সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের শেষরক্ষা হবে কি? by গাজীউল হাসান খান
সিরিয়ার সংগ্রামী জনতার গত সাত মাসের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পেঁৗছানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো এবং আরব লীগের সীমাহীন প্রচেষ্টার ফলে এ যাত্রায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বেঁচে গেলেও তাঁর শেষরক্ষা হবে কি না তা নিয়ে এখন বিভিন্ন মহল অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কারণ অবিলম্বে রক্তাক্ত সংঘর্ষের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সিরিয়ার সরকার ২ নভেম্বর আরব লীগের প্রস্তাবিত বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নিলেও হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। সেদিনও সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর হাতে হোমসের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ২০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ জন ছিল কারখানার শ্রমিক।
তার আগের দিন হোমসে আসাদের আলাওয়াইট শিয়া সম্প্রদায়ের ৯ জনকে হত্যা করেছিল আন্দোলনকারীদের একটি দল। আসাদপন্থী এবং বিরোধীদের মধ্যে সম্প্রতি শুরু হয়েছে এক প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড। সিরিয়ার সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানী দামেস্কসহ আলেপ্পো, হোমস, হামা, লাটাকিয়া, ডারা, দিয়ার এজ জোর ও অন্যান্য শহরে ইতিমধ্যে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করে না যে বাশার আল-আসাদের স্বৈরাচারী সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের রাজনৈতিক সংস্কারের সব ন্যায্য দাবি মেনে নেবে। তারা মনে করে, আপস-মীমাংসাসংক্রান্ত আলোচনার অন্তরালে বাশার আল-আসাদ সিরিয়াবাসীর সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনকে ক্রমে নিস্তেজ করে দেবে। তাই আসাদ সরকারের সঙ্গে আরব লীগের বর্তমান আলোচনাকে আন্দোলনকারীরা তাদের বিরুদ্ধে একটি চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনও আরব লীগের নেতৃত্বাধীন আপস-মীমাংসার বর্তমান প্রচেষ্টাকে সমর্থন না দিয়ে বরং বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছে, 'যে সরকার তার জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দিতে পারে, ক্ষমতায় থাকার তার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।' আরব বসন্তে ইতিমধ্যে যেমন ঝরে পড়েছে তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার স্বৈরশাসকরা, তেমনি পরিণাম হওয়া উচিত সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের। অথচ আসাদ বলছেন, সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের তিউনিসিয়া, মিসর কিংবা লিবিয়ার মতো নয়। সিরিয়া একটি বহু জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক দেশ। সেখানে সব কিছু যথাযথভাবে সমন্বয় সাধন করা না গেলে এক রক্তক্ষয়ী ও দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ দেখা দেবে, যা হবে আফগানিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি ভয়াবহ।
সাম্প্রতিককালের লেবানন কিংবা ইরাকের মতো সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি না হলেও এ দেশটির সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। স্বৈরাচারী শাসন বা সামরিক আধিপত্য খাটিয়ে এত দিন তা দমিয়ে রাখলেও গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সব কিছুই এখন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মুসলিম হলেও শিয়া, সুনি্ন, ড্রুজ, কুর্দি, খ্রিস্টান এবং আরব ও অনারব সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু সম্প্রতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছিল। মোট দুই কোটি ২৮ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৭৪ শতাংশ হচ্ছে সুনি্ন মুসলমান এবং ১৩ শতাংশ রয়েছে শিয়া সম্প্রদায়। খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১০ শতাংশ এবং ৩ শতাংশ রয়েছে ড্রুজ সম্প্রদায়ের জনগণ। আবার মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু কুর্দি জনগণও রয়েছে_যারা তুরস্ক, ইরাক ও ইরানের কুর্দি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নিজে আলাওয়াইট শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁর প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত উচ্চপদে রয়েছে আলাওয়াইট শিয়াদের প্রাধান্য। এ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সুনি্নসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ অত্যন্ত আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরিয়ার সামান্য যে তেল সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে জনগণের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল থেকে প্রায় ৪৮ বছর স্থায়ী জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংস্কার ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের দাবি উঠেছে। কিন্তু বাশার আল-আসাদ, যিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় কোনো মৌলিক গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকেও হাত দিতে সাহস পাননি। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা কিংবা স্থানীয় সরকারে জনগণের অংশীদারি জন্মলগ্ন থেকে কখনোই ক্রিয়াশীলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রভাবাধীন তথাকথিত 'পিপলস কাউন্সিলের অধীনে বাবার মতো রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন বাশার আল-আসাদ। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান এবং একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বিশ্বব্যাপী যখন সংস্কার ও পরিবর্তনের জোয়ার বইছে, বাশার আল-আসাদ তখনো সিরিয়ার সামাজিক অবস্থান ও সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য রক্ষার দোহাই দিয়ে দেশের জনগণকে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল। তার আগে উমাইয়া বংশীয় খলিফা এবং আব্বাসীয়দের সময়েও সিরিয়া শিল্প-সংস্কৃতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত অগ্রসর ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিপর্যয়ের পর ১৯১৬ সালে স্বাক্ষরিত 'সাঈক-পিকট চুক্তি' আধুনিক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করে। সিরিয়া ১৯২০ সাল থেকে লীগ অব ন্যাশনস নির্ধারিত ফরাসি ম্যান্ডেটের অধীনে শাসিত হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ফরাসি ম্যান্ডেট শেষ হলে সিরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইরাক, জর্দান, ইয়েমেন ও সৌদি আরবের মতো আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সিরিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান চলতে থাকে। তখন ১৯৬৩ সালে ঘোষিত এক জরুরি আইনে সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের বিভিন্ন মৌলিক অধিকারকে রহিত করা হয়েছিল। সে অবস্থায় হাফিজ আল-আসাদ ছিলেন তৎকালীন বাথ পার্টির অধীন সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সে সময় অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর ১৯৭০ সালে সংঘটিত এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রের পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ক্ষমতা গ্রহণের পর 'দ্য কারেকটিভ মুভমেন্ট' নামক একটি প্রক্রিয়ার অধীনে হাফিজ আল-আসাদ আরব বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ১৭৩ সদস্যের 'পিপলস কাউন্সিল' নামে একটি আইন পরিষদ গঠন করেছিলেন। তাতে বাথ পার্টির ছিল ৮৭ জন সদস্য। বাদবাকি পদ ছোট ছোট বামপন্থী ও শ্রমিক সংগঠন এবং অন্যান্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। সে শাসন প্রক্রিয়ায় ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর হাফিজ আল-আসাদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়া গোলাম হাইটস হারায়। তখন সিরিয়ায় আগমন ঘটে অসংখ্য ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর। ১৯৪৯ সালের পর থেকেই বিশেষ করে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে, সিরিয়া ইরাকের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে ২০০০ সালের ১০ জুন বাবার মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তখন থেকে তিনিও প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন; কিন্তু এর মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে মৌলিক কোনো পরিবর্তন সাধন করেননি। এ যেন ক্ষমতায় থাকার জন্যই ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখা।
আরব লীগের প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ী অবিলম্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের যে ধরনের উদ্যোগ থাকা উচিত ছিল, তা মোটেও সিরিয়ার আন্দোলনকারীদের কাছে যথেষ্ট আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না। এ ব্যাপারে এ অঞ্চলের একমাত্র গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী দেশ তুরস্কের যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তুরস্কের নেতারা সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। আরব বসন্তের ছোঁয়ায় জাগ্রত ও আন্দোলিত সিরিয়াবাসী গভীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তনের সূচনার জন্য। এ সময়টি সিরিয়ার শাসক বাশার আল-আসাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ সুযোগ হাতছাড়া হলে তাঁর জন্য আর তেমন কোনো পথ খোলা থাকবে না। তাঁকেও সম্ভবত তখন তিউনিসিয়ার জাইন এল আবিদিন বেন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক ও লিবিয়ার গাদ্দাফির ভাগ্যবরণ করতে হবে। খিলাফত পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের অনুপস্থিতি কিংবা স্বৈরশাসনের জন্য ইসলাম দায়ী নয়, দায়ী সেখানকার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী। সে কারণেই আরব লীগ ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তাইপ এরদোগান সিরিয়ার ব্যাপারে এতটা উদ্বিগ্ন। তাঁদের আশা, সিরিয়ার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে জোরদার করবে।
লন্ডন, ৩ নভেম্বর, ২০১১
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
email: gaziulhkhan@gmail.com
সাম্প্রতিককালের লেবানন কিংবা ইরাকের মতো সিরিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি না হলেও এ দেশটির সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। স্বৈরাচারী শাসন বা সামরিক আধিপত্য খাটিয়ে এত দিন তা দমিয়ে রাখলেও গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে সব কিছুই এখন বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ মুসলিম হলেও শিয়া, সুনি্ন, ড্রুজ, কুর্দি, খ্রিস্টান এবং আরব ও অনারব সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু সম্প্রতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করেছিল। মোট দুই কোটি ২৮ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৭৪ শতাংশ হচ্ছে সুনি্ন মুসলমান এবং ১৩ শতাংশ রয়েছে শিয়া সম্প্রদায়। খ্রিস্টান জনসংখ্যা ১০ শতাংশ এবং ৩ শতাংশ রয়েছে ড্রুজ সম্প্রদায়ের জনগণ। আবার মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু কুর্দি জনগণও রয়েছে_যারা তুরস্ক, ইরাক ও ইরানের কুর্দি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ নিজে আলাওয়াইট শিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য। তাঁর প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত উচ্চপদে রয়েছে আলাওয়াইট শিয়াদের প্রাধান্য। এ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সুনি্নসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ অত্যন্ত আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরিয়ার সামান্য যে তেল সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে জনগণের অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল থেকে প্রায় ৪৮ বছর স্থায়ী জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার এবং ব্যাপক গণতান্ত্রিক সংস্কার ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের দাবি উঠেছে। কিন্তু বাশার আল-আসাদ, যিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কায় কোনো মৌলিক গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকেও হাত দিতে সাহস পাননি। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা কিংবা স্থানীয় সরকারে জনগণের অংশীদারি জন্মলগ্ন থেকে কখনোই ক্রিয়াশীলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আরব সমাজতান্ত্রিক বাথ পার্টির নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রভাবাধীন তথাকথিত 'পিপলস কাউন্সিলের অধীনে বাবার মতো রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন বাশার আল-আসাদ। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান এবং একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বিশ্বব্যাপী যখন সংস্কার ও পরিবর্তনের জোয়ার বইছে, বাশার আল-আসাদ তখনো সিরিয়ার সামাজিক অবস্থান ও সাম্প্রদায়িক ভারসাম্য রক্ষার দোহাই দিয়ে দেশের জনগণকে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সিরিয়া অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে একটি সমৃদ্ধ প্রদেশ ছিল। তার আগে উমাইয়া বংশীয় খলিফা এবং আব্বাসীয়দের সময়েও সিরিয়া শিল্প-সংস্কৃতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত অগ্রসর ভূমিকা পালন করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিপর্যয়ের পর ১৯১৬ সালে স্বাক্ষরিত 'সাঈক-পিকট চুক্তি' আধুনিক দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করে। সিরিয়া ১৯২০ সাল থেকে লীগ অব ন্যাশনস নির্ধারিত ফরাসি ম্যান্ডেটের অধীনে শাসিত হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে ফরাসি ম্যান্ডেট শেষ হলে সিরিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইরাক, জর্দান, ইয়েমেন ও সৌদি আরবের মতো আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সিরিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান চলতে থাকে। তখন ১৯৬৩ সালে ঘোষিত এক জরুরি আইনে সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের বিভিন্ন মৌলিক অধিকারকে রহিত করা হয়েছিল। সে অবস্থায় হাফিজ আল-আসাদ ছিলেন তৎকালীন বাথ পার্টির অধীন সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিরক্ষামন্ত্রী। সে সময় অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর ১৯৭০ সালে সংঘটিত এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রের পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ক্ষমতা গ্রহণের পর 'দ্য কারেকটিভ মুভমেন্ট' নামক একটি প্রক্রিয়ার অধীনে হাফিজ আল-আসাদ আরব বাথ সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ১৭৩ সদস্যের 'পিপলস কাউন্সিল' নামে একটি আইন পরিষদ গঠন করেছিলেন। তাতে বাথ পার্টির ছিল ৮৭ জন সদস্য। বাদবাকি পদ ছোট ছোট বামপন্থী ও শ্রমিক সংগঠন এবং অন্যান্যের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। সে শাসন প্রক্রিয়ায় ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর হাফিজ আল-আসাদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়া গোলাম হাইটস হারায়। তখন সিরিয়ায় আগমন ঘটে অসংখ্য ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর। ১৯৪৯ সালের পর থেকেই বিশেষ করে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে, সিরিয়া ইরাকের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যে ২০০০ সালের ১০ জুন বাবার মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তখন থেকে তিনিও প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় রয়েছেন; কিন্তু এর মধ্যে কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে মৌলিক কোনো পরিবর্তন সাধন করেননি। এ যেন ক্ষমতায় থাকার জন্যই ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখা।
আরব লীগের প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ী অবিলম্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের যে ধরনের উদ্যোগ থাকা উচিত ছিল, তা মোটেও সিরিয়ার আন্দোলনকারীদের কাছে যথেষ্ট আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে না। এ ব্যাপারে এ অঞ্চলের একমাত্র গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী দেশ তুরস্কের যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তুরস্কের নেতারা সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। আরব বসন্তের ছোঁয়ায় জাগ্রত ও আন্দোলিত সিরিয়াবাসী গভীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে রাজনৈতিক সংস্কার ও পরিবর্তনের সূচনার জন্য। এ সময়টি সিরিয়ার শাসক বাশার আল-আসাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ সুযোগ হাতছাড়া হলে তাঁর জন্য আর তেমন কোনো পথ খোলা থাকবে না। তাঁকেও সম্ভবত তখন তিউনিসিয়ার জাইন এল আবিদিন বেন আলী, মিসরের হোসনি মুবারক ও লিবিয়ার গাদ্দাফির ভাগ্যবরণ করতে হবে। খিলাফত পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোয় জনগণের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের অনুপস্থিতি কিংবা স্বৈরশাসনের জন্য ইসলাম দায়ী নয়, দায়ী সেখানকার স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী। সে কারণেই আরব লীগ ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী তাইপ এরদোগান সিরিয়ার ব্যাপারে এতটা উদ্বিগ্ন। তাঁদের আশা, সিরিয়ার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক চর্চাকে নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে জোরদার করবে।
লন্ডন, ৩ নভেম্বর, ২০১১
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
email: gaziulhkhan@gmail.com
No comments