মমতার 'পেট্রল বোমা' এবং জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা by সুব্রত আচার্য্য
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় রাজনীতিতে 'পেট্রল বোমা' ছুড়েছেন। সেই বোমা বিস্ফোরণ কবে হবে, সেটা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু আপাত বোমা ছোড়ায় দেশটির রাজনীতি বেশ সরগরম অবস্থা বিরাজ করছে সন্দেহ নেই। মঙ্গলবার রাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বশেষ হুমকি, 'পেট্রলের দাম এবার বাড়লেই সমর্থন প্রত্যাহার।' অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের ১৯ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং চারজন মনোনীত সংসদ সদস্য সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারই করবেন।
এঁদের মধ্যে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, যাঁর মন্ত্রণালয় হচ্ছে রেল এবং চারজন প্রতিমন্ত্রীও পদত্যাগ করবেন। ঘটনার সূত্রপাত ৩ নভেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ স্থানীয় টেলিভিশনগুলোতে ব্রেকিং নিউজ 'মাঝ রাত থেকে বাড়ছে পেট্রলের দাম'। এই খবরে সেদিন রাতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস তীব্র প্রতিক্রয়া জানায়। রাতেই কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে তৃণমূল সংসদ সদস্যরা দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে থাকা না থাকার চূড়ান্ত ফর্মুলা নির্ধারণের জন্য সংসদীয় কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকার কথা জানান। ফলে আরো একটি 'ব্রেকিং' নিউজের জন্ম হয় অডিও-ভিজুয়্যাল মিডিয়ায়। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে দ্রুত খবরটি ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির হাঁসফাঁস বন্ধ করেই দেশবাসীর নজর ঘুরে যায় জাতীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে সেটা নিয়ে। বলা ভালো, তৃণমূল কংগ্রেসের বৈঠকের সিদ্ধান্ত কী হচ্ছে সেদিকে। দুটি কারণে বৈঠকটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
এক, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে সরকার গঠন করার পর মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল কি না। দুই, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার এই পরিস্থিতিতে কী করবে। তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে কংগ্রেস কি মুলায়ম সিং কিংবা মায়াবতীর সমর্থন পাবে, নাকি তৃণমূলকে আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে আপাত 'ম্যানেজ' করে নেবে ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার। ৪ নভেম্বর সকালে বাইপাসের ধারে তৃণমূল কংগ্রেসের রেজিস্টার্ড অফিসে সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুকুল রায়ের নেতৃত্বে বৈঠকে 'কংগ্রেসের অবহেলা' প্রতিবাদে সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূলের সংসদীয় দল। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য সরকারের সচিবালয় মহাকরণের দলীয় নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যান এমপিরা। সেখানে প্রায় আধঘণ্টা বৈঠক শেষে সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়ান ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বলতে শুরু করলেন, 'এক বছরে ১১ বার জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ালে বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কমলে কমানো হচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, এসব সিদ্ধান্ত হচ্ছে গভীর রাতে। আমাদের জানানো হচ্চ্েছ না। সরকারে থেকে দায় নেব, কিন্তু সিদ্ধান্ত জানব না_এটা হয় না। আজ তৃণমূলের সংসদীয় দল একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে এসেছে আমার কাছে। তাঁরা আর এই সরকারের থাকতে চান না। আমার সব এমপি এবং মন্ত্রীরা চূড়ান্ত রেজুলেশনও করেছেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাঁকে (প্রধানমন্ত্রী) জানিয়ে নেওয়া উচিত বলে দায়িত্বশীল শরিক হিসেবে আমি মনে করি। তাই ৮ এবং ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ সিদ্ধান্তটি জানানোর কথা বলেছি।'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথা থেকে আর যা-ই হোক এটা পরিষ্কার, সংসদীয় কমিটি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে নৈতিকভাবে সমর্থন প্রত্যাহার করেই নিয়েছে এবং দলীয়ভাবেও কাগজে-কলমে সংসদের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলনেত্রীর কাছে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ওই সিদ্ধান্তটি শুধু ঘোষণা করা হবে মাত্র। সেই ঘোষণা শুনতে দেশবাসী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদীয় কমিটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথাও জানান ড. মনমোহন সিংকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জানিয়ে দেন, সরকারের পক্ষে 'রোল ব্যাক' করা বা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। কারণ জ্বালানি তেলের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে সরকার ভবিষ্যতে বিষয়টি দেখবে বলে আশ্বস্ত করেন ড. সিং।
দেশটির প্রশাসনিক রাজধানী দিলি্লতে যখন এই বৈঠক চলছে, ঠিক তখনই দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের ক্রাইসিস ম্যানেজার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি কলকাতার রাজভবনে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের মধ্যস্থতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের বকেয়া ২১ হাজার কোটি টাকার 'অর্থনৈতিক প্যাকেজ' নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। কো-ইনসিডেন্ট কি না সেটা কেউ বলতে না পারলেও দৃশ্যত দুটিই ছিল 'নিষ্ফলা' বৈঠক। রাজভবন থেকে বাইরে বেরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, 'আর একবার দাম বাড়ালেই কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা হবে।'
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষ করে দিলি্লতে সাংবাদিকদের সামনে প্রায় একই রকম হুঙ্কার দেন তৃণমূল কংগ্রেসের চিফ হুইপ ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং কোনো আশ্বাসের কথাই শোনাতে পারেননি আমাদের।' ৮ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত মমতার এই হুঙ্কার নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো হৈচৈ করেছে। তবে অনেকে এও মনে করেন, এ মুহূর্তে এই হুঙ্কার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দেহ এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে।
প্ুজোর ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় কয়লা সরবরাহই বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গত এক দশকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গকে কয়লা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে নজিরবিহীন লোডশেডিং শুরু হয়েছে রাজ্যে। যদিও পরে কিছু বকেয়া শোধ করায় আপতত কয়লা সরবরাহ শুরু হয়েছে। লোডশেডিং নেই। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনী প্রচারণায় এসে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় সরকার 'আর্থিক প্যাকেজ' দেবে বলে যে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন, সেই প্যাকেজের ২১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সেই টাকা এখনো রাজ্য সরকারের অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে_রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই এ কথা বলে বেড়াচ্ছেন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তৃণমূলের অনড় অবস্থানকেও যখন কংগ্রেস পাত্তা দেয়নি তখনই মমতার মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের এ ধরনের অসহযোগিতার অভিযোগ শোনা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার, এ থেকেই মূলত ক্ষোভ বেড়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের।
কিন্তু জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতাও মেনে নিতেই হবে মমতাকে। তাই রাগ থাকলেও বাস্তবতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়লেই রাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্ক কিছুটা পাল্টে যাবেই। এ মুহূর্তে বামফ্রন্ট একা তৃণমূলের বিরোধিতা করছে। তখন তারাও পাশে পাবে কংগ্রেসকে। ফলে বিরোধীরা শক্তিশালী হবে। আগামী বছরই পঞ্চায়েত নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে। ফলে এখানেও তৃণমূল কংগ্রেসকে কঠিন হিসাব-নিকাশ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
এক, তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে সরকার গঠন করার পর মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করল কি না। দুই, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার এই পরিস্থিতিতে কী করবে। তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করলে কংগ্রেস কি মুলায়ম সিং কিংবা মায়াবতীর সমর্থন পাবে, নাকি তৃণমূলকে আর্থিক প্যাকেজ দিয়ে আপাত 'ম্যানেজ' করে নেবে ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার। ৪ নভেম্বর সকালে বাইপাসের ধারে তৃণমূল কংগ্রেসের রেজিস্টার্ড অফিসে সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুকুল রায়ের নেতৃত্বে বৈঠকে 'কংগ্রেসের অবহেলা' প্রতিবাদে সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূলের সংসদীয় দল। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য সরকারের সচিবালয় মহাকরণের দলীয় নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যান এমপিরা। সেখানে প্রায় আধঘণ্টা বৈঠক শেষে সংসদ সদস্যদের নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়ান ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বলতে শুরু করলেন, 'এক বছরে ১১ বার জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ালে বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু কমলে কমানো হচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, এসব সিদ্ধান্ত হচ্ছে গভীর রাতে। আমাদের জানানো হচ্চ্েছ না। সরকারে থেকে দায় নেব, কিন্তু সিদ্ধান্ত জানব না_এটা হয় না। আজ তৃণমূলের সংসদীয় দল একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে এসেছে আমার কাছে। তাঁরা আর এই সরকারের থাকতে চান না। আমার সব এমপি এবং মন্ত্রীরা চূড়ান্ত রেজুলেশনও করেছেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন এনেছি। এ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন। একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাঁকে (প্রধানমন্ত্রী) জানিয়ে নেওয়া উচিত বলে দায়িত্বশীল শরিক হিসেবে আমি মনে করি। তাই ৮ এবং ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ সিদ্ধান্তটি জানানোর কথা বলেছি।'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কথা থেকে আর যা-ই হোক এটা পরিষ্কার, সংসদীয় কমিটি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে নৈতিকভাবে সমর্থন প্রত্যাহার করেই নিয়েছে এবং দলীয়ভাবেও কাগজে-কলমে সংসদের এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলনেত্রীর কাছে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ওই সিদ্ধান্তটি শুধু ঘোষণা করা হবে মাত্র। সেই ঘোষণা শুনতে দেশবাসী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল। ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদীয় কমিটির সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথাও জানান ড. মনমোহন সিংকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জানিয়ে দেন, সরকারের পক্ষে 'রোল ব্যাক' করা বা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। কারণ জ্বালানি তেলের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে সরকার ভবিষ্যতে বিষয়টি দেখবে বলে আশ্বস্ত করেন ড. সিং।
দেশটির প্রশাসনিক রাজধানী দিলি্লতে যখন এই বৈঠক চলছে, ঠিক তখনই দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের ক্রাইসিস ম্যানেজার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি কলকাতার রাজভবনে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের মধ্যস্থতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্যের বকেয়া ২১ হাজার কোটি টাকার 'অর্থনৈতিক প্যাকেজ' নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। কো-ইনসিডেন্ট কি না সেটা কেউ বলতে না পারলেও দৃশ্যত দুটিই ছিল 'নিষ্ফলা' বৈঠক। রাজভবন থেকে বাইরে বেরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, 'আর একবার দাম বাড়ালেই কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করা হবে।'
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষ করে দিলি্লতে সাংবাদিকদের সামনে প্রায় একই রকম হুঙ্কার দেন তৃণমূল কংগ্রেসের চিফ হুইপ ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং কোনো আশ্বাসের কথাই শোনাতে পারেননি আমাদের।' ৮ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত মমতার এই হুঙ্কার নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো হৈচৈ করেছে। তবে অনেকে এও মনে করেন, এ মুহূর্তে এই হুঙ্কার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দেহ এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে।
প্ুজোর ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় কয়লা সরবরাহই বন্ধ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গত এক দশকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ফলে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গকে কয়লা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে নজিরবিহীন লোডশেডিং শুরু হয়েছে রাজ্যে। যদিও পরে কিছু বকেয়া শোধ করায় আপতত কয়লা সরবরাহ শুরু হয়েছে। লোডশেডিং নেই। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনী প্রচারণায় এসে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় সরকার 'আর্থিক প্যাকেজ' দেবে বলে যে ঘোষণা করে গিয়েছিলেন, সেই প্যাকেজের ২১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও সেই টাকা এখনো রাজ্য সরকারের অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে_রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যেই এ কথা বলে বেড়াচ্ছেন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তৃণমূলের অনড় অবস্থানকেও যখন কংগ্রেস পাত্তা দেয়নি তখনই মমতার মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের এ ধরনের অসহযোগিতার অভিযোগ শোনা যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার, এ থেকেই মূলত ক্ষোভ বেড়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের।
কিন্তু জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতাও মেনে নিতেই হবে মমতাকে। তাই রাগ থাকলেও বাস্তবতার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন্দ্রে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়লেই রাজ্যের রাজনৈতিক অঙ্ক কিছুটা পাল্টে যাবেই। এ মুহূর্তে বামফ্রন্ট একা তৃণমূলের বিরোধিতা করছে। তখন তারাও পাশে পাবে কংগ্রেসকে। ফলে বিরোধীরা শক্তিশালী হবে। আগামী বছরই পঞ্চায়েত নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে। ফলে এখানেও তৃণমূল কংগ্রেসকে কঠিন হিসাব-নিকাশ করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক : কলকাতার সাংবাদিক
No comments