কোনও নদী দেখিনি, দেখিনি জোনাকপোকা by মাহবুব মিঠু
গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর সিডিতে গান বাজছিল, ‘তুমি যদি চাও মেঘে মেঘে আকাশটা সাজিয়ে দেব’। অসম্ভব ভাললাগা একটা গান। নতুন প্রজন্মের শিল্পী আরেফীন রুমীর গাওয়া। পাশের সিটে আমার ভাগ্নি বসা।বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের উপরে ব্যাচেলর করছে। পিছনে আমার একমাত্র মেয়ে (যদিও ওর দাবি ও আমার ‘বিগ মা’) বেবি সিটে বসে আছে। কয়েকটি আধুনিক গানের পরে কিছু বাঙলা ফোক গানের রিমিক্স, কিছুটা ফিউশন বলা যেতে পারে হয়তো। ‘বলে দেনা প্রাণ সখি’ আমার খুবই পছন্দের একটা ফোক গান।
ভাগ্নিকে গানটা কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করতেই অবাক করা উত্তর পেলাম। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে আমাদের মাটির গান সেই পল্লী গীতি, ভাটিয়ালী কিংবা জারী সারী আর ভাল লাগে না। এটা শুধু আমার ভাগ্নির কথা তা নয়। আমি এর আগেও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি এ রকমই।
বড় ভাবনার বিষয়। বদলে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে মাটি আর মানুষের মধ্যে। নাকি এটাই স্বাভাবিক কে জানে! মনে পড়ে, ৬/৭ বছর আগে ঢাকার এ্যালিফ্যান্ট রোডের (যদিও পরে জেনেছিলাম রাস্তার নামটি ভিন্ন, ভুল নামে চিনি) গীতালী থেকে সেই ৫০, ৬০ দশকের কিছু বাংলা গান রেকর্ড করিয়েছিলাম সেকালের বাংলা গানগুলো কেমন ছিল জানার জন্য। আমারও কিন্তু খুব একটা ভাল লাগেনি। গানগুলো অত্যন্ত ধীর তালের, কথাগুলো বদলে যাওয়া আমাদের পরিবেশ, আমাদের স্বপ্ন কিংবা আমাদের যন্ত্রণার সাথে খাপ খায় না ততোটা। যদি আমি এবং আমার ভাগ্নি ও ওদের প্রজন্মকে প্রতিস্থাপন করে ওদের জায়গায় আমাকে এবং আমার স্থানে আমার পিতামহের জমানার কাউকে আনতে পারতাম তবে তাদের কন্ঠেও একই আক্ষেপের সুর পেতাম হয়তোবা!
আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ে অনড় নই। সংস্কৃতি একটা পরিবর্তনশীল স্রোতধারা সেটা ঠিক আছে। সেই হিসেবে নতুন প্রজন্মের পরিবেশ, সমস্যা, স্বপ্ন এবং যন্ত্রণার ভিন্নতার কারণে গানের স্বাদ ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু সব পরিবর্তনই কি সংস্কৃতি? তাহলে অপসংস্কৃতি কোনটা? আর এগুলো সংজ্ঞায়িত করার দায়িত্বটাই বা কার? এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্নে না গিয়েও কিছু বিষয় ভাল কি মন্দ সেটা বোঝা কিংবা সমালোচনার ক্ষমতাটা অন্তত্: আমজনতার আছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গ্রাম বিমুখতা তাদের একটা নিজস্ব শহুরে ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যে সংস্কৃতি গানের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন উপায়ে তাদের একেবারে নিজস্ব কথা বলে। এই ভিন্নতার জন্য শহুরে নতুন প্রজন্মকে কোনভাবেই দায়ী করা চলে না। এর জন্য গ্রাম এবং শহরের মধ্যে মানুষের আসা যাওয়ার যে ঘাটতিটা ঘটেছে মূলতঃ সেটাই দায়ী। এক সময় ঈদ-পার্বন কিংবা বছরের স্কুল ছুটির সময়ে শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে যাবার প্রবণতা ছিল। কিন্তু জীবন যুদ্ধে লড়তে গিয়ে এবং বেহাল সড়ক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, তীব্র যানজটের কবলে পড়ে বাড়ির পাশের আরশী নগরও হয়ে পড়েছে দিল্লির চেয়েও অনেক অনেক বেশি দূর। এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চড়লে মাত্র কয়েক ঘন্টায় দিল্লী যাওয়া যাবে, একটু দূর ব্যাংককেও যাওয়া খুব একটা ব্যপার না। কিন্তু ঢাকা থেকে আমার জেলা গোপালগঞ্জ যেতে ঈদের সময়ে কমসে কম ১০/১২ ঘন্টাতো মামুলী ব্যাপার।
নিরবে বা সরবে হোক আরেকটি বিভ্রান্তিকর এবং উদ্ভট (হয়তোবা আমার চিন্তাটাই উদ্ভট) পরিবর্তন ঘটে চলেছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশের ভিতরে। শহর কিংবা গ্রাম বলতে কথা নয়। ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইটের সঠিক ও ন্যায় সঙ্গত ব্যবহারের অভাবে এই পরিবর্তনটা একটা আগ্রাসী রূপ ধারণ করতে চলেছে। সেদিন বন্ধুর ফেসবুকে দেখলাম একটা মেয়ে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে স্টেডিয়ামে পশ্চিমা স্টাইলে নাচছে। ইউটিউবে এই ভিডিওর ক্যাপশন করা হয়েছে ‘ইনসেন ফিমেল ফ্যান অব মেসি’। কথাটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত থাকতে পারে। আমি নৃত্যটা ভাল বা মন্দ ছিল কিনা সেই মতামতে যাব না। কিন্তু শরীর দুলিয়ে যেভাবে সে নেচেছিল তা কি আমাদের সংস্কৃতির সংগে যায়? মেয়েটির নাচের চেয়ে ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকা দর্শক আর পুলিশের দৃশ্যটা বেশ মনোরম! ঐ মুহুর্তে মেসির চেয়ে হয়তো ঐ মেয়েটা এদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। নাচ এবং দর্শক পুলিশের এই ন্যাকামো দুটোই প্রমাণ করে আমাদের দীনতা কোন পর্যায়ে নেমেছে। মেসি অনেক অনেক ভাল খেলোয়াড় সে কথা ঠিক আছে। তার প্রতি একটু বাড়তি আগ্রহ সেটাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে তার আগমনে সব ভুলে নিজেকে ভাঁড়ের মতো তুলে ধরা কিছুতেই সঙ্গত নয়। একটা জিনিস আমরা পরিষ্কার করেছি সেটা হলো, মেসির প্রতি আমাদের ভালবাসা খাঁটি নয়। আমাদের সম্পর্কে যে একটু ‘হুজুগে বাঙালি’র তকমা আছে সেটাই হয়তো সত্যি। তা না হলে যে মেসির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে গাঁটের টাকা খরচ করে টিকেট কিনে স্টেডিয়ামে আসা সেখানে অখ্যাত এক মেয়ের নাচেই বাঙালি কাবু!
ঘটনা দুই, সেটাও এই ঢাকা স্টেডিয়াম। বেশ কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের ক্রিকেট চলাকালে সময়ে স্টেডিয়ামে জনৈক মেয়ে ‘মেরি মি, আফ্রিদী’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছিল। কি উদ্ভট দৃশ্য! কি অশোভন আবেদন! এটাও কি তবে আমাদের সংস্কৃতি?
আরেকটি উদ্বেগের কথা বলতে হয়। ফোনে কথা হচ্ছিল এক বন্ধুর সঙ্গে। সে প্রায় আতংকিত হয়ে বলেছিল, কথাগুলো। দেশে টিভিতে নাকি স্যাটেলাইট কোন চ্যানেলে হিন্দি একটা কার্টুন দেখানো হয়। তা দেখে দেখে বাচ্চারা নাকি বাংলা ভুলতে বসেছে। ভারতে আমাদের চ্যানেল প্রবেশে কঠোরতা থাকলেও আমরা কেন তাদের ব্যাপারে এতোটা উদার সেটা ভাবনার বিষয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানাটা জরুরি। কিন্তু কোন যুক্তিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দি শিখছে সেটা বোধগম্য নয়।
ফেসবুকে ঢুঁ মারলে দেখা যায়, হিন্দি, বাংলা, ইংরেজির সংমিশ্রনে কি অদ্ভুত একটা ভাষা তৈরি হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ঘটা করে সেটা পালনও হয়। অবশ্য ভাষার জন্য যে দিবস ইংরেজি দিনটা উল্লেখ করে দিবসটা নিজের দোষে দুষ্ট। সে সময়কার বাংলা তারিখ ৮ই ফাল্গুন হিসেবে প্রতিবছর বাংলা তারিখের সাথে মিল রেখে করলে ক্ষতি কি ছিল?
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এই ধারণাকে অপব্যবহার করে যারা সব কিছুকে গ্রহণ করতে চায়, আমি বলবো সেটা তাদের চিন্তার দীনতা। আমার গীতালীর পুরানো দিনের গান ভাল না লাগা কিংবা নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে ফোক গান ততোটা পছন্দ না হওয়ার সাথে কেউ যদি স্টেডিয়ামে মেয়েটির বেমানান নৃত্য কিংবা মেরি মি আফ্রিদী আহবানকে গুলিয়ে ফেলেন তবে সেটা হবে চরম বিপর্যয়। সংস্কৃতির সতত প্রবাহ এবং বিচ্ছিন্ন ধারার মধ্যে একটা ব্যাপক পার্থক্য আছে। নিজেরটাকে ঘষেমেজে কিংবা ভিন্নরূপে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা আর অন্যেরটা হুবহু নকল করা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এ রকম অসংখ্য অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যাবে যা থেকে উন্মাদনার নামে আমাদের দীনতাই প্রকাশ পায়।
তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা থেকে সৃষ্টি কিছু বেমানান উপস্থাপনার জন্য তাদের দায়ী না করে রাষ্ট্র এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের এর পিছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে। শহর এবং গ্রামের মাঝে তৈরি করা বিভাজনের দেয়ালটা সরিয়ে ফেলতে হবে। শহরমুখি মানুষের ঢল কমানোর জন্য উন্নয়নের কিছুটা স্বাদ গ্রামের মানুষকেও দেওয়া চাই।
‘উজান গাঙের নাইয়া’ গানের মাধুর্য এবং সুন্দরকে ছুঁতে হলে তাকে উজান গাঙে যেতে হবে। ডিঙি নৌকায় চড়ে নদীর সাথে কথা বলতে হবে। এর কুলুকুলু আওয়াজ কান পেতে শুনতে হবে। শহরের মানুষ তাদের অন্নদানকারী কৃষকের কথা ভুলে গেলেও নদী, মাঠ প্রকৃতি তাদের ভোলেনি। তাই সেখানে কান পাতলেই শোনা যায় গ্রামের সেই গরীব মানুষের কথা। শহুরে মানুষদের গ্রামে যেতে হবে, গ্রামের মানুষদের কথা শুনতে হবে মন দিয়ে। তাহলেই বোঝা যাবে আমাদের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গানের ভিতরগত সৌন্দর্য। আমি নতুন শহুরে প্রজন্মের অনেকের চোখে তাকিয়ে শুধু ঢাকার ব্যস্ততা, বড় বড় দালান দেখতে পেয়েছি। কোনও নদী দেখিনি, দেখিনি কোনও জোনাকপোকা।
mahalom72@yahoo.com
বড় ভাবনার বিষয়। বদলে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি। দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে মাটি আর মানুষের মধ্যে। নাকি এটাই স্বাভাবিক কে জানে! মনে পড়ে, ৬/৭ বছর আগে ঢাকার এ্যালিফ্যান্ট রোডের (যদিও পরে জেনেছিলাম রাস্তার নামটি ভিন্ন, ভুল নামে চিনি) গীতালী থেকে সেই ৫০, ৬০ দশকের কিছু বাংলা গান রেকর্ড করিয়েছিলাম সেকালের বাংলা গানগুলো কেমন ছিল জানার জন্য। আমারও কিন্তু খুব একটা ভাল লাগেনি। গানগুলো অত্যন্ত ধীর তালের, কথাগুলো বদলে যাওয়া আমাদের পরিবেশ, আমাদের স্বপ্ন কিংবা আমাদের যন্ত্রণার সাথে খাপ খায় না ততোটা। যদি আমি এবং আমার ভাগ্নি ও ওদের প্রজন্মকে প্রতিস্থাপন করে ওদের জায়গায় আমাকে এবং আমার স্থানে আমার পিতামহের জমানার কাউকে আনতে পারতাম তবে তাদের কন্ঠেও একই আক্ষেপের সুর পেতাম হয়তোবা!
আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ে অনড় নই। সংস্কৃতি একটা পরিবর্তনশীল স্রোতধারা সেটা ঠিক আছে। সেই হিসেবে নতুন প্রজন্মের পরিবেশ, সমস্যা, স্বপ্ন এবং যন্ত্রণার ভিন্নতার কারণে গানের স্বাদ ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু সব পরিবর্তনই কি সংস্কৃতি? তাহলে অপসংস্কৃতি কোনটা? আর এগুলো সংজ্ঞায়িত করার দায়িত্বটাই বা কার? এইসব তাত্ত্বিক প্রশ্নে না গিয়েও কিছু বিষয় ভাল কি মন্দ সেটা বোঝা কিংবা সমালোচনার ক্ষমতাটা অন্তত্: আমজনতার আছে।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গ্রাম বিমুখতা তাদের একটা নিজস্ব শহুরে ভিন্ন সংস্কৃতি গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যে সংস্কৃতি গানের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন উপায়ে তাদের একেবারে নিজস্ব কথা বলে। এই ভিন্নতার জন্য শহুরে নতুন প্রজন্মকে কোনভাবেই দায়ী করা চলে না। এর জন্য গ্রাম এবং শহরের মধ্যে মানুষের আসা যাওয়ার যে ঘাটতিটা ঘটেছে মূলতঃ সেটাই দায়ী। এক সময় ঈদ-পার্বন কিংবা বছরের স্কুল ছুটির সময়ে শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে যাবার প্রবণতা ছিল। কিন্তু জীবন যুদ্ধে লড়তে গিয়ে এবং বেহাল সড়ক, যোগাযোগ ব্যবস্থা, তীব্র যানজটের কবলে পড়ে বাড়ির পাশের আরশী নগরও হয়ে পড়েছে দিল্লির চেয়েও অনেক অনেক বেশি দূর। এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চড়লে মাত্র কয়েক ঘন্টায় দিল্লী যাওয়া যাবে, একটু দূর ব্যাংককেও যাওয়া খুব একটা ব্যপার না। কিন্তু ঢাকা থেকে আমার জেলা গোপালগঞ্জ যেতে ঈদের সময়ে কমসে কম ১০/১২ ঘন্টাতো মামুলী ব্যাপার।
নিরবে বা সরবে হোক আরেকটি বিভ্রান্তিকর এবং উদ্ভট (হয়তোবা আমার চিন্তাটাই উদ্ভট) পরিবর্তন ঘটে চলেছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশের ভিতরে। শহর কিংবা গ্রাম বলতে কথা নয়। ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইটের সঠিক ও ন্যায় সঙ্গত ব্যবহারের অভাবে এই পরিবর্তনটা একটা আগ্রাসী রূপ ধারণ করতে চলেছে। সেদিন বন্ধুর ফেসবুকে দেখলাম একটা মেয়ে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে স্টেডিয়ামে পশ্চিমা স্টাইলে নাচছে। ইউটিউবে এই ভিডিওর ক্যাপশন করা হয়েছে ‘ইনসেন ফিমেল ফ্যান অব মেসি’। কথাটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক মতামত থাকতে পারে। আমি নৃত্যটা ভাল বা মন্দ ছিল কিনা সেই মতামতে যাব না। কিন্তু শরীর দুলিয়ে যেভাবে সে নেচেছিল তা কি আমাদের সংস্কৃতির সংগে যায়? মেয়েটির নাচের চেয়ে ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকা দর্শক আর পুলিশের দৃশ্যটা বেশ মনোরম! ঐ মুহুর্তে মেসির চেয়ে হয়তো ঐ মেয়েটা এদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। নাচ এবং দর্শক পুলিশের এই ন্যাকামো দুটোই প্রমাণ করে আমাদের দীনতা কোন পর্যায়ে নেমেছে। মেসি অনেক অনেক ভাল খেলোয়াড় সে কথা ঠিক আছে। তার প্রতি একটু বাড়তি আগ্রহ সেটাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে তার আগমনে সব ভুলে নিজেকে ভাঁড়ের মতো তুলে ধরা কিছুতেই সঙ্গত নয়। একটা জিনিস আমরা পরিষ্কার করেছি সেটা হলো, মেসির প্রতি আমাদের ভালবাসা খাঁটি নয়। আমাদের সম্পর্কে যে একটু ‘হুজুগে বাঙালি’র তকমা আছে সেটাই হয়তো সত্যি। তা না হলে যে মেসির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে গাঁটের টাকা খরচ করে টিকেট কিনে স্টেডিয়ামে আসা সেখানে অখ্যাত এক মেয়ের নাচেই বাঙালি কাবু!
ঘটনা দুই, সেটাও এই ঢাকা স্টেডিয়াম। বেশ কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের ক্রিকেট চলাকালে সময়ে স্টেডিয়ামে জনৈক মেয়ে ‘মেরি মি, আফ্রিদী’ লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করছিল। কি উদ্ভট দৃশ্য! কি অশোভন আবেদন! এটাও কি তবে আমাদের সংস্কৃতি?
আরেকটি উদ্বেগের কথা বলতে হয়। ফোনে কথা হচ্ছিল এক বন্ধুর সঙ্গে। সে প্রায় আতংকিত হয়ে বলেছিল, কথাগুলো। দেশে টিভিতে নাকি স্যাটেলাইট কোন চ্যানেলে হিন্দি একটা কার্টুন দেখানো হয়। তা দেখে দেখে বাচ্চারা নাকি বাংলা ভুলতে বসেছে। ভারতে আমাদের চ্যানেল প্রবেশে কঠোরতা থাকলেও আমরা কেন তাদের ব্যাপারে এতোটা উদার সেটা ভাবনার বিষয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানাটা জরুরি। কিন্তু কোন যুক্তিতে আমাদের ছেলেমেয়েরা হিন্দি শিখছে সেটা বোধগম্য নয়।
ফেসবুকে ঢুঁ মারলে দেখা যায়, হিন্দি, বাংলা, ইংরেজির সংমিশ্রনে কি অদ্ভুত একটা ভাষা তৈরি হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ঘটা করে সেটা পালনও হয়। অবশ্য ভাষার জন্য যে দিবস ইংরেজি দিনটা উল্লেখ করে দিবসটা নিজের দোষে দুষ্ট। সে সময়কার বাংলা তারিখ ৮ই ফাল্গুন হিসেবে প্রতিবছর বাংলা তারিখের সাথে মিল রেখে করলে ক্ষতি কি ছিল?
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এই ধারণাকে অপব্যবহার করে যারা সব কিছুকে গ্রহণ করতে চায়, আমি বলবো সেটা তাদের চিন্তার দীনতা। আমার গীতালীর পুরানো দিনের গান ভাল না লাগা কিংবা নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে ফোক গান ততোটা পছন্দ না হওয়ার সাথে কেউ যদি স্টেডিয়ামে মেয়েটির বেমানান নৃত্য কিংবা মেরি মি আফ্রিদী আহবানকে গুলিয়ে ফেলেন তবে সেটা হবে চরম বিপর্যয়। সংস্কৃতির সতত প্রবাহ এবং বিচ্ছিন্ন ধারার মধ্যে একটা ব্যাপক পার্থক্য আছে। নিজেরটাকে ঘষেমেজে কিংবা ভিন্নরূপে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা আর অন্যেরটা হুবহু নকল করা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এ রকম অসংখ্য অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা দেওয়া যাবে যা থেকে উন্মাদনার নামে আমাদের দীনতাই প্রকাশ পায়।
তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা থেকে সৃষ্টি কিছু বেমানান উপস্থাপনার জন্য তাদের দায়ী না করে রাষ্ট্র এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের এর পিছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে। শহর এবং গ্রামের মাঝে তৈরি করা বিভাজনের দেয়ালটা সরিয়ে ফেলতে হবে। শহরমুখি মানুষের ঢল কমানোর জন্য উন্নয়নের কিছুটা স্বাদ গ্রামের মানুষকেও দেওয়া চাই।
‘উজান গাঙের নাইয়া’ গানের মাধুর্য এবং সুন্দরকে ছুঁতে হলে তাকে উজান গাঙে যেতে হবে। ডিঙি নৌকায় চড়ে নদীর সাথে কথা বলতে হবে। এর কুলুকুলু আওয়াজ কান পেতে শুনতে হবে। শহরের মানুষ তাদের অন্নদানকারী কৃষকের কথা ভুলে গেলেও নদী, মাঠ প্রকৃতি তাদের ভোলেনি। তাই সেখানে কান পাতলেই শোনা যায় গ্রামের সেই গরীব মানুষের কথা। শহুরে মানুষদের গ্রামে যেতে হবে, গ্রামের মানুষদের কথা শুনতে হবে মন দিয়ে। তাহলেই বোঝা যাবে আমাদের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি গানের ভিতরগত সৌন্দর্য। আমি নতুন শহুরে প্রজন্মের অনেকের চোখে তাকিয়ে শুধু ঢাকার ব্যস্ততা, বড় বড় দালান দেখতে পেয়েছি। কোনও নদী দেখিনি, দেখিনি কোনও জোনাকপোকা।
mahalom72@yahoo.com
No comments