পাহাড়ের কোলে-সবুজ সবুজে মেশা নীল নীলিমায় সাজেক by বিপ্রদাশ বড়ুয়া

সাজেক, সাজেক, সাজেক। এর উপরিভাগ সমতল। একে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাদ বলা যেতে পারে। উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। বড্ড গাছপালাহীন। আছে ছোট গাছ ও ঝোপঝাড়। জুমের ধান তোলা শেষ। জুমের ধান কাটা হয় না, শুধু ধানের ছড়া ভেঙে পিঠের থুরংয়ে (কল্লোং বা ঝুড়ি) করে ঘরে এনে বাকি কাজ করে। উদুখলে চাল বের করে। একসময় এখানে বাঁশ-গাছের গভীর অরণ্য ছিল। এখান থেকে কাসলং নদী বেয়ে


বাঁশ যেত কর্ণফুলী কাগজ কলে। মাঝেমধ্যে পাহাড়ের নিচে অনাথের মতো বাঁশ দেখা যাচ্ছে।১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ সম্পূর্ণ হয়। এর আগে বাঁধের কারণে উদ্বাস্তুদের ছয় হাজার ৩১০টি পরিবারকে এই কাসলং উপত্যকা ও পাহাড়ে ২৯ হাজার ৬৬৫ একর জমি দেওয়া হয়। সেই থেকে শুরু কাসলং সংরক্ষিত বনের বিশাল বিপর্যয়। এখন এখানে গভীর অরণ্য নেই। অথচ এখানকার অধিবাসীরা সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতিনির্ভর। সাজেকের ছাদের মানুষও তাই। জুমের ফসল তাদের জীবন-মরণ। ধান, ধানি লঙ্কা, মারফা (এক ধরনের শসা), ভুট্টা, চিনার (ফুটির মতো ফল), আদা, হলুদ এবং যাবতীয় তরকারি হয় জুমে। জুম হয় এক জমিতে তিন বছরে একবার।
গাড়ি থেকে নেমে মুক্ত আকাশের নিচে বসার জন্য মাচার মতো পাতা তক্তায় বসলাম। পথের শক্ত ধকল গেছে সারা শরীরে। আবার দাঁড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করে শরীরের খাঁচাটা ঠিক করলাম। আড়মোড় ভাঙা, ঝাঁকুনি দিয়ে জুত করা, নিজের কোমরে নিজে দু-দশটা কিল ঘুষি, ধুলো-ধোঁয়াহীন বিশুদ্ধ বায়ু সেবন_শরীরকে কত তোষামোদ যে এ রকম সময় ভেট দিয়ে দুরস্ত করা দরকার হয়। আমার চার সঙ্গীই যুবক, ওদের আর কি!
সাজেক ছাদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সব পাহাড় উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। এখান থেকে টেকনাফ, আগরতলা, মিজোরাম, আরাকান, বার্মা, জাভা, সুমাত্রা হয়ে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এই ধারা। এর উপরিতল মাঝেমধ্যে একটু উঁচু হলেও মোটামুটি সমতল। দুই পাশের
কিনারায় বাড়িঘর, মাঝখানে টানা উঠোন বলা চলে। প্রায় বাড়ির সামনে শুকোচ্ছে টলটলে লাল ধানি লঙ্কা (ক্যাপসিকাম, ফ্রুটেস্চেন্স্)। আর চারদিকে যত দূর চোখ যায় সবুজ সবুজে মেশা পাহাড় মিলেছে নীল নীলিমায়। সবুজ পাহাড়ের ওপর আছে দিনের কুয়াশার সূক্ষ্ম জামদানি। রাতে এই জামদানি হয়ে যাবে পাহাড়িদের হাতে বোনা খাদি কাপড়, সবুজ পাহাড় তাতে ঘন পিনদ্ধ। কুয়াশার বাড়ি দূরে, পাহাড়ের সঙ্গে সুখ সম্ভোগে রত সে। গত রাতে দীঘিনালায় দেবাশীষের বাড়ি ঢেকে গিয়েছিল কার্তিকের সৌন্দর্যের কুয়াশা-ঝরনায়।
বাড়ির পেছনে, সাজেক পাহাড়ের ঊর্ধ্বঢালে আছে কিছু গাছ। বট-অশ্বত্থ-পাকুড় তো সবাই চেনে। দু-চারটি গাছ আমিও চিনি। কিছু কিছু চিনিই না। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সুন্দরবনের অনেক গাছ চেনা আমার আর হয়ে উঠল না। একটা টিলায় উঠলাম, এখান থেকে মোবাইল ফোনে আমার মেয়ে ও বৌয়ের সঙ্গে কথা হলো। কেকা অধিকারী ফোন করলেন। স্বর্গের সঙ্গে দেখা হলো! আড়াই হাজার বছর আগে স্বর্ণের দেবতারা এ রকম পর্বত শীর্ষে দেবলোক ছিল। ভারতবর্ষের হিমালয় ও গ্রিসের অলিম্পাস পর্বতে দেবরাজ ইন্দ্র ও জিউসের সুখ-সমৃদ্ধ রাজত্ব ছিল। মানুষ শেষ পর্যন্ত ওদের জয় করে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন ত্রিপুরি ও পাংখোদের তাড়াতে পারলে একালে আমাদের জয় হবে। আগে এখানে অনেক পাংখো ছিল, এখন আছে ১০-১৫ পরিবার। অদূরে আছে গোনাগুনতিতে কুড়ি পরিবার। এখানে লুসেইরা ছিল ১৯৫১ সালে, এক হাজার ৩৬৯ জন। তাদের বেশির ভাগ সাজেক উপত্যকায় বাস করত। উত্তর সীমান্তে ২০০ বর্গমাইলে ছয়টি মৌজা_বেটলিং, তুইচুই, সিলডাইলুই, কাংলাক্, রুইলুই, লেংকার ছিল এদের।
এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারিত হয় ১৮৯০ সালে ব্যাপ্টিস্ট প্রোটেস্টান্ট এডওয়ার্ড লরেন্সের মাধ্যমে। লুসেই, পাংখোরা প্রথমে ধর্মান্তরিত হয়। সাধারণত প্রতিটি অঞ্চলে বা পাড়ায় গির্জা নির্মিত হয়। সাজেক শীর্ষে একটি গির্জা আছে। পাশে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি প্রাইভেট পাঠকেন্দ্র আছে। বেড়ার প্রাইভেট স্কুলঘরটিতে ২০-২৫ জন বসতে পারে। উঁচু বেঞ্চিতে ২১ জন ছাত্রছাত্রী। একমাত্র শিক্ষিকা ১৮-২০ বছুরে, নাম গণলিকা ত্রিপুরা। শিশুশ্রেণীর এক ছাত্রীর নাম স্বপ্ন বিতি ত্রিপুরা। আমার জাপানি ঐতিহ্যবাহী নোটখাতায় সে নাম লিখে দিয়েছে। রামসুন্দর বসাকের 'বাল্যশিক্ষা' আছে। 'সালমা মাই ফার্স্ট স্পেলিং বুক' আছে। কচিদের ধারাপাত ও অঙ্কশিক্ষা বই আছে। খজবাবু ত্রিপুরা প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্র। ওর 'ইংলিশ ফর টুডে' ও 'আমার বাংলা' বই আছে। প্রতিমালা ত্রিপুরা পঞ্চম শ্রেণী, গণিতা ত্রিপুরা দ্বিতীয় শ্রেণী, চিয়ন্সা ত্রিপুরা শিশুশ্রেণী।
ওদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চারটি ছেলেমেয়ে স্কুলঘরে বই রেখে বাইরে খেলছে। সাড়ে ১২টা, শিক্ষক নেই, ছাত্রছাত্রী নেই। দেখারও কেউ নেই। বেরিয়ে পড়লাম। কার্তিকের কড়া-মিঠে রোদ। হাওয়ার মিষ্টি লেহন। হঠাৎ হঠাৎ আসা পাহাড়ের অচেনা ঝাঁঝালো শীৎকার। খুব আশ্চর্য! বাঘাইহাট ও মাচলংয়ের পর থেকে পাখির ওড়াউড়ি ও ডাক উদ্বেগজনক কম। গির্জার পাশে ও এদিকে তিনটি বট-পাকুড়কে আমার বয়সী মনে করে বাড়াবাড়ি বেশি প্রেম-ভালোবাসা-নেহা জানালাম ছবি তুলে। একটু যেতেই দেখি উঁচু লম্বা গাছের লতায় ঘিয়ে রঙের যৌবন উপচানো ফুল। দুই ত্রিপুুরি যুবকের কাছে জানতে চেয়ে 'চিনি না' উত্তর পেলাম। হাসান লোভীর মতো ছবি তুলছে।
ইসুখা লক্ষ্মী ত্রিপুরার ঘর মাচার ওপর, খুব সাধারণ, এক কামরায়। ঘরের সামনে কাঠ জ্বেলে ধোঁয়া দিচ্ছে মশার জন্য। এখানেও নাছোড়বান্দা মশা! ধোঁয়ায় সুগন্ধ 'রং' গাছ জ্বেলে ধোঁয়া দিচ্ছে। এ গাছ আমি চিনি না। ভেতরে এক বুড়ি। ইসুখার কচি শিশু কাপড়ের দোলনায় ঘুমুচ্ছে। সম্ভবত ওর অল্প বয়সী বাবাই আগুন জ্বেলে রেখেছে, পাখা করছে, যেন আগুনের গরম লাগছে, তাই পাখা।
প্রাচীনকাল থেকে লুসেই, পাংখো, ত্রিপুরি প্রভৃতি জাতিসত্তার মানুষের রোগব্যাধি কম। জেলা গেজিটিয়ারও তাই লিখেছে। এখন একটু তো বেড়েছে। ওদের খাদ্যাভ্যাস ও বনজ ওষুধ, জীবনচর্চা ও প্রকৃতির সানি্নধ্য নীরোগ স্বাস্থ্যের গূঢ় রহস্য। এখন ডাক্তারের দরকার হয়। মাসলং থেকে ডাক্তারের বদলে স্বাস্থ্যকর্মী আসে হ্নায় এক দিন। তাও অনিয়মিত। আরেক বাড়িতে গেলাম। মাচার ওপর দিয়ে ঘরে যেতে হয়। মহিলা চাল ঝাড়ছে। উদুখলে কোটা চাল। হাসান ছবির পর ছবি শিকার করছে। ঘরের বেড়ায় আড়াআড়ি বাঁশ বেঁধে তার ওপর মারফা বসিয়ে রেখেছে। উজ্জ্বল সোনা রঙের। দু-তিন মাস থাকবে। মসল্লা ছাড়া রেঁধে খাবে। বীজ থেকে আগামী বছর গাছ হবে। জুমের সুগন্ধি চাল ৩০ টাকা কিলো। কী মিষ্টি খাবার পানি!
সাজেকের কমলাবাগান পাহাড়ের নিচে, অদূরে। ক্লান্ত শরীরে আর পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ঠেঙাতে পারব না। এখানে ও ওখানে দুটি কমলাগাছে বক্ষ উজাড় করা সবুজ কমলা। বাতাবি, জামির, মিঠালেবু ইদ্যাদি সব ধরনের লেবু এখানে ভালো হয়। ১৯৩০ সালের দিকে এক টাকায় ১০০ কমলা পাওয়া যেত। ১৯৫৭ সালে রাঙামাটিতে আমি টাকায় ১০টা সাজেকের মিষ্টি কমলা খেয়েছি। একটা চড়ুই ডাকল এতক্ষণে। ভূস্বর্গের ছড়ার জল পান করলাম শিশু-কোলের মা থেকে। আহা, মিষ্টি ঠাণ্ডা সুমিষ্ট পানি! অনেক চাকমা ও পাংখো মিজোরামে চলে গেছে স্কুল ও অন্যান্য সুযোগের অভাবে। এখানে ওদের মতে রাস্তা হয় সরকারের সুবিধার জন্য, ওদের ওপর অত্যাচার করার জন্য। ওদের কথা যদি মিথ্যা হতো আমিও বলতে পারতাম, 'সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে...।' ওরাও গাইত, 'আমার দেচ্ছান এদকখানি দোল।' অর্থাৎ আমার দেশটি এত সুন্দর।

No comments

Powered by Blogger.