু স্কুল ত্যাগ করে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে যেতে সেখানে থাকে মাত্র ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই শিশুদের স্কুলত্যাগের জন্য সর্বতোভাবে অর্থনৈতিক দিকটি দায়ী নয়। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় গ্রামাঞ্চলে তেমন বেশি নয়। বই বিনামূল্যে পাওয়া এবং স্কুলের বেতন ফ্রি হওয়ার কারণে অভিভাবক অনেকটাই মুক্ত থাকেন। তাই মনে করার যুক্তি আছে, শিক্ষার পরিবেশ কচি শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় না হওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলত্যাগের অন্যতম কারণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই অর্ধেক শিশুকে স্কুলত্যাগ করতে দেখা যাওয়াটা তাই আমাদের জন্য রাষ্ট্রীয় অপচয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এই ঝরে পড়ার হার দেখে স্পষ্টতই মনে করা যায়_গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চূড়ান্ত রকমের অব্যবস্থাপনা রয়েছে। যে অব্যবস্থাপনার দায় থেকে সরকার মোটেও মুক্ত নয়। আর এই ঝরে পড়ার কারণগুলো এতই ব্যাপক যে তা দূর করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। ঝরে পড়ার সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিরও সম্পর্ক রয়েছে। ফলে দেশের উন্নয়ন-ব্যবস্থার বিষয়টিকেও এর সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ৫৩ শতাংশকেই গৃহশিক্ষকের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাই কোনো রকমে শিক্ষা গ্রহণের পর ব্যয়নির্বাহে ব্যর্থ মা-বাবা তাঁদের সন্তানকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর বাড়তি ব্যয় হিসেবে যোগ হয় স্কুলের বেতন ও অন্যান্য খরচ। স্কুলের বেতনই একমাত্র কারণ নয়, এটা স্বীকার্য। কারণ স্কুলের বেতন দিতে অপারগ অভিভাবকের সংখ্যা এত বেশি হবে না। কিন্তু ৫৩ ভাগ অভিভাবক উচ্চ হারে প্রাইভেট পড়ানোর খরচ বহন করতে পারবেন না_এটাই স্বাভাবিক। তাই স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে হলে স্কুলে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে সবার আগে। প্রাইভেট পড়ানোর যে প্রবণতা আছে, তা বন্ধ করতে হলেও এর কোনো বিকল্প নেই।
তবে এটা ঠিক, ২০ বছর আগে অবকাঠামোগত যে অসুবিধাগুলো প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ছিল, এখন কিন্তু তা তেমন আর নেই। অন্যদিকে শিক্ষকদের কথাও যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলেও বলতে হবে_তাঁদের যোগ্যতার বিষয়টিও আগের মতো পিছিয়ে নেই। আবার ঝরে পড়ার মতো ক্ষতরোগ সারানোর চেষ্টাও লক্ষণীয়। আগে এ দিকটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। দুপুরের খাবার সরবরাহ করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে এটিও বিবেচনায় আনতে হবে। তাই আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই সমস্যার ব্যাপকতা কমতে থাকবে_এটা আমরা আশা করতে পারি। তবে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা সম্ভব না হলে সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে অনেক দেরি হবে।
mhussain_71@yahoo.com
কেন ঝরে যায় শিক্ষার্থীরা? আর ভর্তির হারও কিভাবে বেড়ে গেল এত বেশি? দুটো দিকেরই বিশ্লেষণ হওয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতে। আর সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ভর্তির হার বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি আছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে একটা বোধ কিন্তু জেগেছে। তাঁরা ভাবতে ভালোবাসেন, নিজেদের সন্তানকে স্কুলে দেওয়া তাঁদের কর্তব্য। সেই বোধ থেকে অনেকেই চান তাঁর শিশুটি স্কুলে ভর্তি হোক। হচ্ছেও তা-ই। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, উপবৃত্তি আছে মেয়েদের। প্রাইমারি ছেড়ে হাই স্কুলে গিয়ে তাই মেয়ে-সন্তানটি বোঝা হয়ে ওঠে না মেয়ের মা-বাবার কাছে। উপবৃত্তির টাকাটা তাই শিক্ষার্থীর পরিবারকেও সহযোগিতা করে। বাড়তি লাভ পায় শিক্ষার্থীর শিক্ষাগত সনদ। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক পরিবর্তনও হয়েছে একটা। বিয়ের সময় ছেলের চাহিদা থাকে মেয়ের শিক্ষার বিষয়টি। ফলে মেয়ে-শিশুর পড়ালেখার দিকে মা-বাবার নজর দিতে হয় সামাজিক কারণে। এই পরিবর্তনগুলো শিশুদের স্কুলমুখী করার ব্যাপারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু অন্যদিকে স্কুলে ঢুকে আবার এই শিশুদের বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা যখন অস্বাভাবিক, তখন বলতেই হয়_স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের আনন্দ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা সেখানে যাওয়াটা তাদের জন্য লাভজনক বলে মনে হচ্ছে না। যে কারণে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই ৩২ দশমিক ৬ ভাগ শিশু স্কুল ত্যাগ করে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে যেতে সেখানে থাকে মাত্র ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই শিশুদের স্কুলত্যাগের জন্য সর্বতোভাবে অর্থনৈতিক দিকটি দায়ী নয়। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যয় গ্রামাঞ্চলে তেমন বেশি নয়। বই বিনামূল্যে পাওয়া এবং স্কুলের বেতন ফ্রি হওয়ার কারণে অভিভাবক অনেকটাই মুক্ত থাকেন। তাই মনে করার যুক্তি আছে, শিক্ষার পরিবেশ কচি শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় না হওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলত্যাগের অন্যতম কারণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার আগেই অর্ধেক শিশুকে স্কুলত্যাগ করতে দেখা যাওয়াটা তাই আমাদের জন্য রাষ্ট্রীয় অপচয় হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এই ঝরে পড়ার হার দেখে স্পষ্টতই মনে করা যায়_গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চূড়ান্ত রকমের অব্যবস্থাপনা রয়েছে। যে অব্যবস্থাপনার দায় থেকে সরকার মোটেও মুক্ত নয়। আর এই ঝরে পড়ার কারণগুলো এতই ব্যাপক যে তা দূর করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও গ্রহণ করতে হবে। ঝরে পড়ার সঙ্গে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিরও সম্পর্ক রয়েছে। ফলে দেশের উন্নয়ন-ব্যবস্থার বিষয়টিকেও এর সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ৫৩ শতাংশকেই গৃহশিক্ষকের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত তাই কোনো রকমে শিক্ষা গ্রহণের পর ব্যয়নির্বাহে ব্যর্থ মা-বাবা তাঁদের সন্তানকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন। কারণ ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর বাড়তি ব্যয় হিসেবে যোগ হয় স্কুলের বেতন ও অন্যান্য খরচ। স্কুলের বেতনই একমাত্র কারণ নয়, এটা স্বীকার্য। কারণ স্কুলের বেতন দিতে অপারগ অভিভাবকের সংখ্যা এত বেশি হবে না। কিন্তু ৫৩ ভাগ অভিভাবক উচ্চ হারে প্রাইভেট পড়ানোর খরচ বহন করতে পারবেন না_এটাই স্বাভাবিক। তাই স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমাতে হলে স্কুলে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে সবার আগে। প্রাইভেট পড়ানোর যে প্রবণতা আছে, তা বন্ধ করতে হলেও এর কোনো বিকল্প নেই।
তবে এটা ঠিক, ২০ বছর আগে অবকাঠামোগত যে অসুবিধাগুলো প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ছিল, এখন কিন্তু তা তেমন আর নেই। অন্যদিকে শিক্ষকদের কথাও যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলেও বলতে হবে_তাঁদের যোগ্যতার বিষয়টিও আগের মতো পিছিয়ে নেই। আবার ঝরে পড়ার মতো ক্ষতরোগ সারানোর চেষ্টাও লক্ষণীয়। আগে এ দিকটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। দুপুরের খাবার সরবরাহ করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে এটিও বিবেচনায় আনতে হবে। তাই আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এই সমস্যার ব্যাপকতা কমতে থাকবে_এটা আমরা আশা করতে পারি। তবে শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা সম্ভব না হলে সেই প্রত্যাশা পূরণ হতে অনেক দেরি হবে।
mhussain_71@yahoo.com
No comments