বিএলডিএ-কালের কণ্ঠ গোলটেবিল বৈঠকে সরকারের প্রতি আহবান-কালাকানুন থেকে মুক্ত হোক বেসরকারি আবাসন খাত
বেসরকারি আবাসন খাতকে সব ধরনের কালাকানুনমুক্ত রাখতে সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ)। সংগঠনের নেতারা মনে করেন, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কারণেই আজ ঢাকা শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে। যারা প্লট দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়ে ১৮ বছরেও প্লট দিতে পারে না, সেই রাজউককে দিয়ে
কখনোই আবাসনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় বেসরকারি আবাসন খাতকে সব ধরনের কালাকানুনের হাত থেকে মুক্ত করে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তাঁরা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিএলডিএ ও বহুল প্রচারিত দৈনিক কালের কণ্ঠের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী, পরিবেশবিদ, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
'বেসরকারি আবাসন খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক এ আলোচনায় আবাসন খাতের বিদ্যমান সমস্যা, সম্ভাবনা, সরকারের উদাসীনতা, রাজউকের ব্যর্থতা-দুর্নীতি প্রভৃতি বিষয় খোলামেলাভাবে উঠে আসে। অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমান। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। অনুষ্ঠানে
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবাসন ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, 'আবাসন ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করার একটি বদভ্যাস আছে কারও কারও। অথচ এই মানুষগুলো কাজ না করলে আজ ঢাকার মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা থাকত না। তবে এই শিল্পে কিছু আবর্জনাও আছে। সামান্য জমি কিনে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি জমি বিক্রি করে ফেলে কেউ কেউ। তাদের কারণে পুরো আবাসন শিল্পের দুর্নাম হচ্ছে। এ ব্যাপারে আবাসন ব্যবসায়ীদের সচেতন হতে হবে।'
আবাসন ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ বলেন, বেসরকারি আবাসন শিল্প খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান ২১ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতে দুই কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ৩০০টি শিল্প উপখাত এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪-এর কারণে এই খাত আজ বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন। এই বিধিমালার কতিপয় অযৌক্তিক ধারা সম্ভাবনাময় আবাসন শিল্প বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় থাকা সব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার জন্য তিনি রাজউকের প্রতি আহ্বান জানান।
বিএলডিএর অন্যতম সদস্য এম জি আর নাসির বলেন, সম্পত্তি হস্তান্তর ও নিবন্ধন খরচ যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। নানা রকম ভ্যাট, উৎসে কর ইত্যাদি বসিয়ে ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এই খরচ সাধারণ ক্রেতাদের ওপর গিয়েই পড়ছে। অথচ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান_এগুলো মানুষের মৌলিক চাহিদার অংশ। রাজউক নিজে আবাসন ব্যবসায় জড়িয়ে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। এটা অনৈতিক। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
যমুনা গ্রুপের পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. মো. আলমগীর আলম বলেন, রাজউক ১৮ বছর আগে টাকা নিয়ে পূর্বাচল এলাকায় প্লট দিতে চেয়েছিল; আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। অথচ কোনো বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এ রকম নজির নেই। আজ যাঁরা পরিবেশ নিয়ে কথা বলছেন, তাঁদের কেউই পরিবেশবিদ বা পরিবেশবিজ্ঞানী নন। তাঁরা বিদেশি কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করছেন। ড্যাপ এখনো চূড়ান্ত না হলেও ড্যাপকেই মাস্টারপ্ল্যান ধরে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। নানা হাউজিং প্রকল্প বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলোও সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য আবাসন ব্যবসায়ীদের ভূমিদস্যু বলছে। তাদেরও বুঝতে হবে, সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে।
আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ড. সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বলেন, নগরীতে ভূমিকম্প, জলাবদ্ধতা হলেই দোষ দেওয়া হয় আবাসন ব্যবসায়ীদের। কিন্তু একটা শহরের জন্য কী পরিমাণ ড্রেন-খাল রাখা দরকার, সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না। আজ গার্মেন্ট সেক্টরে বা শেয়ারবাজারে ধস নামলেই তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা উঠছে। কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীরা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন, সেদিকে সরকারের নজর নেই।
শতাব্দী হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহুল ইসলাম নান্নু বলেন, 'আবাসন খাতকে সরকারি-বেসরকারি হিসেবে চিহ্নিত না করে আবাসন শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। রাজউক এ পর্যন্ত যেসব প্রকল্প করেছে, কোনোটিতেই সময়মতো প্লট দিতে পারেনি। আর সব দোষ গিয়ে পড়ছে আমাদের ওপর।' তিনি ড্যাপের ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধানে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী সরদার আমিন বলেন, 'এত দিনে রাজউকের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একজন গিয়ে নতুন লোক আসছেন। তাঁরা ঘুষ খেয়ে মোটা হয়ে চলে যাচ্ছেন। রাজউক চেয়ারম্যানকে বললে তিনি বলেন, আপনারা ঘুষ দেওয়া বন্ধ করেন। আমি বলি, আপনাদের লোকদের ঘুষ নেওয়া বন্ধ করেন। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি। ব্যবসা না করে ঘুষের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নামার সময় তো আমাদের নেই।' ড্যাপের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যাঁরা আবাসন খাত নিয়ে আইন করেন, তাঁরা এমন লোক যাঁদের এই আইন করার মতো যোগ্যতা নেই। যে কারণে বাস্তবতাবর্জিত একটি ড্যাপ হয়েছে। এ রকম জনবিরোধী ড্যাপ হলে সেটা কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিভাগের অধ্যাপক ড. রেজোয়ান হোসেন ভুঁইয়া বলেন, 'ড্যাপ প্রণয়নে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। সেখানে আমার প্রস্তাব ছিল, ২০ বছর আগের উপাত্তকে নিয়ে ড্যাপ প্রণয়ন করলে সেটা হবে অবাস্তব। বর্তমান অবকাঠামো আমলে রেখেই ড্যাপ প্রণয়ন করা হোক।'
বিশ্বাস বিল্ডার্সের পরিচালক মেজর (অব.) দেলোয়ার হোসেন বলেন, একবারে ১০০ বিঘা জমি সরকারের পক্ষে কেনা সম্ভব। কিন্তু বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ৫-১০ বিঘা জমি দিয়েই প্রকল্প শুরু করতে হয়। আর সেটা করলেই সরকারের রোষানলে পড়তে হয়।
পূর্বাচল ইস্ট ওয়েস্ট সিটির চেয়ারম্যান মো. কামালউদ্দিন বলেন, সিঙ্গাপুরে প্রত্যেকের বেতন থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ কেটে রেখে সরকার তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। অথচ বাংলাদেশ সরকারের এদিকে কোনো খেয়ালই নেই। প্রতিদিন বাসাভাড়া বাড়ছে। তার পরও সরকার আবাসন খাতকে টুঁটি চেপে ধরতে তৎপর। আজ আবাসন ব্যবসায়ীরা না থাকলে ঢাকা শহরে অনেক লোককে রাস্তায় ঘুমাতে হতো।
পূর্বাচল রিজেন্ট টাউনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসান মিয়া বলেন, আজ বারিধারায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাট ৪০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। আবাসন কম্পানি খারাপ কাজ করলে জনগণ এত টাকা দিয়ে সেটা কিনত না।
আবাসন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, রাজউকের লোকজন কেবল তাদের ভাগ্য পরিবর্তন নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু কিভাবে মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। তাই রাজউক দিয়ে কেবল ওই সংস্থার লোকজনের ভাগ্যের পরিবর্তনই সম্ভব।
বিওসি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সোহেল বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের পথে বসাতে আজ নানা রকম বিধিমালা হচ্ছে। এগুলোকে বিধিমালা না বলে বন্ধমালা বলাই ভালো। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, 'মানুষের জন্য আইন না আইনের জন্য মানুষ? অযোগ্য লোকদের লাই দিলে যেটা হয়, তাদের কারণেই আজ কোনো প্রকল্প সঠিক পথে এগোচ্ছে না।'
রিজেন্ট গ্রুপের পরিচালক সাজ্জাদ রহমান খান বলেন, 'আজ আবাসন ব্যবসায়ীদের সবাই গালি দেয়। কিন্তু আমরা কি গালি শুনতে এ ব্যবসায় এসেছি? আমরা কি মানুষের জন্য কিছুই করিনি?'
স্টেট ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী ফরহাদ ইকবাল বলেন, একটি নকশার অনুমোদন নিতে হলে একেক জায়গায় যেতে হয়। পরিবেশ ও ভূমির ছাড়পত্র কি এক জায়গা থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না?
অনির্বাণ হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শেখ মো. শোয়েব উদ্দিন বলেন, 'আমার একটা জায়গাকে প্রথমে ড্যাপে একভাবে দেখানো হলো। অথচ পরে দেখি বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর অনেক চেষ্টা করেও পাইনি।'
ক্যাপিটাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিবা খান বলেন, 'আবাসন ব্যবসায়ীদের আজ অনেকেই প্রতারক মনে করে। এই অবস্থা কিভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।'
আলোচনায় আরো অংশ নেন সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার, ফারুক আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আবাসন খাতের সমস্যা নিরসনের জন্য বিএলডিএর পক্ষ থেকে ১৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বিএলডিএ ও বহুল প্রচারিত দৈনিক কালের কণ্ঠের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট আবাসন ব্যবসায়ী, পরিবেশবিদ, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
'বেসরকারি আবাসন খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনা' শীর্ষক এ আলোচনায় আবাসন খাতের বিদ্যমান সমস্যা, সম্ভাবনা, সরকারের উদাসীনতা, রাজউকের ব্যর্থতা-দুর্নীতি প্রভৃতি বিষয় খোলামেলাভাবে উঠে আসে। অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমান। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। অনুষ্ঠানে
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আবাসন ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, 'আবাসন ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে দোষারোপ করার একটি বদভ্যাস আছে কারও কারও। অথচ এই মানুষগুলো কাজ না করলে আজ ঢাকার মানুষের মাথা গোঁজার জায়গা থাকত না। তবে এই শিল্পে কিছু আবর্জনাও আছে। সামান্য জমি কিনে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি জমি বিক্রি করে ফেলে কেউ কেউ। তাদের কারণে পুরো আবাসন শিল্পের দুর্নাম হচ্ছে। এ ব্যাপারে আবাসন ব্যবসায়ীদের সচেতন হতে হবে।'
আবাসন ব্যবসায়ী আবদুস সামাদ বলেন, বেসরকারি আবাসন শিল্প খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান ২১ শতাংশ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতে দুই কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ৩০০টি শিল্প উপখাত এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বেসরকারি ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা ২০০৪-এর কারণে এই খাত আজ বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন। এই বিধিমালার কতিপয় অযৌক্তিক ধারা সম্ভাবনাময় আবাসন শিল্প বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিধিমালা কার্যকর হওয়ার আগে অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় থাকা সব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ার জন্য তিনি রাজউকের প্রতি আহ্বান জানান।
বিএলডিএর অন্যতম সদস্য এম জি আর নাসির বলেন, সম্পত্তি হস্তান্তর ও নিবন্ধন খরচ যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। নানা রকম ভ্যাট, উৎসে কর ইত্যাদি বসিয়ে ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এই খরচ সাধারণ ক্রেতাদের ওপর গিয়েই পড়ছে। অথচ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান_এগুলো মানুষের মৌলিক চাহিদার অংশ। রাজউক নিজে আবাসন ব্যবসায় জড়িয়ে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে। এটা অনৈতিক। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানান তিনি।
যমুনা গ্রুপের পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. মো. আলমগীর আলম বলেন, রাজউক ১৮ বছর আগে টাকা নিয়ে পূর্বাচল এলাকায় প্লট দিতে চেয়েছিল; আজ পর্যন্ত দিতে পারেনি। অথচ কোনো বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এ রকম নজির নেই। আজ যাঁরা পরিবেশ নিয়ে কথা বলছেন, তাঁদের কেউই পরিবেশবিদ বা পরিবেশবিজ্ঞানী নন। তাঁরা বিদেশি কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করছেন। ড্যাপ এখনো চূড়ান্ত না হলেও ড্যাপকেই মাস্টারপ্ল্যান ধরে বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। নানা হাউজিং প্রকল্প বন্ধ করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলোও সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য আবাসন ব্যবসায়ীদের ভূমিদস্যু বলছে। তাদেরও বুঝতে হবে, সাধারণ মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য কিন্তু বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে।
আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ড. সৈয়দ বেলায়েত হোসেন বলেন, নগরীতে ভূমিকম্প, জলাবদ্ধতা হলেই দোষ দেওয়া হয় আবাসন ব্যবসায়ীদের। কিন্তু একটা শহরের জন্য কী পরিমাণ ড্রেন-খাল রাখা দরকার, সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না। আজ গার্মেন্ট সেক্টরে বা শেয়ারবাজারে ধস নামলেই তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা উঠছে। কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীরা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন, সেদিকে সরকারের নজর নেই।
শতাব্দী হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহুল ইসলাম নান্নু বলেন, 'আবাসন খাতকে সরকারি-বেসরকারি হিসেবে চিহ্নিত না করে আবাসন শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। রাজউক এ পর্যন্ত যেসব প্রকল্প করেছে, কোনোটিতেই সময়মতো প্লট দিতে পারেনি। আর সব দোষ গিয়ে পড়ছে আমাদের ওপর।' তিনি ড্যাপের ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধানে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফোরামের সভাপতি প্রকৌশলী সরদার আমিন বলেন, 'এত দিনে রাজউকের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একজন গিয়ে নতুন লোক আসছেন। তাঁরা ঘুষ খেয়ে মোটা হয়ে চলে যাচ্ছেন। রাজউক চেয়ারম্যানকে বললে তিনি বলেন, আপনারা ঘুষ দেওয়া বন্ধ করেন। আমি বলি, আপনাদের লোকদের ঘুষ নেওয়া বন্ধ করেন। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি। ব্যবসা না করে ঘুষের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নামার সময় তো আমাদের নেই।' ড্যাপের সমালোচনা করে তিনি বলেন, যাঁরা আবাসন খাত নিয়ে আইন করেন, তাঁরা এমন লোক যাঁদের এই আইন করার মতো যোগ্যতা নেই। যে কারণে বাস্তবতাবর্জিত একটি ড্যাপ হয়েছে। এ রকম জনবিরোধী ড্যাপ হলে সেটা কখনোই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিভাগের অধ্যাপক ড. রেজোয়ান হোসেন ভুঁইয়া বলেন, 'ড্যাপ প্রণয়নে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। সেখানে আমার প্রস্তাব ছিল, ২০ বছর আগের উপাত্তকে নিয়ে ড্যাপ প্রণয়ন করলে সেটা হবে অবাস্তব। বর্তমান অবকাঠামো আমলে রেখেই ড্যাপ প্রণয়ন করা হোক।'
বিশ্বাস বিল্ডার্সের পরিচালক মেজর (অব.) দেলোয়ার হোসেন বলেন, একবারে ১০০ বিঘা জমি সরকারের পক্ষে কেনা সম্ভব। কিন্তু বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ৫-১০ বিঘা জমি দিয়েই প্রকল্প শুরু করতে হয়। আর সেটা করলেই সরকারের রোষানলে পড়তে হয়।
পূর্বাচল ইস্ট ওয়েস্ট সিটির চেয়ারম্যান মো. কামালউদ্দিন বলেন, সিঙ্গাপুরে প্রত্যেকের বেতন থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ কেটে রেখে সরকার তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। অথচ বাংলাদেশ সরকারের এদিকে কোনো খেয়ালই নেই। প্রতিদিন বাসাভাড়া বাড়ছে। তার পরও সরকার আবাসন খাতকে টুঁটি চেপে ধরতে তৎপর। আজ আবাসন ব্যবসায়ীরা না থাকলে ঢাকা শহরে অনেক লোককে রাস্তায় ঘুমাতে হতো।
পূর্বাচল রিজেন্ট টাউনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসান মিয়া বলেন, আজ বারিধারায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাট ৪০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। আবাসন কম্পানি খারাপ কাজ করলে জনগণ এত টাকা দিয়ে সেটা কিনত না।
আবাসন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বলেন, রাজউকের লোকজন কেবল তাদের ভাগ্য পরিবর্তন নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু কিভাবে মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। তাই রাজউক দিয়ে কেবল ওই সংস্থার লোকজনের ভাগ্যের পরিবর্তনই সম্ভব।
বিওসি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার সোহেল বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের পথে বসাতে আজ নানা রকম বিধিমালা হচ্ছে। এগুলোকে বিধিমালা না বলে বন্ধমালা বলাই ভালো। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, 'মানুষের জন্য আইন না আইনের জন্য মানুষ? অযোগ্য লোকদের লাই দিলে যেটা হয়, তাদের কারণেই আজ কোনো প্রকল্প সঠিক পথে এগোচ্ছে না।'
রিজেন্ট গ্রুপের পরিচালক সাজ্জাদ রহমান খান বলেন, 'আজ আবাসন ব্যবসায়ীদের সবাই গালি দেয়। কিন্তু আমরা কি গালি শুনতে এ ব্যবসায় এসেছি? আমরা কি মানুষের জন্য কিছুই করিনি?'
স্টেট ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী ফরহাদ ইকবাল বলেন, একটি নকশার অনুমোদন নিতে হলে একেক জায়গায় যেতে হয়। পরিবেশ ও ভূমির ছাড়পত্র কি এক জায়গা থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় না?
অনির্বাণ হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার শেখ মো. শোয়েব উদ্দিন বলেন, 'আমার একটা জায়গাকে প্রথমে ড্যাপে একভাবে দেখানো হলো। অথচ পরে দেখি বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর অনেক চেষ্টা করেও পাইনি।'
ক্যাপিটাল ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিবা খান বলেন, 'আবাসন ব্যবসায়ীদের আজ অনেকেই প্রতারক মনে করে। এই অবস্থা কিভাবে পরিবর্তন করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।'
আলোচনায় আরো অংশ নেন সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার, ফারুক আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে আবাসন খাতের সমস্যা নিরসনের জন্য বিএলডিএর পক্ষ থেকে ১৯ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
No comments