প্রতিবেশী-পশ্চিমবঙ্গে মৌসম নূরের গর্জন by অমিত বসু
মৌসমকে আন্ডারএস্টিমেট করলে মমতা ভুল করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যথেষ্ট পরিণত তিনি। স্থান ও সময় নির্বাচনে তার প্রমাণ রেখেছেন। ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। নির্বাচনের ১১ দিন আগে ওই এলাকাতেই মৌসম মিছিল করেছেন। ভোটারদের প্রভাবিত করাই যে তার উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কারপাখার মোটর যত জোরেই ঘুরুক, হাওয়া হবে না, যদি ব্লেড না থাকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুরছেন ছুটছেন উড়ছেন, তবু
স্বস্তির হাওয়া নেই সেই কারণেই। তিনি ব্লেডছাড়া পাখা। কোথায় কমরেড। যারা রাজ্যজুড়ে উন্নয়নের তুফান তুলবে। শুধু টাকাতেই নতুন পথ কাটার চিন্তাটা ভুল। একমাত্র নিঃস্বার্থ তেজি মানুষের কর্মধারায় জমানা বদলাতে পারে। সরকার পাল্টানোর যুদ্ধের শরিকরাও অদৃশ্য। এলাকা দখলের লড়াইয়ের সৈনিকরাও ক্রমশ ক্লান্ত। নেগেটিভ কাজে এনার্জি শেষ। গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প অর্থাৎ রেগাও রোগগ্রস্ত। তহবিলে ৬০০ কোটি টাকা পচছে। কাজ করিয়ে নিরন্ন মানুষের হাতে তুলে দিতে আলস্য। জেলায় জেলায় নির্বাচিত জেলা পরিষদ, অঞ্চল পঞ্চায়েত, গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যরা বেকার, যা করার করছে মহাকরণ। কলকাতা বাদে ১৮টি জেলার ভালো-মন্দের দায়িত্ব ডিএম, এসডিও এবং বিডিওদের। যেখানে কাজ করছেন সেখানকার কেউ নন। তারা মহাকরণের প্রতিনিধি মাত্র। বলা ভালো, তারাই ভ্রাম্যমাণ মহাকরণ। মুখ্যমন্ত্রীর সতীর্থ মন্ত্রীরা সব গেলেন কোথায়? রাইটার্সের পোডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া আর কারও সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার অধিকার নেই। মুখ্যমন্ত্রী যখন কথা বলেন, সচিবরা থাকলেই চলে। মন্ত্রীরা যেন অযথা উপস্থিত হয়ে বিরক্ত না করেন। ৬ মাস হয়ে গেল পাবলিক ভালো করে জানল না কোন মন্ত্রীর কোন দফতর। প্রথম দিকে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকতেন। তারাও এখন দূরে দূরে। আউট অব ফোকাস। এসব দেখেশুনেও সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেবের মতো বিরোধী নেতারা মমতার পাশে থাকার আবদার ধরেছেন কোন আক্কেলে! তারা কি কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সী, মৌসম নূরের গর্জন শুনছেন না? কংগ্রেস, তৃণমূলের শরিক হওয়া সত্ত্বেও মমতাবিরোধী মিছিল করেছেন মমতার ডেরায় গিয়ে। মৌন জনস্রোতে অন্তর্নিহিত শব্দের প্রতিধ্বনি কিন্তু স্পষ্ট। তাদের বক্তব্য, উত্তরবঙ্গে কংগ্রেস ঘাঁটি ভাঙতে গেলে তৃণমূলের খাস তালুকও নিরাপদ থাকবে না।
হাজরায় মিছিল করাটাই কংগ্রেসের মস্তবড় চ্যালেঞ্জ, যে জায়গায় মমতার উত্থান সেখানে কংগ্রেসের উপদ্রব মমতা মানবেন কেন? চিৎকার করে হুশিয়ারি দিয়েছেন। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারকে বলেছেন, রাজ্যে তৃণমূল একাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেস পাশে না থাকলেও চলবে। কিন্তু কেন্দ্রে তৃণমূল ছাড়া ইউপিএ সরকার বাঁচবে না। মৌসম নূর কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিয়েছেন। বলেছেন, মমতা সরতে চাইলে কংগ্রেস হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলুন। মমতার মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা কড়া কাপড়ের মতো কথার ভাঁজ নষ্ট করেছেন মৌসম। রাজনীতিতে নবীনা হয়েও বুঝিয়েছেন এবিএ গনি খান চৌধুরীর পরিবারের যথার্থ প্রতিনিধি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি তাদের আত্মীয় ছিলেন। গনি খান মালদহের নেতা হয়েও গোটা পশ্চিমবঙ্গ কাঁপিয়েছেন। লোকসভায় যখন প্রশ্ন উঠেছিল তার মালদহপ্রীতি নিয়ে, তিনি জবাব দিয়েছিলেন মালদহ কি ভারতের বাইরে?
মৌসমকে আন্ডারএস্টিমেট করলে মমতা ভুল করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যথেষ্ট পরিণত তিনি। স্থান ও সময় নির্বাচনে তার প্রমাণ রেখেছেন। ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। নির্বাচনের ১১ দিন আগে ওই এলাকাতেই মৌসম মিছিল করেছেন। ভোটারদের প্রভাবিত করাই যে তার উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কার।
মৌসম হাইকমান্ডের অনুমতি না নিয়ে যে এ মিছিল করেননি সে বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যেতে পারে। সেই কারণেই কিছু বলার থাকলে হাইকমান্ডকে বলার পরামর্শ দিয়েছেন মমতাকে। মমতা কী করবেন? মৌসমের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কাছে নালিশ করবেন? তা যদি করেন তাহলে মৌসমকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মেনে নিতে হবে। তাতে মমতা দুর্বল হবেন, মৌসমের পালে হাওয়া লাগবে। দক্ষিণ কলকাতায় নতুন করে এলাকা নির্ধারণে ভোটার এদিক-সেদিক ছিটকে গেলেও, সেখানকার কংগ্রেস ভোটেই সিপিআইএমের সাবেক হেভিওয়েট নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মমতার আত্মপ্রকাশ। তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। তৃণমূলের আবির্ভাবে কংগ্রেসের ভোট মমতার দিকে অনেকটা সরলেও কংগ্রেস ভোটব্যাংক শূন্য হয়নি। শুধু এখানে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সব আসনেই কংগ্রেস ভোট জয়-পরাজয়ের বড় ফ্যাক্টর। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল একা লড়ে তার প্রমাণ পেয়েছে। মমতা ছাড়া কেউ জিততে পারেননি। বিধানসভার উপনির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে মমতা ভালো মার্জিনে জিতলেও ভোট কম পেয়েছেন। আগের প্রার্থী সুব্রত বক্সির চেয়ে প্রায় পনের হাজার ভোট হ্রাস। হতে পারে ভোট পড়ার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে আসাতেই এই ক্ষতি। প্রতিবেশীরা মমতাকে ভোট দিতে পোলিং বুথে যাওয়ার সামান্য কষ্টটুকু সহ্য করতে রাজি হলেন না কেন, সেই প্রশ্নটাও ওঠে আসে। মমতা সমর্থকদের আবেগ এত দ্রুত প্রশমিত হওয়াটা তৃণমূলের পক্ষে মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।
অযথা ভাবনায় সময় নষ্ট না করে প্রয়োগ নৈপুণ্যে দখলদারিতে বিশ্বাসী তৃণমূল। সে ক্ষেত্রে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সঙ্গে মমতার তুলনা খোঁজা হয়। অন্যদিক থেকে বৈশিষ্ট্যে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের খুব কাছাকাছি তিনি। যিনি এক বছরও মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেননি। স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। কারণ একটাই, কারও কথা শুনতে রাজি নন। এমনকি মহাত্মা গান্ধী বললেও না। গজু খৈতানকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন গান্ধী স্বয়ং। না মেনে স্বেচ্ছায় সরেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। ১৯৫০-এ কৃষক মজদুর প্রজা পার্টির সচিব হয়েও বেশি দিন থাকতে পারেননি। ১৯৬৭তে আবার ফিরেছেন। প্রথম অ-কংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকে সহ্য করার ধৈর্য দেখাননি। আট মাসে অজয় সরকারের পতন হতেই দল ছাড়াই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোটের মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। যার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। প্রফুল্লচন্দ্রের দল ছিল না। মমতার দল থেকেও নেই। তার দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস না হয়ে মমতা কংগ্রেস হলে মানানসই হতো। তিনি কার্যত একা। একার ক্ষমতায় কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হননি। সঙ্গে কংগ্রেস ছিল। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভোটের পরে নয়, আগে। ভোট ভাগাভাগি হয়নি। হলে মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া কঠিন ছিল। জোট ভাঙলেও ভোট তো আর ভাঙা যাবে না। দক্ষিণ কলকাতার উপনির্বাচনে যদি ভোট ভাঙে? তৃণমূলের ভোট কমবে। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র মমতাকে ছেড়ে মমতার লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুব্রত বক্সি। প্রতিদ্বন্দ্বী বাম ছাত্রনেতা ঋতব্রত ব্যানার্জি। ভোটারদের কাছে পোস্টাফিসের ছাপ ছাড়া নতুন চিঠি। পড়ে দেখার আকর্ষণ কম নয়। মমতা কী করবেন? সুব্রতকে দাঁড় করিয়ে লড়ছেন তো তিনিই। তারই বা কী করার আছে। নিজের জোরে নির্বাচন লড়বে দূরের কথা, দলে এমন কেউ নেই যিনি ভবানীপুর থানায় গিয়ে দলের আটক সদস্যদের ছাড়িয়ে আনার মতো সহজ কাজটা করতে পারেন। সেখানেও যেতে হয় স্বয়ং মমতাকে।
রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর একাকিত্ব অনুভব করেছিলেন। ব্যথিত হয়ে গানও লিখেছিলেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে'। তখন কংগ্রেস গান্ধীজির পাশে থেকেও নেই। সাম্প্রদায়িতায় যারা দেশ বিষোচ্ছে তাদের কাছেও গান্ধীজি চক্ষুশূল। সংহতির পক্ষে তার নির্ভীক একক যাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
মমতা গান্ধী নন। তিনি একাও নন। তাকে সাহায্য করার হাতের অভাব নেই। এমনকি বিরোধীরাও তার পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের দাবিতে সিপিএমও মমতার সঙ্গে থাকতে রাজি। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল এক হতে চাইছে। রাজ্যটাকে যেভাবেই হোক টেনে তোলার অঙ্গীকার। মমতা কারও সাহায্য নেবেন না। একাই যা করার করবেন। পারলে পারবেন, না পারলে যা হওয়ার হবে। স্বেচ্ছায় একাকিত্ব বরণের উদ্দেশ্য একটাই। তিনি কাউকে বিশ্বাস করেন না। কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালে তিনি মনে করেন, সেটা সাহায্যের হাত নয়, ষড়যন্ত্রের। পেছন থেকে ছুরি মেরে পতন ঘটানোর ছক। ভয় তার সবাইকে। সব থেকে ভয় নিজেকে। আত্মবিশ্বাসী হলে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হতেন না।
কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক বিরোধ দীর্ঘদিনের। ১৯৪৮-এ বিধান রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে ছিল তার নিত্য টানাপড়েন।
উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে নাজেহাল বিধায় রায় যখন নেহরুর কাছে হাত পেতেছেন তখনই বিড়ম্বিত হয়েছেন। একশ' চাইলে পেয়েছেন এক। বোঝার ওপর ঘাড়ে চেপেছে শাকের আঁটি। কেন্দ্রের ইচ্ছায় মাশুল সমীকরণ নীতি ঘোষিত হয়েছে। লোহা, তামা, তুলা_ এসব পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যেত অনেক কম দামে; নিজেরাই উৎপাদন করত বলে। সেটা শিল্পায়নের পথে সহায়ক ছিল। অন্য রাজ্যের থেকে শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে ছিল সেই কারণেই। মাশুল সমীকরণে এসব বস্তু সব রাজ্যে এক দামে পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। বিধান রায়ের মাথায় বাজ পড়ল। তবু তিনি থামলেন না। উন্নয়নের জোয়ার তুললেন। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা হলো। সল্টলেক হলো। কল্যাণীর মতো নতুন নগরী মাথা তুলল। উন্নয়নের বান ডাকল। নতুন বাংলার রূপকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন বিধান রায়।
বিধান রায় বঞ্চিত হলেও কিন্তু নেহরুর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেননি। নেহরু অসুস্থ হলে কড়া হাতে ডাক্তারি করতেন। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী নন, প্রথিতযশা চিকিৎসক। বিধান রায়-নেহরু দু'জনেই ছিলেন কংগ্রেস নেতা। এক দলে থাকা সত্ত্বেও মতান্তর ছিল, কিন্তু মনান্তর হয়নি। ইতিহাস সব থেকে বড় শিক্ষক। মমতা না মানলে বিপদ তারই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন।
২৮ রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের যে কমিশন তার চেয়ারম্যান ছিলেন বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর জায়গাটা নিয়েছেন বিহারের অর্থমন্ত্রী সুশীল মোদী। দায়িত্ব পেয়েও কিন্তু অসীম দাশগুপ্তকে ছাড়তে রাজি হননি। তাকে নিজের উপদেষ্টা করেছেন। বলেছেন, আপনার উপদেশ ছাড়া এ কাজ সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনীতির বিষয়টি আপনি ছাড়া কেউ ভালো বোঝেন না। অসীম আর সুশীলের অবস্থান দু'মেরুতে। অসীম বাম, সুশীল কট্টর দক্ষিণপন্থি। তবু তারা পরস্পরের সহযোগী। প্রশাসনিক স্তরে রাজনৈতিক দূরত্ব মুছে ফেলেছেন।
চাইলে মমতাও সেটা পারতেন। না, সেটা তিনি করবেন না। তার কাছে সিপিএমের মুখ দেখাও পাপ। সিদ্ধান্তে তিনি পাথর। নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। কংগ্রেসের কাছে এটাই অ্যাডভান্টেজ। বিরোধীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে শাসনের সুবিধা বেশি।
সরকার আঁতুড়ঘরে থাকতে থাকতেই শেষ তাসটা খেলেছেন মমতা। দরকার ছিল না। আলোচনার দরজা-জানালা খোলা রাখতে পারতেন। তা না করে সরাসরি ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেখিয়েছেন। মমতার উচ্চকিত মন্তব্যে কংগ্রেস নরম হয়নি। উল্টো পাল্টা আক্রমণ করেছে। এতে প্রশাসনিক টানাপড়েন, রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে। মমতা যে শুধু তৃণমূল সভানেত্রী নন, পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রগতিশীল একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বুঝতে চাইছেন না। পূর্বাঞ্চলের ১০ কোটি মানুষের দায়িত্ব তার। সংখ্যায় কাটাকুটি বা ভাঙাভাঙি করতে গেলে তিনি ভাঙবেন। জনপ্রিয়তা হারাবেন। ভোটে তার প্রভাব পড়বে।
নির্বাচনের অনেক নেগেটিভ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রচারে গতি সঞ্চার করেছেন মমতা। এবার তার খেসারত দিতে হচ্ছে। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে খৰহস্ত। বলেছেন, মমতা ফ্যাসিবাদী। সিপিএমকে হটাতে মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ ছিল মমতার বিরুদ্ধে। এখন মাওবাদীদের নস্যাৎ করতে গিয়ে তার দাম দিতে হচ্ছে। তৃণমূল কর্মীদের মরতে হচ্ছে।
জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট জেনেও স্নেহডোরে বেঁধেছিলেন বিধান রায়। নানান বিষয়ে প্রশ্রয় দিতেন। মমতাকেও স্নেহ করতেন জ্যোতি বসু। তাকে কাজ-কর্মে পরামর্শও দিতেন। দলের ঊধর্ে্ব মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কথা মনে রেখে সবাইকে নিয়ে মমতার চলতে হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পকে রাজনীতির বাইরে রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি।
অগি্নকন্যার ইমেজটা সব সময় কাজে লাগে না। গরম পরিস্থিতিতে বরফের আদর বাড়ে। ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার উপনির্বাচনের আগে মমতার সেই পরিবর্তিত ভাবমূর্তি দেখা যাচ্ছে না। ভাব-ভঙ্গিতে আগের লড়াকু মেজাজ। প্রতিপক্ষ পাল্টেছে। সিপিএমের জায়গায় এসেছে কংগ্রেস। যাদের সঙ্গে ছ'মাস আগে জোট বেঁধে ভোটে লড়েছেন, এখন তাদেরই মুখোমুখি। দু'পক্ষই কথায় শান দিচ্ছে।
লোকসভার মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে মমতার হাতে মাত্র ১৯টি। সংখ্যাটা খুব কম হলেও কেন্দ্রে ইউপিএ-টু সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। কিন্তু সেই সুযোগে যদি তিনি কংগ্রেসকে ব্ল্যাকমেইল করতে চান, তারা মানবে কেন? আগেরবার মার্কিন-ভারত পরমাণু চুক্তির ইস্যুতে বামফ্রন্ট ইউপিএ-ওয়ান সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল। তাতে ফল ভালো হয়নি। অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সরকার বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু পরের নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রায় নিশ্চিহ্ন। ২০০৯-এ দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে মমতা জিতেছেন ২,১৯,৫৭১ ভোটে। এবার তার বিকল্প প্রার্থী সুব্রত বক্সি। প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের তরুণ তুর্কি ছাত্রনেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস তৃণমূলের থেকে দূরে সরে যাওয়ায় সিপিএমের সুবিধা। সিপিএম জেতার কথা ভাবছে না। তাদের লক্ষ্য তৃণমূলের জয়ের মার্জিন কমানো। সেটা পারলে গোটা দেশকে বোঝাতে পারবে মমতার জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। মমতা সেটা করতে দেবেন না বলেই মনে হয়। তাই তাকে জনতাকেই কাছে টানতে হবে। আর সেটি যে তিনি করতে পারেন তার প্রমাণ আবার দেওয়া দরকার।
অমিত বসু : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও লেখক
হাজরায় মিছিল করাটাই কংগ্রেসের মস্তবড় চ্যালেঞ্জ, যে জায়গায় মমতার উত্থান সেখানে কংগ্রেসের উপদ্রব মমতা মানবেন কেন? চিৎকার করে হুশিয়ারি দিয়েছেন। কেন্দ্রের ইউপিএ সরকারকে বলেছেন, রাজ্যে তৃণমূল একাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কংগ্রেস পাশে না থাকলেও চলবে। কিন্তু কেন্দ্রে তৃণমূল ছাড়া ইউপিএ সরকার বাঁচবে না। মৌসম নূর কথাটা মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিয়েছেন। বলেছেন, মমতা সরতে চাইলে কংগ্রেস হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলুন। মমতার মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা কড়া কাপড়ের মতো কথার ভাঁজ নষ্ট করেছেন মৌসম। রাজনীতিতে নবীনা হয়েও বুঝিয়েছেন এবিএ গনি খান চৌধুরীর পরিবারের যথার্থ প্রতিনিধি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি তাদের আত্মীয় ছিলেন। গনি খান মালদহের নেতা হয়েও গোটা পশ্চিমবঙ্গ কাঁপিয়েছেন। লোকসভায় যখন প্রশ্ন উঠেছিল তার মালদহপ্রীতি নিয়ে, তিনি জবাব দিয়েছিলেন মালদহ কি ভারতের বাইরে?
মৌসমকে আন্ডারএস্টিমেট করলে মমতা ভুল করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় যথেষ্ট পরিণত তিনি। স্থান ও সময় নির্বাচনে তার প্রমাণ রেখেছেন। ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন। নির্বাচনের ১১ দিন আগে ওই এলাকাতেই মৌসম মিছিল করেছেন। ভোটারদের প্রভাবিত করাই যে তার উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কার।
মৌসম হাইকমান্ডের অনুমতি না নিয়ে যে এ মিছিল করেননি সে বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া যেতে পারে। সেই কারণেই কিছু বলার থাকলে হাইকমান্ডকে বলার পরামর্শ দিয়েছেন মমতাকে। মমতা কী করবেন? মৌসমের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কাছে নালিশ করবেন? তা যদি করেন তাহলে মৌসমকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মেনে নিতে হবে। তাতে মমতা দুর্বল হবেন, মৌসমের পালে হাওয়া লাগবে। দক্ষিণ কলকাতায় নতুন করে এলাকা নির্ধারণে ভোটার এদিক-সেদিক ছিটকে গেলেও, সেখানকার কংগ্রেস ভোটেই সিপিআইএমের সাবেক হেভিওয়েট নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জিকে হারিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মমতার আত্মপ্রকাশ। তখনও তৃণমূলের জন্ম হয়নি। তৃণমূলের আবির্ভাবে কংগ্রেসের ভোট মমতার দিকে অনেকটা সরলেও কংগ্রেস ভোটব্যাংক শূন্য হয়নি। শুধু এখানে নয়, পশ্চিমবঙ্গের সব আসনেই কংগ্রেস ভোট জয়-পরাজয়ের বড় ফ্যাক্টর। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল একা লড়ে তার প্রমাণ পেয়েছে। মমতা ছাড়া কেউ জিততে পারেননি। বিধানসভার উপনির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে মমতা ভালো মার্জিনে জিতলেও ভোট কম পেয়েছেন। আগের প্রার্থী সুব্রত বক্সির চেয়ে প্রায় পনের হাজার ভোট হ্রাস। হতে পারে ভোট পড়ার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে আসাতেই এই ক্ষতি। প্রতিবেশীরা মমতাকে ভোট দিতে পোলিং বুথে যাওয়ার সামান্য কষ্টটুকু সহ্য করতে রাজি হলেন না কেন, সেই প্রশ্নটাও ওঠে আসে। মমতা সমর্থকদের আবেগ এত দ্রুত প্রশমিত হওয়াটা তৃণমূলের পক্ষে মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।
অযথা ভাবনায় সময় নষ্ট না করে প্রয়োগ নৈপুণ্যে দখলদারিতে বিশ্বাসী তৃণমূল। সে ক্ষেত্রে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সঙ্গে মমতার তুলনা খোঁজা হয়। অন্যদিক থেকে বৈশিষ্ট্যে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের খুব কাছাকাছি তিনি। যিনি এক বছরও মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেননি। স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন। কারণ একটাই, কারও কথা শুনতে রাজি নন। এমনকি মহাত্মা গান্ধী বললেও না। গজু খৈতানকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন গান্ধী স্বয়ং। না মেনে স্বেচ্ছায় সরেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। ১৯৫০-এ কৃষক মজদুর প্রজা পার্টির সচিব হয়েও বেশি দিন থাকতে পারেননি। ১৯৬৭তে আবার ফিরেছেন। প্রথম অ-কংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকে সহ্য করার ধৈর্য দেখাননি। আট মাসে অজয় সরকারের পতন হতেই দল ছাড়াই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোটের মুখ্যমন্ত্রী হন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। যার মেয়াদ ছিল মাত্র তিন মাস। প্রফুল্লচন্দ্রের দল ছিল না। মমতার দল থেকেও নেই। তার দলের নাম তৃণমূল কংগ্রেস না হয়ে মমতা কংগ্রেস হলে মানানসই হতো। তিনি কার্যত একা। একার ক্ষমতায় কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হননি। সঙ্গে কংগ্রেস ছিল। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভোটের পরে নয়, আগে। ভোট ভাগাভাগি হয়নি। হলে মমতার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া কঠিন ছিল। জোট ভাঙলেও ভোট তো আর ভাঙা যাবে না। দক্ষিণ কলকাতার উপনির্বাচনে যদি ভোট ভাঙে? তৃণমূলের ভোট কমবে। ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্র মমতাকে ছেড়ে মমতার লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুব্রত বক্সি। প্রতিদ্বন্দ্বী বাম ছাত্রনেতা ঋতব্রত ব্যানার্জি। ভোটারদের কাছে পোস্টাফিসের ছাপ ছাড়া নতুন চিঠি। পড়ে দেখার আকর্ষণ কম নয়। মমতা কী করবেন? সুব্রতকে দাঁড় করিয়ে লড়ছেন তো তিনিই। তারই বা কী করার আছে। নিজের জোরে নির্বাচন লড়বে দূরের কথা, দলে এমন কেউ নেই যিনি ভবানীপুর থানায় গিয়ে দলের আটক সদস্যদের ছাড়িয়ে আনার মতো সহজ কাজটা করতে পারেন। সেখানেও যেতে হয় স্বয়ং মমতাকে।
রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা গান্ধীর একাকিত্ব অনুভব করেছিলেন। ব্যথিত হয়ে গানও লিখেছিলেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে'। তখন কংগ্রেস গান্ধীজির পাশে থেকেও নেই। সাম্প্রদায়িতায় যারা দেশ বিষোচ্ছে তাদের কাছেও গান্ধীজি চক্ষুশূল। সংহতির পক্ষে তার নির্ভীক একক যাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
মমতা গান্ধী নন। তিনি একাও নন। তাকে সাহায্য করার হাতের অভাব নেই। এমনকি বিরোধীরাও তার পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের দাবিতে সিপিএমও মমতার সঙ্গে থাকতে রাজি। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল এক হতে চাইছে। রাজ্যটাকে যেভাবেই হোক টেনে তোলার অঙ্গীকার। মমতা কারও সাহায্য নেবেন না। একাই যা করার করবেন। পারলে পারবেন, না পারলে যা হওয়ার হবে। স্বেচ্ছায় একাকিত্ব বরণের উদ্দেশ্য একটাই। তিনি কাউকে বিশ্বাস করেন না। কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালে তিনি মনে করেন, সেটা সাহায্যের হাত নয়, ষড়যন্ত্রের। পেছন থেকে ছুরি মেরে পতন ঘটানোর ছক। ভয় তার সবাইকে। সব থেকে ভয় নিজেকে। আত্মবিশ্বাসী হলে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হতেন না।
কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনৈতিক বিরোধ দীর্ঘদিনের। ১৯৪৮-এ বিধান রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর সঙ্গে ছিল তার নিত্য টানাপড়েন।
উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে নাজেহাল বিধায় রায় যখন নেহরুর কাছে হাত পেতেছেন তখনই বিড়ম্বিত হয়েছেন। একশ' চাইলে পেয়েছেন এক। বোঝার ওপর ঘাড়ে চেপেছে শাকের আঁটি। কেন্দ্রের ইচ্ছায় মাশুল সমীকরণ নীতি ঘোষিত হয়েছে। লোহা, তামা, তুলা_ এসব পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যেত অনেক কম দামে; নিজেরাই উৎপাদন করত বলে। সেটা শিল্পায়নের পথে সহায়ক ছিল। অন্য রাজ্যের থেকে শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে ছিল সেই কারণেই। মাশুল সমীকরণে এসব বস্তু সব রাজ্যে এক দামে পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। বিধান রায়ের মাথায় বাজ পড়ল। তবু তিনি থামলেন না। উন্নয়নের জোয়ার তুললেন। দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা হলো। সল্টলেক হলো। কল্যাণীর মতো নতুন নগরী মাথা তুলল। উন্নয়নের বান ডাকল। নতুন বাংলার রূপকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন বিধান রায়।
বিধান রায় বঞ্চিত হলেও কিন্তু নেহরুর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করেননি। নেহরু অসুস্থ হলে কড়া হাতে ডাক্তারি করতেন। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী নন, প্রথিতযশা চিকিৎসক। বিধান রায়-নেহরু দু'জনেই ছিলেন কংগ্রেস নেতা। এক দলে থাকা সত্ত্বেও মতান্তর ছিল, কিন্তু মনান্তর হয়নি। ইতিহাস সব থেকে বড় শিক্ষক। মমতা না মানলে বিপদ তারই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ছ'মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন।
২৮ রাজ্যের অর্থমন্ত্রীদের যে কমিশন তার চেয়ারম্যান ছিলেন বামফ্রন্টের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর জায়গাটা নিয়েছেন বিহারের অর্থমন্ত্রী সুশীল মোদী। দায়িত্ব পেয়েও কিন্তু অসীম দাশগুপ্তকে ছাড়তে রাজি হননি। তাকে নিজের উপদেষ্টা করেছেন। বলেছেন, আপনার উপদেশ ছাড়া এ কাজ সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন্দ্র-রাজ্য অর্থনীতির বিষয়টি আপনি ছাড়া কেউ ভালো বোঝেন না। অসীম আর সুশীলের অবস্থান দু'মেরুতে। অসীম বাম, সুশীল কট্টর দক্ষিণপন্থি। তবু তারা পরস্পরের সহযোগী। প্রশাসনিক স্তরে রাজনৈতিক দূরত্ব মুছে ফেলেছেন।
চাইলে মমতাও সেটা পারতেন। না, সেটা তিনি করবেন না। তার কাছে সিপিএমের মুখ দেখাও পাপ। সিদ্ধান্তে তিনি পাথর। নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। কংগ্রেসের কাছে এটাই অ্যাডভান্টেজ। বিরোধীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে শাসনের সুবিধা বেশি।
সরকার আঁতুড়ঘরে থাকতে থাকতেই শেষ তাসটা খেলেছেন মমতা। দরকার ছিল না। আলোচনার দরজা-জানালা খোলা রাখতে পারতেন। তা না করে সরাসরি ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেখিয়েছেন। মমতার উচ্চকিত মন্তব্যে কংগ্রেস নরম হয়নি। উল্টো পাল্টা আক্রমণ করেছে। এতে প্রশাসনিক টানাপড়েন, রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে। মমতা যে শুধু তৃণমূল সভানেত্রী নন, পশ্চিমবঙ্গের মতো প্রগতিশীল একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বুঝতে চাইছেন না। পূর্বাঞ্চলের ১০ কোটি মানুষের দায়িত্ব তার। সংখ্যায় কাটাকুটি বা ভাঙাভাঙি করতে গেলে তিনি ভাঙবেন। জনপ্রিয়তা হারাবেন। ভোটে তার প্রভাব পড়বে।
নির্বাচনের অনেক নেগেটিভ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রচারে গতি সঞ্চার করেছেন মমতা। এবার তার খেসারত দিতে হচ্ছে। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে খৰহস্ত। বলেছেন, মমতা ফ্যাসিবাদী। সিপিএমকে হটাতে মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ ছিল মমতার বিরুদ্ধে। এখন মাওবাদীদের নস্যাৎ করতে গিয়ে তার দাম দিতে হচ্ছে। তৃণমূল কর্মীদের মরতে হচ্ছে।
জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট জেনেও স্নেহডোরে বেঁধেছিলেন বিধান রায়। নানান বিষয়ে প্রশ্রয় দিতেন। মমতাকেও স্নেহ করতেন জ্যোতি বসু। তাকে কাজ-কর্মে পরামর্শও দিতেন। দলের ঊধর্ে্ব মানবিক সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। সে কথা মনে রেখে সবাইকে নিয়ে মমতার চলতে হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পকে রাজনীতির বাইরে রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি।
অগি্নকন্যার ইমেজটা সব সময় কাজে লাগে না। গরম পরিস্থিতিতে বরফের আদর বাড়ে। ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার উপনির্বাচনের আগে মমতার সেই পরিবর্তিত ভাবমূর্তি দেখা যাচ্ছে না। ভাব-ভঙ্গিতে আগের লড়াকু মেজাজ। প্রতিপক্ষ পাল্টেছে। সিপিএমের জায়গায় এসেছে কংগ্রেস। যাদের সঙ্গে ছ'মাস আগে জোট বেঁধে ভোটে লড়েছেন, এখন তাদেরই মুখোমুখি। দু'পক্ষই কথায় শান দিচ্ছে।
লোকসভার মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে মমতার হাতে মাত্র ১৯টি। সংখ্যাটা খুব কম হলেও কেন্দ্রে ইউপিএ-টু সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে অপরিহার্য। কিন্তু সেই সুযোগে যদি তিনি কংগ্রেসকে ব্ল্যাকমেইল করতে চান, তারা মানবে কেন? আগেরবার মার্কিন-ভারত পরমাণু চুক্তির ইস্যুতে বামফ্রন্ট ইউপিএ-ওয়ান সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছিল। তাতে ফল ভালো হয়নি। অন্য দলের সমর্থন নিয়ে সরকার বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু পরের নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রায় নিশ্চিহ্ন। ২০০৯-এ দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে মমতা জিতেছেন ২,১৯,৫৭১ ভোটে। এবার তার বিকল্প প্রার্থী সুব্রত বক্সি। প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের তরুণ তুর্কি ছাত্রনেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস তৃণমূলের থেকে দূরে সরে যাওয়ায় সিপিএমের সুবিধা। সিপিএম জেতার কথা ভাবছে না। তাদের লক্ষ্য তৃণমূলের জয়ের মার্জিন কমানো। সেটা পারলে গোটা দেশকে বোঝাতে পারবে মমতার জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। মমতা সেটা করতে দেবেন না বলেই মনে হয়। তাই তাকে জনতাকেই কাছে টানতে হবে। আর সেটি যে তিনি করতে পারেন তার প্রমাণ আবার দেওয়া দরকার।
অমিত বসু : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক ও লেখক
No comments