ইতিউতি-উত্তপ্ত শীতের পূর্বাভাস by আতাউস সামাদ
বাংলাদেশ বড় অস্থির জায়গা। কখন যে কী হয়, কে যে কী করে, তার ঠিক নেই। পরশু যদি বন্যা এ দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, তো গতকাল তা হয়েছে খরা, আর আজকে সেটা হতে চলেছে ভূমিকম্প। গতকাল যদি আমাদের অর্থনীতি হয়ে যায় 'এশিয়ার জেগে ওঠা বাঘ', তাহলে আজকে তা ইঁদুর না হলেও হয়ে যায় বিড়াল। প্রহরী জাতের সারমেয় এখানে বেশি পাওয়া যায় না, তাই মুরগি পাহারা দেওয়ার জন্য ধূর্ত শিয়ালকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, আর
তাতে কুক্কুট-খামারির হৃৎপিণ্ড অস্থির হয়। বাংলাদেশের যে নেতা জনগণের চোখকে স্বপ্নে বিভোর করে দেন, তিনিই তখন জাদুর চেরাগে বিশ্বাস করার জন্য তাদের গালমন্দ করেন। এরই ফাঁকে তাঁর নিজের জাদুস্পর্শে আখের গুছিয়ে ফেলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এখানকার মানুষ গতকাল ওই রকম স্বভাবের যাঁকে মাথায় উঠিয়ে নিয়েছিল, একটা সুযোগ পেলে আজকে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলবে। আবার এর মানে কিন্তু এমন নয় যে তিনি চিরতরে বাতিল হয়ে গেলেন। এমনকি মিলিটারিও বলতে পারে না কখন কী হবে। তারা একবার যে দুই নেত্রীকে 'মাইনাস' করে দেশছাড়া করতে চেয়েছিল, তাঁরা দুজন 'ডাবল প্লাস' হয়ে দেশে অধিষ্ঠান আছেন, আর মাইনাসওয়ালারা সংগোপনে প্রবাসী হয়েছেন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবাই ভাবছেন, এ দেশের রাজনীতি আবার দারুণ অস্থির হতে চলেছে। তা হতেই পারে। কারণ এখানে একটা দারুণ 'রোল রিভার্সেল' চরিত্র বদল হয়েছে। ১৯৯৬ সালে যে শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত-অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে খালেদা জিয়া ও তাঁর বিএনপিকে বাধ্য করেছিলেন দেশজুড়ে লাগাতার হরতাল-অবরোধ করে, আজ তাঁরা আইন পাল্টে ফেলে বলছেন, অনির্বাচিত লোকদের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে বেগম জিয়া, বিএনপি ও তাঁদের মিত্ররা বলে দিয়েছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না; যদিও ১৯ মার্চ ১৯৯৬ পর্যন্ত তাঁরা ওই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। নয়া পল্টনের বিশাল সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া অক্টোবর মাসে ঢাকা থেকে সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোডমার্চ এবং ওই তিন জায়গায় গণসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই রোডমার্চের পর 'ফাইনাল খেলা' শুরু হবে। এই আন্দোলনে বিরোধী দলের দাবি অবিলম্বে হাসিনা সরকারের পদত্যাগ এবং প্রয়োজনীয় আইন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করছেন, একমাত্র ২০০১ সাল ছাড়া দেশে কখনো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দেশের শাসনভার ফেরত আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে যারা ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়েছিল, তারা যে দুই বছর গদি ছাড়েনি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
তবে আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, তার আগে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সেনাশাসক জেনারেল এরশাদকে সরিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে যে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা শান্তিপূর্ণভাবে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। এরপর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কঠিন আন্দোলন করে, যাতে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি, মতিউর রহমান নিজামীর জামায়াতে ইসলামী এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট দল এলডিপিও সঙ্গী ছিল। বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে জুন ১৯৯৬তে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। তখন শান্তিপূর্ণভাবেই নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। আর ২০০১ সালের কথা তো তিনি নিজেই বলেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি কে এম হাসানকে ২০০৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে বসানোর বিএনপির চেষ্টার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারা, নির্বাচন কমিশনের খামখেয়ালিপনা এবং সর্বশেষ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তৎকালীন সেনাপ্রধান চাপ দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক করতে বাধ্য করেন। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন সাবেক আমলা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। অনেকের মতো আমিও মনে করি, ওই সরকার অসাংবিধানিক ও অবৈধ ছিল। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই মর্মে রায় দিয়েছিলেন যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন জাতীয় সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে আপনা থেকে ভেঙে যাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ায় সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে। ওই অসাংবিধানিক সরকারকে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল প্রথম দিকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং সঠিক ও সচিত্র ভোটার তালিকা তৈরি করার জন্য তাদের সময় দিতে রাজি হয়েছিলেন। ওই সরকার তাদের অনাহূত রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও দেয়। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দৃঢ় সমর্থন দিতে থাকায় মিলিটারি সিভিল ব্যুরোক্র্যাসির রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে দেশে নির্বাচনে অনিয়ম, জালিয়াতি, বিশৃঙ্খলা রোধ এবং জনগণকে বিনা বাধায় তাদের ভোট দিতে পারার জন্য যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা সংবিধানে করা হয়েছিল, তা বারবার ব্যর্থ হয়েছে_এমন দাবি একেবারেই ভুল।
এখন প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়। ওই রায়ে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের পরিপন্থী বলা হয়েছে, আবার একই সঙ্গে আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় হতে পারে বলেও মত প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ওই রায়ে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে যেন জড়ানো না হয়। কোনো বিচারপতিকে (হালের বা সাবেক) যেন ওই সরকারের প্রধান বা সদস্য করা না হয়। এদিক থেকে দেখলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখার সুযোগ ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। তবে আমার মতো লোকজন এবং আমি তো উলুখাগড়া শ্রেণীভুক্ত। যুদ্ধ হয় রাজায়-রাজায়। তাতে আমাদের মতো উলুখাগড়ার জন্য নির্ধারিত ভূমিকা হচ্ছে বিনা প্রতিবাদে আমাদের প্রাণ যেতে দেওয়া। এতে কোনো ট্যাঁফো করলে সেটা হবে অমার্জনীয় বেয়াদবি। এ অবস্থায় আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করব আগমী কয়েক মাস কী হয় তা দেখতে আর তাতে না জানি কত সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় তা নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার সম্ভবত জাতীয় সংসদে এক মন্তব্যে তাঁর অনুপস্থিত প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করেছিলেন, আন্দোলন করতে কে কত পারঙ্গম তা জানা আছে। হতে পারে বিএনপি ভাবছিল না যে তারা এখনো আন্দোলন করতে পারবে, হতে পারে তারা ভুলে গিয়েছিল যে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল এরশাদকে বিদায় করা পর্যন্ত সাতটি বছর তারাও রাজপথের সংগ্রামে ছিল এবং বেশ ভালোভাবেই ছিল। তাই তারা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিহাসের খোঁচা খেয়ে একটু নড়েচড়ে উঠেছে। তারা দেশজুড়ে হরতাল ডেকেছে এবং সেই হরতাল পালিত হয়েছে। বুকের ওপর পুলিশের বুট আর পিঠে-মাথায় ক্ষমতাসীনদের নানা বাহিনীর লাঠির বাড়ির ভয়ে বিএনপি-জামায়াতের সদস্যরা ঢাকার বাইরে কিছু মিছিল করলেও পিকেটিং করেনি। তার পরও দোকানপাট খোলেনি, সড়কপথে গাড়িঘোড়া চলেনি। আর গত মঙ্গলবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে মঞ্চ বেঁধে ইনার সার্কুলার রোডে তারা বিশাল জনসমাবেশ করেছে। নির্দলীয় প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি, বিএনপি সমর্থকদের ওই সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবু তাদের অনেকেই এ সমাবেশে এসেছে। সেদিন সকালে ঢাকায় বৃষ্টিবাদল ছিল। তা সত্ত্বেও বিএনপি সমর্থকরা জনসভায় এসেছে। আমি বলছি না যে এই হরতাল আর সমাবেশের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে ফেলবে বা পড়ে যাবে। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিস্ময়কর রকম কমসংখ্যক আসন পায় বলে এবং বেশ কিছুদিন ধরে তাদের ওপর হামলা-মামলা, জেল-জুলুম চলেছে বিধায় তারা নির্জীব ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছে_আওয়ামী লীগ তেমনটা ভাবলে ভুল করবে। আর আমরা মনে করি, বিএনপি তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন যতটা সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে পারবে, তার সঙ্গে দেশে চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পুলিশের লাঠি, বুট ও ডাণ্ডাবেড়ির অত্যাচার, দস্যু-ডাকাতদের অপতৎপরতায় জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়া, গফরগাঁওয়ে যুবলীগের সদস্য মেহেদী হাসান ইলিয়াসকে ডাকাতরা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে যেভাবে হত্যা করল, সেই নৃশংস ঘটনা তার একটি প্রমাণ এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের ছড়াছড়িতে বিতৃষ্ণ ও যন্ত্রণায় অস্থির বহু মানুষ তাদের নীরবে সমর্থন দিয়ে বাড়তি শক্তি জোগাবে। ফলে এমন মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে একদিকে সরকারের অনমনীয়তা, অন্যদিকে বিরোধীদের মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নামা দেশে যথেষ্ট অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। আর অন্য বিপদ হচ্ছে, দেশে নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায়, অন্যায়-অবিচার দৃশ্যত বেড়ে যাওয়ায় এবং এক শ্রেণীর লোক তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে দেশের সাধারণ মানুষকেও উত্ত্যক্ত করায় রাজনীতির বাইরেও উত্তপ্ত বিক্ষোভ দেখাতে উদ্যত লোকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এ সময়টাতে। সে জন্যই বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার আসন্ন শীতকালকে 'উইন্টার অব ডিসকনটেন্ট' (অসন্তোষের শীতকাল) হিসেবে দেখছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবাই ভাবছেন, এ দেশের রাজনীতি আবার দারুণ অস্থির হতে চলেছে। তা হতেই পারে। কারণ এখানে একটা দারুণ 'রোল রিভার্সেল' চরিত্র বদল হয়েছে। ১৯৯৬ সালে যে শেখ হাসিনা ও তাঁর আওয়ামী লীগ অনির্বাচিত-অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে খালেদা জিয়া ও তাঁর বিএনপিকে বাধ্য করেছিলেন দেশজুড়ে লাগাতার হরতাল-অবরোধ করে, আজ তাঁরা আইন পাল্টে ফেলে বলছেন, অনির্বাচিত লোকদের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। অন্যদিকে বেগম জিয়া, বিএনপি ও তাঁদের মিত্ররা বলে দিয়েছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া জাতীয় সংসদের কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না; যদিও ১৯ মার্চ ১৯৯৬ পর্যন্ত তাঁরা ওই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। নয়া পল্টনের বিশাল সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া অক্টোবর মাসে ঢাকা থেকে সিলেট, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোডমার্চ এবং ওই তিন জায়গায় গণসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওই রোডমার্চের পর 'ফাইনাল খেলা' শুরু হবে। এই আন্দোলনে বিরোধী দলের দাবি অবিলম্বে হাসিনা সরকারের পদত্যাগ এবং প্রয়োজনীয় আইন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় সংসদের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠান।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করছেন, একমাত্র ২০০১ সাল ছাড়া দেশে কখনো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে দেশের শাসনভার ফেরত আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে যারা ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়েছিল, তারা যে দুই বছর গদি ছাড়েনি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
তবে আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, তার আগে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সেনাশাসক জেনারেল এরশাদকে সরিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে যে নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা শান্তিপূর্ণভাবে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। এরপর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কঠিন আন্দোলন করে, যাতে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি, মতিউর রহমান নিজামীর জামায়াতে ইসলামী এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট দল এলডিপিও সঙ্গী ছিল। বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে জুন ১৯৯৬তে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। তখন শান্তিপূর্ণভাবেই নতুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। আর ২০০১ সালের কথা তো তিনি নিজেই বলেছেন। অন্যদিকে বিচারপতি কে এম হাসানকে ২০০৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে বসানোর বিএনপির চেষ্টার প্রতিবাদে বিক্ষোভ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারা, নির্বাচন কমিশনের খামখেয়ালিপনা এবং সর্বশেষ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তৎকালীন সেনাপ্রধান চাপ দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে এবং নতুন তত্ত্বাবধায়ক করতে বাধ্য করেন। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন সাবেক আমলা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। অনেকের মতো আমিও মনে করি, ওই সরকার অসাংবিধানিক ও অবৈধ ছিল। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এই মর্মে রায় দিয়েছিলেন যে ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন জাতীয় সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে আপনা থেকে ভেঙে যাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন না হওয়ায় সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে। ওই অসাংবিধানিক সরকারকে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল প্রথম দিকে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং সঠিক ও সচিত্র ভোটার তালিকা তৈরি করার জন্য তাদের সময় দিতে রাজি হয়েছিলেন। ওই সরকার তাদের অনাহূত রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে। রাজনীতি থেকে বিদায় করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও দেয়। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দৃঢ় সমর্থন দিতে থাকায় মিলিটারি সিভিল ব্যুরোক্র্যাসির রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে দেশে নির্বাচনে অনিয়ম, জালিয়াতি, বিশৃঙ্খলা রোধ এবং জনগণকে বিনা বাধায় তাদের ভোট দিতে পারার জন্য যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা সংবিধানে করা হয়েছিল, তা বারবার ব্যর্থ হয়েছে_এমন দাবি একেবারেই ভুল।
এখন প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়। ওই রায়ে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের পরিপন্থী বলা হয়েছে, আবার একই সঙ্গে আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় হতে পারে বলেও মত প্রকাশ করা হয়েছে। তবে ওই রায়ে শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে যেন জড়ানো না হয়। কোনো বিচারপতিকে (হালের বা সাবেক) যেন ওই সরকারের প্রধান বা সদস্য করা না হয়। এদিক থেকে দেখলে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখার সুযোগ ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। তবে আমার মতো লোকজন এবং আমি তো উলুখাগড়া শ্রেণীভুক্ত। যুদ্ধ হয় রাজায়-রাজায়। তাতে আমাদের মতো উলুখাগড়ার জন্য নির্ধারিত ভূমিকা হচ্ছে বিনা প্রতিবাদে আমাদের প্রাণ যেতে দেওয়া। এতে কোনো ট্যাঁফো করলে সেটা হবে অমার্জনীয় বেয়াদবি। এ অবস্থায় আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করব আগমী কয়েক মাস কী হয় তা দেখতে আর তাতে না জানি কত সাধারণ মানুষের প্রাণ যায় তা নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার সম্ভবত জাতীয় সংসদে এক মন্তব্যে তাঁর অনুপস্থিত প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে মন্তব্য করেছিলেন, আন্দোলন করতে কে কত পারঙ্গম তা জানা আছে। হতে পারে বিএনপি ভাবছিল না যে তারা এখনো আন্দোলন করতে পারবে, হতে পারে তারা ভুলে গিয়েছিল যে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল এরশাদকে বিদায় করা পর্যন্ত সাতটি বছর তারাও রাজপথের সংগ্রামে ছিল এবং বেশ ভালোভাবেই ছিল। তাই তারা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিহাসের খোঁচা খেয়ে একটু নড়েচড়ে উঠেছে। তারা দেশজুড়ে হরতাল ডেকেছে এবং সেই হরতাল পালিত হয়েছে। বুকের ওপর পুলিশের বুট আর পিঠে-মাথায় ক্ষমতাসীনদের নানা বাহিনীর লাঠির বাড়ির ভয়ে বিএনপি-জামায়াতের সদস্যরা ঢাকার বাইরে কিছু মিছিল করলেও পিকেটিং করেনি। তার পরও দোকানপাট খোলেনি, সড়কপথে গাড়িঘোড়া চলেনি। আর গত মঙ্গলবার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে মঞ্চ বেঁধে ইনার সার্কুলার রোডে তারা বিশাল জনসমাবেশ করেছে। নির্দলীয় প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি, বিএনপি সমর্থকদের ওই সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবু তাদের অনেকেই এ সমাবেশে এসেছে। সেদিন সকালে ঢাকায় বৃষ্টিবাদল ছিল। তা সত্ত্বেও বিএনপি সমর্থকরা জনসভায় এসেছে। আমি বলছি না যে এই হরতাল আর সমাবেশের চাপে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে ফেলবে বা পড়ে যাবে। তবে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিস্ময়কর রকম কমসংখ্যক আসন পায় বলে এবং বেশ কিছুদিন ধরে তাদের ওপর হামলা-মামলা, জেল-জুলুম চলেছে বিধায় তারা নির্জীব ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছে_আওয়ামী লীগ তেমনটা ভাবলে ভুল করবে। আর আমরা মনে করি, বিএনপি তার নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন যতটা সক্রিয় ও শক্তিশালী করতে পারবে, তার সঙ্গে দেশে চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পুলিশের লাঠি, বুট ও ডাণ্ডাবেড়ির অত্যাচার, দস্যু-ডাকাতদের অপতৎপরতায় জীবন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়া, গফরগাঁওয়ে যুবলীগের সদস্য মেহেদী হাসান ইলিয়াসকে ডাকাতরা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে যেভাবে হত্যা করল, সেই নৃশংস ঘটনা তার একটি প্রমাণ এবং দুর্নীতি ও অনিয়মের ছড়াছড়িতে বিতৃষ্ণ ও যন্ত্রণায় অস্থির বহু মানুষ তাদের নীরবে সমর্থন দিয়ে বাড়তি শক্তি জোগাবে। ফলে এমন মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে একদিকে সরকারের অনমনীয়তা, অন্যদিকে বিরোধীদের মরিয়া হয়ে আন্দোলনে নামা দেশে যথেষ্ট অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। আর অন্য বিপদ হচ্ছে, দেশে নিয়ম-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ায়, অন্যায়-অবিচার দৃশ্যত বেড়ে যাওয়ায় এবং এক শ্রেণীর লোক তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে দেশের সাধারণ মানুষকেও উত্ত্যক্ত করায় রাজনীতির বাইরেও উত্তপ্ত বিক্ষোভ দেখাতে উদ্যত লোকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এ সময়টাতে। সে জন্যই বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার আসন্ন শীতকালকে 'উইন্টার অব ডিসকনটেন্ট' (অসন্তোষের শীতকাল) হিসেবে দেখছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments