বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-বিষাক্রান্ত মানবদেহ : মনুষ্যসৃষ্ট বিপদ by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত সুখকর সংবাদ বলতে গেলে খুব কম মেলে। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে নানা রকম উদ্বেগজনক সংবাদ দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও নানা দিকে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বিড়ম্বনা এমনিতেই অন্তহীন। এর মধ্যে এসব নেতিবাচক সংবাদ আরো বেশি ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত এমন কিছু সংবাদ জানা গেল, যা পিছিয়ে থাকা কিংবা দারিদ্র্যপীড়িতদের জন্য তো বটেই, দেশের জন্যও অধিকতর দুঃসংবাদ। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই দুঃসংবাদ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাত্রা বহু গুণ বাড়িয়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও শিশুদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত বিষের উপস্থিতি রয়েছে। এর পশ্চাৎকারণ বহুবিধ। বহুলাংশেই মনুষ্যসৃষ্ট কারণে কিংবা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড অথবা অসচেতনতার ফলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুরূহ না হলেও আমাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনাগত নানা ত্রুটি এর বড় প্রতিবন্ধক। ক্ষুদ্র একটি অংশের রক্ত নিয়ে গবেষণা করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে সংগতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, দেহে বিষ বহন করে চলেছে এমন মানুষের সর্বমোট সংখ্যা বাংলাদেশে কত?
আবর্জনা ও ভারী ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করে অর্থাৎ ডাম্পিং পয়েন্ট ও কল-কারখানায় কর্মরত ১৪৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৭৩ জন শিশুর রক্ত নমুনা (স্যাম্পল) হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ওই সংগৃহীত রক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের রক্তে সর্বোচ্চ ৯.৭ এবং উলি্লখিত শিশুদের রক্তে ৫.২ থেকে ১৩.৬ মাইক্রোগ্রাম বিষ রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের উদ্বেগজনক অভিমত হলো, এই বিষ মানুষের সহনীয় মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছে। যেখানে মানবদেহের রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম বিষের উপস্থিতি সহনযোগ্য, সেখানে উলি্লখিত মাত্রা কতটা উচ্চ_এ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। মূলত ভেজাল খাবার ও পানীয় গ্রহণ এবং পরিবেশগত দূষণের কারণে এই হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশদূষণের চিত্র এ দেশে খুব উদ্বেগজনক। এর মধ্যে প্রকৃতির ওপর নির্বিচার অত্যাচার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। যে খাবার জীবনের জন্য অপরিহার্য, সেই খাবার নিয়েই এ দেশে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। ভেজালমিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এ যাবৎ যেসব চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে, এ থেকে মুক্তির পথ তো মেলেইনি; উপরন্তু ক্রমান্বয়ে তা আরো উৎকট রূপ নিচ্ছে। মনে পড়ছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডিএল রায়) সেই বিখ্যাত গানের পঙ্ক্তিটি_'কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।' ডিএল রায়ের গানের এই পঙ্ক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতার অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। ভেজাল খাদ্যদ্রব্যে চারদিক সয়লাব। এই ভেজালের জটাজাল ছিন্নের লক্ষ্যে এ যাবৎ আইনি পদক্ষেপ (অবশ্য বলা যায়, এ সবই গুরু পাপে লঘু দণ্ড) কম নেওয়া হয়নি এবং থেমে থেমে তা অব্যাহতও আছে বটে, কিন্তু ফল কার্যত শূন্য। মনুষ্যসৃষ্ট এই বিপদের কারণে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়লেও ভেজালকারী রাঘববোয়ালরা তাদের তুঘলকি কাণ্ড অব্যাহতই রাখছে এবং মানুষকে বিষাক্রান্ত করে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না।
অন্যদিকে কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল ও রাসায়নিক বস্তুর মিশ্রণে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, এমনকি পশুখাদ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষ গ্রহণ করছে এবং সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকটাই অজান্তেও মানুষ দ্রুত নিজেকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। খ্যাতনামা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় যে ফল মিলেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, রক্তে মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত জৈব যৌগ, যেমন_হেঙ্াক্লোরোবেনজিন, পাইক্লোহেকজিন, ডিডিটি, পলি ক্লোরিনেটেডসহ নানা দ্রব্যের মিশ্রণ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। এসব শুধু স্নায়ু, রক্ত, পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতাই নষ্ট করে দেয় না; মানুষকে পঙ্গু পর্যন্ত করে দিতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আরো অভিমত, রক্তে মিশে থাকা এই বিষক্রিয়া ২০ বছরেও নষ্ট হয় না। তার মানে হচ্ছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিষাক্রান্ত হচ্ছে এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো তা জাল বিস্তার করে চলেছে। কিডনি, ক্যান্সারসহ নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধিও এর ফলেই বাড়ছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের ভাগ্যে এখনো যথাযথ চিকিৎসাসেবা মেলে না। উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বলতে গেলে পুরোপুরি চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অনেকের কাছেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তির বিষয়টি যেন সোনার হরিণ। অথচ এ সেবাপ্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে উন্নত চিকিৎসাসেবা এখন অনেকটা মিললেও সিংহভাগ মানুষের পক্ষে এর দরজা মাড়ানোই সম্ভব নয় প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। পাশাপাশি শ্রেণীবৈষম্য তো আছেই।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে (বলা ভালো অপব্যবহার) প্রায় ৩২৮.৪ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কীটনাশক আমদানির পরিমাণও। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, অবৈধ পথে আসছে আরো প্রায় সমমূল্যের কীটনাশক। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, গুঁড়ো মসলাসহ বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত হারে ক্রোমাটেড, মেটালিন ইয়েলো, টেঙ্টাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে। আরো উদ্বেগজনক তথ্য হলো, মানবদেহের জন্য সাইআরমেথরিন ও ডায়জিননের সহনীয় মাত্রা যেখানে ০.০১ পিপিএম, বাংলাদেশে কোনো কোনো (বিশেষ করে গুঁড়ো মসলায়) ক্ষেত্রে এর মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ০.৭৩ ও ০.১৯ পিপিএম। তা ছাড়া ফলমূল পাকানোসহ তাজা রাখতে ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম কার্বাইড প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে যথেচ্ছভাবে এবং তা অনেকটাই প্রকাশ্যে বলা চলে। মানবদেহ বিষের ভাণ্ডার হয়ে ওঠার এ সবই অন্যতম প্রধান কারণ। জৈব যৌগের প্রায় ৯০ শতাংশ শরীরের চর্বিতে মিশে যাচ্ছে। মানবদেহে বিষক্রিয়ার সমস্যা বলতে গেলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী হলেও বাংলাদেশ কিংবা অন্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের মতো তা এত প্রকট রূপ লাভ করেনি। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর প্রধান সমস্যা সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা এবং পরিকল্পনার অভাব, ব্যবস্থাপনাগত নানা ত্রুটি এবং অর্থনৈতিক অসংগতি। কিন্তু তাই বলে কি এ থেকে আমাদের মুক্তি দুরূহই থাকবে বা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে?
যেহেতু এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বহুলাংশেই মনুষ্যসৃষ্ট, সেহেতু এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মোটেও দুরূহ কোনো বিষয় নয়। প্রথমত, এ ব্যাপারে প্রয়োজন অধিকতর জনসচেতনতা। জনসচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। এর পাশাপাশি দরকার সরকার ও প্রশাসনের যথাযথ আইনি কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। যারা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে, উদর ভরছে, তারা নিঃসন্দেহে জনশত্রু। এ জনশত্রুদের চিহ্নিত করে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে ব্যবস্থা নিতে হবে। গুরু পাপে লঘু দণ্ডের ব্যবস্থা বাদ দিয়ে দৃষ্টান্ত ও স্মরণযোগ্য দণ্ডের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের আমদানি হ্রাস করে তা ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্তু এসব পদার্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই হলো জরুরি। উন্নত দেশে ট্রেস দ্রব্যাদি (কাগজপত্র জাতীয়), রিসাইকেল যন্ত্রাংশ (পলিথিন, ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী) এবং গার্বেজ (গ্যাস উৎপাদনের উপকরণ জাতীয়) বস্তু ফেলা হয় আলাদা ডাম্পিং পয়েন্টে, যেখান থেকে মানুষের দূরত্ব রয়েছে। এগুলো আবার নানা প্রক্রিয়ায় ধ্বংসও করে ফেলা হয়। কিন্তু এ দেশের চিত্র প্রায় এর বিপরীত। আমাদেরও সে রকম জায়গা কিংবা ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা কঠিন কিছু নয়। আমাদের মূল সমস্যা হলো, ব্যবস্থা বহুবিধ ত্রুটিপূর্ণ, তাই অবস্থাও সংকটাপন্ন। ব্যবস্থা ভালো হলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য। যে গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়া গেল, এর পরিপ্রেক্ষিতে এখনই সতর্ক না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ ঢেকে যাবে অন্ধকারে। আধুনিক যুগে তো এমনটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত, অর্থাৎ জনশত্রুদের কোনো ছাড় নয়। একটা জাতি যদি দেহে বিষ বহন করে চলে, তবে সে জাতির সামনে চরম দুর্দিন_এটি বলে দিতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছা, গণমানুষের সচেতনতা ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থাই মানুষকে রক্ষার পথ কণ্টকমুক্ত করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo,com
আবর্জনা ও ভারী ধাতব পদার্থ নিয়ে কাজ করে অর্থাৎ ডাম্পিং পয়েন্ট ও কল-কারখানায় কর্মরত ১৪৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৭৩ জন শিশুর রক্ত নমুনা (স্যাম্পল) হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ওই সংগৃহীত রক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাপ্তবয়স্কদের রক্তে সর্বোচ্চ ৯.৭ এবং উলি্লখিত শিশুদের রক্তে ৫.২ থেকে ১৩.৬ মাইক্রোগ্রাম বিষ রয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষকদের উদ্বেগজনক অভিমত হলো, এই বিষ মানুষের সহনীয় মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছে। যেখানে মানবদেহের রক্তে ০.২ মাইক্রোগ্রাম বিষের উপস্থিতি সহনযোগ্য, সেখানে উলি্লখিত মাত্রা কতটা উচ্চ_এ নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। মূলত ভেজাল খাবার ও পানীয় গ্রহণ এবং পরিবেশগত দূষণের কারণে এই হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশদূষণের চিত্র এ দেশে খুব উদ্বেগজনক। এর মধ্যে প্রকৃতির ওপর নির্বিচার অত্যাচার পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। যে খাবার জীবনের জন্য অপরিহার্য, সেই খাবার নিয়েই এ দেশে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। ভেজালমিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এ যাবৎ যেসব চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে, এ থেকে মুক্তির পথ তো মেলেইনি; উপরন্তু ক্রমান্বয়ে তা আরো উৎকট রূপ নিচ্ছে। মনে পড়ছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (ডিএল রায়) সেই বিখ্যাত গানের পঙ্ক্তিটি_'কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।' ডিএল রায়ের গানের এই পঙ্ক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতার অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। ভেজাল খাদ্যদ্রব্যে চারদিক সয়লাব। এই ভেজালের জটাজাল ছিন্নের লক্ষ্যে এ যাবৎ আইনি পদক্ষেপ (অবশ্য বলা যায়, এ সবই গুরু পাপে লঘু দণ্ড) কম নেওয়া হয়নি এবং থেমে থেমে তা অব্যাহতও আছে বটে, কিন্তু ফল কার্যত শূন্য। মনুষ্যসৃষ্ট এই বিপদের কারণে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়লেও ভেজালকারী রাঘববোয়ালরা তাদের তুঘলকি কাণ্ড অব্যাহতই রাখছে এবং মানুষকে বিষাক্রান্ত করে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে। এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দায়ভার সরকার এড়াতে পারে না।
অন্যদিকে কৃষিজমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল ও রাসায়নিক বস্তুর মিশ্রণে তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, এমনকি পশুখাদ্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষ গ্রহণ করছে এবং সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকটাই অজান্তেও মানুষ দ্রুত নিজেকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে, চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। খ্যাতনামা দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় যে ফল মিলেছে, তা নিঃসন্দেহে একটি জাতির জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, রক্তে মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত জৈব যৌগ, যেমন_হেঙ্াক্লোরোবেনজিন, পাইক্লোহেকজিন, ডিডিটি, পলি ক্লোরিনেটেডসহ নানা দ্রব্যের মিশ্রণ জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। এসব শুধু স্নায়ু, রক্ত, পরিপাকতন্ত্রের কার্যকারিতাই নষ্ট করে দেয় না; মানুষকে পঙ্গু পর্যন্ত করে দিতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আরো অভিমত, রক্তে মিশে থাকা এই বিষক্রিয়া ২০ বছরেও নষ্ট হয় না। তার মানে হচ্ছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিষাক্রান্ত হচ্ছে এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের মতো তা জাল বিস্তার করে চলেছে। কিডনি, ক্যান্সারসহ নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধিও এর ফলেই বাড়ছে। বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের ভাগ্যে এখনো যথাযথ চিকিৎসাসেবা মেলে না। উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বলতে গেলে পুরোপুরি চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অনেকের কাছেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তির বিষয়টি যেন সোনার হরিণ। অথচ এ সেবাপ্রাপ্তি মানুষের মৌলিক অধিকার। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশে উন্নত চিকিৎসাসেবা এখন অনেকটা মিললেও সিংহভাগ মানুষের পক্ষে এর দরজা মাড়ানোই সম্ভব নয় প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে। পাশাপাশি শ্রেণীবৈষম্য তো আছেই।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই এক দশকে কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে (বলা ভালো অপব্যবহার) প্রায় ৩২৮.৪ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কীটনাশক আমদানির পরিমাণও। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ২০ কোটি টাকার কীটনাশক আমদানি করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, অবৈধ পথে আসছে আরো প্রায় সমমূল্যের কীটনাশক। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, গুঁড়ো মসলাসহ বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত হারে ক্রোমাটেড, মেটালিন ইয়েলো, টেঙ্টাইল ডাই পিউরি, পেপরিকা, ফিটকিরিসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হচ্ছে। আরো উদ্বেগজনক তথ্য হলো, মানবদেহের জন্য সাইআরমেথরিন ও ডায়জিননের সহনীয় মাত্রা যেখানে ০.০১ পিপিএম, বাংলাদেশে কোনো কোনো (বিশেষ করে গুঁড়ো মসলায়) ক্ষেত্রে এর মাত্রা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ০.৭৩ ও ০.১৯ পিপিএম। তা ছাড়া ফলমূল পাকানোসহ তাজা রাখতে ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম কার্বাইড প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হচ্ছে যথেচ্ছভাবে এবং তা অনেকটাই প্রকাশ্যে বলা চলে। মানবদেহ বিষের ভাণ্ডার হয়ে ওঠার এ সবই অন্যতম প্রধান কারণ। জৈব যৌগের প্রায় ৯০ শতাংশ শরীরের চর্বিতে মিশে যাচ্ছে। মানবদেহে বিষক্রিয়ার সমস্যা বলতে গেলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী হলেও বাংলাদেশ কিংবা অন্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের মতো তা এত প্রকট রূপ লাভ করেনি। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর প্রধান সমস্যা সুষ্ঠু দিকনির্দেশনা এবং পরিকল্পনার অভাব, ব্যবস্থাপনাগত নানা ত্রুটি এবং অর্থনৈতিক অসংগতি। কিন্তু তাই বলে কি এ থেকে আমাদের মুক্তি দুরূহই থাকবে বা প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্র আরো বিস্তৃত হবে?
যেহেতু এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বহুলাংশেই মনুষ্যসৃষ্ট, সেহেতু এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মোটেও দুরূহ কোনো বিষয় নয়। প্রথমত, এ ব্যাপারে প্রয়োজন অধিকতর জনসচেতনতা। জনসচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। এর পাশাপাশি দরকার সরকার ও প্রশাসনের যথাযথ আইনি কঠোর কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। যারা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে নিজেদের পকেট স্ফীত করছে, উদর ভরছে, তারা নিঃসন্দেহে জনশত্রু। এ জনশত্রুদের চিহ্নিত করে সব কিছুর ঊধর্ে্ব উঠে ব্যবস্থা নিতে হবে। গুরু পাপে লঘু দণ্ডের ব্যবস্থা বাদ দিয়ে দৃষ্টান্ত ও স্মরণযোগ্য দণ্ডের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের আমদানি হ্রাস করে তা ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্তু এসব পদার্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করাটাই হলো জরুরি। উন্নত দেশে ট্রেস দ্রব্যাদি (কাগজপত্র জাতীয়), রিসাইকেল যন্ত্রাংশ (পলিথিন, ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী) এবং গার্বেজ (গ্যাস উৎপাদনের উপকরণ জাতীয়) বস্তু ফেলা হয় আলাদা ডাম্পিং পয়েন্টে, যেখান থেকে মানুষের দূরত্ব রয়েছে। এগুলো আবার নানা প্রক্রিয়ায় ধ্বংসও করে ফেলা হয়। কিন্তু এ দেশের চিত্র প্রায় এর বিপরীত। আমাদেরও সে রকম জায়গা কিংবা ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা কঠিন কিছু নয়। আমাদের মূল সমস্যা হলো, ব্যবস্থা বহুবিধ ত্রুটিপূর্ণ, তাই অবস্থাও সংকটাপন্ন। ব্যবস্থা ভালো হলে অবস্থা এমনিতেই ভালো হতে বাধ্য। যে গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়া গেল, এর পরিপ্রেক্ষিতে এখনই সতর্ক না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ ঢেকে যাবে অন্ধকারে। আধুনিক যুগে তো এমনটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। যারা স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত, অর্থাৎ জনশত্রুদের কোনো ছাড় নয়। একটা জাতি যদি দেহে বিষ বহন করে চলে, তবে সে জাতির সামনে চরম দুর্দিন_এটি বলে দিতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছা, গণমানুষের সচেতনতা ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থাই মানুষকে রক্ষার পথ কণ্টকমুক্ত করতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo,com
No comments