জীবনযাত্রার ব্যায় বাড়ছে by সারোয়ার সুমন
থরে থরে সাজানো আছে আম, আঙুর, আপেল। নগরীর দেওয়ানহাটের ফুটপাতে ফলের এমন পসরা সাজিয়ে বসেছেন মতলব মিয়া। দিনের বেলায় বেচাকেনা শেষে রাতে ফলের ঝুড়ি বাসায় নিয়ে যান তিনি। এটাই নাকি সমস্যা বাড়িয়েছে তার। কারণ তার আট বছর বয়সী ছোট মেয়ে কুলসুম ফলের ঝুড়ি দেখলেই বায়না ধরে আঙুর খাওয়ার। অন্যের কাছে ফল বিক্রি করলেও নিজের মেয়ের মুখে আঙুর তুলে দিতে পারেন না মতলব মিয়া।
কারণটা শুনুন তার মুখেই_ 'প্রতিদিন ফল বেচেই কিনতে হয় চাল, তেল, নুন। আড়াইশ টাকা কেজির আঙুর আমি কেমনে খাওয়াই কন?'
শুধু ফুটপাতের মতলব মিয়ারা নন, খাদ্য তালিকার সঙ্গে এভাবে আপস করতে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদেরও। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, বাসায় বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ, আর সড়কে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সবাই। আবার সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। বাড়ছে শিক্ষা উপকরণ, পোশাক পরিচ্ছেদসহ মৌলিক অন্যান্য উপকরণের দামও। আয়ের তুলনায় সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকায় বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়, বাড়ছে সাধারণ মানুষের কষ্ট।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, সর্বশেষ পাঁচ বছরে মানুষের মাসিক আয় বেড়েছে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ ভোগ ব্যয় বেড়েছে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ! অন্যদিকে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পর্যবেক্ষণে। তাদের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে গড়ে ১২ শতাংশ হারে। কিন্তু সর্বশেষ বছরে ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ছিল ১৬.১০ শতাংশ!
দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা আয়নালরা
আয়নাল হোসেনের বাড়ি রাউজানে। বয়স ৪৪-৪৫। দিনে ৮০ টাকা ভাড়ায় রিকশা চালান তিনি। প্রতিদিনের আয়-ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'রিকশা ভাড়ার টাকা পরিশোধ করে প্রতিদিন হাতে থাকে ১শ' থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ' টাকা। আমার ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য চাল, ডাল, তেল কিনতে প্রতিদিনই পড়তে হচ্ছে সমস্যায়। এক কেজি মোটা চাল কিনতে লাগে ৩৫ টাকা, তেল কিনতে ১০৫ টাকা, চিনি কিনতে ৭০ টাকা এবং পেঁয়াজ কিনতে হয় ৩৫ টাকা কেজি দরে।'
বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যও কথা বলছে আয়নালদের পক্ষে। টিসিবির হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে এক থেকে ১৭ শতাংশ। মাছের বাজার গরম থাকায় নিম্নবিত্তের বিকল্প খাবার ডিম। অথচ সেই ডিমের দামও মাত্র ৩০ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ! এক মাস আগে এক হালি ডিম ২৪ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা কিনতে হচ্ছে ২৮ টাকায়। একইভাবে পেঁয়াজ ৭.৪৬ শতাংশ, শুকনো মরিচ ১৪.২১ শতাংশ, মসুর ডাল ৪.৩২ শতাংশ, খোলা আটা ১০.২০ শতাংশ এবং খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৪.৪১ শতাংশ।
চাকরিজীবীদের যাতনা বাড়াচ্ছে যাতায়াত ব্যয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি প্ল্যানার হিসেবে কর্মরত আছেন মাহবুব মোর্শেদ। ভালো পদে চাকরি করার পরও তিনি তাল মেলাতে পারছেন না জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে। মাহবুব সমকালকে বলেন, 'আমার বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। ১৯৯৯ সালে যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন এতটুকু পথ পাড়ি দিতে রিকশা ভাড়া গুনতে হয়েছে পাঁচ টাকা। এখন একই পথ রিকশা দিয়ে যেতে লাগছে ৩০ টাকা। আর আগের এক টাকা টেম্পো ভাড়া বেড়ে হয়েছে চার টাকা। বর্ধিত এমন খরচের চাপ সামলাতে না পেরে আমি সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া প্রায় বন্ধ করেই দিয়েছি।'
গত ১০ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৫ টাকা। তাই আরেক দফা পরিবহন ভাড়া বাড়ানো নিয়ে চলছে বাগ্বিতণ্ডা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপেও পাওয়া গেছে ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র। আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে ২০০৫ সালে মাসিক ব্যয়ের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেশি ছিল ২৫৫ টাকা। ২০১০ সালে সেই ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ১০৬ টাকায়। চলতি বছর শেষে ব্যক্তিগত এমন গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ আরও কমে নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়!
বাড়িওয়ালার ভয়ে ভাড়াটিয়া
পূবালী ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় অফিসার পদে কর্মরত আছেন সামছুল ইসলাম জাবেদ। তার স্ত্রী তারিফা সুলতানা শিক্ষিকা পদে কর্মরত আছেন নগরীর কোড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার ওপরে। এর পরও জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ব্যাংকার সামছুল ইসলাম জাবেদ বলেন, 'তিন সদস্যের সংসার আমার। এ জন্য দুই বেড রুমের একটি বাসা নিয়েছি আমি। মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা ভাড়ার বাসা এ বছর বেড়ে হয়েছে আট হাজার টাকা। বাড়িওয়ালা বলছেন জানুয়ারিতে আবার ভাড়া বাড়ানো হবে। কত টাকা ভাড়া বাড়ে সেটি নিয়েই এখন টেনশনে আছি।' শুধু জাবেদ নন, বছরের শেষ প্রান্তে এসে আতঙ্ক থাকেন নগরে ভাড়া বাসায় থাকা সবাই। বছর না ঘুরতেই বাড়ে বাড়িভাড়া। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মালিকরা ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেন বাসাভাড়া।
বেড়ে গেছে শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়
দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন মুদি দোকানদার আহসানের স্ত্রী খাইরুন নেছা। ডাক্তারের পরামর্শে মাস তিনেক আগে খাইরুনকেক নগরীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আলট্রাসনোগ্রাফি করান আহসান। চিকিৎসকের পরামর্শে মাস তিনেক পর একই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই টেস্ট করতে গেলে তার কাছ থেকে ৪শ' টাকা বাড়তি নেওয়া হয়। শুধু আলট্রাসনোগ্রাফি নয়, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এনজিওগ্রামসহ বড় বড় সব টেস্টেরই খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। এক বছরের ব্যবধানে এসব টেস্টের খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিকে চিকিৎসার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষা ব্যয়ও। কলম, খাতাসহ সব শিক্ষা সামগ্রীর দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষার্থীদের স্কুলের বেতনও। নগরীর অক্সিজেন এলাকার গৃহিণী নার্গিস আক্তার বলেন, 'আমার দুই সন্তানের একজন প্রাথমিকে, আরেকজন হাই স্কুলে পড়ে। নতুন বছর এলেই তাদের বেতন বাড়িয়ে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ।'
কমছে সঞ্চয়, ছোট হচ্ছে খাদ্য তালিকা
চিকিৎসা, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে সঞ্চয়ের হার। একই কারণে মধ্যবিত্তরা আপস করছে পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে। ছোট হচ্ছে তাদের খাদ্য তালিকা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ছিল দেশের মোট উৎপাদনের ৩০.০২ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২৮.৪০ শতাংশ।
আবার আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্ব বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, বাংলাদেশে এর চেয়ে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের ৭০ ভাগই এখন চলে যাচ্ছে খাবারের পেছনে। আয় কম থাকায় বেশি দামের পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর দিতে পারছে খুব কমসংখ্যক মানুষ।
দাম বাড়ার নেপথ্যে...
ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে আছে বেশকিছু কারণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিবিদরা দায়ী করছেন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারকে। সরকার তিন মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে দুই দফা। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ভবিষ্যতে এর ব্যাপকতা আরও বাড়বে। কারণ গত আগস্টে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.২৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ার এ হার অব্যাহত আছে এখনও।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের সমীক্ষা বলছে, গত এক বছরে দেশে সয়াবিন তেলের দাম ৪২ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩৩ ও ২০ শতাংশ। চিনির উদাহরণ টেনে তারা বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় চিনির দাম বেড়েছে ১৪ ও ৮ শতাংশ আর বাংলাদেশে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ!
অর্থনীতিবিদরা যা বললেন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর
আলি খান সমকালকে বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ব্যাপক হারে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।'
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারেই ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তবে
আমাদের দেশে সরকারের সুষ্ঠু মনিটরিং না থাকায় এটিকে নিয়ে মুনাফা বাড়ান একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি
সরকারের মনিটরিং জোরদার হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা
হলেও কমবে।'
শুধু ফুটপাতের মতলব মিয়ারা নন, খাদ্য তালিকার সঙ্গে এভাবে আপস করতে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদেরও। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, বাসায় বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ, আর সড়কে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সবাই। আবার সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। বাড়ছে শিক্ষা উপকরণ, পোশাক পরিচ্ছেদসহ মৌলিক অন্যান্য উপকরণের দামও। আয়ের তুলনায় সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকায় বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়, বাড়ছে সাধারণ মানুষের কষ্ট।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, সর্বশেষ পাঁচ বছরে মানুষের মাসিক আয় বেড়েছে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ ভোগ ব্যয় বেড়েছে ৯৮ দশমিক ৮ শতাংশ! অন্যদিকে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পর্যবেক্ষণে। তাদের হিসাবে, দেশে প্রতিবছর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে গড়ে ১২ শতাংশ হারে। কিন্তু সর্বশেষ বছরে ব্যয় বৃদ্ধির এ হার ছিল ১৬.১০ শতাংশ!
দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা আয়নালরা
আয়নাল হোসেনের বাড়ি রাউজানে। বয়স ৪৪-৪৫। দিনে ৮০ টাকা ভাড়ায় রিকশা চালান তিনি। প্রতিদিনের আয়-ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, 'রিকশা ভাড়ার টাকা পরিশোধ করে প্রতিদিন হাতে থাকে ১শ' থেকে সর্বোচ্চ দেড়শ' টাকা। আমার ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য চাল, ডাল, তেল কিনতে প্রতিদিনই পড়তে হচ্ছে সমস্যায়। এক কেজি মোটা চাল কিনতে লাগে ৩৫ টাকা, তেল কিনতে ১০৫ টাকা, চিনি কিনতে ৭০ টাকা এবং পেঁয়াজ কিনতে হয় ৩৫ টাকা কেজি দরে।'
বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যও কথা বলছে আয়নালদের পক্ষে। টিসিবির হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে এক থেকে ১৭ শতাংশ। মাছের বাজার গরম থাকায় নিম্নবিত্তের বিকল্প খাবার ডিম। অথচ সেই ডিমের দামও মাত্র ৩০ দিনের ব্যবধানে বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ! এক মাস আগে এক হালি ডিম ২৪ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা কিনতে হচ্ছে ২৮ টাকায়। একইভাবে পেঁয়াজ ৭.৪৬ শতাংশ, শুকনো মরিচ ১৪.২১ শতাংশ, মসুর ডাল ৪.৩২ শতাংশ, খোলা আটা ১০.২০ শতাংশ এবং খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৪.৪১ শতাংশ।
চাকরিজীবীদের যাতনা বাড়াচ্ছে যাতায়াত ব্যয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি প্ল্যানার হিসেবে কর্মরত আছেন মাহবুব মোর্শেদ। ভালো পদে চাকরি করার পরও তিনি তাল মেলাতে পারছেন না জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে। মাহবুব সমকালকে বলেন, 'আমার বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। ১৯৯৯ সালে যখন চাকরিতে যোগদান করি তখন এতটুকু পথ পাড়ি দিতে রিকশা ভাড়া গুনতে হয়েছে পাঁচ টাকা। এখন একই পথ রিকশা দিয়ে যেতে লাগছে ৩০ টাকা। আর আগের এক টাকা টেম্পো ভাড়া বেড়ে হয়েছে চার টাকা। বর্ধিত এমন খরচের চাপ সামলাতে না পেরে আমি সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া প্রায় বন্ধ করেই দিয়েছি।'
গত ১০ নভেম্বর রাত ১২টা থেকে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৫ টাকা। তাই আরেক দফা পরিবহন ভাড়া বাড়ানো নিয়ে চলছে বাগ্বিতণ্ডা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপেও পাওয়া গেছে ব্যয় বৃদ্ধির চিত্র। আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে ২০০৫ সালে মাসিক ব্যয়ের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেশি ছিল ২৫৫ টাকা। ২০১০ সালে সেই ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ১০৬ টাকায়। চলতি বছর শেষে ব্যক্তিগত এমন গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ আরও কমে নেমে আসতে পারে শূন্যের কোঠায়!
বাড়িওয়ালার ভয়ে ভাড়াটিয়া
পূবালী ব্যাংকের হাটহাজারী শাখায় অফিসার পদে কর্মরত আছেন সামছুল ইসলাম জাবেদ। তার স্ত্রী তারিফা সুলতানা শিক্ষিকা পদে কর্মরত আছেন নগরীর কোড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার ওপরে। এর পরও জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ব্যাংকার সামছুল ইসলাম জাবেদ বলেন, 'তিন সদস্যের সংসার আমার। এ জন্য দুই বেড রুমের একটি বাসা নিয়েছি আমি। মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকা ভাড়ার বাসা এ বছর বেড়ে হয়েছে আট হাজার টাকা। বাড়িওয়ালা বলছেন জানুয়ারিতে আবার ভাড়া বাড়ানো হবে। কত টাকা ভাড়া বাড়ে সেটি নিয়েই এখন টেনশনে আছি।' শুধু জাবেদ নন, বছরের শেষ প্রান্তে এসে আতঙ্ক থাকেন নগরে ভাড়া বাসায় থাকা সবাই। বছর না ঘুরতেই বাড়ে বাড়িভাড়া। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে মালিকরা ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দেন বাসাভাড়া।
বেড়ে গেছে শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয়
দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় ভুগছেন মুদি দোকানদার আহসানের স্ত্রী খাইরুন নেছা। ডাক্তারের পরামর্শে মাস তিনেক আগে খাইরুনকেক নগরীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আলট্রাসনোগ্রাফি করান আহসান। চিকিৎসকের পরামর্শে মাস তিনেক পর একই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই টেস্ট করতে গেলে তার কাছ থেকে ৪শ' টাকা বাড়তি নেওয়া হয়। শুধু আলট্রাসনোগ্রাফি নয়, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এনজিওগ্রামসহ বড় বড় সব টেস্টেরই খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। এক বছরের ব্যবধানে এসব টেস্টের খরচ বেড়েছে ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত।
এদিকে চিকিৎসার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষা ব্যয়ও। কলম, খাতাসহ সব শিক্ষা সামগ্রীর দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষার্থীদের স্কুলের বেতনও। নগরীর অক্সিজেন এলাকার গৃহিণী নার্গিস আক্তার বলেন, 'আমার দুই সন্তানের একজন প্রাথমিকে, আরেকজন হাই স্কুলে পড়ে। নতুন বছর এলেই তাদের বেতন বাড়িয়ে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ।'
কমছে সঞ্চয়, ছোট হচ্ছে খাদ্য তালিকা
চিকিৎসা, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কমে যাচ্ছে সঞ্চয়ের হার। একই কারণে মধ্যবিত্তরা আপস করছে পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে। ছোট হচ্ছে তাদের খাদ্য তালিকা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের জাতীয় সঞ্চয় ছিল দেশের মোট উৎপাদনের ৩০.০২ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ২৮.৪০ শতাংশ।
আবার আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্ব বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম যতটা বেড়েছে, বাংলাদেশে এর চেয়ে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি বেড়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের ৭০ ভাগই এখন চলে যাচ্ছে খাবারের পেছনে। আয় কম থাকায় বেশি দামের পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর দিতে পারছে খুব কমসংখ্যক মানুষ।
দাম বাড়ার নেপথ্যে...
ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে আছে বেশকিছু কারণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিবিদরা দায়ী করছেন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারকে। সরকার তিন মাসের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে দুই দফা। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ভবিষ্যতে এর ব্যাপকতা আরও বাড়বে। কারণ গত আগস্টে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.২৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বাড়ার এ হার অব্যাহত আছে এখনও।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের সমীক্ষা বলছে, গত এক বছরে দেশে সয়াবিন তেলের দাম ৪২ শতাংশ এবং পাম তেলের দাম ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৩৩ ও ২০ শতাংশ। চিনির উদাহরণ টেনে তারা বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় চিনির দাম বেড়েছে ১৪ ও ৮ শতাংশ আর বাংলাদেশে বেড়েছে ৩৩ শতাংশ!
অর্থনীতিবিদরা যা বললেন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর
আলি খান সমকালকে বলেন, 'জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব ব্যাপক হারে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।'
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারেই ভোগ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। তবে
আমাদের দেশে সরকারের সুষ্ঠু মনিটরিং না থাকায় এটিকে নিয়ে মুনাফা বাড়ান একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। আমদানি নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি
সরকারের মনিটরিং জোরদার হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা
হলেও কমবে।'
No comments