একটি আসনের সদস্যপদ বাতিল এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা by শাহ আহমদ রেজা
লগি-বৈঠার হত্যা-তাণ্ডব এবং ১/১১ থেকে সংসদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের সরকার গঠন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন উ আহমেদসহ ‘উদ্দিন সাহেবদের’ সঙ্গে দৌড়েও এগিয়ে থেকেছেন সিইসি এবং তার দুই সহকর্মী। এর কারণ আবার কয়েকটি মাত্র নয়। খুব কম করে বললেও শুরুতেই বলতে হবে যে, নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্তও নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি।
কমিশনের প্রায় সব কার্যক্রমই বরং বিতর্কিত হয়েছে—প্রশ্ন, বিভ্রান্তি ও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ পেয়ে যাওয়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হজম করা কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্দেশ চাপানোর চেষ্টা করেছে কমিশন। সিইসির কথা ও কাজে মনে হয়েছে যেন তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে—যদিও এদেশে নির্বাচন হচ্ছে ১৯৩৭ সাল থেকে। সিইসি এমনকি বিএনপির মতো প্রধান একটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলিয়েছেন। দলের সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে ঠিক একজন রাজনৈতিক নেতার মতোই সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি। অথচ কোনো বিচারেই এটা তার এখতিয়ারে পড়ে না। তাকে সিইসি বানানো হয়েছিল জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করার জন্য, কোনো দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মাতামাতি করার জন্য নয়। অন্যদিকে এটিএম শামসুল স্লদাকে বেশি উৎসাহী দেখা গেছে প্রধানত বিএনপির ব্যাপারে। উত্সাহ দেখাতে গিয়ে রাজনৈতিক অর্থে ‘ফাউলও’ তিনি বিএনপির বিরুদ্ধেই বেশি করেছেন। শুনিয়েছেন ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কথা। রাজনৈতিক দলের নিবন্ব্দন নিয়েও সিইসি বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেছিলেন। ভোটার তালিকা ও ছবিযুক্ত আইডি কার্ড তৈরি এবং স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স বানানো থেকে শুরু করে নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণ পর্যন্ত অন্য সব বিষয়েও কমিশন একতরফা ব্যবস্থা নিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছে। বেছে বেছে চারদলীয় জোটের সম্ভাবনা রয়েছে—এমন ১৩৩টি আসনেরই সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছে কমিশন। এভাবে নির্বাচনমুখী কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রে কমিশনকে একচোখা অবস্থানে দেখা গেছে। সিইসির নেতৃত্বে পুরো কমিশনই আওয়ামী লীগ ও তার মহাজোটকে জিতিয়ে আনার জন্য একেবারে ‘আদা-জল খেয়ে’ কাজ করেছে। কোনো নিন্দা ও বিরোধিতাকেই পাত্তা দেয়নি কমিশন। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলেও আওয়ামী লীগ বিরোধী কোনো অভিযোগকে আমলে নেননি সিইসি ও তার সুযোগ্য সহকর্মীরা। কিন্তু কথায় বলে, সত্যের ঢোল নাকি নিজে নিজেই বেজে ওঠে। দেরিতে হলেও জাতি সম্প্রতি সে ঢোলের আওয়াজ শোনার সুযোগ পেয়েছে। এ ব্যাপারে নির্ধারকের ভূমিকা রেখেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আদালতের রায়ে ভোলা-৩ আসন থেকে ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য জসিম উদ্দিনের নির্বাচন এবং সদস্যপদ দুটিই বাতিল হয়ে গেছে। তার মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে প্রথমে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন ২৬ ফেব্রুয়ারি। ১৮ অক্টোবর সেটাই বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগের টিকিটে ‘বিজয়ী’ জসিম উদ্দিন সেনাবাহিনীর মেজর ছিলেন। এই পরিচিতিকেন্দ্রিক অসত্য তথ্যই ‘কাল’ হয়েছে তার জন্য। মনোনয়নপত্রে তিনি এমনভাবে ‘অবসরপ্রাপ্ত’ কথাটা লিখেছিলেন—যা দেখে মনে হবে যেন তাকে স্বাভাবিক অবসর দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ‘বাধ্যতামূলক’ অবসর দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় করা হয়েছিল তাকে। তারও আগে এই সাবেক মেজরের ব্যাপারে সেনাবাহিনী তার আইন অনুযায়ী তদন্ত করেছিল। তদন্তে দেখা গেছে, চাকরিতে থাকাকালে অনিয়ম করেছেন জসিম, নগদ অর্থে ঘুষও খেয়েছেন তিনি ঠিকাদারদের কাছ থেকে। এজন্যই সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। শাস্তি হিসেবেই ‘বাধ্যতামূলক’ অবসর পেয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি হয়তো জানাজানি হতো না, জসিম যদি সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্রে অসত্য তথ্যের উল্লেখ না করতেন। এ ব্যাপারে শুরুতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। কারণ, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারিত বা বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত হলে এবং তারপর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না। কিন্তু স্থানীয় রিটার্নিং অফিসার মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদের আপত্তিকে বিবেচনায় নেননি। নির্বাচন কমিশনও সাবেক মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেনি—নিজে থেকে তো নয়ই, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ দায়ের করার পরও নয়। ফলে দিব্যি সংসদ সদস্য হিসেবে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জসিম উদ্দিন—আইনত যিনি এমনকি প্রার্থীও হতে পারেন না। ওদিকে বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজও হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি উচ্চ আদালতে গেছেন। সাবেক মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন ২৬ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচন কমিশন যে বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেকথাই প্রকাশ্যে এসেছিল। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের সে পর্যায়েও কমিশন নতুন করে আরও একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছিল। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যে ধারা অনুযায়ী সাবেক মেজর জসিমের সদস্যপদ বাতিল করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন, জুন মাসে এসে নির্বাচন কমিশন সে ধারাটিতেই সংশোধনী এনেছে। সংশোধিত ধারায় বলা হয়েছে, দুর্নীতির কারণে বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত হলেই কেবল পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। তা না হলে তিন বছর অতিক্রান্ত হলেই যে কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন। এখানে ইসির উদ্দেশ্যে কোনো রাখঢাক করা হয়নি। সাবেক মেজর জসিম বাধ্যতামূলক অবসর পেয়েছিলেন ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে। সে হিসেবে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে তার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। ফলে সংশোধিত আইন অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য হতে কোনো বাধা ছিল না বলে বোঝাতে চেয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের এই চেষ্টা হালে পানি পায়নি। কারণ, সাবেক মেজরের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দেয়ারও চার মাস পর কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধন করেছে। কিন্তু তার আগেই জসিমের দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ আদালতের নথিভুক্ত করা হয়েছিল, আদালত সেগুলোর ভিত্তিতেই রায় ঘোষণা করেছিলেন। ফলে নির্বাচন কমিশনের চেষ্টা মাঠে মারা গেছে। এরপর আপিলেও কাজ হয়নি, ১৮ অক্টোবর আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রেখেছেন। বাতিল হয়ে গেছে আওয়ামী এমপির সদস্যপদ।
এখানে বিশেষভাবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা লক্ষ্য করা দরকার। ভোলা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় সব তথ্য-প্রমাণও পেশ করেছিলেন তিনি। অভিযোগ পাওয়ার পর উচিত যেখানে ছিল সাবেক মেজরের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা, নির্বাচন কমিশন সেখানে ‘ছুটে’ গিয়েছিল সেনা সদর দফতরে—১/১১-এর খলনায়ক মইন উ’র ঘাঁটি এলাকায়। গিয়েছিল কী করতে হবে তা জানার জন্য। সেনাবাহিনীর জাজ অব অ্যাডভোকেট জেনারেল (জিএজি) নাকি কমিশনকে জসিমের মনোনয়নপত্র বাতিল না করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ীই বেআইনিভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা। মইন উ’সহ উদ্দিন সাহেবদের প্রতি অতি ভক্তি ও আনুগত্যের কারণে তারা এমনকি কমিশনের আইনজীবীদের সঙ্গেও পরামর্শ করেননি। পরবর্তীকালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যোগ্যতা সংক্রান্ত ধারায় সংশোধন করার পদক্ষেপও ছিল বিস্ময়কর। এর মাধ্যমে কমিশন প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী এমপি’র সদস্যপদ টিকিয়ে রাখারই চেষ্টা চালিয়েছিল। এদিকে দেরিতে হলেও সাবেক মেজর জসিমের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসছে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার দলের এমপি জসিমের সদস্যপদ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষিত হওয়ার সাত মাস পর, গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরকে ‘অকালীন’ অবসর হিসেবে পরিবর্তন করিয়েছেন। সে অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশনও জারি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, ‘অকালীন’ অবসরের নির্দেশটি ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু হাইকোর্ট রায় দেয়ার পর জারি হয়েছে বলে আপিল বিভাগ গেজেট নোটিফিকেশনটিকে অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে ব্যর্থ হয়ে গেছে সাবেক মেজর জসিমের সদস্যপদ রক্ষার সব চেষ্টা।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার দিকটি। সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছে কিছু বিষয়। প্রথমত, তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কমিশন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে এবং পরবর্তীকালে তার সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানে সংশোধনী এনেছে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে কমিশনের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পরিবর্তে সেনা সদর দফতরে জিএজি’র কাছে যাওয়ার পদক্ষেপে প্রমাণিত হয়েছে, কমিশন প্রতিটি ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তথা মইন উ’র নির্দেশনা মেনে চলেছে। ফলে ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের অতি উত্সাহে নির্বাচনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় মইন উ’র নেতৃত্বে একদল সেনা অফিসার প্রত্যক্ষভাবেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন। অর্থাত্ বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সব মিলিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন আসলেও আওয়ামী লীগের পক্ষে নগ্নভাবেই ভূমিকা পালন করেছে। কমিশনের এই ভূমিকার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আইনবিরোধী অবস্থানে চলে গেছেন। নিজের দলীয় এমপির সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক আবসরপ্রাপ্ত একজন সাবেক সেনা অফিসারকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য তিনি পাঁচ বছর পেছনের তারিখ দিয়ে নতুন গেজেট নোটিফিকেশন জারি করিয়েছেন। গণতন্ত্রে এর চেয়ে ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে না। এদিকে সাবেক মেজর জসিম ২২ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে জসিম উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনীর কারণেই তাকে আজ ‘রাজনৈতিক মৃত্যুর প্রহর’ গুনতে হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তার অবসর আদেশের ব্যাখ্যায় কখনও ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ বলা হয়েছে, কখনও বলা হয়েছে ‘অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর সর্বশেষ ব্যাখ্যায় যে ‘অকালীন অবসর’ বলা হয়েছে, সেকথাও জানিয়েছেন তিনি। অন্য একটি তাত্পর্যপূর্ণ তথ্যও জানা গেছে তার কাছ থেকে। এই সাবেক মেজর বলেছেন, তিনি নাকি নিজের ‘সুস্পষ্ট অবস্থান’ জানিয়েই মনোনয়নপত্র পেশ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তখন কোনো আপত্তি জানায়নি। এখন তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। এজন্য তিনি নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছেন। এখন দেখার বিষয়, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো ব্যবস্থা নেন কি-না এই সাবেক সেনা অফিসার। যদি না নেন কিংবা নিলেও হেরে যান তাহলে বুঝতে হবে, শুধু কমিশনের নয়, গলদ আসলে তার নিজেরও ছিল। নির্বাচন কমিশনের জন্য অবশ্য কোনো অবস্থাতেই রেহাই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে না।
এখানে বিশেষভাবে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা লক্ষ্য করা দরকার। ভোলা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ পেশ করা হয়েছিল। প্রয়োজনীয় সব তথ্য-প্রমাণও পেশ করেছিলেন তিনি। অভিযোগ পাওয়ার পর উচিত যেখানে ছিল সাবেক মেজরের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা, নির্বাচন কমিশন সেখানে ‘ছুটে’ গিয়েছিল সেনা সদর দফতরে—১/১১-এর খলনায়ক মইন উ’র ঘাঁটি এলাকায়। গিয়েছিল কী করতে হবে তা জানার জন্য। সেনাবাহিনীর জাজ অব অ্যাডভোকেট জেনারেল (জিএজি) নাকি কমিশনকে জসিমের মনোনয়নপত্র বাতিল না করার ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ীই বেআইনিভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা। মইন উ’সহ উদ্দিন সাহেবদের প্রতি অতি ভক্তি ও আনুগত্যের কারণে তারা এমনকি কমিশনের আইনজীবীদের সঙ্গেও পরামর্শ করেননি। পরবর্তীকালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের যোগ্যতা সংক্রান্ত ধারায় সংশোধন করার পদক্ষেপও ছিল বিস্ময়কর। এর মাধ্যমে কমিশন প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী এমপি’র সদস্যপদ টিকিয়ে রাখারই চেষ্টা চালিয়েছিল। এদিকে দেরিতে হলেও সাবেক মেজর জসিমের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসছে। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার দলের এমপি জসিমের সদস্যপদ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষিত হওয়ার সাত মাস পর, গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি ‘বাধ্যতামূলক’ অবসরকে ‘অকালীন’ অবসর হিসেবে পরিবর্তন করিয়েছেন। সে অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশনও জারি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, ‘অকালীন’ অবসরের নির্দেশটি ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু হাইকোর্ট রায় দেয়ার পর জারি হয়েছে বলে আপিল বিভাগ গেজেট নোটিফিকেশনটিকে অকার্যকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সেটা বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে ব্যর্থ হয়ে গেছে সাবেক মেজর জসিমের সদস্যপদ রক্ষার সব চেষ্টা।
ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার দিকটি। সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে এসেছে কিছু বিষয়। প্রথমত, তথ্য-প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কমিশন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মেজর জসিমের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে এবং পরবর্তীকালে তার সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধানে সংশোধনী এনেছে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে কমিশনের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পরিবর্তে সেনা সদর দফতরে জিএজি’র কাছে যাওয়ার পদক্ষেপে প্রমাণিত হয়েছে, কমিশন প্রতিটি ব্যাপারে সেনাবাহিনীর তথা মইন উ’র নির্দেশনা মেনে চলেছে। ফলে ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের অতি উত্সাহে নির্বাচনের সমগ্র প্রক্রিয়ায় মইন উ’র নেতৃত্বে একদল সেনা অফিসার প্রত্যক্ষভাবেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন। অর্থাত্ বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জসিম উদ্দিনের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সব মিলিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন আসলেও আওয়ামী লীগের পক্ষে নগ্নভাবেই ভূমিকা পালন করেছে। কমিশনের এই ভূমিকার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আইনবিরোধী অবস্থানে চলে গেছেন। নিজের দলীয় এমপির সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ঘুষ-দুর্নীতির দায়ে বাধ্যতামূলক আবসরপ্রাপ্ত একজন সাবেক সেনা অফিসারকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য তিনি পাঁচ বছর পেছনের তারিখ দিয়ে নতুন গেজেট নোটিফিকেশন জারি করিয়েছেন। গণতন্ত্রে এর চেয়ে ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ আর কিছু হতে পারে না। এদিকে সাবেক মেজর জসিম ২২ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে জসিম উদ্দিন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন ও সেনাবাহিনীর কারণেই তাকে আজ ‘রাজনৈতিক মৃত্যুর প্রহর’ গুনতে হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, তার অবসর আদেশের ব্যাখ্যায় কখনও ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ বলা হয়েছে, কখনও বলা হয়েছে ‘অকালীন (বাধ্যতামূলক) অবসর’। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর সর্বশেষ ব্যাখ্যায় যে ‘অকালীন অবসর’ বলা হয়েছে, সেকথাও জানিয়েছেন তিনি। অন্য একটি তাত্পর্যপূর্ণ তথ্যও জানা গেছে তার কাছ থেকে। এই সাবেক মেজর বলেছেন, তিনি নাকি নিজের ‘সুস্পষ্ট অবস্থান’ জানিয়েই মনোনয়নপত্র পেশ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তখন কোনো আপত্তি জানায়নি। এখন তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হচ্ছে। এজন্য তিনি নির্বাচন কমিশন এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছেন। এখন দেখার বিষয়, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো ব্যবস্থা নেন কি-না এই সাবেক সেনা অফিসার। যদি না নেন কিংবা নিলেও হেরে যান তাহলে বুঝতে হবে, শুধু কমিশনের নয়, গলদ আসলে তার নিজেরও ছিল। নির্বাচন কমিশনের জন্য অবশ্য কোনো অবস্থাতেই রেহাই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে না।
No comments