নির্বাচনী আনন্দবন্যার পললে বিধৌত রাজনীতি by আসিফ কবীর

উৎসবমুখর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাস প্রায় পার হওয়ার পর কয়েকটি প্রতি আলোচ্য এখন আমাদের সামনে। ইলেকট্রিক ভোটিং পদ্ধতির ব্যবহার, তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচন নিয়ে মূল্যায়ন, সেনাবাহিনী মোতায়েন না করায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে-পরের বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া, গণমাধ্যমের শক্তিমত্তা অনুভব করা ইত্যাদিই এর মধ্যে প্রধান। ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন। এই পদ্ধতিতে ভোটারদের অভ্যস্ত

হতে পারা, গৃহীত ভোটের সঠিক গণনা, সব ভোটকে এ পদ্ধতির আওতায় আনার সম্ভবপরতার প্রশ্নগুলো এ প্রসঙ্গে আলোচিত। নারায়ণগঞ্জে এ পদ্ধতির সফল প্রয়োগ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জেনেছি। ক্রমান্বয়ে এ পদ্ধতির প্রয়োগ বাড়বে। ইতিমধ্যে নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সব কেন্দ্রকে ই-ভোটিংয়ের আওতায় আনা হবে বলে ইসি জানিয়েছে। গণমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই আলোচিত ই-ভোটিং মেশিনের উদ্ভাবকদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আশ্বস্ত করেছে ভোট গণনায় হেরফেরের সুযোগ বা ঝুঁকি কেন নেই এ মেশিনে। সেখানে উদ্ভাবকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইভি মেশিনগুলো ভোট শুরুর আগে পরীক্ষা সাপেক্ষে সচল করার পর মাঝপথে বন্ধ বা ত্রুটি দেখা দেওয়ার সুযোগ নেই। যন্ত্রটি খুলে ফেলে অনাহূত হস্তক্ষেপে ত্রুটি তৈরি না করলে ভুল গণনার ঝুঁকি একেবারে নেই বলেই তাঁরা নিশ্চিত করেছেন। ধীরগতির ভোটারদের এ যন্ত্রে ভোটদানে দুই মিনিটের অধিক লাগার কথা নয়, (পত্রিকার খবরে জানা গেছে) লাগেওনি। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা 'ব্রতী'র সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায়, তাদের জরিপের আওতায় ৭০০ ভোটারের ৮৫ শতাংশ কাগুজে ব্যালটের চেয়ে ইভিএমকে ভালো মনে করেছেন। ৮২ শতাংশ এ যন্ত্রকে নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।
প্রযুক্তির অভাবে জীবনের পুরনো কোনো ছন্দপতন বা অপ্রিয় অভিজ্ঞতা থাকলে বহুদিন পরে বিজ্ঞান সেই ঘাটতি পূরণ করলে সে কথাটি মনে পড়েই। ২০০১ সালের নির্বাচনে (তৎকালীন) চট্টগ্রাম-১৪ আসনে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীর কাছে কর্নেল (অব.) অলি আহমদ হেরে গিয়েছিলেন। পরে জানা যায়, জামায়াতকর্মীরা ভোটদানকে অযথা বিলম্বিত করে কর্নেলের ভোটারদের নির্ধারিত সময়ের (সকাল ৮টা থেকে ৪টা) মধ্যে ভোট দিতে দেয়নি। পরিকল্পিতভাবে দেরি করে লাইনে জট ফেলে এ কাজটি করে তারা। দ্রুত ও সময়সাশ্রয়ী বলে ইভিএম পদ্ধতি বিলম্ব করানোর কৌশলকে চিরতরে প্রতিহত করবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে বুঝে নিতে হবে তাদের অধীনে নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় আসবে নির্ঘাত, তা কিন্তু নয়। জনমতকে পক্ষে রাখতে ও টানতে না পারলে পুনর্বার ক্ষমতাসীন হওয়া যাবে না। বিরোধী দল বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বয়কট বা বাইরে থেকে গেলে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে তাও না। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী মোতায়েন না থাকা সত্ত্বেও সুষ্ঠু হয়েছে ও বাধ্য হয়ে দেওয়া তাঁর মধ্যরাতের ঘোষণাকে তিনি নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর বলে সাংবাদিকদের বলেছেন। এ থেকে সরকারি দলের শাসনকাজে আরো সাফল্য দেখানো এবং বিরোধী দলের নির্বাচনমুখী রাজনীতিতে ব্রতী হওয়া উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে বা নির্বাচনের বাইরে থেকে যথাক্রমে সরকারি ও বিরোধী দলের মোলায়েম পথে কোনো অর্জন হাতে আসবে না। জনগণকে আরো স্বস্তিদায়ক পরিবেশ, দেশকে দূরদর্শিতার সঙ্গে সমৃদ্ধ ও বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল ভাবমূর্তিসম্পন্ন এবং দলীয় সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলার নিবেদিত চেষ্টা করতে হবে মহাজোট সরকারকে। অন্যদিকে বিরোধী দলের জন্য ক্ষমতায় এলে দেশ-জনগণকে আরো ভালো মর্যাদা ও জীবনমান দেওয়ার জন্য তাদের বিশ্বাসযোগ্য প্রস্তুতির কথা মানুষকে জানতে হবে। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলের ব্যর্থতার জের টেনে যাওয়ায় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি গ্রহণযোগ্য করা দুরূহ। এদিকটায় তাদের অগ্রাধিকারে মনোনিবেশ করা জরুরি। বরং প্রধান ইস্যু নির্বাচন বয়কট হলে তারা লাভবান হবে না, এটা নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের টিভি, পত্রিকার বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রকাশমান হয়েছে।
এনসিসি নির্বাচনে কয়েকটি বিষয় সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে ঘটে গেছে। শত শত জোড়া চোখের সতর্ক-সচেতন-সচকিত পাহারায় নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর সুযোগ আজ লুপ্তপ্রায়। ইলেকশন কমিশন নিজেদের সুনাম-সাফল্যের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট। এ ক্ষেত্রে সচেতন ব্যক্তি হিসেবে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে নিজেদের দেদীপ্যমান স্থানলাভের ব্যাপারে কমিশনারদের আচরণও প্রাসঙ্গিক। আত্মসচেতন ব্যক্তিমাত্রই তার হাতে বা সময়কালে ভালো কাজ করার ওপর জোর দেন। ভবিষ্যতেও কমিশন পুনর্গঠনে নিজের সুনাম-সম্মান নিয়ে যত্নবান ব্যক্তিদের নিয়োগদান নিশ্চিত করা গেলে প্রাতিষ্ঠানিকতার উৎকর্ষে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অনিবার্যই আরো অগ্রগামী হবে। এ নির্বাচনে বিকল্প রাজনৈতিক ধারার ধারণার সম্ভাবনা নিয়ে কথা উঠেছে। অনেকে এ থেকে প্রণোদনা লাভ করেছেন। কমিউনিস্ট রাজনীতিকরা কেউ কেউ ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর জয়লাভ থেকে শিক্ষণীয় দিকগুলো খুঁজতে অনুজআত্মজদের পরামর্শ দিয়েছেন, যদিও বাস্তবতার বিচারে স্থানীয় রাজনীতি দিয়ে ১৫ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পুরোটার গতিধারা বোঝা যায় না। একদার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটখ্যাত বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সেবা দাবির আন্দোলনের (২০০৫) নেতা গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী করার কথা পত্রিকান্তরে এসে এসেও হয়ে ওঠেনি। আজ দেশের মানুষ এই আলোচিত ব্যক্তিকে যথারীতি ভুলেও গেছেন। তাই এসব অনুমান বা স্বপ্নবাস না করে জাতীয় রাজনীতি ও জনসমর্থনপুষ্ট দলগুলোর দুর্বলতার গঠনমূলক সমালোচনাকেই আমাদের করণীয় হিসেবে দেখা ভালো।
গণমাধ্যমের শক্তিমানতা আমরা এ নির্বাচনে প্রত্যক্ষ করলাম। তাদের প্রাক-মূল্যায়ন ও জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর যথার্থতার প্রমাণ হাতেনাতে আমরা পেলাম। আমরা প্রধান আলোচিত তিন প্রার্থীকে নিয়ে যে সংবাদ, কার্টুন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় পাঠ করেছি তাতে মূলকথা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ ব্যক্তিদের রাজনীতির সামনের সারি থেকে সরিয়ে নিতে প্রধান দলগুলোকে সম্মত করানোর। গণমাধ্যমের এ চাওয়াকে তীব্রতর করতে প্রাপ্যর চেয়ে অনেক গুরুত্ব ও মনোযোগও নেতিবাচকভাবে হলেও প্রার্থীরা পেয়েছেন। সবশেষে একটি অনুমাননির্ভর প্রশ্নে আলোকপাত করি। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শামীম ওসমান বা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়ে ডা. আইভী জয়লাভ করলে কী বলা হতো? শামীম ওসমান হয়তো অত জনপ্রিয় নন বলেই পরাজিত হয়েছেন। এ কথা ঠিক। কিন্তু বাস্তবের বিজয়ী প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে ভোটের যোগফলে তিনিই (শামীম) জিততেন। আর শামীম দলীয় সমর্থন না পেয়ে সরকারদলীয় প্রার্থী হয়ে আরো বেশি ভোটে ডা. আইভী জয়ী হলেই বা কী বলা হতো বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। আমার এক অতি পরিচিত নিরীহ, মিশুক ও আমোদপ্রিয় বন্ধু আছেন। তাঁকে তাঁর চারপাশের মানুষ সারল্যের সুবাদে বেশি বেশি কথা শোনান, অকারণ দোষারোপ করেন। এতে মজা করে তিনি বলেন, 'এরপর শুনব আমার দোষ আমার জন্মতারিখ ২৩ জানুয়ারি।' আমি বলি, 'এমনও তো বলতে পারে তোমার বাড়ি ওমুকখানে।' তিনি বলেন, 'জন্মস্থান বা স্থায়ী নিবাসের কারণেও মানুষের চরিত্র ভালো-মন্দ হয়। ব্যক্তির জন্মের দিনক্ষণই সবচেয়ে নির্দোষ অপরাধ।'
সমালোচনার হালচাল প্রসঙ্গে মনে পড়ল, তিস্তার পানি চুক্তি প্রত্যাশা অনুযায়ী সময়ে হলো না, এ নিয়ে এন্তার সমালোচনা আমরা শুনেছি। যদি হয়ে যেত তবে কি সবাই একযোগে প্রশংসা করত? গঙ্গার পানি চুক্তির (১৯৯৬) সময়ে অন্তত করেনি বলে মনে আছে। এ ক্ষেত্রেও যে কতটা করত তা রাজনীতির খবর যাঁরা রাখেন ঠিকঠাক, তাঁরা ভালোই অনুমান করতে পারেন। গঠনমূলক বিশ্লেষণ যখন অনুপস্থিত, সে ক্ষেত্রে সমালোচকদের দায়িত্বশীল ও যুক্তিবাদিতায় অভ্যস্ত করে তোলার দায়িত্বও বহুলাংশে গণমাধ্যমের।
লেখক : সাংবাদিক